চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪ (২)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

দখিনা বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ নিঃশব্দ মেঘাচ্ছন্ন রাতের মাদকতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে আসা হালকা পিড়পিড় হাওয়ায় চিত্রার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। সে চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের উদাসীনতার মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। হাসপাতালের একঘেয়ে বেডে সে শুয়ে আছে বাধ্য হয়েই। কিছুক্ষণ আগে ফারিয়া এসেছিল। কথা বলেছিল কিছুক্ষণ। এখন হয়তো করিডোরে পায়চারি করছে। চিত্রার হাতে স্যালাইনের সূঁচ বিঁধে আছে। শরীরও ভীষণ দুর্বল। কিন্তু চিত্রার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই নিষ্পাপ শিশুটির নিথর দেহ। কি থেকে কি হয়ে গেল আজ?সন্ত্রাসের বিষবাষ্প আজ কিশোরগঞ্জকে গ্রাস করেছে, কাল হয়তো পুরো দেশকে করবে। এসব কেবল নৃশংসতার নয়। এর পেছনে আছে সুপরিকল্পিত এক ব্যবসা। যারা মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে, তাদের দিয়ে অপরাধ করিয়ে ফায়দা লুটছে তারাই এসব ঘটনার মূল কারিগর। রাজনৈতিক চালের চেয়ে এখানে ব্যবসায়িক স্বার্থই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।

চিত্রা শ্বাস ছাড়ল। আজকের আকাশ তাকে বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই দিনে বাড়িতে কত আয়োজন হতো! গরম গরম ভাজাপোড়া,চায়ের আড্ডা চলত দীর্ঘরাত অব্ধি। চিত্রা নিজ হাতে সবকিছু করত। নিজের ভাগের খাবার টুকুও লুকিয়ে যখন সোহাগকে দিত তখন যে কি শান্তি লাগত চিত্রার। এক রাতের কথা,সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো।
বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ ছিল না। চারদিকে কেবল প্রকৃতির নীরব কান্না। প্রতিদিনের মতোই চিত্রা লুকিয়ে লুকিয়ে সোহাগের রুমে গেল। সে প্রায়ই যেত, ঘুমন্ত সোহাগের পাশে বসে থাকত, নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে স্বপ্ন দেখত। একদিন এই মানুষটার পাশেই সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সেদিন সোহাগ রুমে ছিল না। চিত্রা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় গেল সে? হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল ছাদের কথা। ছুটে গেল সেখানে। সোহাগ একলা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজছিল নিঃশব্দে। পরনের সাদা সেন্ডো গেঞ্জি ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল। লুঙ্গিটাও ভারী হয়ে গিয়েছিল জলে। কিছু না বলে চিত্রাও পাশে গিয়ে দাঁড়াল।সারারাত তারা একটাও কথা বলেনি। শুধু একসঙ্গে ভিজেছে। তাতেই চিত্রা খুশী ছিল। অথচ আজ সেই সোহাগ চিত্রাকে মনে রাখে না। যে সোহাগ একসময় চিত্রার সামান্য জ্বরেও পুরো বাড়ি মাথায় তুলত, সে এখন অন্য কাউকে ভালোবাসে, অন্য কাউকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে! চিত্রার চোখের কোণে অজান্তেই জল জমে ওঠে। মুহূর্তেই কান্না ফেটে বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে। সবাই বলে, কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়, দুঃখ কমে যায়। যদি দুঃখের সঙ্গে তার স্মৃতিগুলোও যদি মুছে যেত, তাহলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু মানুষ স্মৃতির বাহক। স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হয় তাকে। তবে যারা স্মৃতি ভুলতে পারে, তারাই সামনে এগোতে পারে। চিত্রার এখনো অনেক দূর যেতে হবে। মাঝপথে সে কিছুতেই থামতে পারবে না। কিছুতেই না…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কাঁদছো কেন প্রিয়তমা?”
চিত্রা চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করল। পাশ ফিরে দেখল দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। গায়ে একটা শুভ্ররঙা শার্ট। ব্লেজারটা হাতে। ফারাজ এগিয়ে এসে চিত্রার পাশে এসে বসল। চিত্রা মুখ ফিরিয়ে অভিমান জড়িত গলায় বলল,
“আমি ঠিক আছি। জোর করে এখানে বন্দী করার কারন কি?”
” রোগীরা ঔষধের ভয়ে এমন দুই-চারটে চাপা মেরেই থাকে। তাই বলে কি সব বিশ্বাস করতে হবে?”
“চাপাবাজ বললেন?”
ফারাজ চোখ সরু করে তাকাল।ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। “কেন? কারো গায়ে লেগেছে বুঝি?”
“দেখুন…”
“এখানে দেখাবে?”
ফারাজ চারিপাশে চোখ বুলায়। জিহ্বা কেটে বলে,
“দুঃখিত বউ রুমে সিসি ক্যামেরা আছে। তবে তুমি চাইলে আমি ক্যামেরার চোখেও পট্টি বেঁধে দিতে পারি। দে…বো নাকি?”

