রং পর্ব ৬০

রং পর্ব ৬০
তন্নী তনু

পরবর্তী রাত,
মাঝরাত ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় গাড়ি সজোড়ে হাঁকিয়ে আধারের কালো ছায়ার সুযোগে গা ঢাকা দিয়ে অবৈধ পথে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা,গাড়িতে বসে প্রভাতরঞ্জনের চৌকস চোখ দুটো নজরদাড়ি করছে, আধারে স্বপ্নের বাস্তব রূপ চোখ দুটোতে জ্বলজ্বল করছে। বন্দি, ভয়ানক জীবন একটুখানি চাবি ঘুরাতেই চোখের পলকে বদলে যাবে সব, সপ্ন সত‍্যিতে বদলে যাবে, মুক্তির আগে সে সত‍্যিই দিধাদন্দে ছিলো।তবে আরেকটু খানি পথ। সে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে গা ঢাকা দিবে, অন্ধকারে কালো জগতে মিলিয়ে যাবে সে গর্ত থেকে আর কেউ তাকে বের করতে পারবে না। হদিস ই পাবে না, কল্পনার ইন্দ্রজালে হিহি করে হাসে প্রভাতরঞ্জন। গাড়িতে বসে আছে মাফিয়া দলের বস, আছে তপন চৌধুরী, আরোও অনেকেই। মনের আনন্দে ছটফট করছে গাড়িতে থাকা কালো জগৎ সৃষ্টির অধিপতি। অন্ধকারাচ্ছন্ন গাড়ির কালো কাচ দেয়াল ভেদ করে মনের আনন্দে তাকিয়ে থাকে প্রভারঞ্জন সরকার। সহসাই মৃদু শব্দে কেঁপে ওঠে মুঠোফোন। শত্রুপক্ষকে ধ্বংসের পরিকল্পনার যে জাল পেতে এসেছিলো তা বাস্তবায়নের ডাক এসেছে। মুঠোফোন কানে ঠেকায় আয়েশী ভঙ্গিতে। স্ক্রিনের মৃদু আলো পাকা পাকা ছাটা দাড়িতে পড়ে। ওষ্ঠের কোণে পৈচাশিক হাসি। গলায় গম্ভীরতা,

— প্ল‍্যান ঠিকঠাক?
অপরপ্রান্তে টেনে টেনে কেউ বলে,
— জ্বি বস! এসপি সাব আজ বাড়িতেই ঢোকেনি। কাল ছিলেন মধ‍্যরাত পর্যন্ত।
— ওদের একটাকেও ছাড়বি না। ঝাঝড়া করে দিবি। সকালে উঠে যখন হারামজাদা নিজের পরিবারের রক্তে ডুবে মরবে তখন আমার জ্বালা কমবে। শালা, আমার সাথে লাগতে আসোস! ভালোবেসে তোকে শুধু তোকে সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম। মারতে তো চাইনাই। তুই নিজে মরার জন‍্য আকুপাকু করছিস। এখন একটা একটা করে মারবো। সবাইকে মারবো। শোন ! এমন ভয়ানক ভাবে মারবি,পিছপিছ করবি যাতে আন্দাজও করার যায় না কোনটা কার হাড় কোনটা কার মাংস।
— চিন্তা করবেন না বস। আপনি সাবধানে যাবেন।
–হাড়গোড় ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবি ঐ কু** বা**র। জানো** বা***। কর্ণেলের র!ক্তে আমার হয়ে স্নান করে আসিস। ওর গোস্ত গুলো কু!ত্তা দিয়ে খাওয়াবি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— জ্বি হুকুম জাহাপোনা। সব আপনার হুমুম মতোই হবে। কাম শুরু কইরা দেই।
ফোন কেটে দেয় শয়তানটা। দলবল নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পায়চারী করে। পূর্ব পরিকল্পনা আর কষে রাখা ছকের খেলা শুরু হয়। গাছের উপরে উঠে আশে পাশের সিসি ক‍্যামেরায় জড়ানো হয় কালো কাপড়। সুকৌশলে কেটে দেয় কারেন্টের তার। অন্ধকারে তলিয়ে যায় ইরফাদের স্বপ্ন ঘেড়া বাড়িটা।
ঘুমের অতলে হারিয়ে গেছে রিদুয়ানুর রহমান। টুম্পাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে ইভা। একজোড়া হৃদয়ের একখন্ড বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিছানায় চোখ ভারী হয়ে আসা সত্ত্বেও চোখজোড়া ঘুমের অতলে হারাতে পারছে না। এপাশ ওপাশ করে কাটছে রাত সিনথিয়ার। হঠাৎ করেই কক্ষের ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ রূপান্তরিত হচ্ছে, গরম হয়ে উঠছে কক্ষ। ধীরে ধীরে উঠে বসে সিনথিয়া। এয়ারকন্ডিশনার টা বন্ধ। ফোনের টর্চ জেলে লাইটের সুইচগুলো চাপে সিনথিয়া। “লোডশেডিং! এখন?” কখনো তো হয় না?”

