প্রেমের সমর পর্ব ২২

প্রেমের সমর পর্ব ২২
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সাদাফকে ডেকে নিয়ে ডক্টর এটুকুই জানিয়েছে যে রিপোর্টে স্বচ্ছর ব্রেইনের একটা ধমণীতে ড্যামেজ দেখিয়েছে। যার কারণে স্বচ্ছর জ্ঞান ফিরলেও সারভাইভ করাটা নিয়ে তারা নিশ্চিত করতে পারছেন না। ফলস্বরূপ ডক্টররা আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিলেন একটা অপারেশন করার। তবে এই অপরেশনটা রিস্কি! হতে পারে স্বচ্ছ প্রাণ আর ফিরলইনা অপারেশনটা করার পর। আবার হতে পারে স্বচ্ছ এরপর একদম সুস্থ জীবন যাপন করল। এই দুই চিন্তায় ডক্টররা যখন কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে পারছিল না তখনই সাদাফ এবং আবিরকে বিষয়টা জানাল। যেহেতু এসেছে পর্যন্ত এই দুটো ছেলেকেই রোগীর জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছেন তারা। ভেবেই নিলেন এরা রোগীর ভাই হয়তো। কিন্তু যখন শুনল বন্ধু হয় তখনই স্মিত হাসলেন ডক্টর মাহবুব!বললেন,

“ তোমাদের বন্ধু বোধহয় খুব ভাগ্যবান যে তোমাদের মতো দুইজন বন্ধু পেয়েছে সে। ”
আবির মৃদু হাসে। চোখে তার হাজার ক্লান্তি। কান্না পাচ্ছে কেমন তার। সাদাফ তখন ভাঙ্গা চাহনিতে আবিরের দিকে তাকায়। এই অনিশ্চায়তার সংবাদ স্বচ্ছর বাবাকে কিভাবে দিবে বোধহয় তাই প্রশ্ন। আর সুহা? মেয়েটাতো স্বচ্ছর সাথে দেখা করার পর থেকে কেমন কঠিন হয়ে আছে। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে আশ্বাস দিয়ে বের হয়৷ রাহাকে ডেকে শান্ত চাহনিতে বিষয়টা বুঝানোর চেষ্টা করে বলে। যখন পুরো বিষয়টা রাহার সাথে আলোচনা চলছিল ঠিক তখনই সেখানে এল ছুটি। বোধহয় অনেকদূর জার্নি করেই এসেছে। চুল এলোমেলো দেখাচ্ছে মেয়েটার। অন্য সময় বোকাবোকা চাহনিতে আবিরের দিকে চেয়ে থাকলেও আজ থাকল না। এসেই আবির আর রাহাকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে রাহাকে জিজ্ঞেস করে,

“ সুহা কেমন আছে রাহা? আর দুলাভাই? কেমন আছে এখন? ”
রাহা ছোট ছোট চোখে তাকায়। ছুটির সাথে দেখতে পায় সুহাদের ফ্রেন্ড সাদকেও। রাহা কোনরকমে অবস্থার কথা জানিয়ে জানায় সুহা কোথায়। ছুটি সব শুনে। পরমুহুর্তেই আবিরের দিকে চোখ যায় তার। কেমন লালচে রক্তিম দেখাচ্ছে চোখজোড়া। যেন কতোটা বিষাদ! ছুটির কেন জানি না আবিরকে দেখেই মনে হলো এক বিধ্বস্ত আবির এ। এক ক্লান্ত আবির দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ছুটির মায়া হয়। এক হাতে আবিরের একটা হাত ধরে ক্লান্ত গলায় বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ চিন্তা করবেন না আবির ভাই। আমাদের সুহা স্বচ্ছ ভাইয়াকে অনেকটা ভালোবাসে। সে ভালোবাসা পূর্ণতা না পেতে দুলাভাইয়ের কিছু হতেই পারে না বুঝলেন? উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। আপনাদের আবার আড্ডা জমবে। আবারও আপনারা আপনাদের শয়তানি বুদ্ধি ফলাতে পারবেন। চিন্তা করবেন না আবির ভাই। এভাবে ভঙ্গুর আবিরকে আমি কখনো দেখিনি আবির ভাই। ”
আবির হাত টেনে নিল। বোধহয় সবার সামনে হাত ধরাটা সে পছন্দ করেনি। ছুটিও তাই আর সান্ত্বনা দিতে গেল না। তবে রাগবশত হাত সরিয়ে নিয়েছে কিনা তারজন্য কৈফিয়ত স্বরূপ বলল,
“ সাদ আমার বন্ধুই। একটু দূর তো। একা একা আসতে পারতাম না। তাই ওর সাথে চলে এসেছি। আমার কথাগুলো খারাপ লেগে থাকলে স্যরি। তবে আপনাকে সত্যিই বিধ্বস্ত লাগছে আবির ভাই। আমি সেকারণেই আপনাকে মনোবল দিতে চেয়েছিলাম। স্যরি! ”

কথাগুলো এক টানে বলেই সাদ সহ সুহার কাছে গেল ছুটি। অপর দিকে আবির তাকিয়ে রইল বোবা দৃষ্টিতে। ইশশ! ছুটি যদি বুঝত তার মনের ভেতর কতোটা অনিশ্চায়তা এখন খেলা করছে। কতোটা চিন্তা!ছুটি যখন তার হাত ধরে এসব বলছিল তখন ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটাকে এক টানে জড়িয়ে নিক। বুকের ভেতর আগলে রাখুক কিছুটা সময়। তবুও যদি চিন্তা কমে? তবুও যদি শান্তি লাগে? অথচ তা তে সম্ভব নয়। তাই তো আবির ওভাবে হাত সরিয়ে নিল। আর মেয়েটা বোধহয় তার এই কাজে কষ্ট পেল শুধু শুধু!

স্বচ্ছর অপারেশনের সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্যই ওর বাবাকে সবটা জানানো হলো। উনি বুঝে উঠলেন না যেন কি করা উচিত। পরমুহুর্তে ডক্টরের সাথে অনেকটা আলোচনা করেন সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনটা হবে। পরদিনই হবে! বিষয়টা সুহাকেও জানানো হলো। সুহা কেমন যেন থমকানো দৃষ্টিতে তাকায়। অপারেশনের পর যে স্বচ্ছর বেঁচে থাকার অনিশ্চায়তাটার কথা তা আবির আর সাদাফ সুহার থেকে লুকাতে চাইলেও লুকানো গেল না। সুহা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ফ্যাসফ্যাস স্বরে বলে,
“ যদি উনি না ফিরেন আর? কি করব আমি?”
উপস্থিত আবির, সাদাফ আর রাহা তিনজনই নিশ্চুপ থাকল। উত্তর দিতে পারল না। সুহা হাসে হালকা এবারে। পরমুহুর্তেি অনুরোধ নিয়ে বলে উঠে,
“ আমাকে কি আরেকটাবার স্বচ্ছর সাথে দেখা করতে দিবেন? আমাকে কি উনার সাথে আর কিছুটা সময় কাঁটাতে দিবেন? প্লিজ!কিছু করব না কথা দিচ্ছি। ”

কেউই না করল না। বরং আবিররা ডক্টর আর নার্সদের সাথে কথা বলল যাতে কাল অপারেশনটা হওয়ার আগ অব্ধি সুহাকে ওর সাথে থাকতে দেয়। রাজিও হলেন উনারা। সুহা একটু হাসে। অনুমতি পাওয়া মাত্র স্বচ্ছর কাছে গিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে স্বচ্ছকে দেখতে থাকে সে। চোখ বুঝে আছে ছেলেটা। ঘুমোচ্ছে। মুখে দেখা যায় অক্সিজেন মাক্স। সুহার চোখ টলমল করে। ঝুঁকে গিয়ে স্বচ্ছর মুখে আঙ্গুল বুলায়। বিড়বিড় স্বরে বলে,
“ শাস্তি আপনার প্রাপ্য ছিল স্বচ্ছ। কষ্ট আপনি দিয়েছেন আমায়। তাহলে ? সবসময় আমিই কেন ভুগব? সবসময় আমিই কেন কষ্ট পাব স্বচ্ছ? আমার প্রতি এতোটা অবিচার কেন হবে বলুন? ভালোবাসি বলে?”
সুহা বিড়বিড় করে কথাগুলো বলেই থামে। স্বচ্ছর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
“ আমি ভয় পাচ্ছি স্বচ্ছ। আমি জানি, আমি জানি তো আপনি আমায় ছাড়বেন না। আপনি আমায় একা ফেলে যাবেন না৷ এত বড় শাস্তি নিশ্চয় আমার প্রাপ্য নয় স্বচ্ছ? বলুন? এতোটা শাস্তি কি আমার প্রাপ্য? ”

স্বচ্ছ শুনে না। চোখ মেলে তাকায় না৷ সুহার চোখ টলমল করে। দুয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছর মুখেও। অথচ স্বচ্ছ তখনও চোখ বুঝা। সুহা শুকনো ঢোক গিলে। সেভাবেই স্থির বসে থাকে স্বচ্ছর কাছে। স্বচ্ছর হাতটা সেভাবেই আগলে রাখে নিজের হাতের মুঠোতে। এভাবে কতোটা সময় যে পার হলো সুহা নিজেই জানে না। এখন এই অবস্থায় সময়জ্ঞাস টুকু নেই তার। তবুও সময় যখন মাঝরাত্রিতে ঠিক তখনই স্বচ্ছ চোখ মেলে তাকায়। সুহাকে সেভাবে আলোআঁধারে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসে যেন। যে হাতটা সুহার হাতের মুঠোয় রাখল সে হাতটা একটু নড়চড় করে বুঝাল সে সুহার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সুহাও তাকাল।বলল,

“ স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ তাকিয়ে থাকে। কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই তার। তবুও সে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। চোখে চোখে হাসি খেলে যায় যেন। সুহা হাত চেপে ধরে। বলে,
” আমাকে বিয়ে করেছিলেন স্বচ্ছ। একবার বিয়ে করে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। এইরকম ভুল দ্বিতীয়বার করার সাহস করবেন না স্বচ্ছ। খু’ন করে ফেলব আপনাকে। কখনোই ক্ষমা করব না, কখনোই না। ”
স্বচ্ছ এবারেও সুহার কথা শুনে হাসে৷পরমুহুর্তেই টের পায় সুহা কাঁদছে কথাগুলো বলতে বলতে। টলমল করছে চোখজোড়া। স্বচ্ছ হাত এগোতে চায় সুহার চোখের পানি মোঁছার জন্য। কিন্তু পারল না। ব্যর্থ হলো। সুহা তা বুঝে মুখটা স্বচ্ছর হাতের কাছে আনে। গালে হাত ছুঁইয়ে বলে,

