প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৬

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৬
মিমি মুসকান

আলো নিভানো। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার।‌ পুরো বিছানার এক কোণায় প্রিয়তা শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েনি। তার ঘুম আসছে না। শরীরে অনেক ক্লান্ত তবুও ঘুম আসছে না মনের কষ্টে। পুরো ঘরের ভেতর কেবল সে নেই। আছে আরেকজন ও। তার উপস্থিতি পেয়েছে আরো ১ ঘণ্টা আগে। কিন্তু কেউই কোনো কথা বলছে না। কেন বলছে না কেউ জানে না। এমন পরিস্থিতিতে এসে প্রান্তিক কি বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারল না। শুধু একটা সরি এর সমাধান হতে পারে না।কারণ কিছু পাপের কোনো ক্ষমা হয়না।
অন্ধকারের মাঝেও প্রিয়তার চোখ বন্ধ। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজে গেছে আরো আগেই। চোখ এবার খুব জ্বলছে। ছোটবেলা থেকেই সে এমন। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কাঁদতে পারে না। চোখ জ্বা’লা করে। কিন্তু খুব ভালো করে বুঝতে পারছে, প্রান্তিক তার পায়ের কাছে বসে আছে। কেন বসে আছে সেখানে? আচ্ছা তার কপালে একটু মলম লাগিয়েছিলো কি? লাগায়নি বোধহয়। কিভাবে এমনটা হয়ে গেল। বুক মুচরে উঠল তার। আ’ঘাত যেন কপালে না পুরো এসে তার বুকের মধ্যে লেগেছে।

নিস্তব্ধ ঘর। নিস্তব্ধ সবকিছু। একসময় মনে হলো ঘরে হাওয়ার চলাচল ও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দুই মানব মানবী কেবল নিশ্চুপে বসে আছে দুই প্রান্তে। অথচ তাদের হৃদয় বাঁধা এক সুতায়। নিরবতা ভেঙে প্রান্তিক কথা বলল। তার গলার স্বর অন্যরকম লাগছে। অন্ধকারে বুঝি মানুষের সাথে সাথে গলার স্বর ও অপরিচিত লাগে।
তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে সে কেঁদেছিলো। কেমন ভাঙা ভাঙা গলা। কিন্তু কাঁদল কখন? এতোক্ষণ ধরে! প্রিয়তা বুঝতে পারল না কেন? নাকি নিজের কান্নায় অতি ব্যস্ত থাকার কারণে খেয়ালই করেনি। পায়ের উপর শক্ত হাতের স্পর্শে চমকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে লাফ মেরে উঠে বসল। প্রান্তিক তার পায়ে হাত দিচ্ছে কেন? এটা হয় কখনো। বর কখনো বউয়ের পায়ে হাত দেয়? মা জানলে আর রক্ষে থাকবে না।
বড় আশ্চর্য হয়ে গেলো প্রিয়তা। এমন পরিস্থিতিতে এসব ভাবনা গুলো কেমন হাস্যকর লাগছে তার কাছে। যেই সম্পর্কের বিন্দুমাত্র কোনো মূল্য দিবে না বলে ঠিক করল সেই সম্পর্কেই আবার এতো অনুরাগ কিসের? প্রিয়তা বুঝতে পারল, এখনো এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি সে। যতো সহজে বিয়ের সম্পর্কে বাঁধা পড়া যায় ততো তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রান্তিক হাত সরায়নি। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। প্রিয়তার ইচ্ছে করল একবার বলবে, পা ছাড়ুন! কিন্তু চুপসে গেল। যখন ভেবেই নিয়েছে কথা বলবে না তো বলবে না। যা কিছু হয়ে যাক না কেন। প্রান্তিকের সবকিছু্ই এখন তার কাছে ছলনা মনে হচ্ছে। জীবনে কখনো কোনো পর পুরুষের আকৃষ্ট হয়নি তা নয় তবুও নিজেকে সবসময় সামলে নিয়েছে। যতখানি ভালোবাসা ছিল সবটুকু তুলে রেখেছে মনের মানুষের জন্যে। মনের মানুষকে পেয়ে তার চরণে পুরো ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে। ফিরিয়ে নেওয়া যে অসম্ভব। কেবল ঘৃণা করতে পারে সে। ভেবেছিলো ভালোবাসায় কেবল সুখ। কিন্তু সে কি জানত, ভালোবাসা নিজেই একটা জ্ব’লন্ত অগ্নিশিখা!
প্রান্তিকের ব্যাপারে যত বলব ততোই তাকে ঘৃণা করার কারণ বেড়ে যাবে। ভালো মানুষির গুণ তার নেই বললেই চলে। তবু কোন কারণে প্রিয়তার মতো এতো লক্ষ্মী মেয়ের সাথে ভাগ্যের সন্ধি জুটল তা কেবল বিধাতা জানে। প্রিয়তার পা দুটো আঁকড়ে ধরে “বউ” বলে ডাকতেও কেঁপে উঠল তার স্বর। প্রিয়তা কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। তার লোমকূপ শিরশির করে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে যেন বশ করার পুরো প্রচেষ্টা চলছে। প্রান্তিক কিভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এমন দ্বিধায় আগে কখনো পড়েনি।
“আমি কোনো অজুহাত দিবো না বউ, আমার দোষ আছে। আমি শুদ্ধ নই। শুদ্ধ পুরুষ নই।তবে তুমি তো শুদ্ধ, পবিত্র। আমার বড় অপ’রাধ আমি তোমাকে অশুদ্ধ করে দিলাম।”

