ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৯

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৯
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরল। তার মনে এখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মিষ্টি সেসব প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। প্রশ্ন গুলো ক্রমশ তাকে বিরক্ত করে চলেছে। মিষ্টির চোখে জল বয়ে পড়ছে অনবরত। মিষ্টির এহেন অবস্থার মধ্যেই রোকসানা শিকদার এসে বসলেন তার পাশে। তিনি এসেই অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন,
“রাফা এসব কি বলছে মিষ্টি? সত্যিই কি আমার রাফসান…ও ফিরে এসেছে? ওকে দেখেছে রাফা।”
মিষ্টি মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বলে,
“হ্যাঁ, মা। আমি যেন অনেক দিন পর নতুন আশা খুঁজে পেলাম। কিন্তু রাফসান কি সত্যিই ফিরবে আমার কাছে?”
এমন সময় রোকসানা শিকদার বললেন,

“কেন ফিরবেনা? ওকে ফিরতেই হবে আমাদের কাছে। আমি ওর বৃদ্ধ মা ওর জন্য অপেক্ষা করছি, তুমি ওর স্ত্রী আছ এমনকি ওর একটা মেয়েও আছে। ও আমাদের থেকে আর দূরে থাকতে পারবে না।”
“কিন্তু ও কেন সবসময় পালিয়ে বেড়ায় মা? ওর এই মিশনের জন্য? কিন্তু আমি তো এই মিশনে ওর সঙ্গী ছিলাম। তবুও কেন বারবার এইভাবে কষ্ট দেয়? আমরা কি একটু সুখে সংসার করা ডিজার্ভ করি না? আমাদের তো বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিয়ের পর একদিনও শান্তিতে সংসার করতে পারি নি। যদিওবা এক সময় গিয়ে মনে হলো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। উলটে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। বারবার ও এভাবে কেন আমায় কষ্ট দিচ্ছে? কি ভুল করেছি আমি?”
“তুমি কোন ভুল করো নি মা। তুমি তো একটা ভালো মেয়ে। তোমার মতো মেয়েই হয় না। তবুও জানি না ভাগ্য কেন আমাদের সাথে এই নির্মম খেলা খেলছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে বাইরে, সুইটি চৌধুরী মোর্শেদ চৌধুরীকে বলছেন,
“এসব কি শুরু হলো? এই সব কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ের জীবনে কি একটুও শান্তি লেখা নেই৷ এত দিন ধরে যখন ধীরে ধীরে আমার মেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরল তখন আবার হঠাৎ করে অতীতের হাতছানি কেন? এটা মোটেই ঠিক না। সব দোষ তোমার। তুমি কেন ঐ রাফসানের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলে? তোমার এই একটা সিদ্ধান্তের জন্য আজকে আমার মেয়ের জীবন এমন এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ঘৃণা করি তোমাকে এই কারণে। ”

“তুমি আমাকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো সুইটি। এসব তোমার মেয়ের জেদের জন্যই হয়েছে। ও এই মিশনে যোগ দেয়ার জন্যই রাফসানকে বিয়ে করেছিল তাহলে এখন তুমি আমায় কেন বলছ?”
“মিশন, মিশন, মিশন এই মিশনের জন্যই সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল। আমার হাসিখুশি মেয়েটার আজ এই কি অবস্থা। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আল্লাহ যে কেন আমায় তুলে নিচ্ছে না।”
“জানি, এসব কিছু মেনে নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু এভাবে বলো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
“আর কিচ্ছু ঠিক হবার নেই। একবার শুধু আমাকে ঐ রাফসানের মুখোমুখি হতে দাও। এবার ওকে আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোন অধিকার ওর নেই। এটা আমি ওকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেব।”

রাফা মিষ্টির কাছে এসে বলে,
“মম, ড্যাড কোথায় চলে গেল? ড্যাড কি কখনো আর আমাদের কাছে ফিরবে না?”
মিষ্টি রাফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“ফিরবে, তোমার ড্যাডকে ফিরতেই হবে। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি তোমার ড্যাডকে তোমার কাছে আনবোই। ছোটবেলা থেকে তুমি তোমার যেই পাওনা ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছ সেই ভালোবাসা তুমি পাবেই।”
রোকসানা শিকদার মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করেন,
“কিন্তু তুমি কিভাবে রাফসানকে খুঁজে বের করবে?”
“উনি সারাজীবনই আমার থেকে পালিয়ে বেরিয়েছেন। তবে এবার আমি ওনাকে আর পালাতে দেব না। উনি যেখানেই থাকুক, ওনাকে খুঁজে বের করবোই।”
বলেই মিষ্টি উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস দেখা গেল।
এরইমধ্যে সুইটি চৌধুরী এসে বললেন,
“তুমি ভুলে যাও রাফসানের কথা। ও কখনো তোমার কথা ভাবে নি। তাহলে তুমি কেন নিজের জীবনের এত গুলো বছর নষ্ট করছ ওর কথা ভেবে? অনেক ভেবেছ রাফসানের কথা। এবার অন্তত নিজের কথা ভাবো। নিজের মতো বাঁচার চেষ্টা করো। ”
মিষ্টি বলে,

