কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৩
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সময় রাত এগারটার কাছাকাছি!
সচারাচর ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁলেই বস্তির এলাকা নিশ্চুপ হয়ে যায়। আস্তেধীরে টং দোকানের ঝাপ নেমে আসে। যে যার ঘরে গিয়ে খিল টানে দরজায়। তবে
আজকের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের অন্ধকার প্রগাঢ় হলেও এখনো সরব বস্তির সরু গলি। ছোটো ছোটো ঘর থেকে বেরিয়ে প্রায় প্রত্যেকে ভিড় করেছেন তুশিদের বাড়ির সামনে।
কেঁদেকেটে অস্থির হাসনা। বৃদ্ধ মানুষটা মেঝেতে বসে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছেন।
দুপাশে টিনটিন,বাবলু হত্যে দিয়ে বসেছে। সংকীর্ণ আদলে তাদের চোখেও টলমলে জল।
সেন্টারে ঢোকার পর তুশিকে স্টেজে বউ সাজে দেখেই ফের বস্তিতে ছুটে এসেছিল ওরা। কিন্তু হাসনা শোনার পর কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাননি। তুশি আর বিয়ে! তা কখনো হয়?
তবে তাও ওদের জোরাজোরির তোড়ে সাথে যেতো হলো। আর যতক্ষণে সেন্টারে পৌঁছালেন,ততক্ষণে ইয়াসিরদের গাড়ি সীমানার বাইরে। স্টেজও ফাঁকা। তবে ভেতর থেকে জোরে জোরে দুজন ভদ্রলোকের কথার শব্দ আসছিল।
হাসনা তখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। ভেবেছিলেন বাচ্চা মানুষ, কী বলতে কী বলছে! কিন্তু,রাত বাড়লেও তুশির যখন দেখা নেই,তখন আর সন্দেহের কোনো অবকাশ রইল না। সাথে টিনটিনদের গলার জোরই যেন সমস্ত কিছুর প্রমাণ।
সব মিলিয়ে হাসনা ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। তুশির বিয়ে হয়েছে, তাও এইভাবে ওনাকে না জানিয়ে? একটা তুলতুলে বাচ্চা থেকে পেলেপুষে যাকে এত বড়ো করলেন,তার বেলায় এসব মানা যায়! নাতনিটা তার কার খপ্পরে পড়েছে জানেন না৷ কোথায় আছে,কোথায় থাকবে,কার কাছে,কে ওর স্বামী সব অজানা, সব। হাসনা কোনোদিন তুশিকে ছাড়া ঘুমোননি। একটা বেলাও খাননি ওকে ছাড়া। সকালে ঘুম ভেঙেই মেয়েটাকে দেখা অভ্যেস ছিল তার৷
অত আদর দিয়ে বড়ো করা নাতিটা এভাবে হারিয়ে যাবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হাসনার কান্না বাড়ল। হা-হুতাশের জোরালো আওয়াজ ছিটকে এলো বাইরে। আশেপাশের প্রত্যেকে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এটা সেটা বলে শান্ত করছেন ওনাকে।
তিন্নির মা এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন৷ সামনে হাসনা কাঁদলেও, তার চেহারা চকচকে। তুশির বিয়ে হয়ে গেছে,খোঁজ খবর নেই মানেই ও মেয়ে আর বস্তিতে আসবে না। এ নিয়ে কতবার যে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি। এমন মেয়ে না এলেই ভালো। হাড়-মাংস জ্বালিয়ে খায়। পানি নিতে,লাইন দিতে,হাঁটাচলা সবেতে পোদ্দারি তুশির। এবার অন্তত একটু শান্তিতে থাকতে পারবেন!
কিন্তু মনের এই ফূর্তি তিনি দেখাতে পারলেন না। প্রায় সকলেই যেখানে মন খারাপ করে রেখেছে,সেখানে ওনার আনন্দ ভীষণ বেমানান।
ভদ্রমহিলা মুখের হাসিটা চাপা দিলেন অভিনয়ের তলায়। দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বললেন,
“ চাচী,আর কাইন্দো না। শরীরডা খারাপ অইব না! কানলে কি তুশি ফিরব কও?”
