প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৫
মিমি মুসকান
প্রিয়তা ওঘর ছেড়ে নিজের ঘরে ফেরত চলে এলো। তার পিছন পিছন আসছে প্রান্তিক। প্রিয়তা হাঁটছে আগে আগে। নিজের ঘরে ঢুকে এবার দরজা বন্ধ করল না প্রিয়তা। প্রান্তিক দরজায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থমকে গেল। তার পা থেমে গেছে। মুখশ্রীতে থমথমে ভাব। প্রিয়তা চোখের জল মুছে ব্যাগ হাতে তৈরি। প্রিয়তা তবে ঘরে বসে এই করছিলো। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। প্রিয়তা কি তবে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রিয়তা এগিয়ে আসছে। প্রান্তিক দরজার গোড়ায় সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রিয়তা থমথমে কণ্ঠে বলল, “সরুন!”
মূহুর্তের মধ্যেই প্রান্তিকের কণ্ঠস্বর বদলে গেলো। এতোক্ষণ যেই পুরুষ আকুতিতে জর্জরিত ছিল এবার মূহুর্তেই সেই পুরুষ কেমন তেজী হয়ে গেল। তার কণ্ঠে রুক্ষতা পাওয়া যায়। বেশ ভারী আর মোটা কণ্ঠস্বর যেন। সিরিয়াসনেস ভাবটা একটু বেশিই। তার এই পার্সোনালিটি কেবল অফিসের স্টাফদের জন্য। এমন রুক্ষ আচরণ কি তবে এবার প্রিয়তার সাথেও করবে সে। বেশ ঠান্ডা গলায় শুধাল,
“কোথায় যাচ্ছো? তোমার হাতে ব্যাগ কেন?”
প্রিয়তা তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। তার গা এখন থেকেই শিউরে উঠছে। এই কণ্ঠ তার চেনা! ভীষণ রকমের চেনা। কোন এক রাতে এই কণ্ঠের অধিকারীকে ভ’য় পেয়ে কুঁকড়ে উঠেছিলো সে। আজও তার ভয় লাগছে না এমনটা নয়। মনে হচ্ছে এই এসে বাজ পাখির মতো প্রান্তিক হাম’লে পড়বে তার উপর। মনে একরাশ সাহস আর অভিমান জুগিয়ে বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি।”
”কোথায়?”
খানিকটা সময় নিয়ে বলল, “আমার বাড়ি!”
“বিয়ের পর এটাই তোমার বাড়ি!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কেমন চটপট উত্তর দিচ্ছি। প্রিয়তার রাগ মাথায় চেপে উঠছে। আর কোনো জবাব দিলো না সে। প্রান্তিক ছো মেরে প্রিয়তার হাত থেকে ব্যাগটা কে’ড়ে নিল। শাসনের সুরে বলল, “কোথাও যাবে না তুমি?”
প্রিয়তা আশ্চার্যান্বিত হলো। হতভম্ব স্বরে শুধায়, “আপনি এতো বড় অ’ন্যায় করে আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছেন কোন সাহসে। নূন্যতম অপরা’ধবোধ কি নেই আপনার?”
প্রান্তিক ব্যাগটা রেখে দিল। দু হাতে তার বাহু আকড়ে ধরল। প্রিয়তার এবার চোখাচোখি হলো প্রান্তিকের সাথে। কি অদ্ভুত চাহনি! চোখ দিয়ে অর্ধেক শা’সিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “কোথাও যাবে না তুমি! কোথাও না। আমায় ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না। যা হয়েছে আমরা কথা বলে নিব। তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু তুমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। বুঝলে! আমি যেতে দিবো না!
প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। চারদিক শান্ত! ঝড়ের আসার পূর্বে যেমন শান্ত থাকে, ঠিক তেমন। সে এবার বলেই ফেলল, “তাহলে ডির্ভো’স দিন আমায়!”
