প্রেমের সমর পর্ব ১৪
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সারারাত ফ্লোরে গড়াগড়ি করার দরুণ স্বচ্ছর শরীরময় ব্যাথা অনুভব হলো। কোন রকমে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসেই তাকাল সুহার দাদার দিকে। হাত বাড়িয়ে বেহাল ভাবে বলল,
“ ডিয়ার দাদাজান, চারবছর তো আপনার নাতনিকে আপনার কাছেই আমানত রেখে গেলাম। কিন্তু তাই বলে এখনও আমাকে এখন এভাবে অপমান করবেন?”
সুহার দাদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। লাঠির ঠকঠক আওয়াজ তুলে বলে,
“ এই হতচ্ছাড়াকে এখানে থাকার অনুমতি দিল কে? ”
সুহা ছোট ছোট চোখে তাকায়। স্বচ্ছ ততক্ষনে উঠে দাঁড়ায়। দাদাজানের সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে বলে উঠে,
“ শ্বশুড়বাড়ির জামাই শ্বশুড়বাড়িতে থাকবে। তাতে আবার অনুমতি দিবে কে বলুন? এইটুকু অধিকার তো আমার আছেই না? ”
দাদাজান গম্ভীর স্বরে উত্তর করলেন,
“ না নেই, তুমি যদি এখানে থাকোই তাহলে ছাদের চিলেকোঠার ঘরটাতে থাকবে। বাসায় থাকার অধিকার তোমার নেই। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠল,
“ ছিঃ দাদাজান! আপনার নাতজামাই হই আমি। ”
দাদাজান এবারে লাঠি দেখালেন। চোখ রাঙ্গিয়ে বলে উঠলেন,
“ দেখেছো? যদি পিঠে এটার মার না চাও তো ওখানেই থাকবে। আর নয়তো আজই এখান থেকে চলে যাবে। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্বচ্ছকে কান টেনে দাদাজান ছাদের সেই চিলেকোঠার ঘরটাতেই নিয়ে গেল। শাস্তিস্বরূপ দিয়ে গেল রোদে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জীবনেই একটাই বিয়ে করেছে, একটাই বউ তার। সে বউকে পেতেই কি না কি করছে সে। ছোট শ্বাস টেনে দাদাজানের কথামতো রোদের দাঁড়িয়ে থেকেই সিগারেটে আগুন ধরাল। মুখে তুলে ধরতেই পেছন থেকে শুনতে ফেল,
“ দুপুর হলো। ক্ষিধে লাগে নি যে সিগারেট ফুঁকছেন? ”
স্বচ্ছ তাকায়। সুহাকে নাস্তা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায় অন্য পাশে। পরমুহুর্তেই সদ্য আগুন ধরানো সিগারেটটা পায়ে পিষে ফেলে বলে উঠে,
“ লাগলেও খেতে দিবে কে? তোমার দাদাজান নিষ্ঠুর মানুষ। রোদে দাঁড় করিয়ে চলে গেছে। আর তুমি তো নির্দয় মহিলা। দেখা যেত বিষ মিশিয়ে খাবার খাইয়ে দিতে।”
সুহা হতাশ শ্বাস ফেলে। রেগে না গিয়ে খাবার গুলো স্বচ্ছর সামনে ধরে বলে উঠে,,
“ আম্মু পাঠিয়েছে। শতহোক আমরা মানুষ তো স্বচ্ছ, কেউ আমাদের বাসায় আসলে আপ্যায়ন না করে পারি না। ”
স্বচ্ছ ভ্রু বাঁকায়। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে উঠে,
“ এটা আপ্যায়ন ? যায় হোক, খাবারটা দাও, পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আমার। ”
