একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৪৬
Mousumi Akter
একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামল বাসার নিচে। রোশান -সারাহ তরীকে একটা কালো বোরকা পরালো। রোশান সারাহ’কে বলল, ব্যাংকের কার্ডটা নিয়ে নামো। সারাহ ব্যাংকের কার্ডটা নিজের ব্যাগে ভরে তরীর হাত ধরে নিচে নামল। রোশান গাড়ির দরজা খুলে দিলো। প্রথমে তরী উঠল, পরে সারাহ উঠল। রোশান সিদ্দিকী ড্রাইভারের পাশে বসল। গাড়িটা স্টার্ট দিতেই সারাহ তরীর নেকাবের মুখ খুলে দিলো। গাড়িতে এসি চলছে তাই গ্লাস বন্ধ করে রাখা। তরী অশ্রুসিক্ত চোখে গাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ তরীর মুখে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে ঘোরালো। চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত, টলমল করছে পানিতে। কান্নার বেগ যেন থামছেই না। সারাহ তরীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে তরীকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলল,
” খুব কষ্ট হয়েছিলো এতদিন তাইনা? ”
তরী যন্ত্রণায় জর্জরিত চেহারা নিয়ে বুকফাঁটা আর্তনাদ দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো সারাহ’কে জড়িয়ে ধরে। এ যেন দীর্ঘদিন দিনের জমানো কান্না আজ ভেতর থেকে উপচে পড়ছে। এ যেন দীর্ঘদিনকার জমানো ভয়ানক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। তরীর কান্নার বেগ বাড়ল। আবেগেরা যেন আরো উপচে পড়ল। কারো কান্নায় যেন এত ভয়াবহ যন্ত্রণা ফুটে উঠতে পারে তা তরীর কান্না না দেখলে অনুভব করা যেতনা। যন্ত্রণায় যেন জ্বলে পু’ড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বুক কান্নার তীব্রতা বাড়ার সাথে শীতল হচ্ছে। যেন দীর্ঘদিন পরে মন খুলে কান্না করার মত একটা বিশ্বস্ত বুক পেয়েছে। যে বুকে সব কান্না সব কষ্ট নিংড়ে দেওয়া যায়। তরীর কান্নায় সারাহ’র বুকটা পু’ড়’ছে। তার চোখে পানি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সারাহ তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আর কাঁদেনা সোনা, মাথা ধরবে। আমি আর কোনদিন তোমাকে কাঁদতে দিবোনা। সারা দুনিয়ার বিপক্ষে গিয়ে আমি তোমার হাসির কারণ হবো। ”
তরী কান্নামিশ্রিত জড়ানো গলায় বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমাকে একটু কাঁদতে দিবেন, ওরা আমাকে একটু কাঁদতেও দেয়নি। কাঁদলেও মে’রে’ছে। আমার বুকে অনেক কান্না জমে আছে। কান্নার একটা পাহাড় জমেছে। একটা আপন মানুষ ছিলোনা যার বুকে মাথা রেখে কেঁদে নিজেকে হালকা করব।”
এত যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে তরীর কথায়, যে সারাহ’র দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। রোশান সিদ্দিকী ঘাড় কাত করে পেছনে তাকাল। মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
” তরীকে কাঁদতে দাও সারাহ। যতক্ষণ না ওর কষ্টের তীব্রতা কমছে ততক্ষণ ওকে কাঁদতে দাও। একমাত্র কান্নাই পারে ওর যন্ত্রণার তীব্রতা কমাতে। যত কাঁদতে হৃদয় তত হালকা হবে।”
রোশান সিদ্দিকী’র কথা শুনে তরীর কান্নার মাত্রা আরো বাড়ল। এই পৃথিবী কত নিষ্টুর তা একটি মা ছাড়া মেয়ে বুঝতে পারে। মা ছাড়া পৃথিবীটা নরকের সমান। তাই যাদের মা আছে মায়ের কদর করা উচিৎ। এ এক অমূল্য সম্পদ।
কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পরে তরীর কান্নার তীব্রতা কিছুটা কমলো। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে তরীর। সারাহ আবার ও বলল,
” ওরা তোমাকে মা’র’ত?”
তরী হেচকি ওঠা অবস্থায় বলল,
” ওরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। অনেক মে’রে’ছে। দিশা আমাকে অনেক অত্যাচার করেছে। যখন তখন গায়ে হাত তুলেছে। অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ দিয়েছে। এত অত্যাচার করেছে সারাক্ষণ মৃ’ত্যু ভ’য় দেখাতো।”
” এত কষ্ট দিয়েছে?” সারাহ’র কৌতুহলী প্রশ্ন।
তখন তরী দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
” ওরা সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে আমার মনে। হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত করেছে ধারালো ছু’রি দিয়ে। শারীরিক আঘাত আমাকে কষ্ট দেয়নি, কষ্ট দিয়েছে মনের যন্ত্রণা।”
সারাহ তরীকে আবারও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আজ থেকে তুমি মুক্তপাখি তরী। আকাশে ডানা মেলে উড়বে। কেউ তোমাকে আটকাতে পারবে না। বাকিটা আমি দেখে নিবো।”
” ওরা আপনাদের নামে মামলা দিবে। আমার জন্য আপনারা ঝামেলায় পড়বেন। ”
” মামলার ভ’য় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। এইবার তোলপাড় করে ছাড়ব সব। তুমি নিশ্চন্তে মৃন্ময়ের সাথে তোমার স্বপ্নের পৃথিবীতে উড়বে।”
তরীর কান্না যেন থামেই না। থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে।
এরই মাঝে গাড়ি প্রায় তার গন্তব্যর দিকে।
দিশা রাগে ছটফট করতে করতে রুমে এলো। তরীর বাবা খাতা কলমে একটা টাকার অঙ্কের হিসাব কষছিলো। দিশাকে রাগে গজগজ করতে দেখে তরীর বাবা বলল,
” কি হয়েছে তোমার? তোমার শান্তির জন্য তো তরীকে বিদায়ের ব্যবস্থা করলাম।”
দিশা খাটের কোনায় বসে পড়ে বলল,
” একটা ভুল হয়েছে আপনার।”
তরীর বাবা খুব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ভুল।”
দিশা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
” আগের বাসার মৃন্ময় নামক ছেলেটির সাথে তরীর বিয়ে দিলেই ভাল হত। এত ঝামেলা করা লাগত না।”
তরীর বাবা দিশার অন্যমনস্ক চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
” মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? যে ছেলে তোমার সাথে বেয়াদবি করেছে আমি তার সাথে তরীর বিয়ে দিবো।”
দিশা আজ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল,
” তা কি হয়েছে। এমন ঘটনা তো কত ঘটে থাকে। ছেলেটা নিশ্চয় তার ভুল বুঝত পরে। তুমি যেখান থেকে পারো ওই ছেলেকে খুঁজে এনে তরীর বিয়ে দিয়ে দাও। যেভাবে পারো বিয়ে দাও। তরী ওই ছেলেকে ভুলতে পারছেনা।”
তরীর বাবা বেশ অবাক হচ্ছে দিশার কথায়। হঠাৎ দিশা এসব বলছে কেন? দিশা দু’দিন আগেও বলেছে ম’রে গেলেও ওই ছেলের সাথে তরীর বিয়ে দেওয়া যাবেনা। তরীর ওপর অত্যাচার করেছে, ওই ছেলেকে ভালবাসার জন্য। তাহলে আজ সুর পাল্টালো কেন? দিশাকে কেমন যেন উন্মাদের মত দেখাচ্ছে। সামথিং ইজ রং। তরীর বাবা তাও শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” ইম্পসিবল। জীবনেও তরীর বিয়ে ওখানে দিবোনা।”
দিশার মাথা ঠিক নেই। সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে বেলকনিতে গেল। সে এখন বুঝতে পারছে জীবনে চরম ভুল করেছে। মৃন্ময় তার ভালবাসা ছিলোনা। মৃন্ময় ছিলো মোহমাত্র। সেই মোহের জন্য এত বাড়াবাড়ি ভুল হয়েছে। তার জীবনে ভালবাসার মানুষ এসে গিয়েছে। সে এখন বুঝতে পারছে সত্যিকারে ভালবাসলে কেমন অনুভূতি হয়। যে অনুভূতি মৃন্ময়ের বেলায় হয়নি। তার সত্যিকারের ভালবাসার নাম রোশান সিদ্দিকী। রোশান সিদ্দিকীর মত স্মার্ট, সুদর্শন পুরুষ জীবনে দেখেনি সে। তার কথার স্টাইল, খাওয়ার স্টাইল সব অন্য রকম। এই পুরুষটিকে তার লাগবেই। এই পুরুষটির জন্য যা কিছু করতে হয় সে করবে। পৃথিবীর সবার চোখে ঘৃণিত হলেও রোশান সিদ্দিকী’কে তার লাগবে। লাগবে যখন ছিনিয়ে নিলেও নিতে হবে। রোশান সিদ্দিকী’র জন্য একটা ছক এঁকে নিলো দিশা। গতবারের মত ভুল করা যাবেনা।