এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১২
Yasira Abisha
রুহির নিঃশ্বাস অনিয়ন্ত্রিত। ইরাদের মুখ এতটাই কাছে যে তার উষ্ণ নিঃশ্বাস রুহির ঠোঁটে লাগছে।
বাইরে ঝড়ের শব্দ যেন থেমে গেছে, কিংবা হয়তো এই মুহূর্তে রুহির কানে কিছুই আসছে না।
তার আঙুল ইরাদের শার্টের কলারে আটকে আছে, আর ইরাদের হাত এখনো তার কোমরের পাশে, দু’জনের মাঝখানে কোনো দূরত্ব নেই।
ইরাদ ধীরে ধীরে তার মুখ নামিয়ে আনে, ঠোঁট এতটাই কাছে চলে আসে যে রুহি নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।
ঠিক তখন রুহি বলে
— “আপনি জানেন, এই মুহূর্তে আমার… কেমন লাগছে?” রুহির কণ্ঠ যেন ঘুমের ঘোরে ঢেকে গেছে।
ইরাদ ধীর গলায় বলল, “কেমন?”
রুহি উত্তর দিতে চাইল, কিন্তু কথাগুলো যেন মনের ভেতরেই আটকে গেল। শরীরটা আরও ভারী হয়ে আসছিল, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো, যেন মাটির নিচে কিছু নেই, সে শূন্যে ভাসছে। মুহুর্তের মধ্যেই সে ঢলে পড়লো ইরাদের ওপর।
“রুহি!”
ইরাদের কণ্ঠে স্পষ্ট আতঙ্ক। সে দ্রুত রুহিকে ধরে ফেললো, শক্ত করে ওর শরীর আঁকড়ে ধরলো।
— “রুহি, চোখ খুলুন! রুহি!”
কিন্তু রুহির শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো, মাথাটা হালকা ভাবে ইরাদের বুকের ওপর গড়িয়ে পড়লো।
ইরাদ রুহির নিস্তেজ শরীরটা দেখে আতঙ্কে চমকে উঠল। তার ঠোঁট দ্রুত শুকিয়ে এলো, বুকের ভেতর কেমন একটা অজানা শঙ্কা দোল খেলো।
— “কে আছেন! প্লিজ আসেন!”
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা শুনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছন তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকল।
— “কী হয়েছে?”
ইরাদ রুহিকে শক্ত করে ধরে আছে, তার মুখের ওপর থেকে ভেজা চুলের গোছা সরিয়ে দিচ্ছে। রুহির নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এসেছে, চোখদুটো বন্ধ, ঠোঁটের কোণ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এরকম হচ্ছে কেন? ছন, প্লিজ কিছু বলেন!” ইরাদের কণ্ঠ ভেতর থেকে কাঁপছিল।
ছন রুহির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ভয়ের কিছু নেই ডাক্তার সাহেব। শরীর গরম রাখার জন্য যে পানীয়টা খাওয়ালাম, সেটা এই গ্রামের শীতের রাতে সবাই খায়। তবে…”
সে একটু থামল, ইরাদ অধৈর্য হয়ে তাকাল।
— “তবে কী?”
— “এটার একটা প্রভাব আছে। এটা শরীর উষ্ণ রাখার পাশাপাশি…” ছন একটু ইতস্তত করল, “এইটা… যৌন উত্তেজনাও বাড়ায়। কিন্তু মেম সাহেব তো জীবনে প্রথম খেলেন মনে হয়, তাই সহ্য করতে পারেননি। শরীর দুর্বল ছিল, মাথা ঘুরে জ্ঞান হারিয়েছে। চিন্তার কিছু নেই, কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।”
ইরাদের বুক ধক করে উঠল। এইরকম অনুভূতি হবার কারণ গুলো ও আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছে।
ভোর হয়ে এসেছে।রুহি গভীর ঘুমে, নিস্পাপ এক শিশুর মতো। ইরাদ তার পাশে বসে, এক হাতে রুহির মাথার কাছে হেলান দিয়ে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘরটা নরম আলোয় ঢাকা, রুহির প্রশান্ত মুখখানি তাতে যেন আরও কোমল দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ, নিঃশ্বাস একটানা, শান্ত। ঠিক যেন কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
ইরাদ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে—সে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসা, যা অহনার জন্য ছিল, তার ছায়া নয়। এই অনুভূতি একেবারে নতুন, একেবারে স্বতন্ত্র। রুহির মুখটা অহনার সঙ্গে মিলে গেছে বলে হয়তো প্রথমে দুর্বল হয়েছিল সে, কিন্তু এখন? এখন সে জানে, রুহি কেবল এক চেহারার প্রতিচ্ছবি নয়—সে নিজেই এক অনন্য অস্তিত্ব।
এই মেয়েটাই ইরাদের ভালোবাসা হয়ে উঠেছে। যে রুহি আনাইকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, যাকে সে নিজের মায়ের মতো আঁকড়ে ধরে, যে রুহির মমতায় আনাই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়।
আর আনাই? ইরাদের আপন মেয়ে তো নয় সে। তবু ইরাদ তার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে মেয়েটাকে। যত্ন করে, আগলে রাখে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আনাইয়ের পাশাপাশি কেউ আরেকজনও খুব কাছের হয়ে উঠেছে। ইরাদ তাকায় রুহির দিকে—শিশুর মতো নি:সঙ্গ অথচ গভীরভাবে ভালোবাসার যোগ্য এক মায়াবী রূপ।
তার এই অনুভূতির কোনো ভুল নেই। সে আবার প্রেমে পড়েছে।
রুহির প্রেমে।
রুহির ঘুম ভাঙল ধীরে ধীরে, চোখের পাতাগুলো একটু কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকাল সে। মাথাটা যেন একটু ভারী লাগছে, শরীরটা কেমন আলসেমিতে আচ্ছন্ন।
কিন্তু পরের মুহূর্তেই সে স্থির হয়ে গেল।
তার পাশেই ইরাদ! একই বিছানায়!
