প্রেমের সমর পর্ব ২০

প্রেমের সমর পর্ব ২০
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

গাড়ির যে সিটটাতে স্বচ্ছ বসা ছিল সে সিটটা ফাঁকা আছে মিনিট বিশ হলো। গাড়িটা সাইড করে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। আর তারপরই স্বচ্ছ গাড়ি থেকে নেমে যে কোথায় গিয়েছে কে জানে! সুহা বিরক্ত হয়। এপাশ ওপাশ চেয়ে গাড়ি থেকে যখন নেমে দাঁড়াবে ঠিক তখনই দেখা মিলল স্বচ্ছর। খাবারের তিন তিনটা প্যাকেট হাতে। একটা প্যাকেট সামনের ড্রাইভারের হাতে তুলে দিয়ে খেতে বলে বাকি দুটো প্যাকেট নিয়ে স্বচ্ছ গাড়িতে উঠল। পানির বোতলের ডাকনা খুলতে খুলতে তাকাল সুহার দিকে। পরপরই মুখে পানি ঢালে। গিলে নিয়ে কৌতুক স্বরে বলে উঠে,

“ ইশশ! আমার অপেক্ষা করতে করতে তো তোমার মুখটা চুপসে গিয়েছে একেবারে সুহাসিনী। এত বেশি চোখে হারাও আমায়? ”
সুহা কেমন করে তাকায়। বিরক্ত স্বরে বলে উঠে,
” ভূতে পেয়েছে আমায় যে আপনাকে চোখে হারাব আমি? ”
স্বচ্ছ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” হারাও না? ”
সুহা তখন ফোঁসফোঁস করতে করতে উত্তর করে,
“ দরকার পড়লে হরর মুভির ভূতগুলোকে চোখে হারাব স্বচ্ছ। তবুও আপনাকে নয়। ”
স্বচ্ছ দাঁত কেলিয়ে হাসে।মজা করে বলে,
” তাহলে তোমার জন্য ভূত হতেও রাজি আছি। ভূত হলে চোখে হারাবে তাহলে? ”
“ আপনি একটা পাগল স্বচ্ছ!”
স্বচ্ছ খাবারের প্যাকেট খুলতে লাগে। সুহার দিকে এক পলক চেয়ে শুধায়,
“ তুমি একটা আস্ত নেশা সুহাসিনী।”
কথাটুকু বলেই খাবারের লোকমা তুলে ধরল সুহার মুখরর সামনে। আকস্মিক এই কান্ডে সুহা ভ্যাবাচ্যাঁকা খায়। স্বচ্ছ কি তাকে খাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে খাবার মুখের সামনে ধরেছে? নাকি এমনিই? দ্বিধান্বিত চাহনিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আমার খাবার? ”
স্বচ্ছ হাসে। আরেকটু এগিয়ে ধরে বলে,
“ খাইয়ে দিব। ”
সুহা তৎক্ষনাৎ বিস্ময় নিয়ে তাকায়। স্বচ্ছ কিনা তাকে খাইয়ে দিবে? তাও এই মাঝরাস্তায় গাড়িতে।এসব কি নতুন রকমের ঢং হু? সুহা সঙ্গে সঙ্গেই সুচালো কন্ঠে বলে উঠল,
“ আমি কি ছোটবাচ্চা? ”
স্বচ্ছ মাথা দুলায়। সঙ্গে সঙ্গেই বাধ্যগত গম্বীর স্বরে উত্তর করে,
” একদমই নয়।বড় বাচ্চা। ’
“ তাহলে? কেন মনে হচ্ছে যে আমি নিজ হাতে খেতে পারব না? ”
স্বচ্ছ করুণ ভঙ্গিতে তাকায়। একটাই বউ তার। কোন জম্মে কোন পাপ করেছিল যে বউটাকে পাত্তা না দিয়ে সে চারবছর আগে বহুত বড় একটা ভুল করে বসেছিল। এমন যদি জানত তাহলে তো সে এই মেয়েটাকে সর্বপ্রথম মুহুর্তটা থেকে মাথায় তুলে রাখত৷ কে জানত যে চারবছর পর এসে এই একটা মেয়েরই প্রেমে স্বচ্ছ এমন বেফাঁস ভাবে ফেসে যাবে?কে জানত?স্বচ্ছ ছোট শ্বাস ফেলে জানায়,