ভাবুক মন নিয়ে কক্ষ জুড়ে পায়চারী,আবদ্ধ দেয়াল শ্বাস রোধ করে নিচ্ছে। জানালার পর্দা গুলো ধীরে ধীরে টেনে দেয় সিনথিয়া, খুলে দেয় জানালার কাচ দেয়াল। সামনের ফ্ল‍্যাটের মৃদু আলো চোখে পড়তেই কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ে সিনথিয়ার। ঐখানে আলো জ্বলছে? তাহলে তাদের বাসা অন্ধকার কেনো?
একদল শয়তান গাছের উপরে দাঁড়িয়ে মোটা রশি গোল গোল করে পেঁচায়। তার পরে শক্তিশালী হাতে রশিটা এক ছুঁড়ে মারে উপরদিকে। লক্ষভ্রষ্ট রশি ফেরত আসে কয়েকবার। ছুড়তে ছুড়তে একবার লক্ষ্য পৌঁছে যায়, রেলিং এ একদম ঠিকঠাক বাজে বাকানো ইউ আকৃতির লোহাটা। রেলিং বাঁকানো লোহা আটকে জোড়ালো শব্দ হয় । অন্ধকারাচ্ছন্ন,নিরব রাতে সে শব্দ কানে আসে সিনথিয়ার। সহসাই কান পেতে থাকে সেদিকে। বুকের মধ‍্যে অশনী সংকেত উতলা পাড়ে। হঠাৎ নৈঃশব্দ! লোডশেডিং! অন্ধকার! তারপর জোড়ালো শব্দ! বিপদ সংকেত!

শা শা শব্দ তুলছে বাতাস। অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে সে বাতাস শরীরে মাখছে প্রভাতরঞ্জন সরকার। স্নিগ্ধ বাতাশ, আধার রাতে পুলকিত হচ্ছে তার অন্তরাত্মা। বুকের খাঁচায় কয়েক শব্দের গোছানো বাক‍্যখানা অহমিকার সুর তুলে বাজছে–” এসপি! শেষ রক্ষা হলো না। শেষ অবধি ধরে রাখতে পারলি না। হেরে গেলি এসপি! হাহাহা”
আধারে ডুবানো রাস্তা, রাস্তার ধার ঘেষে লম্বা লম্বা গাছ গুলো এক এক করে পেছনে চলে যাচ্ছে। পেছনে চলে যাচ্ছে ভয়-ভীতি আশঙ্কা। এইতো স্বপ্নের পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। গাড়ির হলদেটে আলোটা যতদূর পৌঁছায় ধূ ধূ শূন‍্যতা। মাঝ রাত্রি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর কখোনো নৈঃশব্দ!

প্রভাত রঞ্জন আয়েশ করে বসেন, ঠান্ডা ঠান্ডা আবহে রসে রসে সিগারেট টানেন। গাড়ি চলছে চাঙ্গা গতিতে। গাড়িতে বসে বসে শুরু হয় মদের আসর। ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া উড়িয়ে টানেন সিগারেট। গাড়িতে নেশায় মত্ব মাফিয়াদের ঘোর লাগা অবস্থা। অকস্মাৎ ব্রেক কষে ড্রাইভার! হাতের স্বচ্ছ গ্লাস গুলো থেকে ছিটকে পড়ে তরল। হঠাৎ ব্রেক করায় স্বচ্ছ গ্লাস থেকে তরল ছিটকে পড়ে, কারো কারো কপাল ছিটকে এসে বাড়ি খায় সামনের শক্ত সিটের সাথে। প্রভাত রঞ্জনের বিকট গর্জন,