চিত্রা বিরক্ত চোখে তাকাল।”আপনি কোন পদের মানুষ বলুনতো?”
ফারাজ মুচকি হেসে একদম স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়,
“সেই পদ, যেটা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমার জন্য বানিয়েছেন।”
চিত্রা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আপনার মতো পুরুষ আমি আমার পুরো জীবনে আর একটাও দেখি নি। আপনার সঙ্গে পেরে উঠা দায়।”
” ফারাজ এলাহীর একটা ভার্সনই ওপরওয়ালা তৈরি করেছেন পিও। দুনিয়ায় শত পুরুষ পাবে তবে ফারাজ এলাহী হারিয়ে গেলে কচুও পাবে না।”
চিত্রা বিরক্ত হয়ে বলল,
“নিজের এত প্রশংসা কেমন করে করেন? মুখ ব্যাথা করে না?”
“তোমার ওপর দিয়েও তো কত ঝড় বয়ে যায় …কই ব্যাথা করে না?”ফারাজ চোখ টিপে মুচকি হাসল।
চিত্রা এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে বলল,”ছি! খালি ডাবল মিনিং কথাবার্তা।জাস্ট অসহ্যকর।”
ফারাজ মুখ ভেংচি কেটে চিত্রাকে ক্ষেপানোর জন্য বলল,
“খোদা তোমার মুখে কচু ধলে দিয়েছে নাকি?মুখ থেকে চুলকানো কথাবার্তা ছাড়া ভালো কিছু বের হয় না? মুড়ি খাও শশুড় আব্বার মাইয়া।”

বাহিরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের জানালা দিয়ে সোঁ সোঁ করে হাওয়া ঢুকছে। মার্জিয়া রান্নাঘরে ঢুকে ঠিক করে ফেলল আজ হবে জম্পেশ এক খাওয়াদাওয়া! মেনু? খিচুড়ি ,বেগুন- ইলিশ ভাজা, আর ইলিশের লেজ ভর্তা! সকালে সোহাগ ঘাট থেকে তাজা ইলিশ কিনে এনেছিল। জান্নাত নতুন বউ তাই মার্জিয়া তাকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। মারিয়া শাশুড়ীকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে। শুক্রবার সোহাগ আর জান্নাতের বিয়ের একটা ছোটখাটো আয়োজন করা হবে। হাতে সময় নেই। সেই বাজার গুলোও তো করতে হবে।বাড়ি-ঘর এখন অগোছালো। দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে। মার্জিয়া প্রথমেই পোলাওয়ের চাল আর মুগডাল একসঙ্গে ধুয়ে পানি ঝরাতে দিল। তারপর কড়াইয়ে অল্প ঘি গরম করে চাল-ডাল হালকা ভেজে নিল, যতক্ষণ না হালকা বাদামি রঙ ধরে। মসলা কষানোর পর ভাজা চাল-ডাল মিশিয়ে দিয়ে গরম পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে রাখল। পনেরো-বিশ মিনিট পর ঢাকনা তুলতেই দারুণ এক সুবাস! খিচুড়ির দানাগুলো একদম ঝরঝরে হয়ে এসেছে। শেষে এক চামচ ঘি ছড়িয়ে দিল, যেন স্বাদ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। মার্জিয়ার স্বামীর খুব পছন্দ ছিল এই খিচুড়ি তবে বছর খানেক পেরিয়ে গেল ভালো খাবার তার গলা দিয়ে নামেনি। ওদিকে ভাজাভুজির কাজ মারিয়া করছে। কড়াইতে সর্ষের তেল ধুঁয়া ওঠা গরম করে মাছ ছাড়তেই চিড়চিড় শব্দে রান্নাঘর মুখর হয়ে উঠল!
জান্নাত রুমে এসে বিছানায় ফেলে রাখা সোহাগের লুঙ্গিটা বাজ করতে করতে তাকে বলল,

