প্রেমের সমর পর্ব ১৭
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
বিকালের দিকে স্বচ্ছর অবস্থার আরেকটু অবনতি ঘটল। হুশই নেই ছেলেটার তখন। বাধ্য হয়ে স্বচ্ছকে ছাদের চিলেকোঠার ঘরটা থেকে বাসার একটা রুমেই থাকার অনুমতি দিলেন দাদাজান। স্বচ্ছর বাবা মাকে খবর দেওয়ার পাশাপাশি ডক্টর আনলেন বাসায়৷ ডক্টর ঔষুধপত্র দিয়ে চলে যেতেই সুহা নিরবে চেয়ে থাকে। উপরে উপরে রাগ দেখালেও এই মুহুর্তে এসে তার সত্যিই মায়া হচ্ছে। দুদিনেই বোধ হচ্ছে ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। চোখজোড়ায় সে চঞ্চলতা কিংবা অহংকারী ভাবটা চোখে আসে না যেন। সুহা তাকাল। দু পা বাড়িয়ে যখন স্বচ্ছর মাথায় হাত বুলাতে হাত বাড়াল ঠিক তখনই দাদাজান হুংকার ছুড়লেন,
“ ঐ ছেলের থেকে দূরে দূরে থাকবে। যা নাটকবাজ ছেলে দেখা গেল জ্বরটাও ঐ বাঁধর ছেলের নাটকই। ”
সুহার ভালো লাগল না কথাটা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার। হুশজ্ঞানই নেই। সে ছেলে এই অবস্থাতেও নাটক করবে? বলল,
“জ্বরে বেহুশ হয়ে আছে দাদাজান। এটা নিশ্চয় নাটক না। ”
দাদাজান বিশ্বাস করলেন না কথাটা৷ ব্যঙ্গ করে বললেন,
“ আবার নাটকও হতে পারে। দিন পনেরোর মধ্যে তোমার মনে জায়গা করতে অনেক কিছুই করতে পারে। আমি এই ছোখরাকে বিশ্বাস করি না।”
কথাটা বলেই দাদাজান রুম ছেড়ে বাইরে গেলেন। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খাটের এককোণায় বসে হাত ছোঁয়ায় স্বচ্ছর কপালে। এখনও উত্তাপ।কপালে পগে আছে এলোমেলো চুল। কতোটা মায়াময় লাগছে মুখটা। সুহা যখন তাকিয়ে থাকে মুখপানে ঠিক তখনই রাহা পেছন থেকে বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আপু? দুলাভাই কি কিউট ভাবে ঘুমায় তাই না? ঘুমালে কি সুন্দর লাগে দেখ। ”
রাহার মুখে চঞ্চল হাসি। সুহার রাগ হয়। স্বচ্ছকে অন্য কেউ কেন সুন্দর বলবে? অন্য কেউ কেন ওর ঘুমানো মুখটা দেখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকবে? সে নিজের বোন হোক বা অন্য কেউ। সুহা নিজের বোনের প্রতিই এই ইর্ষাবোধে বিরক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
“ তো? তোর কি? বিয়ে করবি?”
“ ছিঃ আপু, তোমার বর তো। তোমার বর না হলে নাহয় বিয়ে করার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম। কারণ ভাইয়া সুন্দর। ”
সুহা চুপ থাকে। দাদাজানকে সে এতকাল দমিয় রেখেছিল। স্বচ্ছর সাথে না হওয়া সংসারটা টিকিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টাটাও এতকাল সেই করেছিল। দাদাজান তো শুরু থেকেই স্বচ্ছর তেমন কাজ পছন্দ করেনি। রাগ ফুসেছিল। সুহা এতকাল দমিয়ে রাখতে পারলেও শেষ সময়ে যখন দাদাজানের রাগের দাবানলে পড়তে হয় তখনই স্বচ্ছকে জ্বালানো শুরু করেছিল সে। ভেবেছিল স্বচ্ছ ফিরবে শুধুই তার জন্য। স্বচ্ছ ফিরেই তাকে চাইবে। অথচ তা হলো না। স্বচ্ছ দেশে ফিরেও বাউন্ডুলে পনা দেখাল। চ্যালেঞ্জ জেতার নেশা দেখাল। যা দাদাজান জানার পর থেকেই দ্বিগুণ রাগ ফুসছেন। শুধু প্রকাশ করতে পারছেন না। সুহা জানে, দাদাজান স্বচ্ছকে কখনোই মেনে নিবে না। এখন তো আরও না। ছোটশ্বাস ফেলেই বলে,
“ দুদিন পর তো আর আমার বর থাকবে না। দাদাজান ভেঙ্গে দিবেন তো সম্পর্কটা৷ তখন তুই বিয়ে করে নিস। শান্তি?”