— শালা! শু*** বা** ব্রেক করলি ক‍্যান?
মাফিয়া ড্রাইভারের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ। থমথমে গলায় বলে,
— বস! কিছু দেখলাম মনে হয়।
— নেশায় ধরছে শু**র! গাড়ি চালা।
প্রভাতরঞ্জনের কথা মতো গাড়ি স্টার্ট দেয় মাফিয়া দলের ড্রাইভার। আবারো মত্ত হয় নেশায় সকলে। গাড়ির হলদেটে আলো গড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। হলদেটে আলোতে পোকার দল খেলা করছে। আলো শেষ হয়ে যাওয়া মৃদু আলোয় ধরা দেয় এক ভৌতুক অবয়ব। বুকের রক্ত ছলকে ওঠে ড্রাইভারের। থমথমে গলায় ডাকে,

— বস দেখুন! ঐটা কি?
প্রভাতরঞ্জনের বিরক্তিকর বুলি,
–আরে শালা! মদ টাও তোর জ্বালায় গিলতে পারবো না নাকি?
গাড়ি স্পিড কমায় ড্রাইভার। ভয়ার্ত গলায় বলে,
— আরে ব‍্যাটা মদখোড়! সামনে তাকা।
গাড়ির মাফিয়া দল চেতে ওঠে ড্রাইভারের উপর। পেছন থেকে ফটাফট কয়েক দফা কিলঘুষি চালায়। থেমে যায় গাড়ি। প্রভাতরঞ্জন লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয় ড্রাইভারকে। অতঃপর নিজেই বসে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টারট নিতেই হেলে দুলে মনের সুখে গাড়ি চালায় প্রভাত রঞ্জন। আবার গানও ধরে বেসুরে গলায়। গাড়ির গতি মন্থর! রাস্তায় গড়িয়ে পড়া আলোর শেষ প্রান্তে কালো পোশাকে আবৃত কোনো এক অবয়ব লম্বা পা ফেলে হাঁটে। ঘোলা চোখে ভুতুড়ে অবয়ব ধরা দিতেই ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো মুছে নেয় প্রভাতরঞ্জন। গাড়ি র স্পিড বাড়ায়। আলো যতো সামনে এগিয়ে যায় অবয়বটি ধীরে ধীরে নাই হয়ে যায়। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খোঁজে প্রভাতরঞ্জন। ধূ ধূ শূন‍্যতা! নৈঃশব্দে তলিয়ে যায় চারপাশ। অজান্তেই হাত পায়ের লোম গুলো দাঁড়িয়ে যায়। বুকে পাথর চেপে ধরে। কে ছিলো?

অনেকটা পথ পাড়ি দেয় আবার। মনের ভয় ভীতি দূরে ঠেলে আবারো স্বপ্নের মজলিসে ডুবে যায়। গাড়ি চারদেয়ালে জমে ওঠে মদের আসর। স্ট্রিয়ারিং ঘুড়ানোর তালে তালে প্রভাত রঞ্জন সিগারেট টানে। আয়েশী ভঙ্গিতে ধোঁয়াগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে তার সাথে উদ্ভট চিন্তাগুলোকেও উড়িয়ে দেয় আকাশে। সহসাই দ্বিতীয় বারের মতো আত্মা কেঁপে ওঠে প্রভাতরঞ্জনের। অকস্মাৎ আবারো জোড়ালো ব্রেক!
সকলের চোখে প্রশ্ন। আলোর শেষ প্রান্তে কালো পোশাকধারী অবয়ব,পরণে কালো কুচকুচে চিকচিকে পোশাক, উঁচু কলার,লম্বা কোর্ট, কালো কুচকুচে হাইবুট খটখট আওয়াজ তুলে সামনের দিকে তুফান তুলে হাঁটছে, বুটের সাইড জিপার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, বেগতিক মাতাল হাওয়া, লম্বা কোর্ট বাতাসে উড়ছে, হচ্ছে ধূলোঝড়, স্বাভাবিক পরিবেশে টালমাটাল তান্ডব,ভৌতিক জগতের অশুভ উপাখ‍্যানের যেনো বাস্তব সূচনা, গথিক ভূতুড়ে রাজ‍্যের ভ‍্যাম্পায়ার টুপ করে বাস্তব জগতে তুফান তুলে দিচ্ছে। প্রভাতরঞ্জনের কপাল চুইয়ে পড়া দুঃচিন্তারা শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। গাড়িতে মাফিয়া দল শক্ত ঢোক গেলে। অতঃপর সাহসের সঞ্চয় করে বাকিরা,

— বস গাড়ি চালিয়ে দেন উপর দিয়ে। শালাকে উপরে পাঠিয়ে দেন।
গাড়ি স্টারট দেয় প্রভাতরঞ্জন! গাড়ির গতি বাড়াতেই ম‍্যাজিকের মতো নাই হয়ে যায় ভুতুড়ে অবয়ব। পরপর আরো কয়েকবার একই অবয়ব এর সম্মুখীন হয় গাড়িটা। একই ভাবে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। অতঃপর সমস্ত চিন্তাকে উপেক্ষা করে ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালায় প্রভাতরঞ্জন সরকার। ঠিক সে সময়ে তুমুল ঝড়ের বেগে বাইক ক্রস করে যায় প্রভাত রঞ্জনের গাড়ি। কালো বাইক, লম্বা কোর্ট পরিহিত সুঠাম দেহের অধিকারী অবয়ব, আবারো সেই হাই বুট, মাথায় ক‍্যাপ। একটান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে যায় ঝড়ের গতিতে,তারপর হঠাৎ ব্রেক! জোড়ালো ব্রেক!

হঠাৎ জোড়ালো ব্রেকেই বাইকের পেছনের চাকা তুঙ্গে উঠে যায়, সেকেন্ড সময় পর মাটি কাঁপিয়ে আছড়ে পড়ে সে চাকা, ভূমিকম্প!!তুফান তোলা ভুতুরে রুপের অববয় বাইক থামিয়ে পিছু ফিরে চায়, মুখে কালো মাস্ক, চোখে গগলস,মাস্কে নিচ থেকে পৈচাশিক হাসিটুকু যেনো আগুনের গোলার মতো ঠিকরে বের হয়। গাড়িতে ব্রেক কষে প্রভাতরঞ্জন। সামনের বাইকটি চলতে শুধু করে আবারো ঝড়ের গতিতে। এরপর নাই হয়ে যায়। মাফিয়া দল হা হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
প্রভাতরঞ্জনের গাড়ির পেছন দিকে একঝাক আলোকদ‍্যুতি দিনের আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। প্রভাতরঞ্জন পিছু ফিরে তাকায়। পিছন ঘুরে বসে বাকিরাও। আলোকদ‍্যুতির সাথে আরেকটি বাইক আর রোডের ঘর্ষনে সৃষ্ট শব্দ হাওয়ার বেগে এগিয়ে আসে। সামনে বাইক পেছনে বাইক মাঝখানে সাগরে পড়ে হাতরাচ্ছে প্রভাতরঞ্জন! কোনদিকে যাবে এখন?

আলোকদ‍্যুতি নিয়ে তুফান তুলে পেছনের বাইকটি আরেকবার ক্রস করে যায় কুচকুচে বড় গাড়িটিকে। আবারো পূর্বের মতো হঠাৎ ব্রেক করে বাইক! সেই আগের মতো লম্বা কোর্ট, বুট তবে মাথায় কালো ক‍্যাপ। থেমে যাওয়া বাইকের পেছনের চাকা শূন‍‍্যে ওঠে, পেছনের চাকাটা পিচঢালা রাস্তায় আছড়ে পড়ে। পূর্বের ন‍্যায় এইবারেও পিছু ফেরে ভুতুরে অবয়ব। আবারো কালো মাস্ক, চোখে সেই গগলস, মাস্কের আড়ালে পৈচাশিক হাসি যেনো চোখ এড়ায় না সবার। পূর্বের ন‍্যায় এইবারেও বাইকটি গিয়ার তুলে নাই হয়ে যায়। দুরু দুরু বুকে গাড়ি চালায় প্রভাতরঞ্জন। তার বুকের গহীনে ষষ্ট ইন্দ্রীয় যে ঝড় তুলেছে তা থামবার নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে গাড়ির গতি বাড়ায় প্রভাতরঞ্জন। মিনিট পাঁচেক পর- তুফান তুলে তার গাড়িকে ক্রস করে আরেকটা বাইক। পূর্বের বাইক দুটোর তুলনায় এই বাইকের গতিবেগ ভিন্ন- যেনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে পিচঢালা রোডের উপরে, ঝড়ের বেগে খুলে যাচ্ছে পরণের লম্বা ঢিলেঢালা কোর্টটা। তুফান তুলে যাওয়া বাইকটি পূর্বের ন‍্যায় থামে না, পিছুও ফেরে না।

