কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩১

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩১
মিসরাতুল রহমান চৈতী

কবরস্থান নিস্তব্ধ। চারপাশে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে একরকম শূন্যতায়। শহরের কোলাহল এখানে এসে থমকে গেছে।
চৈতী চুপচাপ বসে আছে। কবরের মাটির ওপর তার হাত রাখা, আঙুল দিয়ে মাটি স্পর্শ করছে ধীর গতিতে। যেন এই মাটির ভেতর দিয়ে সে বাবা-মায়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে চাইছে। চোখের কোণে জমে থাকা জল ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই—শুধুই নিঃশব্দে প্রবাহিত কষ্ট।
ইমাম সাহেব স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,
— “মা, আল্লাহ তোমার বাবা-মাকে জান্নাত নসিব করুন। দুনিয়ায় আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। তবে যারা নেক আমল করে, তারা কবরে শান্তি পায়। তোমার বাবা-মায়ের জন্য বেশি বেশি দোয়া করো, সাদকা দাও। এতে তাদের আখিরাতে উপকার হবে।”
চৈতী কোনো কথা বলল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কবরের দিকে। তার চোখে অনুরাগ, অভিমান আর সীমাহীন শূন্যতা।
রাতুল পুরো সময়টাই নীরব। চৈতীর প্রতিটি অভিব্যক্তি খেয়াল করছে সে। জানে, এই মুহূর্তে কোনো কথা বলার দরকার নেই। পাশে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

— “আপনার দোয়ার জন্য ধন্যবাদ, হুজুর।”— শান্ত গলায় বলল রাতুল।
ইমাম সাহেব মাথা নাড়িয়ে রাতুলের দিকে তাকালেন। তার চোখে কিছু বোঝার চেষ্টা চলছিল, তারপর মৃদু হাসলেন।
— “তোমার স্ত্রী ভাগ্যবান যে, এমন একজন মানুষ তার পাশে আছে, যে তাকে বোঝে, তার পাশে থাকে। আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন, বাবা।”
রাতুল কিছু বলল না, শুধু সম্মতির হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকালো।
চৈতী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। একবার শেষবারের মতো কবরের ওপর হাত বুলিয়ে নিল। বাবার মাটি, মায়ের মাটি—এই স্পর্শেই হয়তো একরকম শান্তি খুঁজে পেল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধীরে পেছনে ঘুরল। রাতুলের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল সে।
রাতুল হাত বাড়িয়ে দিল। চৈতী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই হাতের দিকে, যেন দ্বিধায় আছে। তারপর আস্তে করে হাত রাখল তার হাতে।
শহরের আলো-আঁধারির মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গাড়িতে বসেও চৈতী নিস্তব্ধ। সারা পথ একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন জানালার বাইরে তাকিয়ে সে হারিয়ে গেছে অন্য কোনো ভুবনে।
রাতুল গাড়ি চালাচ্ছিল ধীর গতিতে। তার এক হাত স্টিয়ারিংয়ে, অন্য হাত কনসোলে রাখা। মাঝে মাঝে এক ঝলক তাকিয়ে দেখছিল চৈতীকে।
এক সময় ড্যাশবোর্ড থেকে এক বোতল পানি বের করে চৈতীর দিকে বাড়িয়ে দিল।
চৈতী প্রথমে খেয়ালই করল না। রাতুল কিছু বলল না, শুধু বোতলটা তার সামনে ধরে রাখল।
কিছুক্ষণ পর চৈতী বোতলটা হাতে নিল। ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।
বাইরে রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠছে এক এক করে।
শহর নিঃশব্দে জেগে উঠছে, আর চৈতীর ভেতরটা নিঃশব্দেই আরও শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
রাতুল গভীর দৃষ্টিতে একবার চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলল,

— “তুমি ঠিক আছো?”
চৈতী কোনো উত্তর দিল না।
তার নিস্তব্ধতা রাতুল বুঝতে পারল। বুঝতে পারল, কিছু ব্যথার ভাষা থাকে না, কিছু কষ্টের উত্তর হয় না।
রাতুল আর কিছু বলল না।
কখনো কখনো কিছু না বলাটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হয়…
গাড়িটা থামল একদম নদীর ধারে। শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল যেন বহু দূরের কোনো স্মৃতি মাত্র—এখানে শুধু নীরবতা, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, আর চাঁদের মায়াবী আলোয় মোড়ানো এক স্নিগ্ধ রাত।
চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু মাঝেমধ্যে বাতাসের মৃদু শীষ ধরা শব্দ আর নদীর জলে লেগে যাওয়া ঢেউয়ের গুঞ্জন। দূরের কোনো এক বাড়ির আঙিনা থেকে মৃদু কুয়াশার মতো আলো ছড়িয়ে পড়ছে, তার ঠিক ওপাশেই নীরবে দুলছে কাশফুলের সারি।

চৈতী জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরের বাতাসে মুখ বাড়াল। চাঁদের আলোয় নদীর বুকে রুপালি ঝিলিক, হালকা বাতাস বয়ে আসছে, সেই বাতাসে তার হিজাবের প্রান্ত একটু নড়ল। হিজাবের ফাঁক গলে দু-একটা চুল বেরিয়ে এসে কপালের পাশে ঝুলে পড়েছে, সে খেয়াল করল না।
রাতুল নীরব চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। চৈতী কিছু বলল না, শুধু দু’হাত গুটিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।
— “নেমে আসবে?”
রাতুলের কণ্ঠ গভীর, ধীর, প্রশান্ত।

চৈতী কোনো কথা বলল না, শুধু দরজা খুলে আস্তে করে গাড়ি থেকে নামল। ভেজা ঘাসের উপর তার নরম পায়ের ছোঁয়া লাগল, চারপাশের বাতাসে হালকা সোঁদা গন্ধ।
একঝাঁক জোনাকি নদীর ধারে আলোকরেখার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা যেন রাতের গহীনে ছোট ছোট প্রদীপের মতো জ্বলে উঠছে, নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলছে।
চৈতী স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, এক মুহূর্তের জন্য তার চোখের গহীনে ছড়িয়ে পড়া শূন্যতা যেন ওই জোনাকিদের আলোয় ভরে উঠল।
রাতুল পাশে এসে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলল না।
কখনো কখনো নীরবতাই সবচেয়ে গভীর অনুভূতির ভাষা হয়ে ওঠে…
রাতুল ধীরে ধীরে চৈতীর হাত ধরল, তারপর তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল নদীর ঘাটের দিকে। নদীর তীরে একটা পুরনো ছোট ভাঙা ডিঙি নৌকা পড়ে ছিল, হয়তো বহুদিন কেউ ওটায় বসেনি। তবু চাঁদের আলোয় সেটাকে যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল—শান্ত, নির্জন, স্মৃতির মতো মায়াবী।
চৈতী কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে পড়ল নৌকার ধারে। তার হিজাবের ফাঁক গলে কয়েকটা চুল কপালের পাশে এসে পড়েছে, বাতাসে ওগুলো উড়ছে। চোখের দৃষ্টি স্থির, নদীর বয়ে চলা পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতুল তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকল, তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল,,

ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি…

তার কণ্ঠ গভীর, মৃদু, অথচ নদীর জলের মতো প্রবাহিত। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, নদীর ধীরস্রোতা ঢেউয়ের শব্দ, আর সেই সাথে রাতুলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন সময়ের গহীনে আটকে গেল।
চৈতী চুপচাপ শুনতে লাগল, চোখের পলকও ফেলছিল না, যেন এই মুহূর্তটা সে প্রাণভরে গ্রহণ করছে, নিজের ভেতরে গেঁথে রাখছে। তার মনে হচ্ছিল, এই গান, এই পরিবেশ—সব কিছু একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একটি একক অনুভূতি তৈরি করেছে, যা ভাঙা যাবে না।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩০

একঝাঁক জোনাকি এবার উড়ে এসে নৌকার চারপাশে আলোর রেখা টেনে নাচতে শুরু করল। চাঁদের আলোয় নদীর বুকে চিকচিক করা জলকণা আর রাতুলের গাওয়া সুর এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করল। সেই আবেশ যেন সময়ের সীমানা পেরিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার মতো কিছু, যেখানে শুধু ভালোবাসা, শান্তি আর নিরবতা বিরাজমান ছিল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩২