কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৭
মিসরাতুল রহমান চৈতী
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে টুপটাপ শব্দে বৃষ্টি নামল। যেন প্রকৃতিও আজ সাক্ষী হয়ে থাকল এক কঠিন সত্যের, এক অমোঘ পরিবর্তনের।
অন্ধকার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষ—একজন অপরাধের ভারে নুয়ে পড়া, আরেকজন ন্যায়ের দীপ্তিতে অটল। রাতুলের দৃষ্টি গভীর, তীক্ষ্ণ—একদিকে ক্ষমতা, অন্যদিকে ভালোবাসা। একদিকে তার রক্তে লেগে থাকা পাপের ছাপ, অন্যদিকে এক সম্ভাব্য শুদ্ধ ভবিষ্যৎ।
চৈতীকে দেখে মনে হলো, সে যেন কোনো এক অনড় পাহাড়। ঝড় আসবে, প্রবল বেগে আছড়ে পড়বে, কিন্তু তাকে টলাতে পারবে না।
রাতুলের কণ্ঠ যেন নিস্তব্ধ রাতে বজ্রপাতের মতো শোনাল, “তাহলে তুমি চাও আমি সব ছেড়ে দিই?”
তার গলায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি, অথচ সেই প্রশান্তির গভীরে ভয়ঙ্কর এক ঝড় লুকিয়ে আছে।
চৈতী এক ইঞ্চিও না নড়ে দাঁড়িয়ে থাকল, চোখের ভাষায় অবিচল সংকল্প। তার কণ্ঠস্বর আজ শাস্তির মতো কঠিন, “পাপের প্রায়শ্চিত্ত আত্মদানে হয়, ক্ষমতায় নয়। পতিতালয়ের দেয়াল গুঁড়িয়ে দিন, রাতুল আহমেদ! যে ক্ষমতা নারীদের চোখের পানি ঝরায়, সেই ক্ষমতার অভিশাপে একদিন আপনি নিজেই পুড়ে ছাই হবেন!”
রাতুল চৈতীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেখানে আজ ভয় নেই, করুণা নেই—শুধু দাবানলের মতো জ্বলে ওঠা ক্রোধ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চৈতী এক ধাপ এগিয়ে এলো, যেন সরাসরি রাতুলের আত্মার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলো তার কথা।
“আপনার ক্ষমতা যদি সত্যিই কিছু সৃষ্টি করতে পারে, তবে তা হবে এই সমাজের নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে কোনো নিষ্পাপ মেয়ে আর পতিতালয়ের অন্ধকারে গুম হয়ে যাবে না। যেখানে কেউ আর পুরুষের লালসার শিকার হবে না। আপনি কি পারবেন? পারবেন নিজের হাতের রক্ত মুছে সত্যের পথে আসতে?”
রাতুলের বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। তার ভেতরে যেন একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে—অন্ধকার তাকে টেনে ধরে রেখেছে, আর চৈতীর কথাগুলো সেই অন্ধকার ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সে এক পা পিছিয়ে নিলো।
“তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করবে, চৈতী?”
“বিশ্বাস করবো না। তবে আমি অপেক্ষা করবো। আমি দেখবো আপনি সত্যিই মানুষ হতে পারো কিনা।”
বজ্রবিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, বৃষ্টির ফোঁটা গরম হয়ে পড়া পৃথিবীকে শীতল করছে। কিন্তু রাতুলের ভেতরের অগ্নিকুণ্ড কি এভাবে নিভে যাবে?
রাতের বৃষ্টি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে, কিন্তু রাতুলের ভেতরের ঝড়টা একটুও থামেনি। চৈতীর কথাগুলো তার মনের দেয়ালে তীব্র আঘাত হানছে। সত্যিই কি সে বদলাতে পারবে? নাকি এই ক্ষমতা, এই পাপ, এই দম্ভই তার চিরস্থায়ী পরিচয় হয়ে থাকবে?
রাতুল তাকে আরেকবার শেষবারের মতো দেখে নিলো। সেই দৃষ্টি শীতল, তবু কোথাও যেন একটা নীরব প্রত্যাশা লুকিয়ে আছে।
“আমি যাচ্ছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো চৈতী। এই রাতে, এই মুহূর্তে সে তার কাছে আর কিছুই চায় না। শুধু সময়ের কাছে ছেড়ে দিতে চায় রাতুলের পরিবর্তনকে।
রাতুল চলে যেতে নিলে সে হঠাৎ চৈতী স্বর আরও কঠিন করে বলো , “একটা কথা মনে রাখবেন, রাতুল আহম্মেদ। অন্যায় করে যদি নিজেকে অপরাজেয় ভাবেন, তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কিন্তু যদি সত্যিই পরিবর্তন চান, তবে এই সমাজ আপনাকে একদিন ঠিকই গ্রহণ করবে। পাপী হয়ে মরবেন নাকি একজন নতুন মানুষ হয়ে বাঁচবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনার।”
রাতুল তার কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো চৈতীর দিকে, যেন তার মুখের প্রতিটি শব্দ সে হৃদয়ে গেঁথে রাখছে।
চারপাশে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে, তার শরীরের প্রতিটা রোমকূপ শিহরিত হচ্ছে। আজ প্রথমবার মনে হলো, তার চারপাশের ক্ষমতার জালটা কতটা দুর্বল, কতটা ঠুনকো!