রুহি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। ইরাদ তার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, ঘুমন্ত। গম্ভীর, শান্ত মুখ, যেন কোনো গোপন চিন্তায় ঢাকা।
কিন্তু… রুহি তো কিছুই মনে করতে পারছে না!
শেষ যা মনে পড়ছে, তা হলো গত রাতে শরবত খাওয়ার পর ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল তার। তারপর? তারপর কি হয়েছিল? কিভাবে এখানে এল সে?
রুহি ধীরে ধীরে উঠে বসল, ইরাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কি কিছু হয়েছিল রাতে? নাকি কিছুই হয়নি?
তার মনে একগুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে।
-স্যার আমি এভাবে?
-আপনি রাতে ঘুমিয়ে গেছিলেন, আমি আপনার পাশেই ছিলাম। কেমন লাগছে এখন?
– জ্বি ভালো
– আপনি ঘুমান নি?
সে মুহুর্তেই রুমে ছন নাস্তা আসে এবং বলে, সারারাত ডাক্তার সাহেব আপনার পাশে বসেই ছিলো। একদমই ঘুমায় নি। আপনি অনেক ভাগ্যবতী।
এমন কথা শুনে রুহি লজ্জা পেয়ে যায়।
চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। ইরাদ ও রুহি গ্রামে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা দিয়ে ফিরেছে, ওরা সাধ্যমতো সবার সেবা করেছে। ক্লান্ত হলেও মনে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল।
ঢাকায় আসার পরের দিনই রুহি আনাইকে দেখতে গেল ইরাদের বাসায়।
বাড়ির দরজায় পা রাখতেই আনাই ছুটে এসে রুহিকে জড়িয়ে ধরল, “আম্মু!”
রুহি অবাক হয়ে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওর স্পর্শে এক ধরনের উষ্ণতা, এক ধরনের নির্ভরতা আছে—যেটা রুহি নিজেও উপভোগ করে।
কিন্তু ঘরের ভেতরে থাকা অন্য সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল।
ইরাদের মা তানিয়া, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন রুহির দিকে। এতদিন আনাই ‘আম্মু’ বলে ডাকছে, কিন্তু কে ছিল সেই ‘আম্মু’? আজ যখন চোখের সামনে রুহিকে দেখলেন, তার হৃদয়ের গভীরে একটা অনুভূতি জন্ম নিল।
রুহি দেখতে একদম অহনার মতো।
তানিয়া এগিয়ে এসে রুহিকে আদরে জড়িয়ে ধরলেন, যেন বহু বছর পরে পাওয়া কোনো হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন।
—”তোমাকেই তাহলে আনাই মা বলে ডাকে?” তানিয়ার কণ্ঠ কাঁপছিল, চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল।
রুহি একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করল, “আমি তো ওকে নিজের সন্তানের মতোই দেখি, আনাই খুব ভালো মেয়ে।”
তানিয়া চোখ মুছে হাসলেন, কিন্তু তাতে বিষাদের ছাপ লুকোনো ছিল না।
—”তোমার আসাটা কেমন যেন একটা নতুন আলো নিয়ে এসেছে,” তানিয়া গভীর মমতায় বললেন, “আমি ভাবতেই পারিনি, আমার ছেলে আবার জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু তুমি আসার পর… হয়তো সব বদলে যাবে।”
রুহি কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। সে কি সত্যিই ইরাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন এনেছে? ইরাদ তো কখনো এমন কিছু প্রকাশ করেনি। আনাই তাকে ‘আম্মু’ বলে ডাকে, কিন্তু ইরাদ? সে কি রুহিকে অন্যভাবে দেখে? নাকি ওদের সম্পর্ক এখনো শুধুই সহকর্মীর গণ্ডিতে আটকে আছে?
