আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১১

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১১
তানহা ইসলাম বৈশাখী

প্রার্থ গাড়ির ভেতরে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মাথা হেলে রেখেছে পেছনে। বাইরে আকাশ হালকা পরিষ্কার এখন।
কিছুক্ষনের মধ্যেই পুষ্প আসলো। ভার্সিটি যাবে তবুও শাড়ী পরে এসেছে। সাদা রংয়ের শাড়ীর মাঝে নানা রংয়ের ফুলের ছোয়া। এমনিতেও শাড়ীতে পুষ্পকে দারুন লাগে। আজ সাদা শাড়ীতে থাকা ছোট ছোট পুষ্পের মাঝে তাকে পুষ্পের রানী লাগছে।
পুষ্প এসেই কথাবার্তা ছাড়া গাড়িতে উঠে বসলো। পুষ্প উঠার সাথে সাথেই প্রার্থ গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছে। সিটবেলটাও বাধতে পারেনি এখনো। হঠাৎ গাড়ি চলায় পেছনে হেলে পড়ে পুষ্প। আবার উঠে ঠিকঠাক হয়ে বসে সিটবেল বেধে নেয়।
প্রার্থ সমস্ত মনোযোগ ড্রাইভিংয়ে রেখে বলে উঠলো।

“-মাকে কি বলেছিস?
পুষ্প না জানার ভান করে বললো।
“-কি বলেছি?
প্রার্থ ঘুরে তাকালো পুষ্পর দিকে। এতক্ষণে খেয়াল করলো তাকে। শুভ্র রংয়ের মাঝে শ্বেতবর্নের পুষ্পকে দেখে চোখ আটকে গেলো। সাদার মাঝেও সাদা রংয়ের মানুষকে এত সুন্দর দেখায়! মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ এখনো অক্ষত, পাতলা চিকন ঠোটে হালকা রংয়ের লিপ্সটিক, চোখে কাজল। ব্যাস এইটুকুতেই তাকে অপ্সরী লাগে।
প্রার্থ একপ্রকার জোর করে চোখ সরালো পুষ্পর থেকে । সামনে তাকিয়ে বললো।
“-এত সেজেছিস কেন?ভার্সিটি যাচ্ছিস নাকি কোন বিয়ে বাড়ি?
পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-কোথায় সেজেছি?
“-শাড়ী পরেছিস কেন?
“-শাড়ী তো আমি রোজই পরি।
“-ভালো। এখন বল মাকে কি বলেছিস? আমি রাতে কখন তোকে টাকা দিলাম?
পুষ্প জানালায় বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো।
“-মিথ্যে বলেছি।
“-কেন?
“-তো কি বলতাম বড়আম্মুকে? বলতাম, আমার কাছে টাকা ছিলো সেই টাকাই দিচ্ছি। তারপর বড়আম্মু বলতো, তোর স্বামী কেন দিলোনা? তখন আমি বলতাম আমাদের মাঝে তো তেমন সম্পর্কই নেই সে কি করে আমার সবকিছুর দায়িত্ব নেবে? তারপর কি হতো? আমার সব কষ্ট এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যেতো। বড় আম্মু জানতো পুষ্পকে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সুখী করতে পারেনি।
প্রার্থ চোখ সরু করে বললো।

