এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৩

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৩
Yasira Abisha

বিকেলের নরম বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। রুহি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, আনাই পাশেই খেলছে। চারপাশে নরম আলো, কিন্তু রুহির মনে যেন কুয়াশা নেমে এসেছে।
ফোনটা বাজছে।
স্ক্রিনে ভেসে উঠছে এক পরিচিত নাম— Afan Calling…
হাতের আঙুল শক্ত হয়ে এল। এত মাস পর, এত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হঠাৎ এই ফোন?
সে ফোন ধরবে কি না, বুঝতে পারছে না। একটা সময় ছিল যখন এই নামটাই ছিল তার সব, যখন এই মানুষটার এক ফোন কলের জন্য সে অপেক্ষা করত। কিন্তু সেই মানুষটাই একদিন পেছন ফিরে তাকায়নি। আর আজ? আজ কেন?
ফোনটা থেমে যায়, আবার বাজতে শুরু করে।
পঞ্চাশবার উপেক্ষা করেও একান্নতমবার সে আর উপেক্ষা করতে পারল না।
ধীরে ধীরে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এল এক চাপা শ্বাস, যেন ওপ্রান্তের মানুষটা দ্বিধাগ্রস্ত, অথচ ভীষণভাবে কিছু বলার প্রয়োজন অনুভব করছে।

— “রুহি… আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যাওনি।”
রুহির কপালের ভাঁজ গভীর হলো। সে চুপচাপ অপেক্ষা করল, অফান বলে যেতে থাকল—
— “সুহা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে…”
এক মুহূর্তের জন্য রুহির নিঃশ্বাস আটকে গেল।
— “সে এখন অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসে। আমার কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়ে চলে গেছে। এত দিন ধরে আমি যাকে ভালোবেসেছি, যার জন্য তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, সে আমাকে একটা পয়সার মূল্যও দিল না। আমি শেষ হয়ে গেছি, রুহি।”
সুহা—সুন্দরী, আধুনিকা, অহংকারী একটা মেয়ে ছিলো অনেকটাই স্বার্থপর তাই তো নিজের কাজিনের হবু বরকে বেছে নিয়েছিলো।কিন্তু তবুও সে-ই ছিল অফানের ভালোবাসা। হয়তো সুহা তখন আফানের চোখে রুহির চেয়ে ‘ভালো’ একটা অপশন।
রুহি গভীর শ্বাস নিল।
— “তাহলে আজ এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল?”
ওপাশে নীরবতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “তুমি চাইলে আমরা আবার এক হতে পারি, রুহি। আমি জানি, তোমার মন এখনো আমার জন্য কাঁদে।”
এই কথাটা শুনে রুহির ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। এত সহজ! এত সহজে সে ভাবছে রুহি আবার সব ভুলে ফিরে যাবে? এই কটা মাসের কষ্ট, প্রতিটা দুঃখ, একাকীত্ব… এসবের কোনো মূল্য নেই?
ঠিক তখনই দরজাটা খুলল।
ইরাদ।
ক্লান্ত, অপারেশন শেষ করে ফিরেছে। চোখের নিচে হালকা ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মুখে একরকম প্রশান্তি।
রুহির চোখ তার চোখের সাথে আটকে গেল।
ইরাদ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, কিন্তু কোনো কথা বলল না। শুধু আনাইকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বিছানার ওপর একটা ছোট্ট প্যাকেট রেখে গেল, এক ঝলক হাসি দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে বলল—
— “এটা আপনার জন্য।”
তারপর চলে গেল।
রুহি তাকিয়ে রইল। ইরাদের ওই ক্লান্ত চোখের তলাতেও একচিলতে মায়াময় হাসি ছিল, যেন সে জানে, রুহির জীবনে তার জায়গাটা কোথায়।
ফোনের ওপাশে তখনো অফান কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু রুহির মন তখন অন্য কোথাও।
সে প্যাকেটটা খুলল।

ভেতরে একটা হালকা রঙের শাড়ি, একটা শুভ জন্মদিনের কার্ড, আর একটা ছোট্ট গিফট বক্স—যেখানে কাঁচের চুড়ি, টিপ, আলতা আর কাজল রাখা। এতদিন পর কেউ ওর জন্য এই ছোট ছোট জিনিসগুলো মনে রেখেছে?
তার চোখ জলে ভরে উঠল।
অফানের কণ্ঠ তখনো কানে আসছে—
— “রুহি, আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো। আমিও ভালোবাসি। একবার শুধু বলো, সব ঠিক হয়ে যাবে…”
রুহি এবার ফোনটা কানে ধরে একটানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর নিঃশব্দে ফোনটা কেটে দিল।
আর কোনো উত্তর দিল না।
শুধু একটা টেক্সট করলো আফানকে
“ধন্যবাদ আফান আমাকে বুঝানোর জন্য যে তুমি আমার জীবনে এখন না ভালোবাসায় আছো, না করুণায় আছো, না আছো ঘৃণায়।
আজকে তোমার টাকা চলে গেছে, প্রতারিত হয়েছো, তবুও মনটা ভালো হয় নি। কথার ভেতর এখনো কতটা স্বার্থপরতা তোমার। আমি আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করি তোমার জীবন থেকে সড়ে আসার সুযোগ পেয়ে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি না আফান। আর তোমার কাছে ফেরার প্রশ্নই আসে না। ”
আর রুহি তার উত্তর তো সে নিজেই পেয়ে গেছে।
অফান যদি হয় ঘনঘটা মেঘ, ইরাদ তবে এক চিলতে রোদ্দুর।

