রং পর্ব ৫৮ (৪)
তন্নী তনু
এই স্নিগ্ধ, কোমল চাহুনি, এই মায়াবী চোখজোড়া কেনো তার আগে চোখে পড়েনি? এই দূরত্ব কি করে ঘোচাবে সে?
যদি সম্ভব হতো তাহলে জানালার গ্রীল এর এই ইস্পাতের বাঁধা ভেঙ্গে একবার ইভার সামনে দাঁড়াতো রাফসান। তবে কিছু ভুল চোখের সামনে আপাদমস্তক মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকা সত্যেও তার মধ্যেকার দূরত্ব বাড়ায় বহুগুণে। এই টুকু দূরত্ব ঘোচানোর শক্তি, ক্ষমতা তার নেই,নেই মনের অন্তরালে বয়ে চলা এলোপাথাড়ি ঝড় থামানোর। যদি বিচ্ছেদ ই লেখা ছিলো তাহলে গল্পের শেষ প্রান্তে আবার কেনো দেখা হলো, কেনো মায়া বাড়ছে, কেনো হৃদয় ভাঙছে। এই কেনো গুলোর উত্তর কেনো নেই? যদি নতুন করে মেয়েটার মায়াতেই জড়াতে হবে তাহলে সময় থাকতে কেনো এই মায়ার সৃষ্টি হলো না। সব কিছু কেবল প্রশ্ন! আর প্রশ্ন।
ইভা একপলক তাকায় রাফসানের দিকে। নিঃশব্দ, নিরব চোখ দুটোর চোখের জল মিশে গেছে সময়ের সাথেই। ভাসানো চোখ দুটো ফিরিয়ে নেয় ইভা। এক সময়ে মানুষটা তাকে ছুঁড়ে ফেললেও ঐ যে ভালোবাসার একটা দোষ আছে কি না? নিজের কষ্টও নিজের আবার পাষাণ, নির্দয় মানুষগুলোর ব্যথাও নিজের। জানালার গ্রীলে খামছে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে রাফসান। চোখ দুটো যেনো বলছে– আমি অসহায়। সে চোখে তো ইভা আর তাকাতে পারবে না। পারবেই না। রাফসানের গলা চিরে আবারো আকুতি,
— ইভা! একবার কথা বলো। আমি ভুল করেছিলাম ইভা। প্রতিশোধের নেশায় আমি উম্মাদ হয়ে গেছিলাম। তুমি আমাকে পাঁচটা মিনিট দাও আমি সব বলবো। সব।
কথাটা শেষ না হতেই ইরফাদ উপস্থিত হয় সেখানে। মুখোমুখি ইভা আর রাফসানের দেখা হওয়াটা মোটেও সহজ ভাবে দেখছে না সে, আর এটাই স্বাভাবিক। রগচোটা গলা ফেঁড়ে ডাকে ইরফাদ,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ইভা!
এই ছোট্ট শব্দ, আর তীক্ষ্ম গলার স্বরে ইভার হৃদযন্ত্র থেমে যায় ন্যনোসেকেন্ড। অতঃপর নিঃশব্দে পিছু ফেরে। ইরফাদের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। পিপিলিকার মতো ধীর গতিতে পা ফেলে ইভা। পেছনের আস্ত, জ্যন্ত মানুষটা ক্ষমতাহীন, শক্তিহীন দূর্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। ইভা, টুম্পার সাথে আস্ত কলিজাটাও যেনো টেনে ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধীর গতিতে পা ফেলে ইভা ভয়ে ভয়ে ইরফাদের পাশাপাশি দাঁড়ায়। ইরফাদের শক্ত হাতের মুঠিতে ইভার হাত। গলায় চাপা স্বর। যেনো রাগ গুলো দাঁতে পিষছে ইরফাদ,
— এই জন্য নিয়ে এসেছিলাম তোকে……!
ভয়ে ভয়ে ইভার আত্মা কাঁপছে,ইচ্ছে করে সে পিছু ফেরেনি এই সত্যটুকু বলার সাহস ও নেই। তবে অগ্নীমূর্তী ধারণকারী ইরফাদ কঠিন গলায় বলে,
— আর একবারো নিয়ে আসবো না।
পুরো বিষয়টা অন্য দিকে ঘুরে যাওয়া অবস্থা দেখে সিনথিয়া বলে ওঠে,
— আপুর দোষ নেই। আপুতো….