“আপনে তারে এখনো ভালোবাসেন?”
সোহাগ তখন পুরোনো একটা ঘড়ির বেল্ট বদলাচ্ছিল। জান্নাতের কথায় তার কপাল কুঁচকে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কার কথা বলছ?”
“ওই যে, চিত্রা আপার কথা।”
সোহাগ হেসে বলল,”তোমাকে কে বলল যে আমি এখনো তাকে ভালোবাসি?”
জান্নাত চোখ নামিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মন বলছে।”
সোহাগ একটা মেকি হাসি দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মন তোমাকে ভুল বুঝাচ্ছে।”
জান্নাত চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“শুনেছি, সে নাকি খুব সুন্দরী?”
সোহাগ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর জান্নাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাতে কী আসে যায়? তুমি কি কোনো অংশে কম?”
জান্নাত তিক্ত হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সে তো সোনা, আর আমি কয়লা।”
সোহাগ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কয়লার মূল্য জানো?”
“জানতে চাই না।”

সোহাগ এবার আর কিছু বলল না। তবে জান্নাত থামল না। তার গলার স্বর কাঁপছিল,
“আপনি আমাকে ভালোবাসলে আমার কাছে আসতেন। ছুঁয়ে দেখতেন। কিন্তু আপনি তো আমার দিকে ফিরেও তাকান না। অথচ সবাই ভাবে, আমাদের মধ্যে কত মোহাব্বত! কিন্তু সত্যিটা শুধু আমি জানি।”
সোহাগ কোনো জবাব দিল না। কেবল পাশের টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিল।জান্নাত পিছন থেকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
সোহাগ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু থামল, তারপর কটাক্ষভরা গলায় বলল,
“সিগারেটের সঙ্গে প্রেম করতে যাচ্ছি, সখী। একটু হাওয়া খেতে চাই। তুমি আম্মার কাছে যাও।”
জান্নাত আর কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকে রাখল। কেন তাকে এভাবে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে? কেন চিত্রা সোহাগের জীবনে না থেকেও সবটা নিয়ন্ত্রণ করছে? কোন অধিকারে? সৌন্দর্যের অধিকারে?জান্নাতের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই কষ্টেরও কি কোনো শেষ নেই?

ফারাজের গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই লোকজন দৌড়ে এল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। কিন্তু ফারাজ কারও দিকে তেমন একটা তাকাল না। সে বরাবরের মতোই গম্ভীর। চিত্রার হাতে এখনো ব্যথা। সে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামতে গেল। কিন্তু ফারাজ আগেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
“কোথায় যাচ্ছ, বউ?” ফারাজ একদম তার পথ আটকে দাঁড়াল। চিত্রা বিরক্ত গলায় বলল,
“মরতে।”
ফারাজ হেসে ফেলল। দুই হাতে কোমর ধরে বলল,
“এই মরামুখো শ্বশুরের ঘাড়ত্যাড়া মাইয়া! স্বামীর সঙ্গে রোমান্স করতে হয়, ত্যাড়ামি নয়। এসব শেখায়নি কেউ?”
চিত্রার চোখমুখ গরম হয়ে উঠল। কাঁপা গলায় বলল,
“আমার মরা বাবাকে নিয়ে কিছু বলবেন না! একেবারে মেরে চারার মতো বাগানে রোপণ করে দেব। তারপর…”
ফারাজ একদম স্বাভাবিকভাবে কথার মাঝেই যোগ করল,
“তারপর সেই চারা গাছ বড় হবে। আর সেখান থেকে ফারাজ এলাহী নামক একটা হ্যান্ডসাম ফুলের জন্ম হবে। ফুলের ঘ্রাণ একেবারে এলাচের মতো হবে!”
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে বলল,