হাসনা কেঁদে কেঁদে বললেন,
“ ওয় কই গেল আমারে থুইয়া? ও তুশিরে! আমি এহন কই গেলে তোরে পামু? ও বু রে,আমার লগে রাগ কইররা গেলি বু। ফিইরা আয় বু। আর তোরে কিছু কমু না আমি। আয় বু,আয়।”
পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন,
“ আইচ্ছা ওর জামাইয়ের নাম টাম কিছু হুনছো চাচী? কার লগে বিয়া হইল জানো? “
টিনটিন ভেজা গলায় বলল,
“ ওস্তাদের জামাইরে তো চিনি । হেয়
পুলিশ।”
সবার চোখ কপালে। হতবাক বনে একে-অন্যের মুখ দেখলেন তারা। সমস্বরে বললেন,
“ পুলিশ!”
হাসনা ত্রস্ত হাতে চোখের পানি মুছলেন৷ কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ তোরা জানোস হেয় কই থাহে?”
বাবলু মাথা নেড়ে বলল,
“ না। আমরা তো ওইদিন দেকছি খালি। ওস্তাদরে নিয়া গেল। এই পুলিশরে টিবিতেও দেখাইছিল একদিন। কিন্তু কই থাহে জানি না।”
সেদিনের সেই দোকানি ভিড়ের মাঝেই ছিলেন। বাবলুর কথায় চট করে মনে পড়ল কথাটা। সাথে সাথে বললেন,
“ হ আমিও তো দেকলাম সেদিনকা। ওই যে পকেট মারতে গিয়ে ধরা খাইল। কিন্তু ওই পুলিশ তো মতিঝিলের।”
হাসনা নড়েচড়ে উঠলেন। কান্নার বেগ থামল। বুক থমথমে করে ভাবলেন,
“ মতিঝিলের পুলিশের লগে তুশির বিয়া হইছে? হায় হায়! তুশি তো চোর। যার যা মনে ধরে তাই চুরি করে। অহন পুলিশের বাড়িত ও সংসার করব ক্যামনে?”
তিন্নির মা ফিক করে হেসে ফেললেন এবার।
কণ্ঠে বিদ্রুপ,
“ মুরগী নিজে গিয়া শিয়ালের গরে ঢুইকা গেল? তুশির দেখি মেলা কপাল!”
হাসনা বানুর মুখ শুকিয়ে থাকে। চিন্তায় একশেষ অন্তঃপুর! মেয়েটা এমনিই কপাল পোড়া। সব সময় হেসেখেলে, ফূর্তিতে মজে থাকলেও হাসনা অন্তত জানেন,তুশির মতো মন্দভাগ্য পৃথিবীতে আর কারো নেই। সেই মেয়ে যদি এমন সংসারের যাতায় পড়ে,এরপর কী হবে ওর!
গাড়ির চার চাকা হাইওয়ের ওপর সাই সাই বেগে ছুটছে। হুহু করা অন্ধকার আর লম্বা লম্বা সোডিয়ামের আলো মিলিয়ে অদ্ভুতুরে সুন্দর দৃশ্য। রোমকূপে আলোড়ন তোলা বাতাস আসছে ভেতরে।
তুশি জানলা থেকে মাথাটা বের করে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ভেলকি। ও কখনো এমন গাড়িতে চড়েনি। সিটগুলো কী নরম! কী পরিষ্কার,তকতকে সব! তুশিদের খাটের তোষকও এত নরম না তো। মাথা এলিয়ে বসলেই যে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। বদ পুলিশটা নিশ্চিত বড়োলোক ঘরের ছেলে। কত দাম হবে গাড়িটার? তুশির কাছে যদি একটা পিস্তল থাকতো,এক্ষুনি ড্রাইভারের মাথায় ধরে হাইজাক করত এটাকে। বেচলে নির্ঘাত প্রচুর টাকা পাবে!
এই বিস্ময় আর অহেতুক চিন্তার তোড়ে পেছনের সব কথা ভুলে গেছে মেয়েটা। ভুলে গেছে ইয়াসিরের সেই ছুড়ে দেয়া হুমকি। ভুলে গেছে দাদির সাথে আর কক্ষনো দেখা না হওয়ার শোক। খুব আনন্দ নিয়ে রাস্তা উপভোগ করার মাঝে, একটা মিহি কণ্ঠ বলল,
“ মাথা ভেতরে ঢোকাও। এক্সিডেন্ট হবে।”
তুশি ফিরে চাইল। বসল সোজা হয়ে। ওর পাশে ইউশা বসে আছে। মেয়েটা ওর থেকে একটু খাটো! তবে কী মিষ্টি একটা মুখ!