সারাদিন অনেক কিছু ঘটে গেছে। সকাল থেকেই বাসায় একটা ব্যস্ততা ছিল। ইরাদের মা-বাবা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন কয়েক দিনের জন্য, আর রুহির মা-বাবাও আজ রাজশাহী রওনা দিয়েছেন।
রুহির ছোট ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, তাই পুরো পরিবার ওর সাথে গেছে। রুহিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যাবে কি না, কিন্তু সে রাজি হয়নি। আনাই ছোট্ট মেয়ে, ওকে একা ফেলে যেতে মন চাইছিল না।
তার ওপর ইরাদের মা-বাবাও চলে যাচ্ছেন, বাসায় শুধু ইরাদ, আনাই থাকবে। একা হাতে আনাইকে সামলানো অনেক কঠিন হয়ে যায় ইরাদের জন্য, রুহির পরিবারেও সবাই যেনো আনাইকে চেনে এই কয়দিনে ভালো একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে আনাইয়ের সাথে তাদের।
শেষ অধ্যায়: এক চিলতে রোদ্দুর
সন্ধ্যা নামছে।
বাসাটা বেশ ফাঁকা লাগছে শুধু রুহি, ইরাদ আর আনাই এখানে।
আফানের ফোন রেখে দেওয়ার পর রুহির ভেতরটা অদ্ভুত রকমের হালকা লাগছে। যেন একটা ভার কাঁধ থেকে নেমে গেছে।
সে আনাইকে খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে, আর এখন বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনই ইরাদ এসে পাশে দাঁড়াল।

— “আপনি ভাবছেন কী নিয়ে?”
রুহি হেসে বলল, “কিছু না, হঠাৎ একটু একা লাগছে। সবাই তো চলে গেলো আজ।”
ইরাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রুহির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মৃদু হাসল।
— “একটা প্রশ্ন করব?”
রুহি অবাক হয়ে বলল, “করুন।”
— “আজকের দিনে কেউ আপনাকে স্পেশাল অনুভব করিয়েছে?”
রুহি কিছু বলল না, শুধু একটু অস্পষ্ট হাসল।
ইরাদ তখন পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করল।
— “জানেন, আজকের দিনটা আমারও খুব স্পেশাল। কারণ আজ যেই মেয়েটা আমাদের জন্য এত কিছু করে, আনাইয়ের জন্য নিজের ভালোবাসা উজাড় করে দেয়, তার জন্মদিন।”
রুহি তাকিয়ে রইলো,
— “আপনি জানলেন কীভাবে?”
ইরাদ হেসে বলল, “অফিসের ফাইল দেখেছি।”
রুহি অবাক হয়ে বলল, “ফাইল?”
ইরাদ মাথা নাড়ল।

— “যখন একজন ডাক্তার তার পেশেন্টের সব খুঁটিনাটি খেয়াল রাখে, তখন কি সে তার আপন মানুষদের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে না?”
রুহির গাল লাল হয়ে উঠল।
ইরাদ তখন আর একটা গিফটের বাক্সটা রুহির হাতে দিল।
— “খুলে দেখবেন না?”
রুহি ধীরে ধীরে খুলল।
ভেতরে একটা ছোট্ট লকেট। সোনালি রঙের, খুব নরম ডিজাইন। খুলতেই ভেতরে ছোট্ট একটা ছবি—রুহি আর আনাইয়ের হাসিমুখ।
রুহির চোখ ছলছল করে উঠল।
— “স্যার”
ইরাদ একটু কাছে এগিয়ে এল।
— “আজ শুধু আপনার দিন। আর আমি চাই, এই দিনটা আপনি হাসি মুখে কাটান। আপনি আজকে যা চাইবেন সব আপনার”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১২

রুহির বুকের মাঝে কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল।
এই মানুষটা সত্যিই যেন একটা এক চিলতে রোদ্দুর… ঝড় পেরিয়ে শান্তির আলো এনে দেওয়া কেউ।
এতোদিন যে প্রশ্নটা রুহি করতে পারে নি ইরাদকে আজকে সে প্রশ্নটাই করবে,
-অহনা যদি আনাইয়ের মা না হয়, ইরাদের স্ত্রী নাহয় তাহলে তিনি কেন আনাইয়ের জন্মের খবর পেয়ে এতো বছর দূরে থাকার পরেও ইরাদের একটা কলে আসতে রাজি হয়েছিলো???

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৪