“হ্যাঁ, তাতে আমার এলাচ কেনার টাকাও বেঁচে যাবে। আমি আপনাকে বাগান থেকে ছিঁড়ে নিয়ে গরম পানিতে ডুবিয়ে চা বানিয়ে আয়েশ করে খাব।”
ফারাজ নাক কুঁচকে বলল,
“যা দুষ্টু! তোমার মুখে দেখছি জমজমের পানি ছিটাতে হবে। খালি উল্টাপাল্টা কথা বলো! ছিঁড়ে, ডুবিয়ে… টুমাচ বেড সাউন্ড!”
চিত্রা হতবিহ্বল হয়ে গেল। আশপাশের কর্মচারীরা তো তাকিয়েই আছে! অথচ ফারাজ এলাহীর মনে একটুও লজ্জা নেই! চিত্রা কিছু বোঝার আগেই ফারাজ হঠাৎ ঝুঁকে তাকে দুই হাতে তুলে নিল।
“আরে! আপনি কি করছেন? ছাড়ুন বলছি!”
ফারাজ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরিনি, বউ। শিকার করবো বলে ধরেছি!”
চিত্রা ধাক্কা দিয়ে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু ফারাজের বাঁধন শক্ত। চিত্রাকে নিয়ে সরাসরি বাড়ির মধ্যে ডুকে পড়ে। বাড়ির সবাই তাদের দেখছে। অথচ ফারাজের চোখেমুখে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। চিত্রার মাথায় যেন বাজ পড়ল, এ লোককে কি সত্যিই কন্ট্রোল করা সম্ভব?
চিত্রাকে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফারাজ শার্টের উপরের বোতামটা আলগা করল। তারপর কোনো রকম ভণিতা না করেই গলা ফাটিয়ে ডাক দিল,

“মিতালি!! শালী কই তুমি?”
চিত্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এমন সময়, এমন মুহূর্তে ষাঁড়ের মতো চেঁচানোর প্রয়োজনটা কী? তার মাথা যেন ভো করে উঠল।
“মিতালিকে কেন ডাকছেন? কী দরকার?” চিত্রা বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল।
“মিতু?” ফারাজ কপাল কুঁচকে তাকাল।
“হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবেসে মিতু বলে ডাকি। কোনো সমস্যা?”
ফারাজ চোখ সরু করল। “ন্যাকামি…! যাক, আমিও ভালোবেসে আজ থেকে তোমাকে ‘চুতু’ বলে ডাকব। কোনো সমস্যা?”চিত্রা ধপাস করে উঠে বসে তাকাল।
“চুতু? এটা আবার কেমন নাম?”
“কেনো, পছন্দ হয়নি? চাইলে শুঁটকি,সাদা মুলা কিংবা লিলিপুট বলেও ডাকতে পারি। তোমার সঙ্গে নামগুলো বেশ যায়।”
চিত্রা রাগে চোখ গোল করে তাকাল।
“ধ্যাৎ!”
ফারাজ গলা নামিয়ে রহস্যময় কন্ঠে বলল,
“বুঝতে পেরেছি। তোমার যে প্রেমের নেশা ধরেছে। এমন হ্যান্ডসাম স্বামী থাকলে নেশা ধরাটা স্বাভাবিক। আই নো, আই নো… ডোন্ট ওয়ারি, নেশাটা যেহেতু আমার কারণেই ধরেছে, তাই তা কমানোর দায়িত্বও আমার।”
চিত্রা কিছু বলার আগেই দরজার কাছে হুড়মুড় করে মিতালি হাজির হলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এসেছে সে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,