ইস্পাতকঠিন হৃদয়ের মানুটা হিসহিসিয়ে ওঠে। তার স্বরে শোনা যায় “শশশ” শব্দটাই। অতঃপর ইভার হাতটা শক্ত হাতে ধরে টেনে নিয়ে যায় ইরফাদ। পেছন থেকে এক পাপিষ্ঠ হৃদয় অনুতপ্ততার দহনে পুড়ে ছাঁই হতে থাকে। অদৃশ্য টানে কিছু একটা ইভাকে স্থির থাকতে দেয় না। রাস্তা ফুরিয়ে যায়। মনটা ঠিকই একবার পিছু ফিরে তাকানোর কথা বলে। তবে পূর্ববর্তী দিনের প্রতিচ্ছবির তিক্ততা তাকে পিছু ফিরতে দেয় না। অনলে জ্বলা জ্যন্ত তরপাতে থাকা মানুষটাকে পিছনে ফেলে ইরফাদের সাথে সে জায়গা ত্যাগ করে ইভা। পেছনের চাতক পাখির মতো দুটো চোখ, দগ্ধ হওয়া হৃদয় ইভার শেষ পদচিহ্ন পর্যন্ত চেয়ে থাকে। তবে মেয়েটা আর পিছু ফেরে না। ফেরেই না…….
সিনথিয়াকে যে কাজে নিয়ে এসেছিলো ইরফাদ কাজ শেষ করে ঘুমন্ত টুম্পাকে বুকের মধ্যে রেখেই গাড়িতে ওঠে। পেছনে বসে ইভা। সিনথিয়া পাশে বসতে চাইলেও ইভা তাকে বাঁধা চাপা স্বরে বলে,
— কোনো কারণেই বরের থেকে দূরত্বে থাকবে না। ভাইয়ার কাছে বসো।
–তুমি একা বসবে?
— আ”ম ওকে।
ঠেলেঠুলে সিনথিয়াকে সামনে দিকে পাঠায় ইভা। ইরফাদ তখনো শক্ত চোখ মুখ নিয়ে বসে আছে। ইভা ধীর গলায় বলে,
— ভাইয়া।
কোনো উত্তর দেয় না ইরফাদ। ইভা বুঝতে পারে ইরফাদের নিরব থাকার কারণ। ভয়ে ভয়ে তবুও বলে,
— তুমি যা ভাবছো এমন কিছু না।
ইরফাদ স্ট্রিয়ারিং ঘুরায়, নিরবে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে ইরফাদ। ইভা আবারো বলে,
— তোমাকে কষ্ট দিয়ে কিচ্ছু করার ইচ্ছে আমার নেই। আমি আমার প্রিভিয়াস লাইফ টা ভুলিনি?
— আমি তোকে বলেছিলাম ওর ফেস টু ফেস হতে?
— ট্রাস্ট মি ভাইয়া। আমি শুধু টুম্পাকে দেখার জন্য জানালা খুলেছিলাম। আর তুমি যেটা দেখছো….
— কোনো এক্সপ্লেইনেশন চাচ্ছি না। এর পরে তুই আর আসবি না।
এরপরেই ইরফাদের ফোনটা মৃদু কেঁপে ওঠে। এরপর,
— স্যার!
— জাবির… বলুন।
— থানায় একজন মেয়ে এসেছে। খুব জেদ দেখাচ্ছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য। দেখা না করে যাবেই না।
— ঐটা কি জেদের জায়গা? আপনারা কি করছেন?
— উনি রায়হান রাফির মিসেস।
— তো….? ওনার জেদের জন্য কি রাফির জামিন হয়ে যাবে? নাকি ওনার সাথে দেখা করানো হবে? কোনটা?
— স্যার! বিষয়টা একটু আলাদা। তিনি তার হাজব্যন্ডের সাথে দেখা করতে আসেননি। এসেছেন আপনার ওয়াইফের সাথে দেখা করতে।
— বুঝলাম না।
— আমি যতোটুকু বুঝেছি তিনি আর ম্যাডাম মনে হয় ফ্রেন্ড ছিলো। আগের কেসের জন্য দুই জনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। আই মিন রাফির জন্য ম্যাডাম তো এক সময় থানায় ছিলেন।
–তো?
— রায়হান রাফির চাচা ম্যজিস্ট্রেট। উনি একটা কলও করেছেন আমাকে। মেয়েটা খুব ইনোসেন্ট। হাজব্যন্ড বিয়ের পরেই উধাও। এখন আবার অপরাধীর লিস্টে নাম। রায়হান রাফির জন্য বন্ধুত্ব ছিন্ন করে তিনি অনুতপ্ত। বাসায় খুব পাগলামি করে। মানাতে না পেরে আরকি আমাকে কল দিয়েছেন ওনার চাচা শ্বশুর ।আপনি যদি একটু মেয়েটার সাথে কথা বলতেন।
— সরি জাবির।
— স্যার! মেয়েটা আপনার ওয়াইফের বাসাতেও গিয়েছিলো সকালে।
এতোটুকু শুনে ইরফাদ সিনথিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
— বাসা থেকে কল দিয়েছিলো তোমাকে?
নিজের ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগের জিপার খুলে ফোন চেক করে। পাঁচটা মিসড কল দেখে চোখ বড় বড় করে সিনথিয়া,
— অনেক বার দিয়েছে তো। ফোন তো সাইলেন্ট ছিলো।
বলেই কল ব্যাক করে সিনথিয়া। ইরফাদ সাথে সাথে বলে,
— ডোন্ট…
সিনথিয়া কল কেটে দেয়। ইরফাদ আবার জাবিরের সাথে কথা বলে,
–সব বুঝলাম। কিন্ত সিনথি আমার কাছে আছে তিনি কি করে জানলেন?
— বউ আপনার, এমন কথা কি আর চাপা আছে? এসপির বউ বলে কথা,সবাই জানে। তবে আরেকটা কথা বলি, রেজিস্ট্রি টা দ্রুত করে ফেলুন স্যার। শত্রুর তো অভাব নেই। কখন যেনো আঙুল তোলে।
— আজ কালের মধ্যেই সেরে ফেলি তাহলে?
— শুভ কাজে দেরি করতে নেই স্যার।
স্যার,এদিকটা কি করবো?
— বলুন পরে কথা হবে।
— ওকে স্যার।
পুরো কথাতেই ইরফাদের মুখপানে তাকিয়ে থাকে সিনথিয়া। কথা শেষ হতেই প্রশ্ন করে,
— কি হয়েছে?
–আমাদের রেজিস্ট্রি করা দরকার। বেশী লেট হয়ে যাচ্ছে।
কথাটা আনন্দের হলেও বুকের মধ্যে মুচড়ে ওঠে সিনথিয়ার। তার ভালো থাকাটা মনে হয় শেষ হয়ে এলো। সবাই জেনে যাবে এইবার তার পরিচয়। এরপর? এরপর সব সত্যিই এমন থাকবে? আতঙ্কের ভেলায় ভাসতে থাকা সিনথিয়ার কোমল হাতের উপর হাত রাখে ইরফাদ। চোখে চোখে কথা হয়,” কি হয়েছে।”
মাথা দুলিয়ে নিরবে সিনথিয়া বলে,” কিছুনা।”
ইরফাদ স্ট্রিয়ারিং ঘুরায়। রাস্তা মোর নেয় অন্ধকার গলিতে। ইরফাদ ছোট করে শ্বাস ফেলে বলে,
— থানায় তোমার ফ্রেন্ড এসেছে।
ছোট মুখটাতে প্রশ্নের ভিড়। তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন,
— কোন ফ্রেন্ড?
— রায়হান রাফির মিসেস।
মুখের উপর খুশির আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। ইরফাদ মৃদু হাসে,
— দেখা করবে? কথা বলবে?
সিনথিয়া দুদিকে মাথা দোলায়। ইরফাদ মৃদু হেসে বলে,
— এইবার শখ মিটেছে মনে হয়।
সিনথিয়া চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর ধীর গলায় বলে,
— ও কেনো কথা বলতে চায়? এখন তো পুরো দেশ জানে আমার কোনো দোষ নেই।
— তিনি অনুতপ্ত মনে হচ্ছে। কথা বলবা?
আগের কথাগুলো চোখের সামনে উদীয়মান হতেই সিনথিয়া দুদিকে মাথা নাড়ায়। ইরফাদের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি,
— কোথায় থামতে হয় শিখে গেছো মনে হচ্ছে?
রাতের খাবার টেবিলে দিচ্ছে সিনথিয়া। ইভা টুম্পার জন্য দুধ গোলাচ্ছে রান্না ঘরে। বাকি জিনিসগুলো আনতে রান্না ঘরে যায় সিনথিয়া। ইভা আড় চোখে সিনথিয়াকে একবার দেখে। তারপর নিজের কাছে ডাকে,
— এদিকে আসবে একটু।
সিনথিয়া ইভার কাছে দাঁড়ায়। অকস্মাৎ যেনো শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে ইভা বলে,
— রাফসান তোমার ভাইয়া?
অপ্রত্যাশিত, অসময়ে এমন একটা প্রশ্নে পায়ের তলায় যেনো শূন্য হয়ে যায় সবকিছু। বাকশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সিনথিয়া।
রং পর্ব ৫৮(৩)
গভীর রাত, মোবাইলের মৃদু রিংটোনের শব্দে ঘুম ছুটে যায় ইরফাদের। ঘুমচোখে ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বলে,
— জাবির?
–স্যার! প্রভাতরঞ্জন পালিয়েছে। সাথে আরোও কয়েকজন।মনে হচ্ছে সব প্রি প্ল্যানিং ছিলো।
ইরফাদ ঘুম চোখেই বলে,
–ওকে।
— স্যার আর ইউ ওকে? বুঝতে পারছেন কি হয়েছে।
— আই ওয়াজ ইনডিড ওয়েটিং ফর দিজ।
— সিরিয়াসলি?
— হান্ড্রেড পার্সেন্ট।