অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা সায়নের সাথে কথা বলা শেষ করে আফিফার কাছে এসে বসলো। আরিশাকে বসতে দেখেই আফিফা বলে উঠলো,”কি হলো বোনু? সায়নের সাথে কি কথা বললি তুই?”
আরিশা বললো,”উনি আমাকে এমটা প্রশ্ন করেছিলেন আর আমি ওনাকে আমার উত্তরটা দিয়ে এসেছি।”
“আর তোর উত্তর নিশ্চয়ই না ছিল?”
আরিশা মাথা নাড়ায়। আফিফা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, ভেবেচিন্তে নিয়েছিস তো?”

“আমি না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নেই না, আপ্পি। একটা মেয়ের জীবন কি শুধু বিয়েশাদি এসব নিয়েই গঠিত? ছোটবেলা থেকেই তো আমাদের এটাই শেখানো হয় যে, মেয়ে হয়ে জন্মেছ মানে তোমায় একসময় বিয়ে করতে হবে, নিজের স্বামীর সেবা করতে হবে, স্বামী যেমনই হোক, শ্বশুর বাড়ি যেমনই হোক না কেন সবার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আমি মোটেই তেমন ধারণায় বিশ্বাস করি না। জীবনে একবার বিয়ে করেছি আমি, যদিওবা নিজের ইচ্ছায় করিনি। কিন্তু সেই বিয়েতে যা যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তাতে আর আমার সংসারের প্রতি কোন রুচিই নেই। আমি এখন শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, নিজের একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে চাই। আজকাল কার যুগে একটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানো যে অনেক দরকার। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমার বাবা অনেক ক্ষমতাবান, তার অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে কিন্তু তার বাইরে গিয়েও আমি নিজের একটা পরিচয় গড়তে চাই। তাই এসব ব্যাপারে আমি আর মাথা ঘামাতে চাই না৷ আপাতত আমার চেষ্টা সামনের এইচএসসি পরীক্ষায় একটা ভালো রেজাল্ট করা তারপর ভালো কোথাও এডমিশন নেয়া। এসব বিয়ে, সংসার এসব নিয়ে আমি ভাবতে চাই না।”

আফিফা আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুই একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বোনু। আমার গর্ব হচ্ছে তোর কথাগুলো শুনে।”
দুজন মিলে গল্পই করছিল এমন সময় হঠাৎ করে আফিফার মাথা ঘুরে ওঠে এবং সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নেয়। আরিশা আফিফাকে সামলে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে আপ্পি? তুমি ঠিক আছ তো?”
“জানি না রে,মাথাটা কেন জানি ঘুরছে খুব।”
“আচ্ছা, চলো। তোমার রুমে চলো। তোমার এখন বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ, চল।”
আরিশা আফিফাকে ধরে তার রুমে নিয়ে যায়। কিন্তু রুমে যেতেই হঠাৎ করে আফিফা বমি করতে শুরু করে। আরিশা আফিফাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘর ও আফিফার শরীর পরিস্কার করিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলে কেন আপ্পি? আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

আফিফা বলে,”দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই৷ তুমি একটু আমার ওয়ারড্রব থেকে প্রেগ্যান্সির কিটটা নিয়ে আয় তো।”
আরিশা খুশি হয়ে বলে,”আপ্পি! কি বলছ তুমি? তারমানে আমি খালামনি হতে চলেছি?”
আফিফা কিছুটা লাজুক স্বরে বলে,”আগে দে..একটু পরীক্ষা করে দেখি।”
আরিশা আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”যদি সত্যি এমনটা হয় তাহলে আমি খুব খুশি হবো। আমি তো ভীষণ আনন্দিত।”

আফিফা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিশ্চিত হয় যে সে প্রেগন্যান্ট। আরিশা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে,”ইয়ে..আমি খালামনি হতে চলেছি। যাই, এই সুখবরটা সবাইকে দিয়ে আসি। তুমি বিশ্রাম নাও আপ্পি। ”
বলেই আরিশা রুম থেকে বের হয়। এদিকে আফিফা নিজের পেটে হাত রাখে। তাকে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে। আফিফা মনে মনে ভাবে,”আমি কি পারবো নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চার দায়িত্ব সামলাতে? এখনো যে আমার মেডিকেলের পড়াশোনা শেষই হয় নি। একসাথে কি আমি ডাক্তার ও মা এই দুই দায়িত্ব সামলাতে পারবো?”
এদিকে আফিফার খবরটা শুনে সবাই ভীষণ খুশি হয়। নির্ঝর তো এসেই আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ধন্যবাদ, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এত খুশির একটা সংবাদ দেবার জন্য।”
নিঝুম খান বলেন,”বাহ, লন্ডনে যাবার আগে এত খুশির খবর পাবো সেটা ভাবতেই পারি নি। আমি দাদিমা হতে চলেছি।”