“ খেতে পারবে না তা তো বলিনি। ”
“ তবে?”
স্বচ্ছ না পেরে বউকে খাইয়ে দিতে অযুহাত খুঁজল। কারণ এই মেয়ে জম্মগত ঘাড়ত্যাড়া। দেখা গেল হাতের গ্রাসটুকু তো গিললই না বরং স্বচ্ছর মুখে ছুড়ে মারবে। তাই তো অযুহাত স্বরূপ বলে উঠল,
“তুমি আমায় জ্বরের সময় খাইয়ে দিয়েছিলে সুহাসিনী। আমিও এখন খাইয়ে দিলে শোধবোধ হয়ে যাবে।শত হোক আমি কারোর ঋণ রাখতে চাইনা সুহাসিনী। ”
“ তাই নাকি?”
স্বচ্ছ মাথক নাড়ে। খাবার নেওয়া হাতটা এগিয়ে ধরে বলে উঠে,
“ হা করো। ”
সুহা হা করে। মুখে নেয় স্বচ্ছর হাতের খাবারটুকু। আর তখনই নিজের ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ লাগে স্বচ্ছর হাতের আঙ্গুলে। স্বচ্ছ কেমন করে যেন চায়। তাকিয়ে থাকে। সুহার খাবার খাওয়াটাও মুহুর্তের জন্য অপরূপ মনে হলো তার। সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল সুহার ঠোঁটেও। এককেণায় একটা ভাত লেগে আছে। স্বচ্ছ কিছুক্ষন চেয়ে থেকে আঙ্গুল দিয়ে সে ভাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
“ তোমার ঠোঁটজোড়াও সুন্দর সুহাসিনী। এই প্রথম তোমার ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম তাও হাতের আঙ্গুলে। বড়ই দুঃখ। ”

সুহা খাবার খেতে খেতেও রেগে তাকায়। ভরা মুখেই বলে,
“ আপনার মনটা আসলেই অস্বচ্ছ। স্বচ্ছতার কানাকড়িও দেখতে পাচ্ছি না। ”
স্বচ্ছ মুখ ফুলিয়ে খাবারের অপর গ্রাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
“ দোষ তো তোমার। ঠোঁট লাগিয়েছো কেন আমার আঙ্গুলে?”
“আপনাকে খাইয়ে দিতে বলেছি আমি? লাগবে না খাইয়ে দেওয়া। ”
“ দিব। আমার যখন মন চেয়ে তখন বউকে অবশ্যই খাইয়ে দিব। ”
সুহা খাবার চিবোতে চিবোতে অন্য পাশ ফিরে বসল। বিরক্ত কন্ঠে শুধাল,
” ছোট বাচ্চাদের মতো বউ বউ করবেন না স্বচ্ছ। বিচ্ছিরি শোনায়। ”
স্বচ্ছ বউ বউ করে না এবারে। চুপ থাকে না। অতঃপর অনেকটা সময় পর সুহার ঠোঁটের কোণে খাবারের ঝোলই লেগে গেল। স্বচ্ছ তা দেখে হেসে বণণ,

“ তোমার ঠোঁটের কোণায় খাবার লেগে আছে। ”
“ তো? ”
স্বচ্ছ এবারে ফিসফিস স্বরেই বলল,
“ যদি ড্রাইভার মামা না থাকত তাহলে তোমার ঠোঁটের খাবার গুলো আমার পেটে চালান করার ব্যবস্থা করতাম। ”
সুহা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। তড়াৎ করে বলে,
” সবকিছুতেই বেশি বকেন। ”
স্বচ্ছ ততক্ষনে হাত বাড়িয়ে সুহার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ঝোলটুকু আঙ্গুলে নিল। পরমুহুর্তে তা জিভে ছুঁইয়ে মজা করে বলল,
“ টেস্টি। ”
সুহা গা জ্বালানো ভঙ্গিতে বলে,
“ বক্সের খাবার গুলো টেস্টি না? ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাকায়। ফের সুহাকে বিরক্ত আর জ্বালাতে বলে উঠে,
“ বাট তোমার ঠোঁটেরটা বেশি টেস্টি। ”
সুহা হুশিয়ারি দিয়ে বলল,
“ফ্লার্ট করবেন না একদম। মেজাজ খারাপ এমনিতেই!”
স্বচ্ছ হাসে। বলে,
“ আচ্ছা, ফ্লার্ট করব না। প্রেম প্রেম কথা বলব। ”
এই পর্যায়ে সুহা এমন ভাবে তাকাল যেন গিলে নিবে সে স্বচ্ছকে। স্বচ্ছ বুকে হাত রাখে। কাতর গলায় বলে,
” ওভাবে তাকাতে নেই। বুক কেমন করে সুহাসিনী। ”

