কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২০
মিসরাতুল রহমান চৈতী
পুলিশের সাইরেনের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। বাতাসে অস্থিরতা। আশপাশের মানুষজন উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, কী হতে যাচ্ছে এখন!
রাতুল দাঁড়িয়ে আছে একেবারে সামনে। সে একটুও বিচলিত নয়, যেন সে জানে, এই মুহূর্তটা আসবেই।
ভেতরের মেয়েগুলোর চোখেমুখে ভয়, কিন্তু তার মাঝেই একটা আশার আলো ফুটে উঠেছে। ওরা জানে না, রাতুল তাদের কতটুকু সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু তারা এটাও জানে, আজ যা হচ্ছে, তা আগে কখনো হয়নি!
“এখানে কী হচ্ছে?”
পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে। একদল অফিসার, নেতৃত্বে একজন এসিপি। তিনি রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিস্টার আহমেদ, আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু এটা কোনো আইনসিদ্ধ কাজ নয়।”
রাতুল ঠান্ডা স্বরে বলল, “এসিপি সাহেব, আপনি জানেন এই জায়গাটায় কী হয়। আপনি জানেন, এখানে কত মেয়ে আটকে আছে জোরপূর্বক। তবুও, আপনি বলছেন আমি অন্যায় করছি?”
এসিপি একটু থমকালেন। তিনি রাতুলের সম্পর্কে জানেন। রাতুল যেটা ঠিক মনে করে, সেটা করেই ছাড়ে। তার বিশাল রাজনৈতিক প্রভাব, সাধারণ মানুষের ওপর তার গ্রহণযোগ্যতা— এগুলো ভালোই জানেন এসিপি।
“কিন্তু আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না, মিস্টার আহমেদ,” এসিপি বললেন, একটু কঠিন গলায়।
“আইন যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না, তখন ন্যায়ের পক্ষেই মানুষের দাঁড়ানো উচিত,” রাতুল বলল। তার চোখে এক অদ্ভুত জেদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এসিপি এবার আশপাশের পরিস্থিতি লক্ষ করলেন। পতিতালয়ের মেয়েগুলো কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তারা কি আসলেই স্বেচ্ছায় এখানে? নাকি রাতুল যা বলছে, তা-ই সত্য?
“আপনার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে যে এখানে মেয়েরা জোরপূর্বক আটকা?” এসিপি জানতে চাইলেন।
রাতুল হাসল। একেবারে ঠান্ডা অথচ বিদ্রুপাত্মক হাসি। সে পকেট থেকে একটা ফাইল বের করে অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দিল।
“এই ফাইলটা খুলুন। এখানে প্রত্যেকটা মেয়ের নাম আছে, যাদের এখানে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের পরিবারের খোঁজ করা হয়েছে। বেশিরভাগেরই পরিবার জানে না, ওরা কোথায়।”
এসিপি ফাইলটা নিয়ে দ্রুত চোখ বুলালেন। মুখ কঠিন হয়ে গেল।
“এসিপি সাহেব, আপনি যদি সত্যিকারের আইনরক্ষক হন, তাহলে আজ এই জায়গাটা বন্ধ করতে সাহায্য করুন। যদি না পারেন, তাহলে আমি আমার মতো করেই করব,” রাতুল বলল, একদম নির্ভরতার সুরে।
পাশে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকালো। অফিসার বুঝলেন, রাতুলের কথাগুলোকে উপেক্ষা করা কঠিন হবে।
তিনি গভীরভাবে শ্বাস নিলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, তদন্ত চলবে। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে এই জায়গা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“অভিযোগ সত্যি, অফিসার,” পেছন থেকে এবার কাঁপা গলায় বলল এক তরুণী। ওর চোখে ভয়, কিন্তু সে সামনে এসে দাঁড়াল। “আমাকে এখানে জোর করে আনা হয়েছিল। আমার পরিবার জানেই না আমি এখানে।”
এরপর একের পর এক মেয়েরা সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। তাদের চোখে ভয়, কিন্তু তারা কথা বলছে!
এসিপি এবার বুঝলেন, রাতুল ভুল বলেনি।
“পতিতালয়টি আজ থেকেই বন্ধ!” এসিপি ঘোষণা দিলেন।
এক মুহূর্তের জন্য চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর রাতুলের কর্মীদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেয়েরা কেঁদে ফেলল, কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না, এত বছর পরে অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছে!