প্রিয়তা হাঁটু তুলে বসে পড়ল। মাথা রাখল হাঁটুর উপর। নিশ্চুপ হয়ে শুনছে তার বরের কথা। তার অবিশ্রান্ত অশ্রু যেন আবারো ছটফট করছে গড়িয়ে পড়ার জন্য। প্রান্তিকের স্বর কেঁপে উঠছে বার বার,
“আমি ভেবেছিলাম আমার জীবনটা এভাবেই চলে যাবে। ভালোবাসা, বিশ্বাস, সংসার এসব আমার ভাগ্যে নেই। জীবন কেটে যাবে নিঃসঙ্গতায়। বিয়েতে আমার কখনো মত ছিলো না। জানতাম আমার জীবন ভালো না, এই জীবনের সাথে আরেকজন কে জুড়ে নিয়ে খুব বেইমানের মতো কাজ করেছি। কিন্তু দাদাজান কিছু বুঝতে চাইলেন না। রীতিমতো হাসপাতালে বেডে থেকে আমার থেকে কথা আদায় করে নিলেন বিয়ে করাবেন। আমি কথাও দিলাম। ভাবলাম বাড়ি আসার পর দেখে নিবো।

কিন্তু আমি হ্যাঁ বলার আধঘণ্টার মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি তখনো টের পায়নি কতো বড় অ’ন্যায় করেছি তোমার সাথে। আমার এই একটাই দোষ। সবকিছু বুঝতে খুব দেরি হয়ে যায়। কখনো ভাবিনি কাউকে ভালোবাসতে পারবো। কোনো একজন মানুষ নিয়েও আমার জীবন কেটে যাবে। অনেকগুলো বছর ছন্নছাড়া ভাবে কেটেছি। আমার ছেলেবেলা অযত্নে কাটেনি প্রিয়তা। দাদাজান খুব যত্নে রেখেছেন আমায়। আমি মা বাবা ছাড়া মানুষ, একা দাদা জানের ভালোবাসা পেয়েছি। তবুও আফসোস করিনি। মেনে নিয়েছি। মেনে নেওয়াটা খুব ছোট থেকেই শিখেছি। দাদাজানের কথায় দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পা দিয়েছি। জীবনে প্রথমবার আমি সেখানে ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছি। আমার মনে হলো, দাদাজান ছাড়াও বুঝি কেউ আমায় ভালোবাসতে পারে।”
প্রান্তিক থামলো। তার গলার স্বর আরো ভারী হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধ অন্ধকারে তার গলার স্বর ঘোরের মতো লাগছে প্রিয়তার কাছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল প্রান্তিক!