কথাটা বলেই খাবারটা হাত টেনে নিল স্বচ্ছ। দু পা বাড়িয়ে চিলেকোঠার ঘরটায় যেতেই দেখল ময়লা হয়ে আছে। ধূলোবালিতে তার এলার্জি। মোট কথা তার থাকার যোগ্য নয়। তবুও স্বচ্ছ একটা গাছের টুল টেনে নিয়ে বসল। খেতে লাগল। সুহা তা দেখল। স্বচ্ছকে এমন বেমানান পরিবেশে দেখে নরম স্বরে বলল,
“ স্বচ্ছ? চলে যান এখান থেকে। দাদাজান খুব একটা সহজ মানুষ নন। জ্বালিয়ে মারবে আপনাকে। একটা নামমাত্র সম্পর্কের জন্য জ্বলে তো লাভ নেই বলুন? ”
“ তোমার দাদাজান তোমাকে আমার হাতে না তুলে দেওয়া অব্দি যাব না। ”
“ কখনোই তুলে দিবে না। আর তুলে দিলেও আমি কখনো আপনার হবো না স্বচ্ছ। কখনোই না। এখন ও মনের মধ্যে আপনার জন্য ঘৃণা পুষি। ”
স্বচ্ছ তাকায় বাঁকা চাহনিতে। ভ্রু নাচিয় বলে উঠে,
“ কোনদিন ভালোবাসতে চাইবে না তো? ”
সুহা তৎক্ষনাৎ বলে,
“ জীবনেও না। ”
কথাটা বলেই দ্রুত পা চালাতে নিতেই উষ্টা খেয়ে পড়তে নিল সুহা। স্বচ্ছ মুহুর্তেই হাতের থালাটা রেখে সুহার হাত টেনে ধরল। বলল,
“ পরলে তো ব্যাথা পেতে। ”
সুহার ত্যাড়া গলা,
” পেলে পেতাম। ”
স্বচ্ছ হাসে। নিচে বসে সুহার পায়ে হাত রাখে। তারপর উষ্ঠা খাওয়া বুড়ো আঙ্গুলটাতেই হাত বুলিয়ে বলে,
“ ব্যাথা লাগল বেশি? আমি যখন বিরক্ত করব তখন মারতে হবে তো আমায়। ব্যাথা পেলে মারবে কিভাবে? ”
সুহা ফোঁসফোঁস শ্বাস টানে। মুহুর্তেই পা টা সরিয়ে নিয়ে বলে,
“ না বলে পায়ে হাত দিবেন না কখনো। ”
কথাটা বলেই সুহা বেরিয়ে যায়।স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ বুঝে বিড়বিড় করে বলে,
“ সুহাসিনী?যদি পায়ে হাত দিয়ে ভালোবাসা প্রার্থনা চাই? তবুও কি ফিরিয়েই দিবে?”
স্বচ্ছ বিকালেও সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত ছাদে বসে। রুমটা মোটামুটি থাকার মতো করে পরিষ্কার করেছেে।কিন্তু ঐ যে ধুলোবালিতে তার এলার্জি? তার দরুণই একটু পরপর হাঁচি কাশি দিচ্ছে সে। সাথে সিগারেট৷ ঠিক সেই মুহুর্তেই ছাদে এলে সম্মানীয় দাদাজান। স্বচ্ছ তা দেখেই চিলেকোঠার একটা ভাঙ্গা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। সেভাবেই দাদাজানের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল,
“ দাদাজান? আপনার নাতনিকে পেতে হলে কি কি করা উচিত আমার? সাজেশন দিন কিছু। ”
দাদাজান কঠিন মুখচাহনিতে তাকালেন। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠছে উনার। বেয়াদব ছেলে!তার সামনেই সিগারেট টানছে। রেগে বললেন,
” আমাকে কি বন্ধু লাগছে তোমার? ”
স্বচ্ছ হাসে। মজা করে বলে,
“ একদমই নাহ! আমার মনে হচ্ছে আমি আপনার নাতনির প্রেমে পড়ে গিয়েছি। কি একটা বাজে অনুভূতি টের পাচ্ছি। সে অন্য কারোর হয়ে যাবে ভাবলেই দমবন্ধ লাগছে, রাগ লাগছে। ”
“ এসব বললে কি আমি গলে যাব তোমার প্রতি? চুল আমার এমনি এমনি পাঁকে নি। ”
