প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২৭

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২৭
মিমি মুসকান

প্রান্তিক চৌধুরী হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। প্রিয়তা আগে থেকেই গাড়িতে বসা ছিল।‌ প্রান্তিককে গাড়ির কাছে আসতে দেখে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তাদের মধ্যে আদৌও কি কথা হলো? কতদূর হলো? এসব কিছু্ই জিজ্ঞেস করল না। প্রান্তিক ও আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। ফ্লাইওভারের উঠতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল হুট করে। প্রিয়তা তার বাহু আঁকড়ে চোখ বুজে নিল। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। গাড়ির গতি ফের কমিয়ে আনল সে। চোখ মুখ শক্ত নিল আচমকা। ঘাড়ের কাছের রগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে রাগে। ডান হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। বা হাতে ফোনটা নিয়ে কাউকে মেসেজ করছে বিদ্যুতের গতিতে। ইজান শিকদার এখনো হাসি খুশি আছে। সুস্থ আছে! সে এতো ভালো না যে তার সুস্থতা কামনা করবে। এসব চোখে দেখা যায় না!

ইজান শিকদার এসে ঢুকল আরিনার কক্ষে। আরিনা শেখ তখন ঘুমাচ্ছে। নিঃশব্দে টুল টেনে তার বিছানার পাশে বসল সে। প্রহর কাটল। আরিনার ঘুম ভাঙল। চেয়ে ফিরে তাকাল। প্রান্তিক কেই প্রথমে নজর পড়ল তার। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেখা দেখা গেল। ইজান শিকদার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো! আমি আজ একটা কাজ করেছি জানো তো?”
“কি?”
“প্রান্তিককে বলে দিয়েছি আমি তাকে আর ভালোবাসি না!”
“সত্যিই কি তাই?”
আরিনা ঠোঁট চেপে ধরল। চোখ মুখ শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ ওই। মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না। হেরে গেছি আমি, খুব বাজে হেরে গেছি। নিজের কাছে নিজেই এতো নিচু হয়ে গেছি যে…
শেষ করতে পারল না। হাঁপানি উঠে গেল বোধহয়। হম্বিতম্বি করে ইজান শিকদার তার হাত চেপে ধরল।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে! জোর করে কিছু করার দরকার নেই। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!”
বুক ভরে শ্বাস নিল আরিনা। ইজানের হাতটা শক্ত করে ধরে নিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরে চাইল তার মুখশ্রীর দিকে। আবদার রাখল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি ছেড়ে যাবে না তো আমায়?”
কণ্ঠস্বর কাঁপছে! মনে হচ্ছে অ*ন্যায় কোনো আবদার। ইজান শিকদার মুচকি হেসে উঠল। মুখ ফুটে জবাব দেবার দরকার নেই। চোখ যে মনের কথা বলে!
রাতে একটা জরুরী কাজে ইজান কে বের হতে হলো। যাবে আর আসবে। ততোক্ষণ আরিনার সাথে তার মা সাথে থাকবে। ইজান দ্রুত গতিতে পা ফেলে গাড়ির কাছে যাচ্ছে। ঢুকেই গাড়ি স্টার্ট দিল। তাড়াহুড়ো বেশ! সময় নষ্ট করার সময় যেন হাতে নেই। গাড়ির গতি বাড়িয়ে মেইন রাস্তার উঠে গেল।
মেইন রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে বাতাসের বেগে। আশেপাশে গাড়ি কম। ঢাকা শহরে এই চিত্র সহজে মিলে না। দূরের ল্যাম্পপোস্ট গুলোকে আকাশের তারার মতো মনে হচ্ছে। কাছে আসতেই মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার‌‌ আলো ঢেকে দিচ্ছে। সামান্য এই দ্যুতি অন্ধকার সরিয়ে দিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ।
ইজানের বা হাতে ফোন। ডান হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। চোখ সামনের দিকে। হঠাৎ দেখল সামনের দিক থেকে উল্টো পথে দ্রুত গতিতে গাড়ি তার দিকে ধে*য়ে আসছে।‌ সেকেন্ডের মধ্যে চমকে উঠল। কপালে ভাঁজ পড়ল। গাড়ির হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে গাড়ি সরিয়ে নিল। তখনি পেছন থেকে আরেকটা বড়সড় গাড়ি এসে ধা*ক্কা মার*ল তাকে। কিছু সেকেন্ডের জন্য কন্ট্রোল হারি*য়ে ফেলল সে।

বোধ হলো। শক্ত হাতে আবারো গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে রাস্তায় এলো। গাড়ি সচল হলো ফের। পুরো রাস্তা এবার শান্ত আর নিরব। আরেকটু হলেই পাশের রাস্তায় গাড়ি উ*ল্টে যেত। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। এই ভেবে দুমিনিট থামল।
কয়েক দফা শ্বাস প্রশ্বাস গাড়ি চালাতে লাগলো আবারো। আচমকা এরই মধ্যে দুটো কালো রঙের গাড়ি এসে হাজির। একটি তার পাশে আরেকটি পিছনে। দু জায়গা থেকেই ধা*ক্কা দেওয়া হচ্ছে পা*ল্লা দিয়ে। পাশের রাস্তার ব্লকে ধা*ক্কা খেয়ে দ্রুত ব্রেক কসল সে। গাড়ি দুটো এবার চলে গেছে। মাথায় চো*ট পেয়েছে ভীষণ। র*ক্ত পড়ছে গড়াগড়িয়ে!
সুনসান নিরব জায়গা। আশপাশ মানুষের অস্তিত্ব মেলা মুশকিল। বড় দুটো রাস্তা কেবল সোজা চলে গেছে জনসমাগমে। রাস্তার দু ধারে কেবল মাঠের চিহ্ন। এখানে তাকে মে*রে ফেলা খুব একটা মুশকিল কাজ নয়। কাজটা কার হতে পারে এই নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রান্তিক তাকে ছে*ড়ে দিবে এই চিন্তা করাই যেন অ*ন্যায়। আজ তার চোখ দেখেই বুঝে গেছিল। সুযোগ পেলে মে*রে মাটি চাপা দিয়ে দিবে। মৃ*ত্যুকে সে ভয় পায় না। কিন্তু আরিনা! আরিনা কি হবে?