স্বচ্ছদের গাড়িটা যখন ঢাকায় পৌঁছাল অর্থ্যাৎ বাসা থেকে ঘন্টা খানের দূরত্ব ছিল ঠিক তখনই আচমকা ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। হুট করেই বা পাশের রাস্তাটা থেকে ছুটে এল অনিয়ন্ত্রিত এক ট্রাক। স্বচ্ছ যখন বা পাশ ফিরে চাইল সর্বপ্রথম এই দৃশ্য দেখে অবাক হয় সে৷ একনজর তাকায় বা পাশে বসে থাকা সুহার দিকে। স্বচ্ছর বুক কাঁপে। এক মুহুর্তেই সুহাকে এনে বসায় ডান পাশে। পরমুহুর্তেই পান পাশের দরজাটা খুলে সুহাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রাস্তার অমসৃণ জমিটায়। আকস্মিক ঘটনাটায় সুহা স্তব্ধ হয়ে তাকায়।সেকেন্ডের মধ্যে বিরাট রকমের আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল ট্রাকের সামনে থাকা কারটাকে। বিকৃত আকৃতির দেখাচ্ছে কারটাকে এখন। সুহার কলিজা থমকে যায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির এককোণায় স্বচ্ছকে দেখে। গাড়ির দরজাটা খোলা থাকাতে দ্রুত গিয়ে বসে সে। স্বচ্ছকে ভালো করে দেখার আগেই স্বচ্ছ হাত বাড়িয়ে সুহার মুখ ছুঁয়ে। নরম হাতে হাত বুলিয়ে বলে,
“ ঠিক আছো সুহাসিনী? ব্যাথা পেয়েছো? লেগেছে কোথাও? এই সুহাসিনী কথা বলো.. ”

সুহা তাকায়।আকস্মিক রাস্তায় পড়াটাতে হাত পায়ের কিছুটা চিলে গেছে তার৷ ব্যাথা পেয়েছে৷ কিন্তু পরমুহুর্তেই স্বচ্ছর দিকে তাকিয়ে সে থমকে যায়। কপালে কাঁচ ফুটে আছে ছেলেটার। মাথা থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে।মাথার চুল গুলো অব্দি র’ক্তে ভিজে লেপ্টে আছে। সুহার র’ক্তে ফোবিয়া আছে। এত এত র’ক্ত দেখেই তার গা গুলিয়ে উঠে। শরীর নুইয়ে আসে৷ তবুও মস্তিষ্কে ঘুরে, স্বচ্ছর কিছু হবে না তো?ভালো থাকবে তো?সুহা হাত বাড়ায়। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠে,
“ স্ স্বচ্ছ? এ্ ই স্বচ্ছ?আ্ আপনার এত র’ক্ত? এত র’ক্ত কেন স্বচ্ছ? আপনার মাথা….”
সুহার পাগল পাগল লাগে। কিসব প্রশ্ন করছে বা প্রলাপ বকছে তা হয়তো সে নিজেও জানে না। স্বচ্ছ সুহার এলোমেলো প্রশ্ন শুনে আলতো হাসে। সুহার কপালের দিকে একটুখানি কেঁ’টে গেছে। সে অংশ টুকুতেই আঙ্গুল বুলিয়ে বলে,
“ স্যরি ধাক্কা দেওয়ার জন্য।তোমার কপাল কেঁটে গেছে সুহাসিনী! ব্যাথা করছে? ”
সুহা এবার কান্না করে দেয়। চোখ গলিয়ে পানি বের হয়ে আসে তার। হামলে পড়ে স্বচ্ছর দিকে। আটকে আসা স্বরে বলতে থাকে,

” আ্ আ্ আপনার, আপনার র’ক্ত…স্বচ্ছ? ক্ কতগুলো র’ক্ত । স্বচ্ছ, আপনার কতগুলো রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। কি করব আমি। কি করব বলুন না…আপনি তো ম’রে যাবেন স্বচ্ছ। র’ক্ত আটকাব কি করে? প্লিজ, প্লিজ স্বচ্ছ সুস্থ থাকুন না। আগের মত, মজা করুন, জ্বালান সব মেনে নিব আমি। প্লিজ!”
স্বচ্ছ সুহার কথা শুনে হাসে। সুহা পাগলের মতো বকছে তখনো। তার নিজের শরীরের ভরও ছাড়ছে স্বচ্ছর শরীরের উপরে। হাত পা কাঁপছে মেয়েটার। স্বচ্ছ হয়তো বুঝতে পারছে নিজের যন্ত্রনা। হয়তো বুঝতে পারছে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও মজার স্বরে সুহাকে আশ্বাস দিতে বলে,
“ বোকা মেয়ে! এত সহজে মরব না আমি। তোমার ভালোবাসা পাওয়া বাকি তো আমার।”
সুহা তখনও নিজের মতো প্রলাপ বকছে বিড়বিড় করে,
“ আ্ আপ্ আপনার রক্তগুলা? কি করে থামাব স্বচ্ছ? আপনার সব রক্ত তো বের….”
স্বচ্ছ ফের কথা থামাতে বলে,

” ব্লাড ফোবিয়া আছে তোমার? কাঁপছো তুমি।কন্ঠও কাঁপছে।”
সুহা ডুকরে কেঁদে উঠে। ততক্ষনে চোখে পড়ে সামনের সিটে বসে থাকা ড্রাইভারকেও। রক্তাক্ত দেহ। নড়চড় নেই। সুহা খামছে ধরে স্বচ্ছর রক্তাক্ত শার্ট খানা। কেঁদে কেঁদে বলে উঠে,
“ স্বচ্ছ! আপনার কিছু হবে না। কথা দিন , কিছুই হবে না আপনার। শুনুন, শুনুন আমি আপনাকে ভালোবাসি স্বচ্ছ। দীর্ঘ চার বছর ধরে ভালোবেসে আসছি স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছ অল্প হাসে। যন্ত্রনায় চোখ বুঝে আসছে তার। মাথা চিরচির করছে। চোখ বুঝে আসছে নিমিষেই। তবুও প্রেয়সীর সামনে চোখ বুঝা যাবে না। নয়তো মেয়েটা কান্না করবে, ভেঙ্গে পড়বে। ঠোঁট এলিয়ে বলে,
“ তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না সুহাসিনী। কিন্তু, তুমিও আমার প্রথম অনুভূতি। বিশ্বাস করো এটা মিথ্যে নয়।মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলব না আমি সুহাসিনী। ”

প্রেমের সমর পর্ব ১৯

সুহা কাঁদতে কাঁদতেই জড়িয়ে ধরল স্বচ্ছকে।শরীরের ভর ছেড়ে দিল স্বচ্ছর উপর। কয়েক সেকেন্ড যেতেই অতিরিক্ত চিন্তা, অস্থিরতা আর ব্লা’ড ফোবিয়ার কারণে জ্ঞান হারাল সুহা৷ স্বচ্ছ মিনমিনে চোখে চেয়ে থাকে। জড়িয়ে থাকে সুহার শরীরটা।আশপাশে মানুষ চোখে আসে। আওয়াজ ভেসে আসে কানে। আর স্বচ্ছর চোখজোড়া বুঝে আসে ক্রমশ! তবুও স্বচ্ছ চোখ বুঝতে চায় না। যদি এটা শেষবার হয়? যদি আর চোখ খোলা না হয়? তার চাইতে তার সুহাসিনীকে একটু মন ভরে দেখেই নিক নাহয়!

প্রেমের সমর পর্ব ২১