তুশি জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ এটা কি আপনাদের নিজেদের গাড়ি?”
ইউশা মাথা নাড়ল। সাথে বলল,
“ আমি তোমারই বয়সি। আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না। তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো।”
তুশি খুশি হয়ে গেল। পুরোপুরি ঘুরে বসল এবার।
“ আরিব্বাস,তাহলে তো ভালোই হয়। আচ্ছা গাড়ির ভেতর এসি নেই? ওই যে মেশিনটা ছাড়লে সব ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। সিনেমায় দেখেছি তো বড়োলোকদের গাড়িতে এসব থাকে।”
অয়ন বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। এই গাড়িতে আপাতত ওরা কজন। ইউশা,মিন্তু আর সে। মিন্তু ঘুমে কাদা। বাকিরা কেউ তুশির সাথে আসতে চায়নি। বিশেষ করে ইয়াসির! তখন তুশিকে গাড়ির মধ্যে ছুড়ে রেখে গেলেও, সে অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
তুশির শেষ কথা শুনে চট করে পিছু ফিরল অয়ন। মেয়েটার দু ঠোঁটে হাসির ফোঁয়ারা। আগ্রহ চোখেমুখে। কান্না তো দূর, সামান্য একটু চিন্তা,বেদনা, অস্থিরতা কিচ্ছুটি নেই। উলটে সব বাদ দিয়ে এসির চিন্তা করছে। অয়ন মাথা নাড়ল দুপাশে৷ ফিমেইল পকেটমার যেমন ও আগে দেখেনি,তেমন দেখেনি তুশির মতো এমন শক্তপোক্ত মেয়েকে ! এখানে সত্যিই অন্য কেউ থাকলে হেচকি তুলে গাড়ি ভিজিয়ে ফেলতো। এ কী দিয়ে তৈরি কে জানে!
ইউশা বলল,
“ আছে। কিন্তু আমার সাফোকেটিং হয়। সেজন্যে জানলা খুলে রেখেছি।”
তুশি বুঝল না। এত কঠিন ইংরেজি ও শোনেনি তেমন। কিন্তু অর্থটাও জিজ্ঞেস করা যাবে না। তাহলেই ধরে ফেলবে ও পড়াশোনা জানে না। তবে ওর চোখমুখ দেখেই বুঝে ফেলল ইউশা। হেসে বলল,
“ সাফোকেটিং মানে দমবন্ধ লাগা। ”
তুশি একটু থতমত খেল। চোখদুটো বড়ো হলো কিছু। বাপ্রেহ,
পুলিশের বোন পুলিশের মতোই চালাক। না বলতেই সব বুঝে যায়! এদের সবার সাথে বুঝেশুনে চলতে হচ্ছে তো!
তুশি ফের বাইরে তাকাল। পুরোটা সময় ওকে আরো ভালো করে দেখল ইউশা। মেয়েটা ভীষণ ফরসা! সবচেয়ে সুন্দর ওর নাক। ইউশার মতো বোচা নাক নয়। তবে ওর আর তুশির একটা
আশ্চর্য মিল হলো,দুজনের একই জায়গায় তিল। এই তো নিঁচের ঠোঁট থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে। একটা আজগুবি সত্যি হলো,তুশিকে ইউশার পছন্দ হয়েছে। কেন হয়েছে,কী জন্যে এসবের কোনো কারণ নেই। মেয়েটা বেশ ছটফটে, চঞ্চল। হয়ত তাই!
ইউশা হাতটা বাড়িয়ে তুশির এক হাত ধরল। ফিরল সে। অবাক হলেও হাসল দাঁত মেলে। ইউশা বলল,
“ তোমাকে না আমার বেশ ভালো লেগেছে! তুমি এত স্ট্রং কী করে বলোতো! আবার কত্ত সাহস তোমার বাবাহ৷ সেন্টারে লোকটাকে মারতে অবধি যাচ্ছিলে।”
তুশির চোখমুখ কুঁচকে বসল অমনি। বিরক্ত হয়ে বলল,
“ ওকে যদি আরেকদিন আমি পাই না,একেবারে জ্যান্ত…”
তারপর মাঝপথে থামল । মনে পড়েছে এমন ভাবে বলল,
“ আচ্ছা, ঐ যে আরেকটা খচ্চর মহিলা ছিল না ওখানে? ওই মহিলাটা কি ওই বদ পুলিশের মা?”
ইউশা চোখ পাঁকিয়ে বলল,
“ এ্যাই, ওটা আমার মা।”
তুশি জিভ কাটে।
কণ্ঠ নামিয়ে বলে,
“ সরি,সরি!”
ইউশা বলল,
“ শোনো আমার আম্মু এমনিতে একটু মেজাজি,তবে মনটা খুব ভালো। একবার যদি তোমাকে ভালোবেসে ফেলে,দেখবে খুব আদর করবে৷ কিন্তু এক্ষুনি তা হবে কী না জানি না! আর আমাদের বাড়িতে সবথেকে মাটির মানুষ কে জানো? আমার বড়ো মা,মানে তোমার শাশুড়ী৷ বড়ো মা যে কী চমৎকার একজন মানুষ তুমি দেখলেই বুঝবে।”
তুশি বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল,
“ আর এটা,এটা কে?”
“ উনি হলেন অয়ন ভাই। সম্পর্কে তোমার দেবর।”
তুশি ঠোঁট গোল করে বলল,
“ ওওও৷ বিশাল বড়ো দেবর।”
হেসে ফেলল ইউশা।
জিজ্ঞেস করল,
“ আচ্ছা,তুমি কি সত্যিই টাকার জন্যে বিয়ে করেছ?”
তুশির মধ্যে রাখ-ঢাক নেই। বলল ফটাফট,
“ হ্যাঁ। কিন্তু বুঝতে পারিনি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে। আমি তো আর জানতাম না,কেসের ভেতরে এত বড়ো সুটকেস আছে।”
“ কিন্তু তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না বেশি দুঃখ পাচ্ছো। একটু চিন্তাও হচ্ছে না তোমার?”
“ কীসের চিন্তা?”
“ এই যে একটা অচেনা জায়গায় যাচ্ছো। কাউকে চেনো না,জানো না। জীবনে কখনো দেখোনি। সেখানে হুট করে গিয়ে থাকবে কী করে? আর ভাইয়া যা রাগী,ভাইয়াকে তো চেনো না। মনে হয় না তোমার সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করবে।”
তুশি পোড়া শ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল,
“ বদ পুলিশকে আমি আবার চিনি না! ব্যাটার শিরায় শিরায় গুণ্ডামি।”
মুখে বলল,
“ ব্যবহার নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমরা বস্তির মানুষ। ওসব মুখ ঝামটা আমাদের কাছে ডাল ভাতের মতো। কিন্তু কেউ মারতে এলে সাবধান হ্যাঁ? আমি কিন্তু কুস্তি জানি।”
ইউশা হতাশ শ্বাস ফেলল। তুশি এখনো বুঝতে পারছে না ভবিতব্য কী!
ঘুমে ঢলে পড়া মিন্তুর মাথাটা কাঁধে এনে রাখল সে।
ইউশা ভেতর ভেতর দুশ্চিন্তায় ভুগছে। অয়ন ভাইও তো কেমন চুপচাপ বসে আছেন। ওনারও নিশ্চয়ই চিন্তা হচ্ছে খুব! বাড়ি পৌঁছানোর পর যে কী অপেক্ষা করছে তুশির জন্যে,কে জানে!
দেখতে দেখতে সৈয়দ ভবনের সামনে গাড়ি এসে থামল। সবার আগে নামল অয়ন। তারপর ইউশা। ওদের অনেক আগেই ইয়াসিররা পৌঁছে গেছে বাড়িতে। তুশি তখনো একইরকম বসে। সৈয়দ ভবনের বড়ো বড়ো দেওয়াল দেখেই চোখ দুটো কপালে তার। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
“ এত বড়ো বাড়ি! দৈত্য থাকে নাকি এখানে?”
ইউশা বলল তখনই,
“ কী হলো,নামো?”
তুশির হুশ এলো। দরজাটা খুলতে গেল ঠেলেঠুলে। কিন্তু এত শক্ত! খুলছেই তো না। ওর ধাক্কাধাক্কির মাঝেই এসে খুলে দিলো অয়ন। বলল হাস্যহীন,
“ এসো।”
তুশি প্রসন্ন হলো খুব। এর আগে যখন পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল, কত সুন্দর করে ওষুধের কথা বলেছিল অয়ন!