বিকেলের দিকে রুহি আনাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল। ছোট্ট মেয়েটা তার পাশে মুগ্ধ হয়ে শুয়ে ছিল, রুহির আঁচলে মুখ ঘষছিল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এল।
এই সময় তানিয়া এসে চুপচাপ পাশে বসলেন।
—”রুহি, একটা কথা বলবো?”
রুহি তাকাল, “জ্বি আন্টি?”
—”আমার ছেলে ইরাদের জীবনে তুমি এসেছ, আমি তাতে খুশি।”
রুহির ভ্রু কুঁচকে গেল।
—”তবে একটা কথা বলি, আমি কখনো ভাবিনি ইরাদ আবার জীবন শুরু করবে,” তানিয়ার কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া, “কিন্তু তুমি আসায় ওর জীবনটা পূর্ণতা পাবে।”
রুহি কিছু বলতে পারল না। তার নিজের মনেই প্রশ্ন—ইরাদ কি সত্যিই তাকে চায়? নাকি সে শুধুই আনাইয়ের মা হয়ে উঠেছে?
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রুহি নিজেই বলল, “আন্টি, ইরাদের জীবনে আসলে কী হয়েছিল?”
তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—”ইরাদ যখন ছোট ছিল, ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল ওর ভাই মাহিদ। বড় হলেও ওদের সম্পর্ক একইরকম ছিল। মাহিদ সবসময় ইরাদকে আগলে রাখত। আমি জানতাম, এই দুই ভাই একে অপরের জন্য জীবন দিতে পারে।”
রুহি নিঃশব্দে শুনছিল।
—”যেদিন আনাই জন্ম নেয়, সেদিন আমাদের ঘর আলো হয়ে গিয়েছিল। মাহিদ আর তার স্ত্রী—ওরা খুশিতে আত্মহারা ছিল। পুরো পরিবার আনন্দে মেতে ছিল। তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে সবাই মিলে ফিরছিলাম।”
তানিয়ার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
—”আমরা আলাদা গাড়িতে ছিলাম। একটায় ছিল মাহিদ আর ওর স্ত্রী, আরেকটায় ছিল ইরাদ আর ছোট্ট আনাই। ইরাদ তো কোনো মতেই আনাইকে কারো কাছে দিবেনা তাই সে আনাইকে নিয়ে আলাদা গাড়িতে উঠে সাথে আমি আর ইরাদের বাবা ছিলাম। কিছু দূর যেতেই মাহিদের গাড়ির সামনে হঠাৎ একটা ট্রাক এসে পড়ে।”
রুহি হতবাক হয়ে শুনছিল।
—”কেউ কিছু কিছু বোঝার আগেই… ওদের গাড়িটা কয়েকবার উল্টে যায়, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায়।”
তানিয়া আর বলতে পারলেন না, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে লাগল।
—”ইরাদ ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। মাহিদ… আমার মাহিদ আর সুবহা…”
তানিয়া আবার একটু থেমে বললেন,
—”ওরা কেউই বাঁচেনি।”
তানিয়া কাঁদছিল, “আনাই সেদিন বেঁচে গিয়েছিল শুধু ইরাদের জন্য। ওর বাবা-মা তখন পাশেই ছিল , কিন্তু ভাগ্য তাদের ছিনিয়ে নিলো… ওকে কেবল ইরাদের কাছে রেখে দিল। এরপর থেকে আমার ছেলেটার জীবন আনাই হয়ে যায়।”
রুহির গলা শুকিয়ে গেল। এতদিন ইরাদ যেটা বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিল, আজ তার মা তা বলে দিলেন।
—”ইরাদ আনাইকে নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসে। ওর নিজের রক্ত না হলেও, আনাই ওর পৃথিবী।”
তানিয়া চোখ মুছে বললেন, “তুমি ওর জীবনে এসেছ, আমি চাই ও সুখী হোক, অহনার পর আমার ছেলে আর কোনো কষ্ট পাক আমি চাই না।ইরাদ কাউকে সহজে তার কাছে টানতে পারে না। সে নিজের কষ্ট একা বহন করতে চায়। তুমি কতটুকু জানো ইরাদকে আমি জানিনা তবে ওকে অনেক ভালোবেসে আগলে রেখো”
রুহির হৃদয়টা কেমন ভারী হয়ে উঠল।
তাহলে ইরাদ কি কখনো তার কষ্ট ভাগ করে নেবে?
সে কি সত্যিই রুহিকে নিজের জীবনের অংশ করতে পারবে?
এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১১
রুহি জানে না, শুধু জানে—আজ ইরাদের কষ্টের সাথে সে আরও একটু জড়িয়ে গেল।
কথা গুলো বলে তানিয়ে চলে গেলেন, রুহির মনে তখন প্রশ্ন জাগলো তবে অহনার সাথে ইরাদের বিয়ে কেনো হলো না? উনি কোথাহ আছেন এখন??
ঠিক তখনই রুহির ফোনে কল এলো আফানের…..