প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২১

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২১
মিমি মুসকান

২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। প্রান্তিক চৌধুরীর কাছে প্রিয়তার এখনো কোনো খবর নেই। প্রথমে সে ভেবেছিলো প্রিয়তা বোধহয় বাবার বাড়ি গেছে। কিন্তু এখানে আসার পর জানতে পারে সে এখানে আসেনি। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সবার বাড়ি খোঁজ করা শেষ। এসব খোঁজ করতেই একদিন পেরিয়ে গেল। ভোরের আলো ফুটছে আবারো। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, পুরো একটি দিন প্রিয়তার মুখ দেখেনি সে। চোখাচোখি হয়নি তাদের। প্রিয়তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে। প্রিয়তার বাবার অ’বস্থা খুব খারাপ। মেয়ের খবর না পেয়ে তিনি ভীষণ অস্থির হয়ে আছেন। এভাবেই প্রেসার লো তার মধ্যে আবার অস্থিরতা। পুরোটা রাত ঘুমায় নি। ভোরের দিকে প্রিয়তার মা জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে ঘু’মাতে পাঠিয়েছেন।

প্রিয়তার মা বেশ শক্তপোক্ত মানুষ। স্বামীর এমন অবস্থায় এই খবর শুনে তিনিও যথেষ্ট ভেঙে পড়েন কিন্তু হাল ছাড়েননি। কিভাবে ছাড়বেন? তার উপর এখনো তিনটে মেয়ের দায়িত্ব পড়ে আছে। এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলে হবে?
মেয়ে তিনটে সারারাত ঘুমায় নি। কিছুক্ষণ বাদে বাদে বসার ঘরের পর্দার কাছে এসে উঁকি মেরে চলে গেছে। বার বার আড়ি পাতছে যদি কিছু শোনা যায়। প্রান্তিক এবার ক্লান্ত। শোফায় নিজের গা এলিয়ে দিল সে। বুঝতে পারছে না প্রিয়তা গেলো কোথায়? তার সাথে আবার খারাপ কিছু হলো না। এসব ভাবলে আর আরাম করতে ইচ্ছে করে না। উঠে বসল সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লালচে চোখ দুটো আভাস দিচ্ছে ক্লান্তির। মানসূরা তার সামনে পানির গ্লাস রাখলেন। প্রান্তিক মুখ তুলে তাকাতে পারল না। সেই সাহস তার নেই। মানসূরা বেগম পাথরের মূর্তির মতো খসখসে কণ্ঠে বললেন, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কতোই তো অভি’মান হয় তাই বলে কেউ কি এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তুমি বলো বাবা, আমার মেয়েকে কি এতোটাই ক’ষ্ট দিচ্ছিলে? যদি তোমার না পোষাত বাড়ি এসে দিয়ে যেতে। যেভাবে নিয়ে গেছিলে সেভাবেই এসে দিয়ে যেত। আমি আগলে রাখতাম। তুমি ফেলে দিতে পারো, আমি তো পারি না!”
প্রান্তিক কথাগুলো গিলে ফেলল। মুখ ফুটে টু শব্দ অবধি করল না। সে কি করে বোঝাবে, সে তো শত চেষ্টা করেছে তাকে আগলে রাখার। এভাবে চলে যাক সে তো চায়নি। ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে এখন তো সব দায়ভার তার!

এসব কথাগুলো বলার ছিলো লোকমান সাহেবের। কিন্তু মেয়ের শোকে তার অবস্থা পাগল’প্রায়। তার উপর নিজের অক্ষ’মতার কথা মনে পড়ে বাক’রুদ্ধ হয়ে গেলেন। নিজের মেয়েকে খুঁজে বের করার বিন্দুমাত্র শক্তি যে তার নেই। প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না মা, আমি প্রিয়তা কে খুঁজে বের করব।”
মানসূরা বেগম নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। সোফায় বসে পড়ে কেঁদে উঠলেন। বড় মেয়েটা যে তার বড্ড আদরের। এখনই তো বিয়ে করতে চায়নি সে। কেবল পরিবারের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেল। ভেবেছিলো এতে বাড়ির বোঝ কমবে। বোন তো আরো তিনটে আছে। তাদের ও তো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।
পর্দার আড়ালে থাকা আমরিশা ছুটে এলো। ছোট্ট পূরবী জড়িয়ে ধরল আফরিনকে। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে। আমরিশা এসে মা কে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

ভোরের আলো সবে ফুটেছে তবুও রাস্তায় অন্ধকারের ছায়া। সবকিছু যে আলোতে পরিষ্কার হয়ে উঠেনি। সূর্যের মুখখানা ঠিকঠাক করে দেখাও যাচ্ছে না। এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। প্রান্তিক নিজেই গেল দরজা খুলতে। হম্বিতম্বি অবস্থায় মান্নাত কে দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে উঠল। মান্নাত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “প্রিয়তার খোঁজ পেয়েছি, আমার সাথে আয়!”
প্রান্তিক একবার পিছন ফিরে মায়ের দিকে ফিরে বলল, “মা আসছি!” মানসূরা বেগম কান্না থামিয়ে কেবল মাথা নাড়লেন। শুধু কয়েক সেকেন্ডর চোখাচোখি হলো মান্নাতের সাথে। আমরিশা চোখ নামিয়ে নিতেই প্রান্তিক আর মান্নাত ছুটে বেরিয়ে গেল।

প্রিয়তা কতোক্ষণ ধরে রুমে বন্দি আছে বুঝতে পারছে না। একদিন তো হবে নাকি আরো বেশি। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। বাইরের কোনো আলো এসে ঘরে পৌঁছাতে পারে না। কোথায় আছে তাও ঠাওর করতে পারছে না। বলল তো জঙ্গলের মাঝে। সত্যিই কি তাই? নাকি কেবল তাকে ঘাবড়ে দেবার ফন্দি।
অস্থির হয়ে উঠল প্রিয়তা। তাকে পুঁজি করে আবার প্রান্তিকের কোনো ক্ষ’তি করার বুদ্ধি আঁটেনি তো ইজান শিকদার। হতেই তো পারে। নয়তা বা আর কি? প্রতিশোধ’স্পৃহায় পাগল হয়ে গেছে সে। আরিনার এমন অবস্থার জন্য কেবল প্রান্তিক কেই দায়ী করছে সে।
ঘরের এক কোণে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রিয়তার চোখের আড়াল হয়নি সেটা। সর্বক্ষণ তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। বিছানায় ঢাকা খাবার তেমনই পড়ে আছে। দুশ্চিন্তায় আর খাবারের কথা মাথাতেও আসেনি। সে কেবল ঘামছে। এসি তো ছাড়াই আছে মনে হচ্ছে তবুও এতো কেন ঘামছে?

ল্যাপটপের সামনে বসে প্রিয়তার উপর নজর রাখছে ইজান শিকদার। এই মেয়েটির উপর তার মায়া হচ্ছে। বিনা দোষে সে শা’স্তি পাচ্ছে। শুধু কি সে পাচ্ছে? ইজান নিজে কি পাচ্ছে না। ঢাকা থেকে কল আসল। আরিনার অবস্থার কোনো উন্নতি নেই জেনে মনের সেই মা’য়াকে পি’ষিয়ে মে’রে ফেলল সে। এখন আর মায়া লাগছে না। যা হচ্ছে তাতে এই মেয়ের কনট্রিবিউশন না থাকলেও ধরে নিতে হবে সে আছে। সবকিছুর সাথেই আছে। এরই মধ্যে একটি ছেলে এসে খোঁজ দিল, প্রান্তিক তাদেরকে ট্র্যাক করতে পেরেছে। সে এখানেই আসছে। আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে নিশ্চিত!

তারা যেখানে আছে সেখানে আসা তো চাট্টিখানি কথা নয়। একদম দেশের সীমান্তে। ঘন কালো জঙ্গলের মাঝে একটি দুতলা বাড়িতে। বাড়ির অবস্থা বাইরে থেকে ভীষণ করুণ। কেউই থাকে না এখানে। প্রিয়তা এখানে ম’রে পড়ে থাকলেও কেউ টের পাবার কথা নয়। তবে প্রান্তিক জানালো কি করে? ইজান নিজেই তো খবর দেয়নি আবার। দিতে তো হবেই, নাহলে বাকি কাজটা আগাবে কি করে?
দুপুর এখন ১২ টা বাজে। প্রান্তিক এখানে আসছে হেলিকপ্টার দিয়ে। আসতে আসতে আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে নিশ্চিত। ইজানকে এবার সামনের ট্র্যাপ নিয়ে ভাবতে হবে। ছেলেটার উদ্দেশে বলল,
“তাকে খাবার দিয়েছো?”
“নিয়ম করে তো দিয়ে যাচ্ছি স্যার, কিন্তু তিনি খাচ্ছেন না।”
“একটু পর খাবার নিয়ে যাবে, বের হবার সময় দরজা খুলে দিয়ে আসবে।”
“যদি পালিয়ে যায়?”
“পালাক! ঘরে বসে থেকে আর কি মজা আছে? প্রান্তিক আসছে। তাকে ঘর থেকে ছেড়ে দাও। পাগলের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর যাবে। প্রান্তিক এসে যেন জানতে পারে তার বউ জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে। এরপর বাকি কাজটা তোমায় করতে হবে! পারবে তো!”
ছেলেটা নির্বিকার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তার মানে সে পারবে! কিন্তু কিসের কথা বলছিলো তারা? আবার কোন প্ল্যান। ইজান শিকদার উঠে দাঁড়ালো। তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। এখানকার সব কাজ আপাতত শেষ। এখন আরিনার তাকে দরকার।

কিছুক্ষণ বাদে প্রিয়তাকে খাবার পাঠানো হয়েছে। সেই খাবার বিছানায় রেখে আগের খাবার তুলে নিয়ে চলে গেল তারা। আশ্চর্য ভাবে তারা দরজা লাগাতে ভুলে গেল। এই ধারণা প্রিয়তার! দরজা খোলা পেয়ে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠল সে। বুকের মধ্যে পিটপিট শব্দ করছে। সাহস জুগিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। আশপাশ কাউকেই দেখছে না। অতি সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় এলো। সে ভাবল, তাকে কেউই দেখেনি। সে কি করে জানবে, সর্বক্ষণই তাকে নজরে রাখা হচ্ছে। পুরোটাই যে তাকে ফাঁ’দে ফেলার ফন্দি।
কাঁপা কাঁপা হাতে বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল প্রিয়তা। ছাড়া পেয়ে নিজের সব শক্তি নিয়ে দৌড়াতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে যাবে তা জানে না। কেবল চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছে। খুলে দৌড়ালেও লাভ হতো না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে যতই সে অগ্রসর হচ্ছিল ততোই আঁধার ছেয়ে যাচ্ছিল।
ভাগ্যিস একজোড়া স্যান্ডেল পেয়েছিল। নাহলে দৌড়াত কি করে? সে ভারী ঘন জঙ্গল এর মধ্যে তার পা আগে থেকেই জখম হয়ে আছে। কিছুদূর দৌড়ে আসার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। অনেক দূর এসেছে। কিন্তু কোথায় এসেছে সে?

চারদিকে কেবল গাছপালা, খেয়াল করলেই শোনা যায় পশু পাখির আওয়াজ। কিসের আওয়াজ প্রিয়তা বুঝতে পারে না। কিন্তু এসব শুনলেই তার ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। গা শিউরে উঠে। কেবল মনে হচ্ছে আজ তার মৃ’ত্যু নিশ্চিত। ভাগ্য কোথায় এসে ঠেকাল তাকে। মাথার এলোমেলো চুল গুলো দুই হাতে টেনে ধরল সে। ক্লান্ত, নিষ্প্রাণ, নিশ্চল আঁখি দুটি বুলাতে লাগল চারপাশ। ফিরে যাবে কি? না না! একবার পালিয়ে এসে আবার ওখানে যাবার প্রশ্নই উঠে না। সামনেই আগাত লাগল এবার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পা যে ভীষণ ব্যাথা করছে। রে’গে গিয়ে কেন যে খাওয়া দাওয়া করল না সে।‌ খেলে তো একটু শক্তি জোগাড় করতে পারত তাহলে আরো কিছুক্ষণ দৌড়াত পারত। সব রাগ এবার নিজের উপরই হচ্ছে। কেন এতো রা’গ তার? কেন এতো অভি’মান করে? সেদিন না পালালে এতো কিছু তো হতোই না। কিন্তু সে কি আর জানত এতো সব কিছু হয়ে যাবে? দিনের আলো এখনো আছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দিনের আলো থাকতে থাকতে এখান থেকে পালাতে হবে। রাতের বেলা এই জঙ্গলে থাকলে এভাবেই ম’রে যাবে সে। এখনই তার অবস্থা আধ’মরা।

ঝড়ো হাওয়ার মতো বাতাস বইছে। হেলিকপ্টার থেকে প্রান্তিক নেমে পড়ল। তার পিছন পিছন মান্নাত আর রাফিও। বাকিরা আসছে গাড়ি করে। তারা আসতে আসতে রাত হবে নিশ্চিত। সাথে লোক বলতে আর কেউ নেই। আশপাশ কাউকে দেখতে না পেয়ে রাফির ভয় বাড়ল। হাতের ছোট বন্দুক নিয়ে লোড করে রাখল। মান্নাত ও পা ফেলছে সামলে। প্রান্তিকের সেইসব ভাবনা নেই। সে ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতর। রাফি আর মান্নাত ছুটল তার পিছন পিছন।
পুরো বাড়ি খালি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেলো না। কিন্তু বাড়ির হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগেও এখানে মানুষের উপস্থিতি ছিল তাহলে এখন কোথায় গেলো। প্রান্তিক চৌধুরী অস্থির হয়ে উঠল। তার চোখের মণি কোঠা স্থির। লালচে হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। রক্ত জমে যাচ্ছে বোধও। ঠোঁট দুটো কাঁপছে বারংবার। দাঁত দিয়ে চেপে ধরল ঠোট দুটো। কে’টেও গেছে সামান্য। ঘরের কিছু জিনিস ভাং’চুর না করে শান্ত হওয়া সম্ভব না। মান্নাত তাকে শান্ত করানোর খুব চেষ্টা করছে। ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“ভাবী কে আমরা পেয়ে যাবো, পাগলামি করিস না।”
“আমি পাগলামি করছি? তুই এখনো আমায় বলবি? ইজান কি করল? ওর সাহস হয় কি করে আমার বউয়ের গায়ে হা’ত দেবার। পেয়ে নিই। কাউকে ছাড়ব না, কাউকে না!”
রাফি ছুটে এলো তৎক্ষণাৎ। তার হাতে ল্যাপটপ। সেখানে আছে ভিডিও রেকর্ডিং। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রিয়তা বাড়ি ছেড়ে পা’লিয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। ইজান শিকদার তবে কাপুরুষের মতো কাজ করল। একা একটা মেয়েকে জঙ্গ’লের দিকে পাঠিয়ে তারা ভেগে গেলো। রক্ত’ যেন মাথায় চড়ে উঠছে। রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে। কিন্তু রা’গ দেখানোর যে সময় নেই। প্রান্তিক এবার একাই ছুটল জঙ্গলের দিকে। রাফি তাকে আটকে রাখতে পারেনি। আবার একাও ছেড়ে দিতে পারছে না। মান্নাতকে বলে গেলো পুলিশে কল দিতে। লোকদের বলতে, তাদের আরো লোক লাগবে। এতো বড় জঙ্গলে একা কিছু করা যাবে না। বলেই রাফিও ছুটল প্রান্তিকের পিছনে। মান্নাত দাঁড়িয়ে কল লাগালো আলফি কে। দ্রুত আসার জন্য তাড়া দিতে লাগল।

প্রান্তিক জঙ্গল পেরিয়ে ছুটছে। কণ্ঠে তার এক ধ্বনি। কেবল প্রিয়তার নাম। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তার নাম ডেকে যাচ্ছে সে। তার ধ্বনি দূর প্রান্তে ধাক্কা খেয়ে আবার তার দিকেই ফিরে আসছে। তার চেঁচানোতে গলার রগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। দিনের আলো শেষ হয়ে আসছে। যতই আলো কমছে ভয় বাড়ছে। রাতে মেয়েটাকে কি করে খুঁজে পাবে সে? তখন তো আরো মুশকিল হয়ে যাবে।
ছুটতে ছুটতে থমকে এসে দাঁড়াল। গলা শুকিয়ে আসছে। শরীর হার মানতে চাইছে কিন্তু মন না। প্রান্তিক চৌধুরী এতো সহজে তার ভালোবাসা হারাতে দিবে না। সামনে পা বাড়ানোর আগেই রাফি পেছন থেকে এসে ঝাপ্টে ধরে পেছনে ফেলে দিকে তাকে। প্রান্তিক হতভম্ব হয়ে গেল। অতঃপর সামনে চোখ পড়তেই দেখল বিষধর সাপ এঁকে’বেঁকে চলে যাচ্ছে। সাপ তাকে ছোবল মারে’নি তবুও সারা শরীরে সাপের বি’ষ ছড়িয়ে গেছে বলে মনে হলো। প্রিয়তার বিপদের আ’শঙ্কা করে আবারো উঠে দাঁড়াল প্রান্তিক। চোখাচোখি হলো রাফির সাথে। রা’গ রাফির সাথেও কম না। কেবল প্রিয়তাকে খুঁজে বের করার অপেক্ষা। এরপরের শো’ধ সে নিবে।

উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে গেল। মান্নাত সেখান থেকে খুঁজে যাচ্ছে তাকে। লোকজন আসতে আরো ঘণ্টাখানেক লাগবে। ততোক্ষণ বসে থাকা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ রাত ঘনিয়ে আসছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে ইতোমধ্যে। এখন দ্রুত না করলে রাতে আর কিছুই করা যাবে না।
পানির তৃষ্টায় আর ক্ষুধায় প্রিয়তা ক্লান্ত। তার শরীর অসাড় হয়ে গেছে। আর এক পা চলার সাধ্য যে নেই তার। এই জঙ্গলের পথ যেন শেষই হচ্ছে না। রাত ঘনিয়ে আসছে। প্রিয়তার আত্মা কেঁপে উঠছে এই ভেবে যে, রাতে এখানে থাকবে কি করে? চোখ বুজে আসছে। মস্তিষ্ক বার বার ইঙ্গিত দিচ্ছে হার মেনে নিতে। তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। কিন্তু প্রিয়তা হার মানতে রাজি নয়। তাকে তো এখান থেকে বের হতেই হবে। মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে চলে যেতে দেখে বড় একটা গাছের পিছন লুকিয়ে পড়ল সে। ইজান শিকদার আবার হেলিকপ্টার নিয়ে তাকে খুঁজতে বের হয়নি তো। পালিয়ে আসার সময় বাড়ির সামনে হেলিকপ্টার দেখেছিলো সে।

পরক্ষণেই মাথায় এলো, যেখানে গাড়ি দিয়ে আসা যায় না রীতিমতো হেলিকপ্টার দিয়ে আসতে সেখানে পায়ে হেঁটে কতোদূর যেতে পারবে সে? ভাগ্য যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। আদৌও পারবে তো। ব্যাথায় পা টনটন করছে। মনের জোর কমে আসছে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল প্রিয়তা। শুকনো পাতার মর্মর শব্দে আঁ’তকে উঠল সে। চোখ যে বুজে আসছে। ঘুম আসছে দুচোখ ঢেলে।

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় সুবাধে খানিকক্ষণ বাদে এদিক ওদিক তাকানো গেল। একটু একটু দেখা যাচ্ছে কিছু। কিন্তু এখন কি পা বাড়াবে। ভয় হচ্ছে ভী’ষণ। নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল সে। পানির তৃষ্ণা আর ক্ষুধা আবারো আঁকড়ে ধরল তাকে। অসহায়ের মত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল বেশ অনেকক্ষণ। পর পর কয়েকবার নিজের নাম শুনে ভ্রম হলো প্রিয়তার। ভ’য়ে কি তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তাকে। মাথা ঘুরছে! এই বুঝি অ’জ্ঞান হয়ে যাবে। আচ্ছা সে কি মা’রা যাচ্ছে ?
মা’রা যাবার আগে একটিবার প্রান্তিক কে দেখতে পেলে বেশ ভালো হতো। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে। ম’রার আগে প্রিয় মানুষটির মুখই তো বারবার ভেসে উঠে। শুনেছিল সে? তার প্রিয় মানুষটি কি এখনো প্রান্তিকই আছে।
আবারো নিজের নাম। “প্রিয়তা প্রিয়তা” ডাক শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেল প্রিয়তা। যতই সময় যাচ্ছে ততোই স্পষ্ট হচ্ছে নামের আওয়াজ। এই কণ্ঠস্বর তার খুব চেনা। চিনতে সময় লাগল। তবে কি এটা সত্যি?

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২০

প্রিয়তা ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। কোথা থেকে আসছে আওয়াজ। এদিক না ওদিক থেকে। ঠিক একসময় গু’লির শব্দ শোনা গেল। পরপর দু’বার! প্রিয়তার পা জমে গেল। কি হলো আবার? প্রান্তিকের কিছু হয়নি তো? ছুটতে লাগল সেদিকে। যেদিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছে। অশ্রু মুক্তার মতো ঝরে যাচ্ছে গাল বেয়ে। ছুটতে চোখ বন্ধ করে। মনের জোর পাচ্ছে একটু একটু করে। পানি তৃষ্ণা, ক্ষুধা, ক্লান্তি প্রায় সবকিছু ভুলে গেলো সে। এখন কেবল ছুটছে ভালোবাসার টানে!

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২২