কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৮

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৮
মিসরাতুল রহমান চৈতী

রাত গভীর। পুরো শহর এক নিস্তব্ধ ঘুমে ডুবে আছে, শুধু রাস্তার বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, যেন এই রাতের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে এক জায়গায় ঘুম নেই, বরং সেখানে জেগে আছে এক ঝড়, এক বিপ্লবের পরিকল্পনা।
পুরোনো এক বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল আহমেদ। পাশেই তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী, আসিফ। চারদিকে শুধু রাতের বাতাসের শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোথাও কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর আকাশে উড়তে থাকা কিছু চিলের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।
রাতুল দু’হাতে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা কত অদ্ভুত! কত বছর ধরে একই আছে, কোনো পরিবর্তন নেই, অথচ এই আকাশের নিচে কত কিছু বদলে যায়! কিন্তু কিছু কিছু অন্ধকার থেকে যায় চিরস্থায়ী, যেমন এই শহরের সেইসব নিষ্পাপ মেয়েদের কান্না, যারা রাতুলের ক্ষমতার রাজত্বে নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে।
আসিফ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।

“বস, আপনি কি নিশ্চিত? এই সিদ্ধান্তের ফল কিন্তু ভয়ানক হতে পারে!”
রাতুলের চোখে আজ অন্যরকম এক দৃষ্টি। কঠিন, দৃঢ়, অথচ কোথাও যেন একটা অপরাধবোধের ছাপ।
“আমি নিশ্চিত, আসিফ। এবার সব শেষ করতে হবে। এবার সত্যিই বদল আনতে হবে।”
আসিফ কিছু বলল না, শুধু গভীর দৃষ্টিতে বসের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে জানে, আজকের রাত অন্যরকম।
রাতুল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। আসিফ অবাক হয়ে দেখল, সেটা এক পুরোনো সংবাদপত্রের অংশ। সেখানে ছোট্ট এক কলামে লেখা—
“পতিতালয়ে আবারও এক নাবালিকা হারিয়ে গেল। সমাজ কি তাকে ফেরত আনতে পারবে?”
আসিফের চোখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বস, আপনি…”
রাতুল ধীরে ধীরে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল।
“আমি আর এই অন্যায়ের অংশ হতে চাই না, আসিফ।”
তার কণ্ঠে যেন বজ্রধ্বনি।
আসিফ এবার গভীরভাবে বসের চোখের দিকে তাকাল।
“আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, আপনি এটা পারবেন?”
রাতুল এবার এক চিলতে হাসি হাসল। তবে সেই হাসির ভেতর গভীর বিষাদ লুকিয়ে ছিল।
“আমি জানি, এটা সহজ হবে না। এই শহরের পতিতালয়গুলো কারা চালায় জানো তো? সমাজের উচ্চস্তরের কিছু নামমাত্র নেতা, বড় ব্যবসায়ী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তাদের ছায়ায় এসব জায়গা টিকে আছে বছরের পর বছর। কিন্তু এবার তাদের মুখোশ খুলতে হবে।”
সে এক ধাপ সামনে এগিয়ে গেল, নিচের শহরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
“এই শহরের মানুষ জানবে কারা নারীদের কান্না বেচে বিলাসিতা করছে। এবং আমরা এই অভিশপ্ত জায়গাগুলো গুঁড়িয়ে দেবো।”

আসিফ এবার একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
“বস, এরা কিন্তু সাধারণ কেউ না। তারা আপনাকে—”
রাতুল মাঝপথে থামিয়ে দিল।
“আমাকে যদি মরতেও হয়, আমি রাজি। কিন্তু এই অভিশপ্ত জায়গাগুলোকে আমি থাকতে দেবো না। আমি একটা নতুন ইতিহাস লিখতে চাই, আসিফ।”
আসিফ এবার গভীরভাবে বসের চোখের দিকে তাকাল।
“আপনার পরিকল্পনা কী?”
রাতুল এবার দৃঢ়ভাবে বলল,
“আগামীকাল সকালেই আমরা সেই সব প্রভাবশালী নেতাদের নাম ফাঁস করবো, যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত। মিডিয়ার সামনে আনবো তাদের মুখোশধারী চেহারা।”
“আর পতিতালয়?”
“সেখানে আমি আরেকটা কিছু তৈরি করবো।”
আসিফ বিস্মিত হয়ে তাকাল।

“কী?”
রাতুলের চোখে এক কঠিন অঙ্গীকার।
“একটা আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে অসহায় নারীরা নিরাপদে থাকবে। যেখানে কেউ আর বিক্রি হবে না।”
আসিফ হতবাক।
“আপনি কি জানেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আপনার বিরুদ্ধে কত মানুষ দাঁড়াবে?”
রাতুল এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আমি জানি, আসিফ। কিন্তু আমি ক্লান্ত। এই অপরাধের বোঝা আর বইতে পারছি না।”
তার কণ্ঠে ক্লান্তি, অথচ দৃঢ়তাও স্পষ্ট।
“আমি এমন এক আশ্রয়কেন্দ্র গড়তে চাই, যেখানে কোনো নারীকে চোখের পানি ফেলতে হবে না। যেখানে কেউ রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না।”
সেই মুহূর্তে যেন বাতাসের গতি বেড়ে গেল। রাতের নীরবতা ভেঙে কোথাও এক কাক ডেকে উঠল, যেন কোনো সতর্কবার্তা দিচ্ছে।
রাতুলের মনে ভেসে উঠল চৈতীর কথা—

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৭

“আপনার ক্ষমতা যদি সত্যিই কিছু সৃষ্টি করতে পারে, তবে তা হবে এই সমাজের নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র।”
সে চোখ বন্ধ করল।
“তুমি ঠিক বলেছিলে, চৈতী। এবার সত্যিই কিছু বদলাতে হবে।”
আসিফ এবার আর কোনো কথা বলল না।
রাতের বাতাসে যেন এক নতুন যুদ্ধের সুর বাজছে।
কাল ভোরেই নতুন এক ইতিহাস লেখা হবে।
আজ রাতটা শুধু অপেক্ষার।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৯