বৃষ্টি থামেনি। তবে এখন ঝরঝর করে নয়, টুপটাপ টুপটাপ… যেন রাতের নিস্তব্ধতায় প্রকৃতি নিজেই কিছু বলার চেষ্টা করছে।
রাতুল হাঁটছে।
বৃষ্টিতে ভিজে তার পুরো শরীর জমে গেছে। চশমার কাঁচের ওপর জমে থাকা পানির ফোঁটা তাকে দেখতে সমস্যা করছে, তবুও সে থামেনি।
সে আজ প্রথমবারের মতো নিজেকে চিনতে পারছে না।
কখনো কি ভেবেছিল, এই শহরের রাজা হয়েও সে একদিন এমনভাবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবে?
পথের পাশে একটা গলির মুখে থামল সে।
সেখানে ছেঁড়া পোস্টার লাগানো—একটা মেয়ের ছবি, যার চোখের ভাষা শূন্য। নিচে লেখা—”হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি এখন কোথায়?”
রাতুলের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।
সে জানে, সেইসব হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের কজন কোথায় আছে।
সে জানে, তার হাতেও এমন কিছু পাপ লেগে আছে, যা ধুয়ে ফেলা সহজ হবে না।
সে চোখ বন্ধ করলো।
আজ চৈতীর কথাগুলো তার ভেতরে বয়ে চলা অশান্তির ঢেউকে আরও প্রবল করে তুলেছে।
সে সত্যিই কি পাপী? নাকি সে পরিস্থিতির শিকার?
মোবাইল বেজে উঠল।
সে ফোন বের করলো। জিলানীর নাম ভেসে উঠলো স্ক্রিনে।
ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “বস, আপনি কোথায়? এইভাবে একা বের হয়েছেন কেন?”
রাতুল একটু সময় নিয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু কথাটা বলার পর নিজেকেই বিশ্বাস হলো না।
সে কি আসলেই ঠিক আছে?
তার শরীর ভিজে গেছে, মাথা ভারী লাগছে, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে, এই রাতটাই তার আসল সঙ্গী।
“বস, আপনি ফিরবেন তো?”
রাতুল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “আমি ফিরছি না, জিলানী।”
“কি বললেন, বস?”
“আজ আমি একা হাঁটতে চাই। কেউ যেন আমার পেছনে না আসে।”
“কিন্তু বস, এভাবে—”
রাতুল ফোন কেটে দিলো।
সে আবার হাঁটা শুরু করল।
আজ মনে হচ্ছে, এই শহরের আলো তাকে আর আগের মতো স্বস্তি দেয় না।
এই শহর, যা একসময় তার সাম্রাজ্য ছিল, আজ কেন যেন তাকে বহিষ্কার করতে চাইছে।
সে কি ফিরবে?
নাকি নতুন কিছু শুরু করবে?
রাতুল জানে না।
সে শুধু জানে, আজকের রাত তার জীবনের সবচেয়ে বড় সন্ধিক্ষণ হয়ে থাকবে।
বৃষ্টি থামেনি।
তবে এখন ঝরঝর করে নয়, টুপটাপ টুপটাপ…
সেই শব্দের মাঝে কোথাও চৈতীর কণ্ঠস্বর বাজছে—”আপনার প্রায়শ্চিত্ত কী হবে জানেন? পতিতালয়ের দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া। যে ক্ষমতা নারীদের কাঁদায়, সেই ক্ষমতার অভিশাপেই একদিন আপনি পুড়ে যাবেন, রাতুল আহমেদ!”
তার বুকের ভেতর কেমন একটা ব্যথা বাজছে। এ ব্যথা শারীরিক নয়, মানসিক।
একসময় সে ভাবতো, ক্ষমতা মানে ভয়। যার হাতে ভয় দেখানোর ক্ষমতা বেশি, সেই সবচেয়ে শক্তিশালী।
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই ভয়ই তাকে একা করে দিয়েছে।
সে থমকে দাঁড়ায়।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৬
সামনের রাস্তার বাতিটা মিটমিট করছে। শহর ঘুমিয়ে গেছে, কিন্তু তার ভেতরের যুদ্ধ জেগে আছে।
সে কি আসলেই বদলাবে?
নাকি সবকিছু আগের মতোই চলবে?
রাতের বৃষ্টি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে।
কিন্তু রাতুলের ভেতরের ঝড় কি থামবে?