“-আমার কেন এর উত্তর এত বড় করে না দিলেও চলতো। সবার কাছে তুই যেহেতু আমার বউ সেই হিসবে তোর পড়ালেখার দায়িত্বটাও আমার।
পুষ্পও প্রার্থর দিকে সরু চোখে তাকালো।
“-আপনি তো বিয়েই মানেন না। তাহলে বউ আর দ্বায়িত্ব এলো কোথা থোকে?
“-যেখান থেকে তুই সবাইকে বলে বেড়াস তুই আমার বউ আমি তোর স্বামী সেখান থেকে।
“-বলে বেড়ালে….
“-চুপপ!
প্রার্থ ধমকে উঠলো। গাড়ি থামিয়ে দিলো মাঝরাস্তায়। পুষ্পর দিকে ঘুরে ধমকের স্বরে বললো
“-চুপ করে থাকতে পারিস না? একটা বললে উল্টে দশটা বলিস। এত শত বুঝি না। না বিয়ে না অধিকার না দ্বায়িত্ব। কোনটাই বোঝার দরকার নেই আমার। ফি এর টাকা আমি দেবো ব্যাস। এর উপরে আর কোন কথা হবে না।
“-সরি টু সে বাট টাকাটা আমিই দেবো। আপনার থেকে টাকা নিয়ে ছোট হতে চাই না।
প্রার্থ কিছু না বলেই গাড়ি স্টার্ট করলো। অযথা পুষ্পর সাথে তর্ক করে কোন লাভ নেই তাই কিছু না বলে কাজ করাটাই উত্তম।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা ভার্সিটিতে পৌছে গেলো। পুষ্প প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। IUB ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট এবছর।
প্রার্থ ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো। পুষ্প গাড়ি থেকে নামার আগে বললো।

“-থ্যাংক ইউ। এপনি এবার স্টুডিওতে যেতে পারেন। আসি।
পুষ্প নেমে গেলো গাড়ি থেকে। সাথে প্রার্থও নামলো।
পুষ্প প্রার্থকে নামতে দেখে বললো।
“-আপনি কেন নামছেন?
প্রার্থ এগিয়ে গেলো সামনে। পুষ্পকে বললো।
“-আয় আমার সাথে।
পুষ্প পেছন পেছন যেতে যেতে বললো।
“-টাকা কিন্তু আমিই দিবো। আপনার টাকা নিবো না আমি।
দুজনে ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকতেই ছেলে মেয়েরা ঘীরে ধরলো প্রার্থকে। মেয়েরা এসে ছবি, অটোগ্রাফ নিয়ে গেলো। হাজার হোক গায়ক বলে কথা মানুষ এভাবে না ধরলে কি আর নিজেকে সেলিব্রিটি লাগে নাকি। কিন্তু প্রার্থ এসবে বিরক্ত হচ্ছে। এমনিতেই সে একরেখা। এত মানুষে ঘিরে থাকা মোটেও পছন্দ নয়। ওই স্টেজে গান গাওয়ার সময়টুকুই দর্শককে দেয় তাছাড়া খুব একটা মিশেনা তাদের সাথে।
পুষ্প প্রার্থর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সবাই প্রার্থকেই ঘিরে আছে। পুষ্প এখানে কে, কি তাদের তাতে কোনকিছু আসে যায় না।
প্রার্থ কোনমতে ভীর ঠেলে পুষ্পর সামনে এলো। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো।

“- চল এখান থেকে।
পুষ্প তাকিয়ে রইলো প্রার্থর ধরে থাকা হাতের দিকে। অতিরিক্ত ফর্সা হাতের উপর শ্যামরাঙা হাতটা খুব বেশি মানাচ্ছে না। বেমানান লাগছে।কিন্তু পুষ্পর কাছে এটা শ্রেষ্ঠ মনে হচ্ছে। মরুভূমির মাঝে এক পশলা বৃষ্টি নামলে যেমনটা লাগে পুষ্পর ঠিক তেমনটাই অনুভব হচ্ছে।
বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলো সেই হাতের দিকে। পুষ্প জানে প্রার্থ শুধু ভীর থেকে বাচতে তাড়াতাড়ি হাটছে তাই ওকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু না। তাকিয়ে থেকে শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই মায়ার জালে আটকে আছে। আর ফাঁসতে চায় না।
ওরা একটু ভেতরে যেতেই সামনে আসলো আরো কয়েকজন ছেলেপেলে। লাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট তারা। সুন্দর দেখতে একটা ছেলে সামনে এসে বললো।
“-প্রার্থ ভাই কেমন আছেন? কতদিন পর দেখলাম আপনাকে।
প্রার্থ শুধু বললো।

“-হুম ভালো।
ছেলেটাকে দেখেই পুষ্পর মুখ আধারে ছেয়ে গেলো। ছেলেটা পুষ্পকেও জিজ্ঞেস করলো।
“-পুষ্প কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখলাম তোমায়।
“-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি?
“-আমিও ভালোই আছি।
প্রার্থ তাড়া দিয়ে বললো।
“-কিছু বলবে? নয়তো সরো আমার কাজ আছে।
সীমান্ত নামের ছেলেটা বললো।
“-হ্যা ভাই কিছু কথা ছিলো
প্রার্থ ভ্রু কুচকে বললো
“-কি?
সীমান্তর ওই “কিছু কথা ছিলো” শুনেই পুষ্পর বুক কাপছে। কি বলবে এই ছেলে। অতীত নিয়ে কিছু নয়তো?
সীমান্ত রয়ে সয়ে বললো।
“-আসলে ভাই সমৃদ্ধি আপু এখনো আপনাকে অনেক মিস করে। হয়তো এখনো অনেক ভালোবাসে আপনাকে। কাল আপনার আর পুষ্পর ভিডিও দেখে অনেক কান্নাকাটি করেছে। পরে আমি বুঝিয়েছি যে পুষ্প শুধু আপনার বোন হয়। সবাই মিথ্যে গুজব ছড়িয়েছে। এরেপরেই আপু…
প্রার্থ ওকে থামিয়ে দিলো। পুষ্পকে ইশারা করে বললো।

“-হ্যাঁ গুজব ছিলো। ও আমার প্রেমিকা না আমার বউ। তোমার যদি সমৃদ্ধিকে নিয়ে আরো কিছু বলার থাকে তাহলে আসতে পারো। আমার সময় নেই।
পুষ্প, সীমান্ত দুজনেই তাজ্জব বনে গেলো। সীমান্তর বিশ্বাস হচ্ছে না যে প্রার্থ পুষ্পকে বিয়ে করেছে। আর পুষ্পর বিশ্বাস হচ্ছে না এটা যে প্রার্থ সবার সামনে ওকে বউ বলেছে। তাও সীমান্তর সামনে। যে কিনা সমৃদ্ধির ছোট ভাই।
প্রার্থ হাটতে হাটতে আরেকটু সামনে এগোলে বললো।
“-বউ বলেছি বলে আবার আকাশ পাতাল ভেবে নিয়ে লাফাস না। ওটা জাস্ট ওদের জানানোর জন্য বলেছি।
পুষ্প হাটা থামিয়ে দিলো। সাথে থেমে গেলো প্রার্থ। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাতেই পুষ্প প্রশ্ন ছুড়লো কঠোর বানে।
“- আপনি এখনো ভালোবাসেন সমৃদ্ধি আপুকে?
“-তুই যেনে কি করবি?
“-ঘাস কাটবো। আপনাকে যেটা প্রশ্ন করেছি সেটা বলুন।
প্রার্থ কিছুক্ষন পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রশ্নটা তার কাছে বেমানান। দেখলো একটু আগে সমৃদ্ধিত ভাইকে এড়িয়ে এলো। তাকে এখন এই প্রশ্ন করার কোন মানেই হয় না। মেয়েদের মাথায় যে ঘিলু কম এটাই তার প্রমান। প্রার্থ কিছু একটা ভেবে বললো।

“-যদি বলি হ্যাঁ। তো কি করবি?
কথাটুকু শুনে পুষ্পর কোটর ভরে আসে। কন্ঠ মুদে আসে। মৃদু কন্ঠেই বললো
“-তো কিছুই করবো না। সময়ের অপেক্ষা করবো। তারপর হারিয়ে যাবো।
প্রার্থ কিছু বললো না। হাটা ধরলো সামনে। পুষ্পর চোখে আসা জলটুকু মুছে নিয়ে নিজেও হাটলো। আবারও প্রার্থকে উদ্দেশ্য করে বললো।
“-এই জন্যেই বুঝি বিয়ে মানতে এত কষ্ট। লজ্জা লাগে না আপনার তাইনা?
প্রার্থ অকপটে বলে দিলো।
“-না
পুষ্প আর কিছু বললো না। চুপচাপ হেটে গেলো। আর একটা কথাও হলো না দুজনের মাঝে।
সেমিস্টারের ফি প্রার্থই দিয়েছে। দিয়েই চলে গেছে এখান থেকে।
পুষ্প এখন ক্লাসে বসে আছে। সাথে তার বন্ধু সুরাইয়াও আছে পাশে। পুষ্প বেঞ্চির উপর হাত রেখে তার উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।
সুরাইয়া ওকে ডেকে বললো

“-পুষ্প তুই কি এভাবেই শুয়ে থাকবি?
“-কি করতে বলছিস?
“-একটু কথা বল আমার সাথে। কতদিন পর দেখা হলো আমাদের। তোর বিয়েতে কি কি হলো বল শুনি।
“- বলার মতো তেমন স্মৃতি পূর্ন কিছুই হয়নি।
“-এমন বলছিস কেন? প্রার্থ ভাই কি মেনে নেয় নি বিয়ে?
পুষ্প উঠে বসলো। সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে নিভু কন্ঠে বললো।
“-মানবে কি করে? সে তো এখনো তার প্রাক্তন নিয়ে পরে আছে। তাকে নাকি এখনো ভালোবাসে।
সুরাইয়া অবাক হয়ে বললো।
“-কি বলছিস? আমার বিশ্বাস হয় না। সমৃদ্ধি তো প্রার্থ ভাইকে ঠকিয়েছিলো। প্রার্থ ভাই তো তারপর মনেহয় ঘুরেও দেখেনি তাকে। দুইবছর আগের প্রেমিকা এখনো তার মনে থাকবে তোর মনেহয়?
পুষ্পর কান্না গলা অব্দি এসে ঠেকছে। কাপা কাপা কন্ঠে বললো।
“-জানিনা রে। আমিও তো জানতাম সমৃদ্ধি আপুকে নিয়ে উনার মনে এখন কিছুই নেই। যেখানে সমৃদ্ধি আপু নিজে প্রার্থ ভাইকে ধোকা দিয়েছে সেখানে প্রার্থ ভাই তাকে এখনো মনে রাখবে এটা অসম্ভব। আমি এটাই ভাবতাম এতদিন। কিন্তু আজ! আজ উনি আমাকে ভুল প্রমান করে দিলো সুরু। আমি চলে যাবো উনার জীবন থেকে। কিন্তু এমনি এমনিই যাবো না।

“-এমনি এমনি মানে?
“-আমার জন্য একটু হলেও কষ্ট রেখে যাবো উনার জীবনে। সে-ও একটু বুঝুক পুষ্প কি কি সহ্য করেছে।
সুরাইয়া হাত বাড়িয়ে পুষ্পর গাল গড়িয়ে পড়া পানি মুছিয়ে দিলো। বুঝিয়ে বললো
“-দেখ জানু এমন কিছুই করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। প্রার্থ ভাই হয়তো তোকে মিথ্যে বলেছে।
“-জানিনা। ভালো লাগছে না আমার আর এসব। একটা মেয়ের সহ্য শক্তি কতটা? এগুলো আর কতদিন সহ্য করা যায় তুই বল।
সুরাইয়া বুঝে গেলো পুষ্পর না বলা কথাগুলোও। প্রার্থ যে পুষ্পকে মেনে নেয়নি সেটা বোঝা শেষ। তাই শান্তনা দিয়ে বললো।
“-আরো কয়টা দিন সহ্য কর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। তোর মতো মেয়েকে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না দেখিস। যদি এমনটা না হয় তাহলে তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমি তার সাথে আছি।
পুষ্প কিছু বললো না। শুধু একটু মাথা নাড়লো।