“ আজকাল সত্যি কথার দাম নেই। কি এক আজব পৃথিবী! চারবছর আগে যখন ভন্ডামি করলাম তখন আপনার নাতনি গলে জল হয়ে গেল। এবার যখন সত্যি সত্যিই বেহায়াপনা দেখাচ্ছি তখন আপনার নাতনি আমায় ধারে কাছেই ঘেষতে দিচ্ছে না। ”
দাদাজান কঠিন স্বরে বললেন,
“ আমার নাতনিকে আমি অন্যত্র বিয়ে দিব। তোমার সাথে সংসার করতে দিব না বেয়াদব। ”
“ পারবেন? ”
দাদাজান কপাল কুঁচকালেন। কঠিন চাহনিতে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ আমার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করছো তুমি? ”
স্বচ্ছ হেসে বলে,
“ না, শুধু এইটুকু বলে রাখছি যে আমার বউকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দেওয়ার সাহস আপনি করতে পারবেন না। ভালো হবে না। ”
দাদাজান রাগে থমথমে হয়ে বলে,
“ কতটুকু বয়স তোমার? ভালো খারাপ শেখাচ্ছো আমায়? ”
“ আপনি আর আপনার নাতনি দুইজনই সেইম সেইম। বলুন, আপনাকে কিভাবে পটানো যায়? আমি নিশ্চিত আপনাকে পটাতে পারলে আপনার নাতনিকেও পটাতে পারব আমি। ”
দাদাজান রাগ সামলাতে পারলেন না যেন। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলেন,
“ মেরে মুখ ভেঙ্গে দিব বেয়াদব ছেলে। ”
স্বচ্ছ চিলেকোঠার ঘরে নিচে বিছানা করেছে৷ অসুবিধা হচ্ছে তার৷ সাথে মশার কামড় খাচ্ছে। শরীরটা জ্বরজ্বরও লাগছে। কপালটাও ব্যাথা করছে৷ বউ খুঁজতে এসে শরীরের এই তীব্র বেঈমানিতে বিরক্ত হলো স্বচ্ছ। সাদাফকে কল করে বিরক্তি নিয়ে জানাল,
“ একটাই বউ। তাও ভালোবাসে না আমায়। আমার দুঃখটা বুঝিস দোস্ত? ”
সাদাফ ওপাশ থেকে হেসে উপহাস করে বলে,
“ আহারে, আবার মেরেছে নাকি তোকে? কি কারণে মারল এবারে? ”
“ ওকে ঘুমালে সুন্দর লাগে। এতোটা সফট বাচ্চা বাচ্চা লাগে যে শুধু হাত ছোঁয়ালাম গালে। ব্যস! ”
সাদাফ মুহুর্তেই হাসিতে ফেটে পড়ে। বলে,
প্রেমের সমর পর্ব ১৩
“ মেরে দিল? মার খেয়েও পড়ে আছিস ওখানে?ছিঃ! ”
“ ছিঃ?”
“ ভালো টালো বাসিস? ”
স্বচ্ছ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে। সত্যিই তো। সেই ভালোবাসে মেয়েটাকে? ভালোবাসার সংজ্ঞা তো এমনই? শেষমেষ সে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলল? স্বচ্ছ বুঝে উঠেও না বুঝার ভান করে বিড়বিড় করে বলে,
“ বুঝে উঠছি না।একটা মেয়েকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় জেনেও উঠছি না। ওকে ভাবলেই মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে আসছে। মাথা কাজ করছে না। শুধু এইটুকু মনে হয় যে ওকে অন্য কারোর হতে দেওয়া যাবে না দোস্ত। ওকে দেখতে ভালো লাগে, উপস্থিতি ভালো লাগে, ঝগড়া ভালো লাগে এমনকি মার দেওয়াও ভালো লাগে। এবং ওকে জ্বালাতেও ভালো লাগে। ”
ওপাশ থেকে সাদাফ তখন বলে,
“ ঘটনা তাহলে জন্ডিস। তুই বোধহয় কঠিন রকমের প্রেমে ট্রেমে পড়ে গিয়েছিস দোস্ত। ”