প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিল। খানিকটা পিছিয়ে ব্যাগ হাতে তুলে বলল, “সম্ভব না। মরা’র আগ অবধি তোমার পরিচয় আমার বউ হয়ে থাকবে। বললাম তো কোথাও যেতে পারবে না।”
ঘর ছেড়ে প্রান্তিক বেরিয়ে গেলো। তার হাতের ব্যাগটা দোতলা থেকে সিঁড়ির কাছে ছুঁ’ড়ে ফেলল। এতোক্ষণ যারা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলো, তারা এবার আরো ঘাবড়ে গেল। প্রান্তিক চৌধুরীর এই রূপের সাথে তারা পরিচিত। ঘর থেকে প্রিয়তা স্পষ্ট শুনতে পেলো। তার ব্যাগ গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভে’ঙে ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব করছে যাতে সে এই বাড়ি থেকে বের হতে না পারে। বললেই হলো নাকি? থাকবে না সে! এখানে আর এক মূহুর্ত!
প্রান্তিক চৌধুরী আর প্রিয়তা! এরা রা’গের দিক থেকে কারো থেকে কেউ কম না। প্রান্তিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ভেতরে জিনিসপত্র ভাঙ’চুর করছে প্রিয়তা। প্রান্তিক তাকে বাঁধা দিচ্ছে না। যা ইচ্ছে করুক। রাগে অভিমানে তাকে খু’ন করে ফেললেও অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রিয়তা তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। জীবনে ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি সে। বরাবরই এই ব্যাপারে আনাড়ি। যারা এসেছিলো নিজ থেকেই এসেছে, ভালোবেসেছে, জড়িয়ে নিয়েছে আবার নিজ থেকেই চলে গেছে। কিন্তু এরই মাঝে প্রান্তিক কে কতোটা নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে সেটা তাদের জানা নেই। প্রান্তিক কখনো তাদের আটকায় নি। বার বার মনে হয়েছে, সেদিন তাদের আঁটকে রাখলে আজ বুঝি তাঁরা তার সাথেই থাকত! কিন্তু সে রাখতে পারেনি।
কিন্তু প্রিয়তাকে যেতে দিবে না সে। যেভাবেই হোক আটকে রাখবে। এটা ভুল, দোষ, অন্যায় যা ইচ্ছে হোক, তবুও সে দ্বিধা করবে না। ব্যস! তাকে আটকে রাখতে গিয়ে সে খলনায়ক হলেও চলবে।
প্রান্তিকের মুখ গম্ভীর! প্রিয়তা থামছে না। এবার ঘরের ভেতরে ঢুকতে গেলো সে। এটা প্রত্যাশিত ছিলো না। প্রিয়তার হাতের ফুলদানি ছি’টকে এসে লাগল প্রান্তিকের ললাটে। মূহুর্তের মধ্যেই র’ক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রান্তিক টু শব্দ অবধি করল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তার সাদা ধবধবে শার্ট রক্তে রঞ্জিত হতে সময় নিল না।
প্রিয়তা হতবিহ্বল! সে মোটেও ইচ্ছে করে এমনটা করেনি। করতে পারে না! হুট করে হয়ে গেল। সে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ! এগিয়ে এলো না। একবারও কাছে এসে ছুঁয়ে দিল না। অথচ তার মন ক্ষত’বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় যেন জ্বলে’পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কাঁটা বিধেছে গলার মাঝে। তাই তো মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারল না। মাথায় যখন রা’গ চেপে যায় তখন মানুষ এমন অনেক ভুল কাজ করে ফেলে যার জন্য শেষে কেবল আফসোস করতে পারে। প্রিয়তা কি তাই করছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
গম্ভীরতা, নিস্তব্ধতার মাঝে প্রান্তিক কেবল চেয়ে রইল তার প্রেয়সীর দিকে। কিন্তু প্রেয়সী চোখ তুলে একবারও তাকালো না। একবারও তাদের চোখাচোখি হলো না। নিঃশব্দ পা ফেলে প্রান্তিক চলে গেল। প্রিয়তা বুঝতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে তো এসব চায়নি। তার এতো সুন্দর সাজানো সংসার আজ নিজের হাতেই ভে’ঙে চুরমার করে দিলো সে। বুকের মধ্যে চাপা একরাশ কষ্ট আর ক্ষোভ! কি থেকে কি হয়ে গেলো।
সিগারেট খাবার বাজে অভ্যাস প্রান্তিকের নেই। কিন্তু আজ অবলীলায় সে একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে। খুব চেষ্টা করছে কষ্ট গুলো কালো ধোঁয়া হয়ে শূন্যে উড়ে যাক। তবে যাচ্ছে না। কষ্ট কমছে না। আরো যেন দ্বিগুন হয়ে উঠছে। দুঃখ কষ্ট যেন তার পিছু ছাড়েনা। ছাড়বেও না কখনো।
প্রান্তিক শার্ট বদলে ফের হলো। পরনে ছাই রঙের একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার। প্রিয়তার রুম একদম পরিষ্কার ঝকঝকে। এতোটুকু সময়ের মধ্যে তারা কাজ সেরে ফেলেছে। স্যার কে রুমে ঢুকতে দেখেই সকলে তটস্থ। কপালের ক্ষত জায়গায় রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে আপনাআপনি। কোনো রকমের ঔষধ মলম লাগায় নি। দরকার পড়েনি। কালকের মধ্যেই ক্ষত জায়গায় একটা দাগ পড়ে যাবে।
প্রান্তিক কে দেখেই দুজনে একসাথে বলে উঠল, “ম্যাম বাথরুমে!”
