অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। মাথায় এখনো তার প্রচণ্ড ব্যথা। তবে এত কিছুর মাঝেও জাঈদের শেষ দিকের করুণ চাহনি তাকে এখনো ভাবাচ্ছে। আরিশা এসব কিছুই ভাবছিল এমন সময় হঠাৎ করে আফিফা তার রুমে চলে আসে। আফিফা এসেই আরিশাকে বলে,”বোনু, এখন কেমন আছিস তুই?”
আরিশা আফিফার কথায় নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,”ভালো তবে মাথায় এখনো কিছুটা ব্যথা করছে।”
“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক, তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”
“আমার সাথে? কিন্তু কে?”
” আমি।”

হঠাৎ করে এক মায়াভরা কন্ঠস্বর শুনে আরিশা দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় রাহেলা খন্দকারকে। তার মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগেই রাস্তায় এই মহিলাটির সাথে তার দেখা হয়েছিল। আরিশা মৃদু হেসে বলে,”আন্টি,আপনি?”
“হুম,তোমার খোঁজ নিতে আসলাম।”
“আসুন, ভেতরে আসুন।”
রাহেলা খন্দকার ভেতরে এসে একদম আরিশার শিয়রের কাছে বসে বলেন,”টিভিতে নিউজে আমি সবটা দেখলাম। এসব দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। তাই চলে এলাম তোমার সাথে দেখা করার জন্য। এই টুকুনি একটা মেয়ে তুমি আর এই বয়সেই কত কিছু সহ্য করতে হলো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরিশা নিজের অতীতের কিছু খারাপ স্মৃতি মনে করে বলল,”সবই বুঝি ছিল নিয়তির খেলা। কি আর করব বলুন।”
“আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমার জীবনে আর কোন দুঃখ কষ্ট কখনো প্রবেশ করতে না পারে। অতীতের সব দুঃখ ভুলে যেন তুমি এক সুন্দর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারো।”
আরিশা বলে,”আমার জন্য আরেকটা দোয়া করতে পারবেন আন্টি? জানেন, আমার জন্মের পরই আমার আসল পরিবার আমায় ত্যাগ করে। এই পৃথিবীতে আমায় একা ফেলে চলে যায়। তারপর যদিওবা এই পরিবারের মানুষ গুলো আমায় অনেক ভালোবাসা দিয়েছে, একদম নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করেছে। আমার তাদের নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু একটি বারের জন্য হলেও আমি আমার আসল মা-বাবার মুখোমুখি হতে চাই। তাদের সাথে দেখা করে শুধু তাদের একটি মাত্র প্রশ্নই করতে চাই যে কেন..কেন তারা আমায় এই অবস্থায় একা ফেলে গেল। কি দোষ করেছিলাম আমি?”

আরিশার কথা শুনে রাহেলা খন্দকারের বুক হাহাকার করে ওঠে। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে তিনি বলেন,”জানিনা,একজন মা কিভাবে তার সন্তানকে এভাবে ত্যাগ করতে পারে। যেখানে আমি নিজের সন্তানকে হারানোর পর এখনো অব্দি একটি বারও দুচোখের পাতা এক করতে পারি নি।”
আরিশা কিছুটা অবাক স্বরে বলে,”আপনি নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন?”

রাহেলা খন্দকার বলেন,”হুম, জানো আমার না বিয়ের পর থেকে দীর্ঘ ১২ বছর কোন সন্তান হয় নি। এক সময় তো আমি মা হবার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এমন সময় আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। আমি সন্তান সম্ভবা হলাম। সেই সময় যে আমি কত খুশি হয়েছিলাম সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়। আমারও হয়েছিল সেই দশা। আল্লাহ আমায় সন্তান গর্ভে ধারণ করার সৌভাগ্য তো দিলেন তিনি সন্তান্তের গর্ভে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য দিলেন না। জন্মের পরপরই আমার সন্তান মারা যায়। এই ঘটনায় যেন আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। এরপর আর কখনো দ্বিতীয় বার মা হবার সুযোগ পাই নি। জানো, তোমায় দেখলে কেন জানি আমার ভীষণ আপন লাগে। আমার সন্তান যদি বেঁচে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তোমার মতোই হতো।”

আরিশা করুণ চোখে তাকায় রাহেলা খন্দকারের দিকে। এরইমধ্যে আফিফা বলে ওঠে,”আসলে, সকল মানুষের জীবনেই কোন না কোন দুঃখ থাকে। কিন্তু আমাদের সেই সমস্ত দুঃখে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের সেই সব দুঃখকে ভুলে সামনে এগোতে হবে।”
রাহেলা খন্দকার নিজের চোখের জল মুছে বলেন,”একদম ঠিক বলেছ তুমি। আচ্ছা, আরিশা মা, তাহলে তুমি বিশ্রাম নাও। আমি তাহলে এখন আসি।”
আরিশা বলে,”আন্টি, আপনি লাঞ্চটা এখানেই করে যাবেন।”
“আরে না,না এত ব্যস্ত হতে হবে না তোমাদের। আমি বাসায় গিয়ে..”
আফিফাও বলে,”না, আন্টি। আমরা আপনার কোন কথা শুনব না। আজকের জন্য আপনি আমাদের গেস্ট আর তাই আপনাকে লাঞ্চ করে তবেই যেতে দেব।”
রাহেলা খন্দকার এবার হার মেনে নিয়ে বলেন,”বেশ, খেয়েই যাব নাহয়।”
আরিশা ও আফিফা দুজনেই খুশি হয়। রাহেলা খন্দকার আরিশার দিকে আবারো তাকান। মেয়েটির দিকে তাকালেই অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পান তিনি।