সিটে হেলান দিয়ে বসল। হাল কি ছেড়ে দিল তবে? চোখ মুখ করে মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে কেবল। শরীর ক্লান্ত ভীষণ। বিপদে পড়ে সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিচ্ছে কোনো অদৃশ্য এক শক্তি। ঝাপসা চোখে সামনে তাকাল। গাড়ি আরেকটা আসছে। ছোট ট্রাক কি?
স্পষ্ট দেখছে এবার! ছোট ট্রাকই তো। তার বরাবর উল্টো পথে এদিকেই আসছে। কি করবে? গাড়ি ঘুরিয়ে নিবে? হাত রাখল হ্যান্ডেলে! গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ফের। পেছন পেছন ফসফস করছে। যেন সিংহের গর্জন। তার অন্তিম বার্তার আহ্বান!
কিন্তু হা*র মানবে না। এতো সহজে হা*র মানার পাত্র সে নয়। গাড়ির ইঞ্জিন আবারো চালু করল। প্রখর দৃষ্টি সামনের দিকে। শক্ত হাতে হ্যান্ডেল চেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনের গাড়িটাও তাকে অনুসরণ করছে। মুখোমুখি সংঘর্ষ হবার আগেই গাড়ি ঘুরিয়ে সাইড কেটে গেল। তবে শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। ওদিক থেকেও যে আরেকটি ট্রাক…

শক্তিশালী এই ট্রাকের কাছে তার গাড়ি পে*ড়ে উঠবে না। তার শক্তির কাছে হার মেনে গাড়ি পেছনে ঠেলতে লাগল। রীতিমতো তাকে ধা*ক্কা দিয়ে গাড়ি পেছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতই ইজান শিকদার চেষ্টা করুক কি না, গাড়ি সাম*নে আগাচ্ছে না।
ইজানের ঘাম ছুটে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার পেছন দেখছে। গাড়িটা কি তবে খা*দে ফে*লে দিবে? হঠাৎ গাড়ির সামনের আয়না ভে*ঙে কতো গুলো রড ঢুক*ল হৃ*দয় ভে*দ করে। গাড়ির নরম শক্ত সিটের এফোঁড়*ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। ভ*য়ার্ত আঁখি দুটি কেবল দেখছে স্থির দৃষ্টিতে। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল। ঢোক গিলছে বারংবার। পাশের সিটের এরকম হাল তারও হতে পারে। কি সাং*ঘাতিক হুম*কি!
চেতনা ফিরতে সময় লাগল। কিছুক্ষণ আগে ভয়ং*করভাবে গর্জে উঠা সময় আবারো নিশ্চুপ হয়ে গেল। ইজান শিকদার সিটে মাথা হেলিয়ে দ্রুত ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে। এ কি রকম সাপ সিঁড়ি খেলা। সে হচ্ছে একটা ইঁদুর। বড় বিড়াল ছানা‌ তাকে এই ধরে এই ছেড়ে দিচ্ছে। মে*রে ফেলছে না আদৌও। মৃ*ত্যুর মতো কঠিন আর ভারীবহুল শব্দটা আজ ভ*য় দেখাচ্ছে তাকে।

ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠল সে। হাতরিয়ে নিচ থেকে ফোন তুলল। আননোন নাম্বার। কার হতে পারে সে জানে? সময় নষ্ট না করে তুলে নিল। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ। গলা ফাটিয়ে হাসছে কেউ। অন্ধকারে গা শি*উরে উঠা হাসি। ইজান শিকদার কানে ফোন চেপে আছে। হাসি থামল। ওপাশ থেকে বলল,
“বেঁচে আছিস? আছিস আছিস, নাহলে ফোন রিসিভ করলি কিভাবে?”
“তুই কি আমায় মা*রতে চাস?”
“আমি চাইলেই তা করতে পারি। ডেমো দেখলি কি না?”
ইজান শিকদার মাথাটা আবারো সিটে হেলিয়ে দিল। তাচ্ছিল্যের হাসি তার চোখে মুখে। প্রান্তিক চৌধুরী কি আর ওসব দেখতে পেলো নাকি? না পায়নি! তাই তো দ্বিগুণ উৎসাহে বলল,
“বেঁচে থাকিস! তোর কিছু হ*য়ে গেলে আমার বউকে আমি কি জবাব দেবো? ও একটু ভালো কি না! তোর কিছু হলে বলবে আমি করেছি। সাবধানে থাকিস!”

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২৬

আবারো সেই কু*খ্যাত হাসির শব্দে ফোন কেটে দিল। ইজান শিকদার হেসে উঠল আচমকা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে একটা সিগারেট ধরাল। গাড়ির জানালা খুলে সিগারেট ধুয়ে শূন্য উড়িয়ে দিয়ে বিরবির করল,
“আমায় বাঁচিয়ে রেখে তুই যে কতো বড় ভুল করলি তা হাতে নাতে টের পাবি প্রান্তিক চৌধুরী!”
আবারো ঠোঁটের পাতায় সিগারেট রাখল সে। হাসি এবার তার চোখে মুখে!

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২৮