রাহা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। বলে,
“ এভাবে বলছিস কেন? তুই কি রেগে যাচ্ছিস আপু? ”
“ রাগব কেন? রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলেছিস নাকি?আশ্চর্য!”
রাহা ঠোঁট উল্টায়। বোনের পাশে বসেই কৌতুহল নিয়ে শুধায়,
“ আচ্ছা, তুই কি সত্যিই ভালোবাসিস না ভাইয়াকে? আমার কেন যেন মনে হয় যে তুই ভালোবাসিস দুলাভাইকে? ”
সুহা শান্তস্বরে উত্তর দেয়,
“ ভালোবাসলেও ভালোবাসার মর্যাদা তো উনি রাখেন নি তাই না? যদি রাখতেন আমি নিজেই নিজেকে সমর্পন করতাম তার তরে।”
রাহা মন খারাপ করে পুণরায় বলে,
“ আমার তো মনে হয় দুলাভাইও তোকে ভালোবাসে৷ নাহলে কি এতদূর ছুটে আসত?”
“ ওসব তার জেদ আর অহংকার!জয়ী হওয়ার নেশা!”
স্বচ্ছর সেবা করার দায়িত্বটা নিল সুহা নিজেই। শতহোক নিজের ভালোবাসার মানুষ বলে কথা! শখের পুরুষ তো।মায়া ভুলে থাকা যায় না। তাই তো জলপট্টি দেওয়া হতে, ঔষুধ খাওয়ানো সহ খাবার খাওয়ানো সবটাই সুহা করল। অবশেষে স্বচ্ছ যখন রাতে জেগে উঠে সুহা তাকায়। কপালে হাত রেখে বুঝে জ্বর পড়েছে এখন। দ্রুত পায়ে পুণরায় রান্নাঘরে গিয়ে স্বচ্ছর জন্য খাবার আনে। বলে,
“ খেতে হবে। ”
স্বচ্ছ এদিক ওদিক তাকায়। মুখ তেঁতো ঠেকছে তার। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শরীর মেঝমেঝ করছে। স্বচ্ছ বুঝে না উঠেই, এদিক ওদিক চেয়ে বলে,
“ আম্মু কোথায়? আম্মুকে একটু ডেকে দিবে সুহাসিনী?”
সুহা সরু চোখে তাকায়৷ উত্তরে বলে,
“ আম্মু নেই।আমি আছি, আমার কথা শুনতে হবে। ”
” আম্মুর হাতে খাব।”
সুহা তপ্তশ্বাস ফেলে। বলে,
“ আমি খাইয়ে দিব। হবে?”
স্বচ্ছর শরীর ক্লান্ত। উঠে বসার শক্তিটুকুও বোধহয় পাচ্ছে না সে। তবুও উঠে বসার চেষ্টা চালাতে লাগল। বলল,
“ তুমি? ”
স্বচ্ছ উঠতে পারল না। বরংআগের মতোই শুঁয়ে থাকল।বলল,
“ এনার্জি পাচ্ছি না। কি করেছো আমার যে এনার্জি সব হারিয়ে গেছে হুহ?কোন যাদু টাদু করে ফেলো নি তো?”
সুহা দাঁতে দাঁত চাপে। একটা মানুষ এতোটা অসুস্থ হওয়ার পরও কি করে এমন ঢং করতে পারে বুঝে না সে। বলে,
“জানি না। এবার বলুন,আমার হাতে খাওয়া যাবে নাকি?”