ও নেমে এসে বলল,
“ আপনি দেখছি মানুষটা ভালো! এবাড়িতে খারাপ শুধু ওই বদ পুলিশ আর ওই..”
মাঝপথেই তপ্ত চোখে চাইল অয়ন। তুশির কথা থামল। নিশানা থেকে বাঁচতে দেখল এদিক-সেদিক।
অয়ন ড্রাইভারকে বলল,
“ গাড়ি রেখে এসো। দারোয়ানকে বলো গেট লক করে দিতে।”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। তুশি চিলের নজরে চারপাশটা দেখছে। মিন্তু ঘুম ঘুম চোখে নেমে দাঁড়িয়েছে কোনোরকম। অত বড়ো ছেলেটা বায়না করছে কোলে ওঠার। ইউশা ধমকাচ্ছে সে নিয়ে। অয়নও ব্যস্ত!
তুশি ভাবল,পালানোর এটাই মোক্ষম সুযোগ। একবার ভো দৌড় দিলে আর কেউ ধরতে পারবে না।
সবকিছু সতর্ক চোখে দেখে নিয়ে যেই পা বাড়াবে,ইউশা ফিরল তখনই।
“ কোথায় যাচ্ছো? দরজা তো এদিকে।”
তুশির উত্তেজনা ফুস করে উবে যায়। পালানো আর হয় না।
মুখ কালো করে বলে
“ কোথায় আর যাব? জাহান্নাম ছাড়া!”
পুরো বাড়ি সাজানো। উঠোনেও লাইটিং এর কোনো কমতি নেই। নতুন বউ আসার খুশিতে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ও ছিল খুব! ইয়াসিরের বউ দেখতে উৎসুক তারা। অথচ সব আনন্দের রেশ মুছে গেল বউ বদলে যাওয়ার ঘটনা কানে গেলে। সেন্টার থেকে বেরিয়েই তনিমাকে সব ফোন করে জানিয়েছেন শওকত।
আপাতত নিশ্চুপ সব।
তুশির স্বতঃস্ফূর্ত পা জোড়া থমকে গেল চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। ভেতরে এক গাদা মানুষ! ওকে দেখেই যাদের সব কটা চাউনি তিরের মতো এসে আছড়ে পড়ল এদিকে।
তুশির চঞ্চল মুখ মিইয়ে যায়। ভড়কায় কিছু।
রেহনূমা খোঁচা মেরে বললেন,
“ ওই যে এসেছেন,মহারাণী।”
তনিমা উঠে দাঁড়ালেন। মলিন চেহারায় একবার আপাদমস্তক দেখলেন মেয়েটার। তারপর ফিরলেন শাশুড়ির পানে। জয়নবের ঠোঁটে হাসি নেই। বাড়িময় কানাঘুষা শুরু হলো । তুশিকে চোখের কোণ দিয়ে মাপছে সবাই। এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন মেয়েটা হয়নি আগে। না চাইতেও কেমন জড়োতা ভিড়ল শরীরে।
তনিমা স্বভাবে ভীষণ নরম মানুষ। কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলা ধাতে নেই। নিচু স্বরে বললেন,
“ দাঁড়িয়ে কেন? এসো।”
সহসা, দুম করে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শওকত। গজগজে পায়ে ঘরের পথ ধরলেন। নীরবে বুঝিয়ে দিলেন,এখন যা হবে এসবে তার তীব্র অনীহা।
আইরিন এক কোণে দাঁড়িয়ে। ইয়াসিরের বিয়েতে সে ইচ্ছে করে যায়নি। মনের মানুষ চোখের সামনে অন্য কাউকে বিয়ে করবে,এসব কী সহ্য করা যায়? তাই শরীর খারাপের ছুঁতো দিয়ে রয়ে গেছিল বাড়িতে। কিন্তু ইয়াসিরের বউ বদলের ঘটনায় মরে যাওয়া খুশিটা ফের এসে তার বুকে চেপে বসেছে।
রেহনূমা বলেছেন মেয়েটা চোর। বস্তি পাড়ায় থাকে। একে ইয়াসিরের জীবন থেকে তাড়ানো ওর যাস্ট বা হাতের খেল। আইরিন তীক্ষ্ণ চোখে তুশির পা থেকে মাথা অবধি দেখল। বস্তির মেয়ে মানে পড়াশোনা জানে না। নিশ্চয়ই মাথা ভর্তি গোবর! একে যদি হাতের ইশারায় না নাচিয়েছে,ওর নামও আইরিন নয়।
তুশি তখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। বুঝতে পারছে না, ও এগোবে কী না! ইউশা
ফিসফিস করে বলল,
“ কী হলো? চলো। বড়ো মা ভালো মানুষ, বলেছি না?”
ও বলল,
“ আমার হাতটা একটু ধরবে? এত উঁচু জুতো পরে হাঁটতে পারি না।”
ইউশা ধরল সাথে সাথে। সেই দৃশ্য দেখেই খ্যাক করে উঠলেন রেহনূমা,
“ অ্যাই, তুই ওর হাত ধরেছিস কেন? ছাড়।”
বাজখাই ধমকে মেয়েটা ভয় পায়। ধরা হাতটা ছেড়ে দেয় তড়িৎ।
কিন্তু ততক্ষণে সামনে পা বাড়িয়েছিল তুশি। তার সম্পূর্ণ ভরসা ছিল ইউশার ধরে রাখা হাতে। তাই হঠাৎ ছেড়ে দেয়ায়,টাল রাখতে পারল না। হিল নড়বড়ে হয়ে পড়তে ধরল অমনি। পাশে একটা নকল বাঁশগাছের মাটির ফুলদানি ছিল। তুশি আসল-নকল বোঝেনি৷ পড়া থেকে বাঁচতে চেপে ধরল ওটাকে। আর ব্যস,ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।
মাটির টবের টুকরো হওয়া দেখেই,ইউশার জিভ বেরিয়ে এলো বাইরে। উড়ে গেল মিন্তুর ঘুম ঘুম চোখ। মাথায় হাত দিলেন জয়নব। সকলের চমকে যাওয়ার মাঝে রেহনূমা আর্তনাদ করে বললেন,
“ দিলো রে দিলো! আমার এত সাধের ফুলদানিটা এসেই ভেঙে দিলো? এটা মেয়ে না করাত! ওরে সার্থ, তুই কেন একে নিয়ে এলি?”
তুশি সংকীর্ণ আদলে বলল,
“ সরি! আমি কী ইচ্ছে করে ডুয়িং নাকি! ইট একসিডেন্টিং।”
“ চুপ করো মেয়ে। এটার দাম জানো তুমি?”
সাইফুল অতীষ্ঠ হয়ে বললেন,
“ না, এসব নেয়া যায় না। আম্মা,তুমি কিছু বলছো না কেন?”
জয়নাব বললেন,
“ কী বলব আমি এখানে? দাদুভাই যেখানে বউ নিয়ে এসেছে সেখানে তো আমার বলার কিছু নেই। তাছাড়া মেয়ে যেমনই হোক,বিয়ে তো আর অস্বীকার করা যায় না।”
ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“ মানে! এই মেয়েটা তাহলে এখন থেকে এখানেই থাকবে?”
তুশি ঠায় বসে আছে। এক ঘর লোক তার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে। বিয়ের প্রথম দিন শ্বশুর বাড়িতে এসে আছাড় খাওয়া বউতো আর কেউ ইতিহাসে দেখেনি। ইউশা মায়ের ভয়ে ধরতে পারছে না।
অয়ন বহু আগেই ঘরে চলে গেছে৷ তার এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তনিমা নিজেই এগিয়ে এলেন।
হাত পেতে বললেন,
“ ব্যথা পেয়েছ? উঠে এসো।”
তুশির ভালো লাগল। হাতটা ধরে উঠে এলো অমনি।
ঠোঁট উলটে বলল,
“ আমি সত্যিই ইচ্ছে করে…”
মাথপথেই থামালেন তিনি,
“ আমি বুঝতে পেরেছি। ইচ্ছে করে কেউ কিছু ভাঙে না। কোথাও ব্যথা লেগেছে তোমার?”
