কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৬

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৬
মিসরাতুল রহমান চৈতী

রাতের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি চৈতী আর রাতুলের মাঝে এক অনতিক্রম্য দেয়াল গড়ে তুলেছে।
চৈতীর চোখে আজ বিদ্রোহের আগুন, যেন সে নিজেই এক দাবানল—যা কিছু তাকে স্পর্শ করবে, তা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সে ধীরে ধীরে এক পা পিছিয়ে এলো, আর অপরদিকে দাঁড়িয়ে থাকা রাতুল—যে তার সমস্ত পাপ, সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত অপরাধের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবু চোখে শুধুই এক গভীর আকুতি, এক অপরিসীম ভালোবাসা।
“বিশ্বাস করো, চৈতী… আমার ভালোবাসার কোনো খাত নেই। ভালোবাসি তোমাকে, হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে ভালোবাসি!”

চৈতী কটমট করে তাকালো। তার ঠোঁট বাঁকা হাসিতে কেঁপে উঠলো। “এমপি আহম্মেদ, ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা হয়? ভালোবাসার জন্য পবিত্রতা লাগে, আত্মার স্বচ্ছতা লাগে! তোমার ভালোবাসা কি তেমন?”
রাতুল এক ধাপ এগিয়ে এলো, চৈতীর হাত ধরতে গেলো। কিন্তু চৈতী বিদ্যুতের মতো ছিটকে দূরে সরে গেলো। তার চোখের কোণে জ্বলজ্বল করছে অভিমান, ক্ষোভ আর একরাশ অবিশ্বাস।
টেবিলের ওপর রাখা কাজের ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিলো চৈতী, তারপর সেটাকে জোরে টেবিলে আঘাত করলো। ঝাড়ুটার কাঠ ভেঙে গেলো, আর সেই ভাঙা অংশ রাতুলের দিকে তাক করে বললো,
“আমাকে দুর্বল ভেবো না! আমি মায়াবতী হতে পারি, কিন্তু প্রয়োজনে ধ্বংসবতীও হতে পারি। আমি সূর্যের মতো প্রখর, আমার তেজে যদি তুমি হাত বাড়াও, তাহলে ঝলসে যাবে!”
রাতুল হাসলো—একটা বিষণ্ণ, করুণ হাসি। তারপর নিঃশব্দে এক ধাপ এগিয়ে এসে চৈতীর হাতের ভাঙা কাঁচের টুকরোটা নিজের পেটের কাছে চেপে ধরলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বেশ! তবে আমাকে মেরে ফেলো, চৈতী! তোমার হাতে মৃত্যু হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আমি পাপিষ্ঠ, আমি কলঙ্কিত! আমাকে শেষ করে দাও, আর নিজেকে পুণ্যবান করো।”
চৈতী হতবাক হয়ে গেলো! তার হাতের শক্তি যেন এক মুহূর্তে কমে এলো। রাতুলের চোখের ভাষা এতটাই গভীর, এতটাই অসহায়, যে সেই চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, এই মানুষটা সত্যিই হয়তো redemption খুঁজছে।
চৈতী কাঁপতে থাকা কণ্ঠে বললো, “তোমার মৃত্যু চাই না আমি, রাতুল! চাই তোমার অনুশোচনা, চাই তোমার পরিবর্তন! চাই তুমি সত্যিকার অর্থে মানুষ হও, আমার রাতুল হও।”
রাতুল নীরব। বাইরে থেকে তার পাষাণ হৃদয়কে শক্ত মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে।
সে এগিয়ে এলো এক পা, খুব ধীরে। তারপর এক নিশ্বাসে বললো—

“আমি যদি ছাই হয়ে যাই,
তুমি কি সেই ছাইয়ে আগুন দেবে?
আমি যদি হারিয়ে যাই,
তুমি কি আমাকে খুঁজবে না?
আমি যদি বৃষ্টি হই,
তুমি কি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে অনুভব করবে না?
আমি যদি মরে যাই,
তুমি কি এই পৃথিবীকে দোষ দেবে না?”
চৈতীর চোখে জল জমে উঠলো। সে জানে, এই মানুষটা খারাপ হতে চায়নি, কিন্তু পরিস্থিতির টানাপোড়েন তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
রাতুল হাত বাড়ালো, একবার… খুব ধীরে, যেন সেই হাতের স্পর্শে সমস্ত ব্যথা আর দুরত্ব এক নিমেষে মিলিয়ে যাবে।

কিন্তু চৈতী সেই হাত ধরলো না।
বরং তার চোখের গভীরে এক কঠিন সিদ্ধান্তের ছাপ ফুটে উঠলো। ঠোঁট কাঁপলো না, কণ্ঠস্বরেও ছিল না কোনো মায়া। তার গলা কঠোর, দৃঢ়, একেবারে অবিচল।
“আকাশের চাঁদ সবাই দেখে, কিন্তু ছুঁতে কয়জন পারে? আপনি যদি আমাকে ভালোবাসেন, তবে সেই ভালোবাসাকে সত্যি প্রমাণ করুন। নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করুন, আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করুন, রাতুল। ক্ষমতার মোহ ছেড়ে আসুন, দেখুন ভালোবাসার পথ কতটা নির্মল, কতটা শান্তির।”
রাতুল থমকে গেলো।

তার চোখের ভেতর এক মুহূর্তে শত প্রশ্নের ঝড় উঠলো, আবার নিস্তব্ধ নীরবতাও ছড়িয়ে পড়লো। চৈতীর কথাগুলো যেন একেকটা তীক্ষ্ণ শলাকার মতো বুকের ভেতর বিঁধে গেলো।
সে কি পারবে? নিজের তৈরি সাম্রাজ্যকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে, নিজের ভুলের বোঝা মাথায় নিয়ে সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বাঁচতে?

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৫

একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো রাতুল। তারপর, নিঃশব্দে হাত নামিয়ে নিলো।
চৈতী তাকিয়ে রইলো, অপেক্ষা করলো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে। হয়তো এটাই তাদের গল্পের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়—যেখানে ভালোবাসার চেয়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৭