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের রেল লাইনের পাশ দিয়ে ঘেষে যাওয়া একটি রোডে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়, তন্ময়, দ্বীপ। মৃন্ময়কে প্রচন্ড অস্থির দেখাচ্ছে। বারবার হাত উলটে ঘড়ি দেখছে। কি আশ্চর্য! আজ যেন সময় অতিবাহিত হচ্ছেনা। সময় কি ঘড়ির কাটায় আটকে আছে। এক ঘন্টা সময় কেন যেন ফুরাচ্ছেনা। বারবার পানি খাচ্ছে মৃন্ময়। তন্ময় আর দ্বীপ মৃন্ময়কে আজ সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জাবা পরিয়ে এনেছে। মৃন্ময়ের অস্থিরতা কমাতে দ্বীপ বলল,
” তোকে সাদা পাঞ্জাবি পরিয়ে পাপ মুক্ত করে আনলাম। পবিত্র কাজে আসার আগে ধুয়ে মুছে সাফ করে আনলাম।”
মৃন্ময় একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,
” কেন আমি কি মহিলাগো কাছে যাই, যে পাপ মুক্ত করে আনলি? টেনশনে মাথা ফাইটা যাচ্ছে। সারাহ কি মজা করল। সত্যি কি তরীকে আনবে। আজ যদি তরীর দেখা না পাই আমার শেষ আশাটুকুর বাতি নিভে যাই এখানেই নিজের জীবন ত্যাগ করে যাবো।”
তন্ময় বলল,
” এমন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সারাহ ফান করবেনা। একটু ওয়েট কর।”
” ও আবার ফান করবে না। নিজের জামাই এর মাথাটা খাচ্ছে দিনরাত। সেখানে আমি কোন বাল।”
এরই মাঝে কালো রঙের গাড়িটি এসে থামল। দ্বীপ আর তন্ময়ের মুখে এইবার স্বস্তির হাসি ফুটল। মৃন্ময়ের বুকের মাঝে যেন ভয়াবহ কম্পন শুরু হল। তার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করল। কিছু আনন্দে মানুষ যেন আত্মহারা হয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। আনন্দ দ্বিগুন হয়ে পা-গ-ল হয়ে যায়। মৃন্ময়ের অবস্থা ও তেমন। গাড়ি থেকে আগে রোশান-সারাহ কেউ নামল না। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই লাল বেনারসি পরিহিত মাথায় লাল জরজেট বিয়ের ওড়না পরে গাড়ি থেকে নামল তরী। গাড়ি থেকে নেমেই সামনে তাকাতেই চোখ গেল মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় এই পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা নিয়ে অশ্রুসজল চোখে তাকালো তরীর দিকে।
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৪৫
তরী ও অশ্রুসজল চোখে তাকালো মৃন্ময়ের দিকে। এই অশ্রু আনন্দের। সীমাহীন আনন্দে ও মানুষ কাঁদে। প্রিয় মানুষকে আপন করে।পাওয়ার আনন্দেও মানুষ কাঁদে। দু’জনের ই চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসি। আনন্দে বুক কাঁপছে, হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেল বহুগুন। চারদিকে যেন ভূমিকম্পন হচ্ছে। তবে এই ভূমিকম্পন খুশীর তীব্র খুশীর। রোশান সারাহ ও গাড়ি থেকে নেমে এলো। তরী পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা, ভয়,জড়তা, উপেক্ষা করে বৈশাখের ঝ’ড়ে’র মত এগিয়ে গেল মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় ও তীব্র গতিতে এগিয়ে এলো। দু’জন দু’জনের কাছাকাছি আসতেই তীব্রভাবে দু’জনকে জড়িয়ে ধরল। নিভে যাওয়া প্রদীপ যেন জ্বলে উঠল। ভালবাসার সুবাস ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। চারদিকে ফুলের মিষ্টি সুবাস। সেই সুবাস জানিয়ে দিচ্ছে এই দিনটি আসার ছিলো, এই দিনটির জন্য ভালবাসার ফুলেরা এতদিন ফোটেনি, সুবাস ছড়ায় নি।