“ না।”
রেহনূমা বললেন,
“ আপা,তুমি ও মেয়ের মুখ দেখে গলে যেও না। সেন্টারে এর আসল রূপ যদি দেখতে, তাহলে বুঝতে। আমি বলছি শোনো, সার্থকে বোঝাও। কীসের বিয়ে কীসের কী! বের করে দিক এটাকে। আমার তো একে সহ্যই হচ্ছে না।”
তুশির মেজাজ খারাপ হলেও, একটা কথায় মনে মনে একমত।
সেটা হলো,একে বের করে দিক। দিলেই ভালো। তাহলে ও সোজা বাড়ি ফিরে যাবে।
তুশি চোখ ঘুরিয়ে পুরো বসার ঘরটা দেখল এক পল। কোথাও ইয়াসির নেই। নজর ফিরল
তনিমার কথায়। বললেন,
“ তুই একটু শান্ত হ ছোটো। বললেই তো আর হয় না। ও কী ছিল সেসব ভুলে যা। ওর এখন একমাত্র পরিচয় ও এই সৈয়দ বাড়ির বউ । বউ মানুষকে চাইলেই তো আর বের করে দেয়া যায় না। বিয়ে যখন হয়েছে, একটু মানিয়ে-গুছিয়ে নে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই যা, মিষ্টি নিয়ে আয়।”
রেহনূমা প্রকট চোখে চাইলেন,
“ তুমি কি একে এখন মিষ্টি খাওয়াবে নাকি?”
“ আমাদের বাড়ির যা নিয়ম,তা করতে হবে না?”
রেহনূমার ভীষণ রাগ হল। কিন্তু রা করলেন না জায়ের ওপর। দাঁত চেপে গেলেন মিষ্টি আনতে। তুশি চিন্তায় পড়ে গেল।
ঠোঁট কামড়ে ভাবল,
“ খচ্চর মহিলাটা যা চেতে আছে! আবার আমার মিষ্টিতে বিষ মিশিয়ে দেবে না তো!”
রেহণূমা মিনিট কয়েকে ফিরে এলেন। একটা পিরিচে দুটো মিষ্টি আর চামচ নিয়ে হনহনে পায়ে এসে দাঁড়ালেন আগের জায়গায়। তনিমা জয়নবকে ডাকলেন,
“ আম্মা,আসুন।”
বৃদ্ধা লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে এলেন ওপাশ থেকে। ইউশা তুশিকে ইশারা করল বসতে।
তুরন্ত বসে পড়ল মেয়েটা। জয়নব
ফোস করে শ্বাস ফেলে বললেন,
“ দেখো মেয়ে, বিয়ে কীভাবে হয়েছে না হয়েছে আমি ওসব কথায় যাবো না। আমার কাছে সব কিছুর উর্ধ্বে হলো তুমি আমার ইয়াসিরের বউ। এ বাড়ির সম্মান এখন তোমারও হাতে। সব কিছু সামলে সংসার কোরো। খেয়াল রেখ, তোমার জন্য যেন আমাদের কাউকে কখনো বেইজ্জতি হতে না হয়!”
আইরিন ভেঙচি কাটল।
রেহনূমার বিরক্ত লাগল এসব। সাইফুল আশাহত চিত্তে মাথা নেড়ে গেলেন। মা আর ভাবির এসব ভালোমানুষি নেয়া যায় না!
অথচ তুশির কানে একটা কথাও গেল না। ও হাঁ করে জয়নবের গলার দিকে চেয়ে রইল। একটা মোটা চেইন চকচক করছে সেখানে। ক ভড়ি সোনা আছে এতে? তুশির হাতের আঙুল নিশপিশ করে উঠল। চোখদুটোতে লোভাতুর ভাব।
জয়নব চামচ দিয়ে একটা মিষ্টি কাটলেন। কিন্তু তুশি দেখছে অন্য কিছু। যেখানে মিষ্টি নেই,জয়নব নেই। শুধু একটা মোটা স্বর্ণের চেইন হাওয়ায় ভেসে আসছে। তুশি নড়েচড়ে উঠল ওটাকে খপ করে ধরতে। তুরন্ত ওর হাতটা চেপে ধরল ইউশা।
কণ্ঠ চেপে বলল,
“ চুপ করে বোসো। কী করতে যাচ্ছিলে?”