“ একটা মেয়ে আপনাকে ভালোবেসে একবার ঠকে গিয়েছে স্বচ্ছ। দ্বিতীয়বার ঠকাবেন না প্লিজ। প্লিজ স্বচ্ছ। ”
কথাটা বলেই নিরবে কেঁদে ফেলে সুহা। স্বচ্ছ তা দেখে স্থির চেয়ে থাকে৷ সুহা ফের বলে,
“ কে বলেছিল আমাকে সরিয়ে দিকে গাড়ির ওপাশ থেকে? কে বলেছি আমায় বাঁচিয়ে দিতে? বাঁচিয়ে দিয়ে এই কষ্ট আমি চেয়েছিলাম? আপনি, আপনি আজীবনই ফাঁকিবাজ স্বচ্ছ।খবদ্দার বলছি, আমাকে ভালোবাসার সময়ে এসে যদি ভালোবাসায় ফাঁকিবাজি করবেন ভেবে থাকেন তাহলে কিন্তু খারাপ হবে। আমি শুধু আপনার ভালোবাসা পাব বলে চারটা বছর অপেক্ষা করেছি। ”
স্বচ্ছ সুস্থ থাকলে নিশ্চয় এই কথাগুলো শুনে হেসে মজা নিত। তবে এবারে তা হলো। বরং মৃদু হাসলই কেবল। সুহা ঝুঁকে। স্বচ্ছর মুখটা আগলে ধরে লজ্জা ভুলে চুমু দেয় স্বচ্ছর গালে। বলে,
“ আমি আপনাকে এই নিয়ে দুটো কি তিনটে চুমু দিয়েছি স্বচ্ছ। আর আপনি কেবল সেদিন ছাদের চুমুটাই। চুমুর ঋণ শোধ করতে হলেও আপনাকে আমার সাথে সংসার করতে হবে স্বচ্ছ। নয়তো আমি অন্য কাউকে ধরে এনে চুমু খাব। ”

এমন একটা সিরিয়াস মুহুর্তেও সুহা কথাগুলো বলল যেন স্বচ্ছর মন খারাপ না হয়। স্বচ্ছ যাতে ছেড়ে না যায় এই
কারণেই। স্বচ্ছ এই পর্যায় একটু বেশিই ঠোঁট এলিয়ে হাসে৷ চোখ দিয়ে বুঝাতে চায় যেন, অন্য কাউকে চুমু খেলে সে সুহার ঠোঁটই কেঁটে রেখে দিবে!

পরদিন স্বচ্ছর অপারেশনটা সকালেই হয়। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে অপারেশনের পর স্বচ্ছর তখনও জ্ঞান ফেরেনি। বাইরে যখন সবাই চিন্তায় চিন্তিত ঠিক তখনই আবিরের পেছনে এসে দাঁড়ায় ছুটি।আবির সবার থেকে অনেকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে ছুটি এসেছিল। চিন্তায় অস্থির হওয়া আবিরের কাঁধে হাত রেখে সে শুধায়,
“ দেখবেন,একটু পরই ডক্টর এসে বলবে যে অপারেশন সাক্সেসফুল। চিন্তা করবেন না আবির ভাই। ”
আবির চিন্তায় ডুবে আছে ।এই মুহুর্তে সবার মধ্যেই কিন্তু আবড়ালর ফিসফিস স্বরে ছুটির কথাটা তার বিরক্ত লাগল। ছুটি বোধহয় সে বিরক্ত দেখে নিরাশ হয়ে গেল। দ্রুতই আবিরের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। তখনই রাহাকে হুড়মুড় করেই এদিকে আসতে দেখা গেল। চোখে মুখে উচ্ছাস তার। আনন্দ! রাহা এল দ্রুত। খুশিখুশি মুখে আবিরকে ডেকে তার হাত টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

প্রেমের সমর পর্ব ২১

“ ডক্টর বলেছে অপারেশনটা সাক্সেসফুলি হয়েছে। আপনাকে ডাকছে সাদাফ ভাইয়া। ”
মুহুর্তেই আবিরের মুখে হাসি ফুটল যেন। একটু আগের বিরক্তিটাই পরিণত হলো তীব্র সুখে। ছুটি নিজেও খুশি হলো। তবুও কোথাও যেন তার বিশাল এক মন খারাপ কাজ করল। কেন এই মন খারাপ তার? কেন এই বিষাদ? আবির ভাই তার কথা শুনে বিরক্ত হয়েছে বলে? রাহা হাত ছুঁয়েছে বলে? নাকি রাহার মুখে তাকিয়ে আবির ভাই হেসেছে আর তার মুখে তাকিয়ে বিরক্ত হয়েছে বলে? কোনটা?

প্রেমের সমর পর্ব ২৩