কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২২
মিসরাতুল রহমান চৈতী
সকালে যখন চৈতী স্কুলের দিকে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে তার সামনে একটা দৃশ্য দেখতে পেল। সেখানে একটা মেয়ে, অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। পুরো শরীর রক্তাক্ত, পোশাক ছিঁড়ে গেছে, এবং তার চারপাশে মানুষের ভিড় জমে গেছে। রাস্তায় জমে থাকা ভিড় দেখে চৈতীর শরীর কাঁপতে শুরু করল। হাত-পা যেনো জমে গেলো, পুরো শরীরটা অবশ হয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারছিল না সে, শুধু দেখছিল। একের পর এক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল—কী হয়েছে, কীভাবে এই নির্মম ঘটনা ঘটল?
এই দৃশ্য দেখে চৈতীর চোখে ভয় ছিল না, তবে বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল। এটা এমন কিছু ছিল, যা কখনোই তার জীবনে ঘটবে না, এমন কোনো বাস্তবতায় সে কখনো ভাবেনি। চোখে জল আসতে থাকলেও সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।
এদিকে, খবরটা মুহূর্তেই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। রাতুল সব কিছু জানার পর তার ভেতর এক ধরনের তীব্র উত্তেজনা তৈরি হলো। চৈতীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে দ্রুত ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ল। তার পরিকল্পনা ছিল, পরিস্থিতি যেভাবেই হোক শান্ত করা। তাই রাতুল নিজের লোকজন ছড়িয়ে দিলো, যাতে তারা সব দিক থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রাতুল সাবধানে ভিড় ঠেলে, দ্রুত চৈতীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে এক ধরনের গভীর সংবেদনশীলতা ছিল, কিন্তু মুখে ছিল দৃঢ় সংকল্প। সে চৈতীর দিকে এক নজর দেখে বলল, “এইখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ক্লাস রুমে যাও। সব সময় মনে রেখো, রাতুল নামক একটা ছায়া তোমার অস্তিত্বে মিশে আছে। ভয় পেওনা তুমি। না, অগ্নিকন্যা। তোমার চোখে ভয় না, সাহস দরকার। তেজ দরকার। যাও ভিতরে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চৈতীর হৃদয়ে যেনো একটা শক্তি প্রবাহিত হলো। রাতুলের কথাগুলো তার মনোভাব পরিবর্তন করল। সে মাথা তুলে একটু দম নিল এবং স্কুলের দিকে এগিয়ে গেল, তার মধ্যে এক ধরনের নতুন দৃঢ়তা ছিল।
বাহ্যিকভাবে কিছুটা ভীত, কিন্তু ভিতর থেকে আগুনে পোড়া একটি সাহসী মেয়ে, এখন চৈতী প্রস্তুত ছিল যে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে।
রাতুল তার লোকদের দিয়ে মেয়েটিকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। এরপর আসিফ ও রাতুল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। আসিফ মুখে উদ্বেগ নিয়ে বলল, “ভাই, এই কাজটা কার? আর কে এমন নৃশংসতা করেছে? কিছু বুঝতে পারছেন?”