তুশি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ফিরে আসে নিজেতে। সর্বনাশ! ও ফের চুরির কথা ভাবছিল? লোভের বশে ভুলেই গেছিল ও এখন সাক্ষাৎ পুলিশের বাড়িতে। জয়নব মিষ্টি মুখের কাছে আনলেন,আচমকা হাতটায় ধাক্কা মারল কেউ একজন।
চামচটা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চমকে উঠল সকলে।
হকচকিয়ে ফিরলেন প্রৌঢ়া। ইয়াসির দাঁড়িয়েছে এসে।
পরনের শেরওয়ানি পালটে আঁটোসাঁটো টিশার্ট পরেছে এখন।
তুশির মিষ্টি খেতে ফাঁকা করা ঠোঁটটা অমনি বন্ধ হয়ে গেল। মেজাজও খারাপ হলো ভারি! ব্যাটা বদ, এমন কেউ করে? আরেকটু পরে এলে কী হোতো!
তনিমা আর্তনাদ করে উঠলেন,
“ এটা কী করলি?”
ইয়াসিরের কপালে ভাঁজ।
“ ওকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছিলে কেন? ও কি এ বাড়ির বউ! তোমার কী মনে হয়,একটা বস্তির চোরকে আমি আমার বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি?”
নীরস রেহনূমা তটস্থ হলেন অমনি। শশব্যস্ত বললেন,
“ মেনে নিসনি? তাহলে তুই ওকে নিয়ে এলি কেন?”
তনিমা,জয়নব একে-অন্যের মুখ দেখাদেখি করলেন। বিভ্রান্ত তারা।
বৃদ্ধা খুব শান্ত গলায় বললেন,
“ কী হয়েছে,দাদুভাই?”
ইয়াসির জবাব দিলো না। রেহনূমাকে পালটা প্রশ্ন করল,
“ এ বাড়িতে মেইড সার্ভেন্ট কজন ছোটো মা?”
ভদ্রমহিলা ভড়কালেন একটু। প্রশ্নের আগামাথা বুঝলেন না। তাও উত্তর দিলেন থেমে থেমে,
“ দু দুজন।”
ইয়াসির ঘোষণা করল দরাজ স্বরে,
“ ওদের ছুটি দিয়ে দাও। কাল থেকে বাড়ির সমস্ত কাজ এই মেয়েকে দিয়ে করাবে।”
তুশির চোখ বেরিয়ে এলো। উঠে দাঁড়াল তড়াক করে। সাইফুল অবাক হয়ে বললেন,
“ কী বলছিস সার্থ! তুই কি এসবের জন্যে মেয়েটাকে এ বাড়িতে এনেছিস? কিন্তু তুই যে তখন বললি সংসারের কথা!”
জবাব এলো তৎক্ষনাৎ ,
“ একটা চোরের সাথে কীসের সংসার? ওকে এনেছি টাকার জন্যে বিয়ে করার মজা বোঝাতে। বাই দ্য ওয়ে, আমার কথার যেন কোনো নড়চড় না হয়। আমি আবারও বলছি ও এ বাড়ির বউ নয়। এই বিয়েই মানি না আমি। তাই কেউ একে কোনো দয়া দেখাবে না।
আর ছোটো মা, তুমি খেয়াল রাখবে এই চোর যেন কোনোমতেই বাড়ির বাইরে যেতে না পারে।”
রেহনূমা প্রফুল্ল চিত্তে মাথা নাড়লেন। খুশিতে টগবগ করছেন তিনি। আইরিন ঠোঁট চেপে হাসছে। কিন্তু ইউশার মায়া হলো খুব! প্রহৃত চোখে একবার দেখল তুশিকে।
সে মেয়ে স্তব্ধ! হতবাক!
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১২
চোখের পাতা পড়ছে না। বিস্ময়ে শুধু হাঁ করে রইল। ইয়াসির তক্ষুনি ফিরল তুশির দিকে। সূক্ষ্ণ নেত্রে তার জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। প্রতি কথায় ঠিকড়ে দিয়ে বলল,
“ বিয়ের খুব শখ না তোমার?”
তারপর ঠোঁটের কোণ তুলে বক্ররেখার ন্যায় হাসল ইয়াসির। কণ্ঠে রাগ -বিদ্রুপ একসাথে শোনাল,
“ নাউ গেট রেডি মিস তুশি। এএসপি ইয়াসির আবরারের খপ্পরে পড়লে কী অবস্থা হয়,প্রতিদিন টের পাবে।”