প্রভাতরঞ্জনের অন্তরাত্মা বলে দেয়– এই ঝড়! তুফান- জলোচ্ছাস! কেবল ইরফাদের! রক্তহীম করা গতি, চলন তার পরিচিত। সাথে সাথে স্ট্রিয়ারিং ঘুরায় প্রভাতরঞ্জন, অন‍্য পথে হাঁকিয়ে চালায় গাড়িটি। অনেকটা পথ পেড়িয়ে যায়, পিছু ফিরে তাকায় বারংবার। না আর দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির স্পিড কমিয়ে ফোঁস ফোঁস করে সস্তির শ্বাস ছাড়ে প্রভাতরঞ্জন। সহসাই সেই ভয়ানক শব্দ আবারো রাক্ষুসে গতিতে তেড়ে তেড়ে আসে। এইবারের শব্দ ভিন্ন, পেছন ঘুরে তাকায় সবাই। ত্রিভুজ আকারে জায়গা নেয়া তিনটা বাইক। একটা সামনে বাকি দুটো পেছোন পেছোন ছুঁটে ছুঁটে আসছে, জলোচ্ছাসের মতো ধেঁয়ে আসছে তিন তিনটা বাইক। কে ওরা! ইরফাদ! জাবির! আর কে? সারাফি শিশির?
আলোয় আলোয় খা খা করছে চারপাশ। তালগোল পাকিকে স্ট্রিয়ারিং ধরে প্রভাতরঞ্জন, পাগলা ঘোড়ার মতো দাপিয়ে চালায় গাড়ি। পেছনে বাইক তিনটা জলোচ্ছাসের মতো ভেঙ্গে চুড়ে সব বিলীন করে ছুটে আসে। গাড়ির স্পিড বাড়ে, এলোমেলো সাপের মতো ঢেউ খেলে যায় গাড়ি,গাড়িতে থাকা মাফিয়ার দল ঝড়ের দাপটে লন্ডভন্ড! জলোচ্ছাসের দাপটে ভেঙে চুড়মার।

একছুটে চলে গাড়ি! গাড়ির পেছনে তুফান বাইকের! এভাবেই চলছে ঘন্টাখানেক। প্রভাতরঞ্জনের গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। শক্ত হাতের বাঁধন থেকে ফসকে যায় স্ট্রিয়ারিং, আবারো তাল সামলে নেয়। একে একে তুফান তুলে বাইকগুলো সামনে চলে যায়। বাইকের তালে তালে জোড়ালো শব্দে বাজে,”Dhoom Machale Dhoom !”
গরম ধোঁয়া ওঠানো বাইকগুলো এক এক করে থেমে যায়, তাল সামলাতে না পেরে আঁকাবাঁকা এলোমেলো ভাবে চলন্ত গাড়িটি জোড়ালো ধাক্কা খায় লম্বা মোটাসোটা গাছের সাথে। ছিটক খুলে যায় গাড়ির কাচ জানালা। ভেঙে ছিটকে ছিটকে পড়ে কাচ। ছিটকে পড় প্রভাতরঞ্জন! বাকিরা রক্তাক্ত হয়ে গাড়িতেই মিশে থাকে।