“জে খালু?”
ফারাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল।
“কী রে, হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? যাক গে, আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন।”
মিতালি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“আইচ্ছা। চায়ে চিনি কতটু দিমু?”
ফারাজ একটু ভেবে বলল, “তোর যা ইচ্ছে। তবে বউয়ের মতো অত মিষ্টি যেন না হয়। পরে যদি অকালে সুগার লেভেল বেড়ে যায়,তখন লোকে তো আমায় ‘চিনিবাবা’ বলে ডাকবে!”
মিতালি কৌতুহল ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“চিনিবাবা মানে কী, খালু?”
ফারাজ এক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “তোর শা…! ধ্যাত, কিছু না। যা, আমার বউয়ের মতো কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা আর সিগারেট একসঙ্গে না খেলে আমার আবার বাথরুম হয় না। যাহ!”
মিতালি অবাক হয়ে ফারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আর চিত্রা? সে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ লোককে ঠিক করতে গেলে তার নিজেরই মাথা ঠিক থাকবে না!

ফারাজ চা সিগারেট খেয়ে গোসলে চলে গেল। রাতে গোসল না করলে তার ঘুম হয় না। দুনিয়ায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করলেও ফারাজ এলাহীর গোসল করা চাই! তার একটাই কথা দুনিয়া মারা খাক… তার শুধু গোসল করতে পারলেই হলো। গোসল শেষে চিত্রাকে রুমে দেখতে না পেয়ে ফারাজের মুখটা কালো হয়ে যায়। তার ঔষধটা যদি এমন দৌড়াদৌড়ি করে তাহলে ফারাজ নিজের রোগ কি করে সারাবে? ফারাজ কালো ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে নিচে নেমে আসল। ফারাজের লুঙ্গির সঙ্গে দুশমনি আছে। শালা লুঙ্গি চিজটা একেবারে বেইমান। হুটহাট খুলে যায়। চিত্রার থেকেও একধাপ উপরে এই ধাপ্পাবাজ লুঙ্গি। চিত্রাকে তো ফারাজ কন্ট্রোল করতে পারে তবে লুঙ্গিকে আয়ত্তে আনা তার পক্ষে সম্ভব নয় নি। ফারাজের মুসলমানির কথা,তাকে তার মা বিছানায় শুইয়ে রেখেছিল।

লোকজন সবাই ফারাজকে দেখতে আসছিল। সবাই একটু পর পর লুঙ্গি উঠিয়ে ফারাজের মূল্যবান সম্পদ দেখে কত কি বলে চলে গেল। মানে কি একটা অবস্থা। মানুষ বলা নেই কওয়া নেই তার ইজ্জত দেখে চলে যাচ্ছে। বাবার বন্ধুর একটা মেয়েও তাকে সেদিন দেখতে এসেছিল। বয়সে ফারাজের সমানই। ওই শালীও ফারাজের লুঙ্গি তুলে ইয়েটা দেখে ফিক করে হেসে বলেছিল, হি হি সাদা কেঁচো। ফারাজ ব্যথায় সেদিন উঠতে পারে নি। যদি পারত তাহলে ওই শালীর চুল ছিঁড়ে দিত। সেইদিনের পর থেকে লুঙ্গি জিনিসটাকে ফারাজের ছোটলোকি মনে হয়। হুটহাট খুলে যায়। একবার তো লুঙ্গির সঙ্গে ফারাজকে বেল্টও পড়তে হয়েছিল। তাই ফারাজ লুঙ্গি পড়ে না।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪

সে কেনো লুঙ্গি পড়বে? ওইসব ছোটলোকরা পড়ে। ফারাজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। ওইসব ভয়ানক দিনের কথা সে মনে করতে চায় না। ফারাজ নিচে এসে দেখে অন্দরমহলে সবাই মিলে মিলে আড্ডা দিচ্ছে। একসঙ্গে মিলে লুডু খেলছে। নদী ভাবী,ফারিয়া,নিরু আর মোহনা ভাবীও একসঙ্গে খেলছে। চিত্রা এক কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। ফারাজ চিত্রার দিকে এগুতে গেলেই একটা কল আসে তার ফোনে। অভ্র কল করেছে। ফারাজ অভ্রের কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনল। শেষে জবাব দিল,
“আমি আসছি। রান্না করে পার্সেল পাঠাতে হবে না?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪ (৩)