ভার্সিটি শেষ হয়েছে তিনটায়। এখন বাজে তিনটা বিশ। সকালে আকাশ একটু পরিষ্কার থাকলেও দুপুর বারোটা থেকে একটানা বৃষ্টি হয়েছে। এখন একটু থেমেছে তবে আকাশ ভারী হয়ে আছে। কখন যেন ঝমঝমিয়ে পরে বৃষ্টি ফোটা। পুষ্প একা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। সুরাইয়ার বাসা অন্যদিকে হওয়ায় সে রিক্সা পেয়ে চলে গেছে। এখন পুষ্প একটা রিক্সা পেলেই হয়।
আরো প্রায় পাঁচ সাত মিনিট পরে একটা রিক্সার দেখা মিললো। পুষ্প রিক্সা থামিয়ে বললো।
“-মামা মালিবাগ যাবেন?
রিক্সাওয়ালা মামা একটু ভেবে বললো।
“-ওইহান দিয়া তো এহন অনেক পানি উডছে। আইচ্ছা থাক চলেন যাই। কিন্তু ভাড়াডা ইকটু বেশি লাগবো কইলাম।
“-ঠিকাছে ভাড়া বেশিই দেবো আগে চলেন আবার না বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

রিক্সাই উঠে ঠিক পাঁচ মিনিট ভালোই ছিলো। এরপরেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। রিক্সার হুড তোলা ছিলো তবুও ভিজে গেলো প্রায়। সামনে থেকে বৃষ্টির ছাট এসে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিচ্ছে। রিক্সাওয়ালা তো ভিজে ভিজেই চালাচ্ছে। তার তো আর রোদ বৃষ্টির তোয়াক্কা করলে চলবে না। তাকে রিক্সা চালিয়েই টাকা আনতে হবে। পরিবার চালাতে হবে।
রিক্সা আরেকটু সামনে যেতেই দেখলো পানিতে ঢাকা সড়ক। জায়গায় জায়গায় ভাঙা তার উপর বৃষ্টির পানি জমে হয়েছে হাটু সমান। এই ভাঙা আর পানির মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ গাড়িটা কাত হয়ে যায়। কোন ভাঙা অংশে হয়তো এক চাকা ঢুকে গেছে। হঠাৎ কাত হওয়ায় ঝাকুনিতে পুষ্প ছিটকে পড়ে রাস্তার মাঝে। চালক মামাও রিক্সা থেকে লাফিয়ে নামে। রিক্সাটা একেবারে কাত হয়ে নিচে পড়ে যায়।
পুষ্প আগেই ছিটকে পড়ায় বেচে যায় কিন্তু পা টা যায় রিকশার হুডের নিচে। যে পা টায় ব্যান্ডেজ ছিলো সেই পা টাই যায় সেখানে। সেখান থেকে রক্ত বেড়িয়ে মাখিয়ে যায় পানিতে। পুষ্প ব্যাথায় কেঁদে দিয়েছে। বৃষ্টির ফোটার সাথে চোখের জল মিশে গেছে। পড়নের সাদা শাড়ীটাও শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। সাদা পেট সাদা শাড়ীর উপর দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