রাতুল হালকা একটি হাসি দিলো এবং চোখে কিছুটা তীক্ষ্ণতা ছিল। তারপর বলল, “এখনো বুঝতে পারনি? যেই কয়েকজন জানতো আমি বিবাহিত, তাদের স্বার্থে ছোটোখাটো একটা ট্রেলার দেখানো হলো। আমাদের সমাজে যে দয়াশীল নেতা হিসেবে পরিচিত, দেলোয়ার খন্দকার, এই কাজটা তারই। ভুল করেছে। তার বিরুদ্ধে অনেক বেইআনি কাজ চলছে, হিসাব করলে দেখতে পাবে। আর সে কোন কোন পতিতালয়ে যায়, কি কি ঘৃণ্য কাজ করে—সব কিছু আজকের মধ্যে রেকর্ড করে আমার কাছে নিয়ে আসো।”
আসিফ কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু ভাই, বড় বড় পুলিশ নেতা তো আছেই, আর তাদের সাথী ও সহযোগীও রয়েছে। তাহলে ওদের কাছে দিলে তো তারা সব কিছু গায়েব করে দেবে। আর আমাদের বিপদ বাড়বে, এমনিতেই তো তারা আপনার নামে কেস ফাইল করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।”
রাতুল আবার হাসলো, তবে এই হাসির মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর আবাহ ছিল। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা আমাদের আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখব, সব কিছু গোপন রাখব। আর যতগুলো বেইআনি ফ্যাক্টরি দেলোয়ার খন্দকারের আছে, সেগুলো আজ রাতের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে দেব। কাউকে আর ছাড় দেওয়া হবে না।”
রাতুলের এই দৃঢ়তা, সাহস এবং পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল, তার কাছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কেবল সময়ের ব্যাপার।
রাতুল একবার স্কুলের দিকে তাকাল, নিশ্চিত হলো চৈতী ক্লাসরুমে চলে গেছে। তারপর সে ধীর কণ্ঠে বলল, “সব রেডি তো?”
আসিফ দ্রুত মাথা ঝাঁকাল, “হ্যাঁ ভাই, কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দিয়েছি। দেলোয়ার খন্দকারের প্রতিটা গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা আছে…”
রাতুল চোখ সরু করল, “কি সমস্যা?”
আসিফ একটু কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “দেলোয়ার খন্দকার শুধু রাজনৈতিক নেতা না, ওর হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পুলিশের অনেক বড় মাথাদের সাথে তার লেনদেন রয়েছে। আমাদের প্ল্যান যদি একবার ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে উল্টো আমাদের দিকেই ফাঁদ পাতবে।”
রাতুল ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ওরা ফাঁদ পাতবে? তাহলে তো সেটা ওদের জন্যই সবচেয়ে বড় ফাঁদ হবে।”
আসিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “ভাই, আপনি যা বলবেন তাই হবে। তবে সাবধান থাকতে হবে।”
রাতুল একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “তুই শুধু খবর পৌঁছে দে, বাকিটা আমি দেখব। আজ রাতের মধ্যে দেলোয়ার খন্দকারের বেইআনি ব্যবসার অস্তিত্ব থাকবে না।”
আসিফ আর কিছু বলল না, শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানাল। রাতুল তখন পকেট থেকে ফোন বের করে কোথাও একটা নম্বর ডায়াল করল।
হাসপাতালের করিডোরে থমথমে পরিবেশ। মেয়েটিকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে, চিকিৎসকরা তার অবস্থা নিয়ে এখনো কিছু বলেনি। চারপাশে পুলিশ, সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষের ভিড়। এই সময়েই একদল রাজনৈতিক নেতা হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে গাড়ি থেকে নেমে এল। তাদের নেতৃত্বে দেলোয়ার খন্দকার।
সে মুখে দুঃখের ছাপ এনে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়াল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ তার মুখে পড়তেই সে গলায় ভারী আবেগ এনে বলল, “আমাদের সমাজে এমন নির্মম ঘটনা ঘটছে, এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমরা এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। অপরাধীরা যে-ই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তার সাথে থাকা অন্য নেতারা সমস্বরে মাথা নাড়ল। কেউ কেউ চোখে দুঃখের ছায়া ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। সাংবাদিকদের কেউ একজন প্রশ্ন করল, “আপনারা কি ভুক্তভোগীর পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন?”
দেলোয়ার খন্দকার মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, তারপর নাটকীয় কণ্ঠে বলল, “অবশ্যই! আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করব। আমি নিজে তার পরিবারের সাথে দেখা করব, আর প্রশাসনের সাথে কথা বলে দ্রুত দোষীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করব।”
সঙ্গে থাকা নেতারা আবারও মাথা ঝাঁকাল। কেউ কেউ চাপা স্বরে বলল, “ঠিক বলেছেন নেতা ভাই, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে!”
এর মধ্যে হাসপাতালের এক চিকিৎসক বাইরে বেরিয়ে এলেন। সাংবাদিকরা দৌড়ে গেল তার দিকে, কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না। দেলোয়ার খন্দকার দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বলল, “ডাক্তার সাহেব, মেয়েটার অবস্থা কেমন?”
ডাক্তার একটু ইতস্তত করে বললেন, “তার অবস্থা সংকটাপন্ন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, কিন্তু শারীরিক এবং মানসিকভাবে সে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।”
দেলোয়ার খন্দকার মাথা নাড়ল, যেন খুবই মর্মাহত হয়েছে। তারপর সাংবাদিকদের দিকে ফিরে করুণ গলায় বলল, “আমরা সবাই ওর জন্য দোয়া করি। প্রশাসনের কাছে আমার একটাই দাবি, দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক!”
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আবার ঝলসে উঠল। চারপাশে ভিড় আরও বাড়তে থাকল। কিন্তু কেউ জানত না, এই দুঃখ প্রকাশ করা মানুষটাই এই ঘটনার নেপথ্যে মূল খলনায়ক।
স্কুলের নির্জন করিডোরে দাঁড়িয়ে রাতুল আর আসিফ ফোনে চোখ রেখে দেলোয়ার খন্দকারের প্রেস কনফারেন্স দেখছিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে তার নাটকীয় মুখভঙ্গি, সংবেদনশীল কণ্ঠে বলা কথাগুলো—সবটাই যেন সাজানো একটা দৃশ্যের অংশ।
আসিফ ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপাত্মক হাসি টেনে বলল, “দেখছেন তো ভাই, কী সুন্দর করে নাটক করছে!”
রাতুল ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, “অভিনয় ভালোই জানে। তবে এই মঞ্চের পর্দা নামতে বেশি সময় লাগবে না।”
ঠিক সেই মুহূর্তে স্কুলের ঘণ্টা পড়ল। ছুটির সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই চৈতী স্কুল থেকে বেরিয়ে মেইন গেটের দিকে এগিয়ে এল। অন্য শিক্ষার্থীদের মতো সেও গেটের দিকে হাঁটছিল, কিন্তু তার চোখে আজকের সকালবেলার ঘটনার ধাক্কা স্পষ্ট ছিল।
রাতুল ধীর পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গভীর চোখে চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো, গাড়ি রেডি আছে। সিকিউরিটি থাকবে তোমার সাথে, তোমাকে সাবধানে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।”
চৈতী কিছু বলল না, শুধু একবার মুখ তুলে তাকাল। তার চোখের ভাষা বুঝতে পারা কঠিন, তবে তার মধ্যে প্রশ্ন ছিল।
গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার আগে রাতুল পকেট থেকে একটা পুরোনো মডেলের বাটন ফোন বের করে চৈতীর হাতে দিল।
“এইটা সবসময় সাথে রেখো,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে, “এতে শুধু দুটো নাম্বার সেইভ করা আছে—আমার আর আসিফের। যদি আমাকে ফোনে না পাও, তাহলে আসিফকে ফোন করবে।”
চৈতী কিছুক্ষণ ফোনটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ডাগর ডাগর চোখ তুলে সরাসরি রাতুলের দিকে তাকাল। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত আবেগ মিশে ছিল।
“আপনি যাবেন না?”
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২১
রাতুল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “না, এখনো না। আমার কাজ শেষ হলে আমি নিজেই তোমার কাছে যাব। আর শুনো, ক’দিন আর স্কুলে আসতে হবে না। বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে।”
চৈতী কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চোখের সামনে আরও কিছু প্রশ্ন জড়ো হচ্ছিল, কিন্তু সে চুপ করে রইল। রাতুল নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে দিল, চৈতী ধীরে ধীরে উঠে বসল।
গাড়ি ধীরে ধীরে স্কুল গেট পেরিয়ে রাস্তায় মিলিয়ে গেল। রাতুল গাড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিল। তার চোখে তখন শুধু প্রতিশোধের অগ্নিশিখা জ্বলছিল।