রাতুল এগিয়ে গিয়ে সেই তরুণীর কাঁধে হাত রাখল, “তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাদের জন্য একটা নতুন জায়গার ব্যবস্থা করা হবে।”
এদিকে, পতিতালয়ের দালালরা আর মালিক চুপ করে আছে। ওদের মুখে তীব্র ক্ষোভ, কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই।
আসিফ এসে বলল, “বস, আপনি যা করেছেন, তা সত্যিই ইতিহাস হয়ে থাকবে।”
রাতুল কিছু বলল না। সে জানে, এটা শুধু শুরু। সামনে আরও অনেক পথ বাকি।
সে একবার আকাশের দিকে তাকাল। আজ সূর্যটা যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
শহরের বাতাসে আজ ভিন্ন রকম উত্তেজনা। কেউ বলছে, রাতুল আহমেদ আজ এক নতুন ইতিহাস গড়েছে, কেউ বলছে, সে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছে।
পতিতালয় উচ্ছেদের পরের দিনই সংবাদমাধ্যমে ঝড় বয়ে গেছে। প্রতিটি চ্যানেল, প্রতিটি পত্রিকা— সবখানেই রাতুলের নাম।
“রাজনীতির নেতা নাকি সমাজ সংস্কারক? রাতুল আহমেদের সাহসী পদক্ষেপ!”
“এক রাতেই পতিতালয় বন্ধ! কিন্তু এরপর কী?”
কিন্তু এই আলোড়নের পেছনে গভীর এক ষড়যন্ত্র বুনছে কেউ কেউ।
একটি দামি রেস্টুরেন্টের ভিআইপি কক্ষে বসে আছে শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান কয়েকজন মানুষ। মুখ গম্ভীর, চোখেমুখে অস্বস্তি।
সামনের চেয়ারটায় বসে আছে একজন, যার চোখে তীক্ষ্ণ চাহনি। নিখুঁত স্যুট পরা, হাতে এক গ্লাস ওয়াইন। সে ধীর স্বরে বলল,
“রাতুল আহমেদ একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
একজন মাঝবয়সী নেতা মুখে হাসি টেনে বলল,
“সমস্যা? না ভাই, ও তো আমাদের মতোই নেতা। রাজনীতি বোঝে না?”
ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে সেই ব্যক্তি একটু ঝুঁকে এল।
“ও নেতা হতে পারে, কিন্তু আমাদের মতো নয়। আমরা ক্ষমতা দিয়ে খেলি, আর ও দায়িত্ব দিয়ে রাজনীতি করে।”
একজন বৃদ্ধ নেতা গম্ভীর স্বরে বলল,
“এই ছেলে যদি পতিতালয় বন্ধ করতে পারে, তাহলে এরপর কি করবে? আমাদের ব্যবসা, আমাদের ক্ষমতা… সব কিছু তো ওর চোখের সামনে চলে আসছে।”
ওয়াইন হাতে থাকা লোকটা এবার ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“তাহলে, রাতুল আহমেদকে থামাতে হবে।”
এক মুহূর্তের জন্য কক্ষে নীরবতা নেমে এলো।
তারপর বৃদ্ধ নেতা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
“থামানো ঠিক হবে না, ভাই। তাকে ধ্বংস করতে হবে।”
বিকেলবেলা।
রাতুল তার অফিসে বসে আছে। সামনে কিছু রিপোর্ট, কিছু দলিল। ফোনের পর ফোন আসছে— কেউ প্রশংসা করছে, কেউ হুমকি দিচ্ছে।
আসিফ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গম্ভীর মুখে বলল,
“বস, ভালো খবর নেই।”
রাতুল কাগজপত্র থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল, “কী হয়েছে?”
আসিফ টেবিলে একটা ফাইল রাখল।
“তোমার নামে মামলা হয়েছে।”
রাতুল ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল, “কি অভিযোগ?”
“বেআইনি প্রবেশ, ভাঙচুর, নারী নির্যাতন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি।”
রাতুলের চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন এল না। বরং একটা ঠান্ডা হাসি ফুটে উঠল।
“এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?”
আসিফ চিন্তিত মুখে বলল, “এটা স্বাভাবিক না, বস। যেই নেতারা এতদিন তোমার সাথে ছিল, তারাই এখন তোমার বিরুদ্ধে গেছে। তাদের টাকা, তাদের ক্ষমতা— সব কিছু দিয়ে তোমাকে ধ্বংস করতে চাইছে।”
রাতুল চুপচাপ বসে রইল। তারপর চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য।
তার সামনে ভেসে উঠল চৈতীর মুখ।
“আপনার ক্ষমতা যদি সত্যিই কিছু সৃষ্টি করতে পারে, তবে তা হবে এই সমাজের নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র।”
রাতুল চোখ খুলল।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৯
“আসিফ, আমি জানতাম এই দিন আসবে। কিন্তু আমি ভয় পাইনি, আজও পাবো না।”
“কিন্তু বস, যদি তারা…”
“আমি জেলে যেতে রাজি আছি, মরতেও রাজি আছি, কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপস করবো না।”
এই প্রথম আসিফ বসের চোখে এমন অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখল।
তার মনে হলো, রাতুল আহমেদ শুধু একজন নেতা নয়— সে একজন যোদ্ধা।
একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
শহরের বাতাসে একটা ঝড় আসতে চলেছে…