পুষ্প দাত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরলো ব্যাথা সয়ে নিতে। পা টানলে আরো বেশি ব্যাথা লাগছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আশে পাশে কেই নেই। রিক্সাওয়ালা মামাও ওপাশে পড়ে গেছে।
আচানক কোথাও থেকে ‘ফুল’ ডাক ভেসে এলো। পুষ্প চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো প্রার্থ গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আসছে। এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজে পানি মাড়িয়ে দৌড়ে আসছে। প্রার্থকে দেখেই পুষ্পর ব্যাথা, কান্না সব থেমে যায়। সে বিচলিত হয়ে বললো।
“-প্রার্থ ভাই আপনি এখানে কেন এলেন? গাড়িতে যান। আপনি ভিজছেন কেন? আপনার জ্বর আসবে যান এখান থেকে।
প্রার্থ এসেই রিক্সা উচু করে ধরলো। বললো।
“-পা সরা।
পুষ্প পা টা সরিয়ে আনলো সেখান থেকে। ব্যান্ডেজের উপর রক্ত দিয়ে মাখিয়ে গেছে। যেটুকু ঘা ছিলো তার থেকে বেশি ঘা হয়ে গেছে এখন।
প্রার্থ পুষ্পর পায়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে পা টা তার হাতে তুলে নিলো।
পুষ্প প্রার্থর হাত ধরে বললো।
“-কি করছেন?
প্রার্থ পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বললো।
“-চুপ।
রুমাল দিয়ে পায়ের পাতাটা ভালো করে বেধে রক্ত পড়া আটকালো। পুষ্পর দিকে তাকিয়ে দেখলো পুষ্পর শরীরের বেশিরভাগ অংশ ভেজা শাড়ীর ভেতর দিয়েও দৃশ্যমান হয়ে আছে। ফর্সা পেট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রার্থ নিজে থেকে শার্টটা খুলে দিলো পুষ্পর হাতে। বললো।

“-এটা পড়।
পুষ্প লজ্জায় পড়ে গেলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো একেবারে বাজে দেখা যাচ্ছে নিজেকে। শার্টটা হাতে নিয়ে পড়ে নিলো।
প্রার্থ গায়ে এখন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। পুষ্প শার্টটা পড়ে নিতেই প্রার্থ তাকে কোলে তুলে নিলো।
পুষ্প অবাকের চরম পর্যায়ে। এটা তার কাছে অবিশ্বাস্যকর একটা বিষয়। যে প্রার্থ ভাই এখন তাকে লাথি মেরে ফেলে যেতে চাইবে সে কিনা তাকে যত্ন করে কোলে তুলে নিলো। পুষ্পর কাছে এটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য মনে হচ্ছে।
চোখ মুখে অবাকের রেশ নিয়েই শুধালো।
“-আপনি কি করছেন? আমি যেতে পারতাম তো। আপনি কেন ভিজলেন বৃষ্টিতে। আমি বড়আম্মুকে কি বলবো। আপনার আজকে নিশ্চিত জ্বর আসবে। বড়আম্মু তো টেনশন করবে। আপনার জ্বর আসা মোটেও ভালো লক্ষণ না। একবার জ্বর হলে আপনার…..
প্রার্থ দাড়িয়ে গেলো। জোরে ধমকে উঠলো ওকে। বললো।
“-চুপ! ফেলে আসবো আবার? এখন ফেলে আসলে ওই রিক্সার নিচে তোকে চাপা মেরে তারপর আসবো। বল মারবো চাপা?

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১০

পুষ্প চুপ হয়ে গেলো। দুপাশে মাথা নাড়ালো ঘনঘন।
প্রার্থ আবারও হাটা ধরলো। পুষ্প তাকিয়ে রইলো প্রার্থর ভেজা চোখ মুখে। এই একটু খানি যত্নে কতটা মায়াবী লাগছে তার শ্যামপুরুষকে।
হুট করেই মুখ সরিয়ে আনলো প্রার্থর থেকে। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে মনে মনে বললো।
“-তাকাস না পুষ্প। মায়া বাড়াস না। এটা যত্ন নয় এটা মানবতা। তোকে রিক্সার নিচে চাপা পড়তে দেখেছে তাই সাহায্য করেছে। এর বেশি কিছু না। উনি তোকে না কখনো ভালোবাসবে না কখনো যত্ন করবে। এইটুকু সাহায্যে গলে যাস না যেন।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১২