আনিকা খান রান্নাঘরে রান্নাবান্না করতে ব্যস্ত ছিলেন। নিঝুম রান্নাঘরে প্রবেশ করেই বলে ওঠেন,”আরে আনিকা, তুমি একা একা সবকিছু করছ কেন? বুয়া আজকে আসেনি?”
“আর বলো না আপু, বুয়ার স্বামী নাকি ভীষণ অসুস্থ তাই সে কিছুদিন আসতে পারবে না।”
“সে কি! তাহলে তুমি এত কাজ একা সামলাবে কিভাবে? কিছুক্ষণ আগেই তো হাসপাতাল থেকে ফিরলে এত রোগী দেখে আর এখন এত রান্না একা করবে। তুমি বের হও, আমি সব করে দিচ্ছি।”
আনিকা খান বলে ওঠেন,”না, আপু। তার প্রয়োজন হবে না। রান্না প্রায় হয়েই গেছে আর বুয়া বলে গেছে, ওর পরিবর্তে আজকেই নতুন কাউকে পাঠাবে। কিন্তু তার তো আরো অনেক আগেই আসার কথা ছিল৷ এখনো কেন আসছে না বুঝতে পারছি না।”

এমন সময় হঠাৎ করে বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠতেই আনিকা খান বলে ওঠেন,”ঐ যে, নতুন বুয়া বোধহয় এসে গেছে।”
নিঝুম বলেন,”বেশ, তুমি তাহলে এদিকটা সামলাও আমি গিয়ে দেখছি।”
“আচ্ছা।”
নিঝুম গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পান একজন মধ্যবয়সী নারীকে। যার পরনে মলিন বস্ত্র, হাতে একটা পুটলি। নিঝুম তাকে দেখেই বলে ওঠেন,”তুমি কি নতুন বুয়া?”
“জে ম্যাডাম, আমিই আপনেদের নতুন বুয়া। আপনাদের বাড়ির আগের বুয়া আমারে পাঠাইল।”
“তুমি আসতে এত দেরি করলে কেন? এসো ভেতরে এসো।”
“আর বলবেন না, আমি তো আরো কয়েকটা বাড়িতে কাজ করি তাই সব কাজ ছেড়ে আসতে দেরি হয়ে গেল।”
নতুন বুয়া বাড়িতে প্রবেশ করেই চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বলেন,”বাব্বাহ, কি বড় বাড়ি আপনাগো।”
“তা তোমার নাম কি?”

“জে, জরিনা।”
এমন সময় আনিকা রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বললেন,”নতুন বুয়া এসে গেছে আপু.. ”
বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই তার নজর যায় জরিনার দিকে। সাথে সাথেই বিস্ময়ে তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। এদিক জরিনাও আনিকা খানকে দেখে হতবাক হয়ে যান। শুকনো ঢোক গিলতে শুরু করেন। আনিকা খান বলে ওঠেন,”তুমি!”
জরিনা বাড়ি থেকে দ্রুত চলে যেতে নেন এমন সময় আনিকা খান এগিয়ে গিয়ে তার পথ আটকে বলেন,”দাঁড়াও, এভাবে যেতে পারবে না তুমি। আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।”
জরিনা আমতাআমতা করে বলে,”আপনের সাথে তো ২০ বছর আগেই আমার যা সওদা হওনের হয়ে গেছিল। তাইলে এহন কেন আমায় আটকাইতাছেন?”
“আটকাচ্ছি তার কারণ আছে। এত গুলো বছর পর তোমার দেখা পেলাম, এতদিন পর যখন এসেছ একবার নিজের মেয়ের সাথে দেখা করে যাও। ভয় নেই, তার কোন দায়িত্ব তোমায় নিতে হবে না। এতগুলো বছর যখন আমরা তাকে সামলেছি তখন সামনেও সামলাব।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৭

নিঝুম বলে ওঠেন,”তুমি এনাকে চেনো আনিকা?”
“জ্বি, আপু। ইনিই হলেন আরিশার আসল মা। আজ থেকে ২০ বছর আগে ইনিই দারিদ্র্যের অযুহাতে নিজের সদ্যজাত মেয়েকে হাসপাতালে ফেলেই পালিয়ে যান।”
নিঝুম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। ততক্ষণে রাহেলা খন্দকারও নিচে নেমে আসেন। জরিনার নজর যায় রাহেলা খন্দকারের দিকে। সাথে সাথেই তিনি শুকনো ঢোল গিলতে থাকে। রাহেলা খন্দকারও অবাক স্বরে বলেন,”জরিনা, তুমি!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৯