স্বচ্ছ ক্লান্ত মুখে আলতো হেসে বলে,
“ তুমি আমায় বিষ মিশিয়েও খাইয়ে দিতে পারো সুহাসিনী। তোমাদের পরিবারটাই ভয়ংকর নির্দয়।দাদাজান আর তোমার তো স্টোন হার্ট! অসম্ভব কিছু নয়।”
সুহা এবারে রেগে তাকায়। বিরক্ত হয়ে বলে,
“ এর নাকি এত জ্বর। জ্বরে উঠে বসতে পারছে না পর্যন্ত। অথচ ফটর ফটর করে কথা বলেই যাচ্ছে। ”
স্বচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে,
“ কথা অফ রাখব? ”
“ চুপচাপ খাবেন এখন। তারপর ঔষুধ খাবেন। ”
স্বচ্ছ যেন সুহা সামনে অনুভূতি দেখাতে চাইল না। বরং জেদ নিয়ে বলল,
“ আমি নিজের হাতে খেতে পারি। ”
সুহা খাবার ঠেলে দিল। বলল,
“ তাহলে নিজের হাতেই খান। ”
স্বচ্ছ উঠে বসতে চাইল। অথচ শরীর দুর্বল। সুহা তা দেখেই বলল,
“ উঠে বসারও তো শক্তি দেখছি না। টানা একদিন না খেলে তো এমনই হবে তাই না? সবকিছুতে পন্ডিতগিরি না দেখালে তো আবার আপনার চলবে না। ”
স্বচ্ছ কেমন করে তাকায়। যেন চোখজোড়ায় কত অভিমান ছোচ বাচ্চাদের ন্যায়। সুহার এই প্রথম এই চাহনি দেখে হাসি পেল। অথচ হাসল না।স্বচ্ছ বলে,
“ সবসময় রেগে রেগেই কথা বলো কেন? ভালোবেসে কথা বলা যায় না?”
“ না যায়না!”
স্বচ্ছর জ্বরের খবর পেয়ে ওর আম্মু এসেছে ছুটে। তবে আব্বু আসেনি। স্বচ্ছর আম্মু সাহেদা খানম এসেই ছেলেকে ঘুমোতে দেখে হাত বুলালেন চোখেমুখে। ঝুঁকে আলতে চুমু দিলেন কপালে। তারপর দাদাজানের করা কর্মকান্ড সমূহ রাহার কাছ থেকে শুনেই সাহেদা খানম নিরবে রাগ পুষলেন। শত হোক! ছেলে তো! যে ছেলেকে তিনি কোলে কোলে বড় করেছেন সে ছেলেটাকে ধূলোবালিতে চিলেকোঠাতে তাও মেঝেতে থাকতে দেওয়া হলো?এতোটা অনাদর? সাহেদা খানম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এসে পর্যন্ত এখানে কোনকিছুই না খেয়ে ছেলের পাশে বসে থাকলেন। অবশেষে যখন স্বচ্ছ চোখ খুলল তখন সাহেদা খানম হাসেন। জানতে চান কেমন লাগছে?অথচ উনাকে নিরাশ করে দিয়ে স্বচ্ছ জানায়,
“ আম্মু? আমার জ্বরটা হুট করে কেন নামল জানো? ঐ মেয়েটার জন্যই। ওর কথা ভেবে ভেবেই আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম আম্মু। সব দোষ ঐ মেয়ের!”
কথাগুলো বলেই পরমুহুর্তেই মায়ের কোলে মাথা রাখল স্বচ্ছ। হতাশ স্বরে জানায়,
“ আম্মু!তোমরা কি নির্দয় এক রমণীর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছো আমার। এই নারীর মন পাথরের চাইতেও কঠিন।আমি কখনোই এই নারীর মনে জায়গা করতে পারব? ”
স্বচ্ছর মা ছেলের এতগুলা কথার বিনিময়ে একটাও উত্তর করলেন না। বরং ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিরব স্বরে শুধায়,
“ কাল আমার সাথে বাসায় ফিরবে স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ নিরাশ স্বরে জানায়,
“ অসম্ভব! পনেরো দিনের পরীক্ষা আমার। উর্ত্তীর্ণ না হলে বউ ফসকে যাবে? ”
স্বচ্ছর মা শান্ত হয়ে তাকায়। ছেলের কপালে হাত রেখে শান্ত হয়ে বলে,
“ ও এমনিতেও ফসকে গেছে স্বচ্ছ। ওর দাদাজান তোমায় পছন্দ করেন না। এই কথাটা আমাদের বারংবার বলেছেন উনি। তবুও এতদিন সম্পর্কটা ছিল শুধু মাত্র সুহার কথাতে। কিন্তু এখনতো তুমি সুহার কথা বলার কোন জো রাখোনি। ”
প্রেমের সমর পর্ব ১৬
স্বচ্ছ কৌতুহল নিয়েই শুধায়
“ কি করেছি?”
“ দেশে এসেও মেয়েটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তোমার বলদ বলদ কাজকারবার উপহার দিয়েছো।এটাই কি যথেষ্ট নয়? ”