ধুলোঝড়, উত্তপ্ত হাওয়া পিচঢালা পথে দাঁড়িয়ে তিন তিন জন শক্তিধর অবয়ব। যারা জলোচ্ছাসের গতিতে ধেয়ে আসে। কালো লম্বা কোর্ট, চোখে আগুন,মগজে ধার, আর হৃদয়ে হিংস্রতা, হাতে ধারালো চাপাতি ছুড়ি হাতে ধেয়ে আসছে তুফান তুলে। প্রভাত রঞ্জন জান নিয়ে পালাতে পেছনের দিকে ছিটকে দৌঁড়াতে থাকে। মাঝখানের সুঠামদেহী তুখোড় মগজাস্ত্র, শত্রু দমনে অস্ত্রধারী ইরফাদ তুফানের গতিতে এগিয়ে আসে গাড়ির সামনে। ইস্পাত কঠিন হাতের দমনে নাজেহাল মাফিয়া দলের একজন। প্রভাতরঞ্জন তখন ছিটকে পালাচ্ছে। সেদিকে শক্ত রড হাতে ধেঁয়ে যাচ্ছে জাবির। শিশির বাইক থেকে নামায় গোলাকার গাছের গুড়ি, চাপাতি হাতে বসে থাকে অপেক্ষায়।
নিরব শুনশান তলানো পরিবেশ, ফাঁকা রাস্তা। মাফিয়া দলের একজনের গলা চেপে ধরে ইরফাদ। গাড়ি থেকে এক টানে ফেলে রাস্তায়, লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে চায়। ইরফাদের বাক‍্যহীন প্রতিশোধ। হাতের ধারালো চাপাতি জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারে। সেই ধারালো অ/স্ত্রতে ছিন্নভিন্ন করে শয়তানের বাম হাতের কব্জি। খন্ডিত অংশ ছুড়ে দেয় শিশিরের দিকে। গোলাকার গাছের গুড়ির উপর খন্ডিত অংশ ফেলে কুচিকুচি করে শিশির।
হাতের বাকি অংশে আরেকবার কোপ দেয় ইরফাদ,

বৃষ্টির ঝাপটার মতো র@ক্ত ছিটকে আসে ইরফাদের চোখ মুখে। লোকটির গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস। সে চিৎকার উপেক্ষা করে আরেকবার কোপ দেয় মাফিয়ার ডান বাহুতে। গগনবিদারী চিৎকার আরেকবার। র!ক্তে র! ক্তে ঢেকে যায় ইরফাদের চোখ মুখ,কালো পোশাক। চিৎকারে চিৎকারে কাঁপছে আকাশ-বাতাস, জীব জন্তু গুলোও কোথাও হয়তো গা ঢাকা দিয়েছে। গুরুগম্ভীর ইরফাদের ধারালো অস্ত্র চলে আরেকবার। সেই সাথে বিকট গর্জন,

— এই হাতে ছুঁয়েছিলি না ? এই হাতে?
বলেই রক্তাক্ত হাতে আরেকবার কোপ দেয়।লোকটির শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায় বাহু। মাফিয়া দলের লোকটির গলায় আর্তনাদ, আকুতি।
–আমাকে একবারে মেরে ফেলুন!
ফলেই গগনবিদারী চিৎকারে ফেঁটে পড়ে। বাইকে সাইডে বেঁধে আনা সাউন্ড বক্সটাতে ফুল স্পিডে গান ছাড়ে শিশির। শয়তানের আত্মচিৎকার চোখ বন্ধ করে অনুভব করে। আহ! শান্তি! শান্তি! কিযে শান্তি প্রতিশোধের!
আহত ক্ষত বিক্ষত লোকটির ভয়াল চিৎকার,
— জানে মেরে ফেলুন! আমাকে জানে মেরে ফেলুন!
ইরফাদ হাতের ধারালো চাপাতি মাটিতে গেঁথে রাখে, ছোট চাপাতিটা চেয়ে নেয় শিশিরের থেকে। শয়তানের একটা একটা করে কাটে পায়ের আঙুল, পায়ের পাতা। রক্তের ফোয়ারায় বন‍্যা বয়ে যায়। চাপাতির আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মাফিয়ার শরীর। রক্তের বৃষ্টিতে স্নান করে ইরফাদ। ছিটকে আসা রক্তের ঝাপটায় ইরফাদের মুখ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে শয়তানের লাল টকটকে র!ক্ত!

রং পর্ব ৫৯

চিন্তিত সিনথিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে পায়চারী করছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে, নির্ঘাত বিপদ! মোমের ঝাড়বাতিটি নিরবে জ্বালায় সিনথিয়া। হলদেটে টিমটিমে ঝাড়বাতিটি নিয়ে মন্থর গতিয়ে কক্ষের বাইরে যায় সিনথিয়া। সিঁড়ির এপাশ, ওপাশে চোখ বুলায়। সমস্তবাড়ি তন্ন তন্ন করে চোখ বুলায়, এপাশ ওপাশ নিরবে হাঁটে। অতঃপর নৈঃশব্দ! নিরবতা! ধেঁয়ে আসছে অচেনা শব্দ! পায়ের শব্দ! বুকের খাঁচা থেকে কিছু একটা ছটফট করে ওঠে! কি হচ্ছে? কে আসছে?

রং পর্ব ৬০ (২)