“কখন গেছে?”
“অ..অঅঅ..অনেকক্ষণ!”
তাদের কথা বলার ধরণে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে দরজার সামনে গেল। ভেতর থেকে ঝরণার পানি পড়ার শব্দ। দু বার দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “প্রিয়তা! দরজা খোল!”
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। পানি পড়াও বন্ধ হচ্ছে না। প্রান্তিকের টেনশন বাড়ছে। রীতিমতো দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সে। তবুও ওদিক থেকে কেবল নিস্তব্ধতা। প্রান্তিকের ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। মেয়ে দুটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই তবুও তারা নিরব দর্শক। মনের ইচ্ছাকে প্রশয় দিতে তারা বিশ্বাসী খুব! প্রান্তিকের গলার স্বর কঠোর থেকে কঠোর হচ্ছে। ভারী গলায় শেষবারের মতো বলে উঠলো, “তুমি বের হবে নাকি আমি দরজা ভাঙ’বো!”
তবুও ওপাশ নিশ্চুপ। পানি গড়িয়ে পড়ার শব্দ। আর এক মূহুর্ত নষ্ট না করে প্রান্তিক দরজা ধাক্কাতে লাগল। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে কিছুক্ষণ ধাক্কানোর পর দরজা ভেঙে গেল। আপনাআপনি খুলে গেল!
দরজা ভাঙার শব্দে নিচ থেকে ছুটে এলো রাফি। প্রান্তিক চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়ে দুটি আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে। প্রিয়তা ঝরণার নিচে জবুথবু হয়ে বসে আছে। তার সর্বস্ব ভিজে একাকার। ঝরণার পানি অনবরত পড়ছে তার মাথার উপর। তবুও সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখান থেকে একবিন্দু নড়বে না।
আচমকা তাকে টেনে কোলে তুলে নিল প্রান্তিক। প্রিয়তা চমকালো না। কোনো শব্দ করল না। যেমনি ছিল তেমনই রইল। বাথরুম থেকে তাকে নিয়ে বেরুলো সে। রাফি দরজার সামনে এসে এমন পরিস্থিতি দেখে চমকে উঠল। প্রিয়তার অবস্থা তার চোখে লাগছে বলে মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালো সে। মেয়ে দুটি এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। প্রান্তিকের নজর পড়তেই ছুটে পালালো যেন।
প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৪
কাকভেজা প্রিয়তা কে খুব যত্ন করে বিছানার উপর রাখল প্রান্তিক। আর কিছু না হোক, তার কপালের কাটা অংশ ঠিকই চোখে পড়েছে প্রিয়তার। যতবারই এই ক্ষত দেখে ততোবারই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। প্রান্তিক নিজের ঘরে গেল। শাড়ি হাতে ফিরে এলো। বিছানার পাশে রেখে বলল, “বদলে নাও!”
প্রিয়তা এখনো নিশ্চুপ! যেমনি ছিল তেমনি। কোনো ভাবান্তর নেই। সে বোধহয় সংকল্প করেছে। তার বর মশাইয়ের সাথে কোনো কথা বলবে না। প্রান্তিক বুঝে নিল। এতে চিড়ে ভিজবে না। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “তাহলে কি আমি চেঞ্জ করিয়ে দিবো!”
প্রিয়তা শাড়িটা আঁকড়ে ধরল। রাগে ফুঁসছে কেবল। প্রান্তিক হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুল। যাবার আগে বলে গেল, “ঘরের দরজা বন্ধ করবে না বলে দিলাম!”