“এভাবে বলো না, মম।”
“আমি এভাবেই বলব। তোমার আর কারো খোঁজ করতে হবে না। যে তোমার কাছে ধরা দিতে চায়না তার কাছে তোমায় যেতে হবে না। তুমি বরং ভাবো নিজের আর নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা। আর রাফসানকে খোঁজার দায়িত্ব আমার। এবার শুধু আমি ওকে খুঁজে পাই। তারপর আমি ওর সাথে তোমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি।”
রোকসানা শিকদার হতবাক স্বরে বলেন,
“এসব কি বলছেন আপনি?”
“আমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি। আপনার ছেলে আমার মেয়ের জীবনটাকে পুরোপুরি নরকে পরিণত করেছে। আমার মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এসব কোন কিছুই আমার মেয়ে ডিজার্ভ করে না। এবার আমি আমার মেয়েকে সেই সুখের সন্ধান দেব যেটা ও ডিজার্ভ করে। যদি আমি রাফসানকে খুঁজে পাই তাহলে শুরুতেই রাফসানের সাথে আমার মেয়ের ডিভোর্স করিয়ে নেব তারপর অন্য কারো সাথে ওর বিয়ে..”
মিষ্টি আচমকা চিৎকার করে বলে ওঠে,

“চুপ..একদম চুপ করো। এসব কি আজেবাজে কথা বলছ তুমি? আমি শুধু আর শুধু রাফসানের। অন্য কারো সাথে বিয়ে…ছি! এসব কথা আমি ভাবতেও পারি না। রাফসান যদি বেচে নাও থাকতো তাও পারতাম না। আর এখন যদি ও বেচে থাকে তাহলে তো আরোই নয়। রাফসান আমার স্বামী, আমার সন্তানের বাবা। আর ও..আমার সবকিছু।”
বলেই মিষ্টি হঠাৎ করে কোথাও বেরিয়ে যায়। সুইটি বলে ওঠেন,
“মিষ্টি শোনো আমার কথা। এভাবে যেও না।”
কিন্তু মিষ্টি কারো কথা শোনে না। সে দৌড়ে চলে নিজের গন্তব্যে। যেই গন্তব্য তার ছাড়া আর কারো নয়।
রাতে তখন গভীর আধার নেমে এসেছে। মিষ্টি এই আধারের মধ্যেই ছুটে চলেছে। তার চোখে জল। মিষ্টি হঠাৎ একটু দম নিয়ে বলে,

“তুমি ফিরবে না রাফসান? সব সময় আমায় কষ্ট দিয়েই যাবে।”
এমন সময় হঠাৎ মিষ্টি লক্ষ্য করে কেউ যেন তার উপর নজর রাখছে। মিষ্টি আচমকা পিছনে তাকিয়ে দেখে মুখোশ পড়া কোন এক ব্যক্তি। মিষ্টি বলে ওঠে,
“কে আপনি?”
হঠাৎ করে সেই মুখোশ পড়া ব্যক্তি তার পেছন থেকে একটি ছুরি বের করে তার দিকে এগোতে থাকে। মিষ্টি ভয়ে বলে ওঠে,
“কে…কে আপনি?”

কিন্তু লোকটি কোন উত্তর না দিয়ে তার দিকে এগোতে থাকে। ভয়ে মিষ্টি কাপতে থাকে। আচমকা তার মার্সেই শহরের সেই সিরিয়াল কিলারের কথা মনে পড়ে যায়। মিষ্টি বুঝতে পারে এটা হয়তো সেই সিরিয়াল কিলার। তাহলে কি মিষ্টি এর পরবর্তী টার্গেট হতে চলেছে? মিষ্টি আর কিছু বলতে বা ভাবতে পারে না। তার যেন মনে হয় এই মুহুর্তেই তার জীবনটা শেষ হতে চলেছে।
মিষ্টি চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। এমন সময় হঠাৎ মিষ্টি বুঝতে পারে কেউ যেন তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। না এটা সেই সিরিয়াল কিলার নয়। এক চেনা চেনা গন্ধ। মিষ্টি বুঝতে পারছে তার সামনে তার খুব আপন কেউ দাঁড়িয়ে। মিষ্টি অবাক স্বরে বলে ওঠে,

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৮

“রাফসান!”
চোখ খুলতেই মিষ্টি দেখে রাফসান সিরিয়াল কিলারকে ধরে রেখেছে। সে পারেনি মিষ্টির কোন ক্ষতি করতে। মিষ্টির মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪০