কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৩

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৩
মিসরাতুল রহমান চৈতী

গাড়ি ছুটে চলেছে…
শহরের রাস্তায় উঠতে না উঠতেই বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা উইন্ডশিল্ডে আছড়ে পড়তে শুরু করল।
চৈতীর হাত স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে আছে, তার চোখের কোনায় আতঙ্ক জমাট বাঁধছে।
পাশের সিটে রাতুল নিস্তেজ হয়ে বসে আছে। শরীর রক্তে ভিজে গেছে, শার্টের হাতা পুরোপুরি লাল হয়ে গেছে।
“আপনি ঠিক আছেন?”
কোনো উত্তর এল না।
চৈতী একবার পাশে তাকাল—রাতুল চোখ বন্ধ করে আছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।
তার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।
“না! এখনই কিছু হতে পারে না!”
গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে।
রাতুল এবার মৃদু স্বরে বলল, “ডানে নাও…”
চৈতী আঁতকে উঠে তার দিকে তাকাল, “আপনি কথা বলছেন, মানে… মানে কিছু হয়নি, তাই তো?”
রাতুল ঠোঁটের কোণে একটা ক্লান্ত হাসি দিল, “একটা গুলি হাতের মাংস ছুঁয়ে গেছে, আরেকটা পায়ের মাংসে বসে গেছে। মারা যাব না।”

চৈতী কপালে হাত রাখল, সে জানে না এটা স্বস্তির নাকি আরও ভয় পাওয়ার মতো কথা।
“আপনাকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
“না… হাসপাতাল নয়…”
“কিন্তু আপনি…!”
“আমি বলেছি না! হাসপাতালে নিলে ঝামেলা হবে!” রাতুল এবার কড়া স্বরে বলল।
চৈতী থমকে গেল।
গাড়ি তখন শহরের আলোতে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু কোথায় যাবে? কোথায় নিরাপদ?
চৈতী দ্রুত ফোন বের করল, কাকে ফোন করবে বুঝতে পারছে না।
ঠিক তখনই রাতুল কষ্টে উঠে বসল, এক হাতে ক্ষতচিহ্ন চেপে ধরে বলল, “একটা কাজ করো…”
চৈতী দ্রুত মাথা নাড়ল, “বলুন!”
রাতুল একবার চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল, তারপর বলল, “সোজা যাও, শহরের শেষ প্রান্তে একটা পুরোনো বাড়ি আছে। ওখানে নিয়ে চলো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চৈতী কিছু না বুঝলেও আর প্রশ্ন করল না।
গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।
পেছনের আয়নায় একবার তাকিয়ে দেখল, কেউ অনুসরণ করছে না।
গাড়ি ছুটে চলছে শহরের শেষ প্রান্তের দিকে। রাস্তার লাইটগুলো ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, আর রাত যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে।
চৈতীর কপাল ঘামতে শুরু করেছে, তার হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপর শক্ত হয়ে আছে।
পাশে বসে থাকা রাতুল চোখ বন্ধ করে আছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। রক্তের গন্ধ গাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে।
চৈতী আর দেরি করতে চাইল না।
“কোথায় যেতে হবে?” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা।
রাতুল আস্তে করে চোখ খুলল। “সোজা যাও… সামনে একটা বাঁক আছে, ওখান থেকে ডানে নাও।”
চৈতী কোনও প্রশ্ন করল না, গাড়ি আরও দ্রুত চালিয়ে বাঁক ঘুরল।

অবশেষে তারা শহরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল।
সামনে একটা পুরোনো, পরিত্যক্ত বাড়ি। চারপাশে ঘন গাছপালা, আশপাশে তেমন কোনো ঘরবাড়ি নেই।
চৈতী গাড়ি থামাল।
“এখানে কেন?”
রাতুল নিঃশ্বাস নিল, “ভেতরে চলো…”
চৈতী তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রাতুলের দরজা খুলল।
“আমি আপনাকে সাহায্য করি…”
রাতুল এবার বাধা দিল না।
চৈতী তার একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোলো।
পুরোনো কাঠের দরজা ঠেলে তারা ভেতরে ঢুকল।
বাড়ির ভেতরে ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, মনে হচ্ছে বহুদিন কেউ এখানে আসেনি।
“এটা কার বাড়ি?” চৈতী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
রাতুল কষ্টেসৃষ্টে একটা সোফায় বসল।

তারপর ফিসফিস করে বলল, “এটা আমার নিজের একটা জায়গা… জরুরি মুহূর্তের জন্য রেখেছিলাম।”
চৈতী বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু এখন এসব প্রশ্নের সময় নয়।
সে দ্রুত আশপাশ দেখে নিল, কিছুটা পুরোনো কিন্তু একটা ছোট্ট আলমারি দেখা যাচ্ছে।
“আমি আপনার ক্ষতগুলো পরিষ্কার করি।”
রাতুল কিছু বলল না।
চৈতী দ্রুত একটা কাপড় নিয়ে এগিয়ে এল, গ্লাসে থাকা পুরোনো পানি দিয়ে কাপড়টা ভিজিয়ে রাতুলের হাত পরিষ্কার করতে শুরু করল।
রাতুল চোখ বন্ধ করে আছে, যেন ব্যথা অনুভব করলেও কিছু বলবে না।
চৈতী এতদিন শুধু দেখেছে, আজ নিজের হাতে করছে।
তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।
রাতের গভীরতা বাড়তে লাগল।

চৈতী রাতুলের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে করতে কাঁপছিল। তার হাত শক্ত, চোখে ভয় মিশে আছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে রাখছে।
রাতুল সোফার ওপর আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ব্যথায় তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।
চৈতী কাপড়টা আরও শক্ত করে ক্ষতস্থানের চারপাশে চেপে ধরল।
“উঁহ… আস্তে…” রাতুল এবার গুঙিয়ে উঠল।
চৈতী সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল। “আমি… আমি কি করব এখন?”
রাতুল আস্তে করে চোখ খুলল, তার নিঃশ্বাস কাঁপছে। সে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে চৈতীর দিকে এগিয়ে দিল।

“আসিফকে মেসেজ করো। লোকেশন ট্রেস করে যেন এখানে আসে… আর সাথে ডাক্তার নিয়ে আসে।”
চৈতী দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিল। হাত কাঁপছে, কিন্তু দেরি করার সুযোগ নেই।
সে দ্রুত আসিফের নম্বরে মেসেজ টাইপ করল—
“লোকেশন ট্রেস করো, তাড়াতাড়ি এসো! সাথে ডাক্তার আনো !”
সেন্ড বাটনে চাপ দিতেই মোবাইলটা কাঁপতে লাগল।
আসিফের রিপ্লাই এলো সাথে সাথেই—
“কী হয়েছে ভাই? ”
চৈতী দ্রুত টাইপ করল—
“গুলিবিদ্ধ হয়েছে… জলদি আসেন!”

রাতুল চোখ বন্ধ করে ছিল, কিন্তু কপালের ভাঁজ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে পুরোটা শুনতে পাচ্ছে।
চৈতী মোবাইলটা পাশে রেখে আবার রাতুলের ক্ষতস্থানের দিকে মন দিল।
“আর কিছু করতে হবে?” তার কণ্ঠ এবার নরম, যেন সে ভয় পাচ্ছে।
রাতুল আস্তে করে বলল, “হাত চেপে ধরে রাখো… যাতে রক্ত বেশি না বের হয়।”
চৈতী দ্রুত নির্দেশ মেনে নিল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩২

বাইরে গভীর রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ।
কিন্তু এই নীরবতার মাঝেও একটা অদ্ভুত ভয় লুকিয়ে আছে।
আসিফ কি সময়মতো পৌঁছাবে?
নাকি এর মাঝেই আরও কিছু হতে চলেছে?

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৪