নির্ঝর দেখে আফিফা একটু চিন্তিত। সে বলে,”তুমি কি কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ আফিফা?”
আফিফা বলে,”আমি কি নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সামলে একজন ভালো মা হতে পারব নির্ঝর? আমি কি ওকে একজন মায়ের ভালোবাসা দিতে পারব?”
নিঝুম বলেন,”কেন পারবে না? এই আমাকে দেখো না, আমিও তো ডাক্তার হবার পাশাপাশি মায়ের দায়িত্ব সামলেছি।”
ছবি বেগম এসে বলেন,”আর তোমার মাও তো একজন ডাক্তার। সেটা ভুলে গেছ দিদিভাই? সে তো তোমাকে আর আরিশাকে মানুষ করেছে নিজের দায়িত্ব সামলে। তুমিও পারবে। আর আমরা তো সবাই আছিই।”
আফিফা এবার একটু স্বস্তি পায়। আরিশা আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আর আমি তো আছিই..তোমার সন্তানকে মানুষ করতে আমিও তোমায় সাহায্য করবো আপ্পি।”
সবাই মিলে খুশিতে মেতে ওঠে।

দুই দিন পর,
বৃষ্টি নিজের ঘরে বসেছিল। আগামীকাল তাদেরকে লন্ডনে যেতে হবে। যদিওবা আফিফার সন্তানের আগমনের কথা শোনার পর তারা আরো কিছুদিন থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আবরাজ খানের ব্যবসায় একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, নিঝুম খানও হাসপাতাল থেকে এক্সট্রা ছুটি আর পান নি৷ তাই কালই তাদের ফিরতে হবে।
সেজন্যই বৃষ্টি এখন নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ করে আদৃতা তার রুমে এসে বলে,”ভেতরে আসবো।”
বৃষ্টি বলে,”আরে তুমি। হ্যাঁ, এসো।”
“সবকিছু গোছগাছ করা শেষ?”
“হুম, প্রায় শেষ।”
“তোমার নিশ্চয়ই ভীষণ ভালো লাগছে তাই না? খুব শীঘ্রই তুমি লন্ডনে যেতে পারবে। জানো লন্ডন একদম ছবির মতো সুন্দর শহর।”
“হ্যাঁ, আমাদের গ্রামের কিছু মানুষও লন্ডনে ছিল। তাদের কাছে শুনেছি অনেক।”

“গ্রাম বলতেই মনে পড়লো, লন্ডনে যাবার আগে তুমি যাদের কাছে এতদিন বড় হলে তাদের সাথে একবার দেখা করবে না? তারা তো আমার নিজেরও আসল মা-বাবা। চলো না, তাদের সাথে একবার দেখা করে আসি।”
বৃষ্টির হঠাৎ করে তাদের কথা মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। সে বলে,”দেখা তো করতে আমারও মন চাচ্ছে কিন্তু বাবা তো বলল, যাওয়ার আগে ওনাদের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করাবেন।”
“সেটা তো জানি। কিন্তু তাদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ তো পাবো না। তার থেকে বরং চলো, আমরা এখন তোমাদের গ্রামে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসি।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে মা-বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে আসি।”
আদৃতা বৃষ্টিকে আটকে বলে,”আরে যেও না..এখন যদি অনুমতি চাইতে যাও তাহলে আমাদের যেতে দেবে না। তার থেকে বরং চলো কাউকে কিছু না বলেই আমরা যাই।”
“কিন্তু না বলে গেলে যদি ওনারা দুশ্চিন্তা করেন।”

“আরে কেউ কিছু জানতে পারবে না। এখন তো রাত ১০ টা বাজে। সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা এখন বের হই রাত ১২ টার মধ্যে তোমাদের গ্রামে পৌঁছে যাব। তারপর আজকের রাতটা নাহয় ওখানেই কাটিয়ে আসব কাল সকাল সকাল চলে আসব। চিন্তা করো না, আমি গাড়ি নিচ্ছি। আমি কিন্তু ভালোই ড্রাইভ করতে পারি।”
“কিন্তু..”
“ওহ, বুঝেছি৷ তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারছ না, তাইতো? কোন ব্যাপার না। তাহলে যাওয়ার দরকার নেই।”
বলেই বৃষ্টি চলে যেতে নিতেই বৃষ্টি তার হাত ধরে আটকে বলে,”না, না আপু। আপনি ভুল ভাবছেন। মোটেই এমন না। চলুন,আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।”
কথাটা শুনেই আদৃতা বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর মনে মনে বলে,”এই যাওয়াই তোমার শেষ যাওয়া বৃষ্টি। এরপর তুমি আর কখনো এই বাড়িতে ফিরতে পারবে না। তোমাকে আমি চিরকালের মতো নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেব।”
“হ্যাঁ, চলো। এখনই বের হই আমরা।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪১

“আচ্ছা, চলুন।”
বলেই দুজনে বের হয় বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলেই। অতঃপর আদৃতা গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করে। বৃষ্টি তার পাশেই বসে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪৩