এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১১

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১১
Yasira Abisha

ঝড়ের শব্দে যেন কেঁপে উঠছিল গোটা প্রকৃতি। বাতাসের তীব্রতায় জানালার কাঠ বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আকাশে। এমন রাতগুলো আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু আজকের রাতটা যেন অন্যরকম।
ঘরের দরজাটা খুলেই দেখি ইরাদ দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে, সাদা লুঙ্গি আর হালকা নীল ফতুয়া পরে। এত সহজ, এত স্বাভাবিক তবু কী যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। অন্ধকারে বিদ্যুতের আলোয় তার চোখদুটো আরও তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে, যেন কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
তার চোখ ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো— মুখ থেকে ঘাড়, ঘাড় থেকে আমার খোলা হাত, তারপর বুকের কাছে আঁচল ধরা আঙুলের দিকে।
আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
এইভাবে কেউ কখনো আমাকে দেখেনি, এমন দৃষ্টিতে। ইরাদের চোখে কোনো কুৎসিত বাসনা নেই, তবু সেখানে একটা তীব্র অনুভূতি আছে—একটা চাপা আকর্ষণ, যা আমার সমস্ত সত্তাকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার ঠোঁট শুষ্ক হয়ে এসেছে, হাতের আঙুল আঁচলের ভাঁজ শক্ত করে ধরে রেখেছে।

সে কিছু বলল না, আমিও না। কিন্তু এই নীরবতার মধ্যে একটা অদৃশ্য কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমি শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরলাম, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু তাতেও কি কিছু আটকানো যায়?
আমার শরীরের প্রতিটা নার্ভ টানটান হয়ে আছে, যেন কিছু একটা অপেক্ষায়।
এমন মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।
গ্রামের এক মহিলা এসেছেন, হাতে কিছু খাবার। তার সঙ্গে একটা ছোট্ট পাত্র, যেটা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে।
“এই পানীয়টা খাবেন, ঝড়ের রাতে শরীর গরম রাখতে কাজে আসবে।”
আমি কিছু বলার আগেই ইরাদ সেটা হাতে নিল।
মহিলা বেরিয়ে গেলে ইরাদ আমার দিকে এগিয়ে দিল ছোট্ট পাত্রটা।
“নাও, এটা খাও।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই তুলে নিলাম। ঠান্ডায় জমে আসছে শরীর, কিছু একটা গরম খাওয়া দরকার।
একটা ছোট্ট চুমুক দিতেই ভেতরটা কেমন গরম হয়ে উঠলো।
একটা ঝাঁঝালো স্বাদ, মিষ্টি কিন্তু ভেতরে যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
“এটা কী?” আমি আস্তে বললাম।
ইরাদ কোনো উত্তর দিল না, শুধু চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমার মনে হলো, তার চোখেও কেমন যেন অস্থিরতা।
পানীয়টার প্রতিটি চুমুক যেন রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। শরীরের শীত কেটে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে অন্যরকম একটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ইরাদের দিকে।
সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, নিঃশব্দে, গভীরভাবে।
তার চোখে কিছু একটা আছে— হয়তো আকর্ষণ, হয়তো তীব্র সংযম, অথবা হয়তো এমন কিছু যা আমি এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারছি না।
আমি চোখ নামিয়ে নিলাম, কিন্তু এতে যেন পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠলো।
আমার হাতের আঙুল শক্ত হয়ে এলো শাড়ির আঁচলে।
“তুমি ঠিক আছো?” ইরাদের কণ্ঠ গভীর শোনালো, যেন ভেতরে কোনো দোলাচল লুকিয়ে আছে।
আমি নিঃশ্বাস ছাড়লাম, ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম, “হুম।”
কিন্তু সত্যিটা কি তাই?

এই মুহূর্তে আমার শরীরের প্রতিটা নার্ভ, প্রতিটা শিরা-উপশিরা যেন ইরাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছে।
ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে এসেছে, যেন প্রতিটি মুহূর্ত একটা সীমারেখা টেনে দিচ্ছে— যেটা পার হওয়া উচিত না, কিন্তু পার হতে ইচ্ছে করছে।
ঝড়ের গর্জন ঘরের বাইরে আরও বেড়ে গেছে, আর ঘরের ভেতরে আমরা— সময়ের এক অদ্ভুত ফাঁদে আটকে গেছি যেন।
আমি একটু দূরে সরে যেতে চাইলাম, কিন্তু পায়ের নীচে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে গেল।
আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার আগেই ইরাদের হাত আমাকে ধরে ফেললো।
তার হাতের উষ্ণতা আমার ঠান্ডা চামড়ায় যেন দাবানলের মতো লাগলো।
আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
এতটা কাছে…

আমি মুখ তুলতেই ইরাদের চোখের গভীরতা আমায় আটকে ফেললো।
তার দৃষ্টি এখন আমার ভেজা চুল, ভেজা শাড়ি আর আমার অনিয়ন্ত্রিত শ্বাসের দিকে।
তার হাত এখনো আমার কোমরের পাশে, আমার শরীরের তাপ স্পষ্ট বুঝতে পারছে আমি।
আমার বুক দ্রুত ওঠানামা করছে, আর ইরাদ…
সে যেন নিজেকে আটকে রাখছে, কিন্তু তার চোখ বলছে অন্য কথা।
আমি কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু শব্দ হারিয়ে গেল গলার কাছে।
ইরাদ আমার চুলের ভেজা গোছা সরিয়ে দিলো, তার আঙুলের ছোঁয়া গালে লেগে গেল।
আমার শরীর শিউরে উঠলো।
“রুহি…”
তার কণ্ঠ কেমন যেন ভারী, কেমন যেন এক অচেনা আকাঙ্ক্ষায় মোড়ানো।
আমার হৃদস্পন্দন এত জোরে হচ্ছে যে আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছি।
আমার মুখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো, হয়তো ভেজা চুল থেকে, হয়তো আমার ত্বকের উত্তাপ থেকে।
ইরাদ ধীরগতিতে সেটাকে আঙুলের মাথায় নিয়ে নিলো।
তারপর…

আমার মুখের এত কাছে চলে এলো যে তার নিশ্বাস আমার ত্বকে লাগছে।
ইরাদ নিজেকে সামলে নিয়ে রুহিকে একপাশে বসতে সাহায্য করে নিজেও বসলো। এবং সম্পূর্ণ অন্য দিকে ধ্যান দেবার করছিলো। তবে এই শরবতটি খাবার পর থেকে এই ১০-১৫ মিনিটে যেনো অন্য রকম কিছু হয়ে গেলো। যা নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে দিচ্ছে না নিজের ওপর।
বাইরে হঠাৎ এক বিকট শব্দে রুহি ভয় পেয়ে ইরাদকে জড়িয়ে ধরে,
ইরাদ এতক্ষণ ধরে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু রুহির ভেজা শরীর, তার কাঁপুনি, তার অনিয়ন্ত্রিত শ্বাস—সবকিছু যেন ইরাদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।
তার গলা শুকিয়ে এলো, হৃদপিণ্ড দ্রুত লাফিয়ে উঠছে।
সে ফিসফিস করে বলল, “রুহি, তুমি কি জানো তুমি এখন কেমন দেখাচ্ছো?”
রুহি কোনো উত্তর দিলো না। তার চোখ বন্ধ, ঠোঁট কাঁপছে হালকা।
ইরাদ গভীর শ্বাস নিলো।

“এত সুন্দর… এত বিভোর… যেন তোমার অস্তিত্বে আমাকে টেনে নিচ্ছে।”
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত তীব্রতা, একরকম আকর্ষণ মিশে আছে।
তার আঙুল রুহির ভেজা গালের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিলো।
“তুমি জানো না রুহি, তোমাকে এইভাবে দেখলে নিজেকে ধরে রাখা কত কঠিন হয়ে যায়।”
রুহি চোখ খুলল, তার দৃষ্টি আবছা, একটু অবাক, একটু দ্বিধাগ্রস্ত।
ইরাদ তার গলায় হাত রাখল, আঙুলের ডগায় শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে দিলো।
“তুমি কি চাও আমি নিজেকে আটকে রাখি?”
তার স্বর গভীর, তাপলাগা।
রুহি শ্বাস নিলো, কিছু বলল না।
ইরাদ হালকা হেসে বলল, “তুমি তো জানো না, আমি কতদিন ধরে এই মুহূর্তটার থেকে পালাচ্ছি…”
তার কপাল এসে ঠেকলো রুহির কপালে, চোখ বন্ধ করলো সে।
“আর হয়তো পালাতে পারবো না।”

রুহির শরীর শিহরণে কেঁপে উঠছে, তবু সে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছে না। ইরাদের আঙুল যখন তার গালের পাশ থেকে গড়িয়ে নিচে নামে, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ইরাদ আর অপেক্ষা করে না। রুহির কোমরের চারপাশে হাত জড়িয়ে ধরে, তাকে কাছে টেনে আনে। রুহি অনুভব করে ইরাদের গায়ের তাপ, তার শক্তপোক্ত বুকের সঙ্গে নিজের নরম শরীরের সংঘর্ষ, আর সাথে সাথেই ভেতরটা কেমন যেন দুর্বল হয়ে আসে।
রুহি কিছু বলতে চায়, কিন্তু ঠোঁট খুলতেই ইরাদের আঙুল সেখানে স্পর্শ করে।
“শব্দ করো না…” ইরাদের গলা গভীর আর নরম হয়ে আসে, যেন সে কিছু হারানোর ভয়ে আছে।
রুহির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে বাজে।
তারপর হঠাৎ করেই ইরাদ তাকে আরও কাছে টেনে আনে, এতটাই যে, তাদের কপাল একসঙ্গে লেগে যায়।
রুহির ঠোঁটের একদম কাছে ইরাদের নিঃশ্বাস, তার আঙুল আলতো করে রুহির গালে বুলিয়ে চলে যায়, তারপর নিচে নেমে ঘাড়ের কাছে থামে।
রুহির চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে।

তারপর…
ইরাদ আরও সামনে এগিয়ে আসে, রুহির চুলের ভেজা গোছার নিচে হাত রেখে তার ঘাড়ের পেছনে স্পর্শ করে। রুহি শিহরিত হয়, বুকের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়, যেন কিছু একটা চাই সে, কিন্তু কী তা বোঝার আগেই ইরাদ তাকে অনুভব করতে বাধ্য করে।
ইরাদের ঠোঁট আস্তে আস্তে তার গালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে।
শরীরের ভেতরকার উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে, যেন সেই পানীয় তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
রুহি জানে, আর পেছনে ফেরা নেই…

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১০

তার আঙুল ইরাদের চুলের ভেতর গেঁথে যায়, সে নিজেই কাছে এগিয়ে আসে।
একটা শ্বাস, একটা স্পর্শ, একটা গভীর অনুভূতি…
তারপর, সময় থেমে যায়।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১২