“ভালোবাসা আমার ভাগ্যে নেই। তার সাথে আমার দুশমনি আছে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার কাছে ঠকে গিয়ে ভালোবাসাকেই অপমান করতে লাগলাম। ভালোবাসা আবারো ফিরে আসতে পারে সেই ভাবনা আমার ছিলো না। তুমি আমায় চরিত্র’হীন, ল’ম্পট যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। আমি যাস্টিফাই করতে যাবো না। করার কিছু নেই। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো। আমি এখন আর এমন নেই। বিয়ের পর থেকে এই অবধি আমি কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলিনি। দেখা তো দূরের কথা। আরিনার সাথে যা হয়েছে তা কেবল আরিনাই। কারো সাথে সম্পর্ক এতো গভীর ছিল না। যা করেছি অ’ন্যায় করেছি। আমি তোমাকে কাছে ক্ষমা চাইছি। একটা সুযোগ চাইছি। তুমি কি পারবে না বউ! জানি এটা সহজ না, ক্ষমা চাইলেই ক্ষ’ত পূরণ হয় না। আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝবে না। ভালোবেসে কেবল তুমি ঠকো নি। আমিও ঠকেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কখনো তোমাকে অভিযোগের সুযোগ দিবো না। প্লিজ বউ, শুনছো!”

পিনপিনে নিরবতা চারদিকে। প্রান্তিক উৎসুক হয়ে আছে উত্তরের আশায়। তার অবস্থা টের পাওয়া যাচ্ছে না। অন্ধকারে মুখের বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। তবে প্রিয়তা মানে নি। তার মনকে সে মানাতে পারেনি। ধীরে ধীরে প্রান্তিকের হাতটা পায়ের কাছ থেকে সরিয়ে আবারো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল সে। প্রান্তিক যেন এটাই আশা করেছিলো। এতো তাড়াতাড়ি কিছু হবে না। সময় লাগবে। আরো সময়। কিন্তু প্রান্তিক হার মানবে না। সম্ভব না। ভালোবাসা একবার হারিয়েছে বার বার হারাতে দিবে না।

“তোমার সময় চাই আমি জানি, তুমি সময় নাও বউ। আমার সমস্যা নেই। এক দিন, দুই দিন, সপ্তাহ, মাস, একবছর, দুইবছর কিংবা দশবছরই লাগুক না কেন? আমি হার মানছি না। তুমিই শেষ। প্রান্তিক চৌধুরী অসম্ভব ভালোবাসে তোমায়। তোমাকে ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব না। এই সম্পর্ক আমার অনিচ্ছায় জোড়া লেগেছে কিন্তু আমার অনিচ্ছায় ভাঙতে পারবে না। যতদিন না তোমার মন পাচ্ছি তুমি এখানেই থাকবে আমার কাছে। অভি’মান, ঘৃ’ণা যাই করো না কেন? আমার থেকে তোমার নিস্তার নেই। তুমি কেবল আমারই।”

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৫

কণ্ঠে তার রুক্ষতা ছেয়ে গেল আবারো। এবার কণ্ঠে আর অনুনয় নেই কেবল শাসন। শাসিয়ে দিচ্ছে যেন। প্রান্তিক চৌধুরী কি পাগল নাকি? প্রিয়তা অবাক না হয়ে পারছে না। এই তো আকুতি মিনতি করল আবার এই তাকে ধম’কাচ্ছে। একই দিনে একই সাথে এক মানুষের আর কতো রূপ দেখবে সে। দেখতে দেখতে যেন পাগল হয়ে যাবে। প্রান্তিক চৌধুরী নাছোড়বান্দা! সে এবার মন প্রাণ দিয়ে কোনো রমণীকে ভালোবেসেছে। এতো সহজে তাকে ছাড়ছে না। ছাড়ার প্রশ্নই উঠে না। যার সাথে যুদ্ধ করতে হয় করবে। দুঃখ, দু’র্ভাগ্য কেউই তাকে আর প্রিয়তাকে আলাদা করতে পারবে না। উঁহু সম্ভবই না। প্রান্তিক চৌধুরী ছাড় দিচ্ছে না। সে এখনো প্রায় একই বেশে বসে আছে!

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৭