আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৮
তানহা ইসলাম বৈশাখী
নিস্তব্ধতায় ঘেরা রুম। আবছা আলো আবছা অন্ধকার। রুমে শুধু ড্রিম লাইটের আলো জলছে সাথে ল্যাপটপের হালকা আলো। প্রার্থ ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে। দুদিন পরেই তাদের বড় কনসার্ট আছে। সেটা নিয়েই কাজ করছে। আগেরবারব ঝামেলা হওয়ায় এবার সিকিউরিটি টাইট রাখছে। যাদের আগের বারের ঝামেলার কেসে জেলে নেওয়া হয়েছিলো তাদের জামিন হয়ে গেছে। ওরা আবার যে কিছু করবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। বিশেষ করে রক রাইডার্সের লিডার রাজিব। ছেলেটা হাত ধুয়ে পিছে পড়েছে তাদের। জনপ্রিয়তায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি এজন্য তাদের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে চাইছে। আবার ভার্সিটি লাইফেও তাদের মাঝে ছিলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এবার আর ছেড়ে দেবে না প্রার্থ এবারের ফাংশনে যদি কোনরকম ব্যাঘাত সৃষ্টি করে তাহলে তাকে পার্মানেন্টলি জেলে দেওয়ার ব্যাবস্থা করবে সে।
ল্যাপটপে কিছুক্ষণ কাজ করার পর আর মন টিকলো না তার। বন্ধ করে রেখে দিলো সাইডে। এদিকে ফোনে শুধু মেছেজের টুংটাং শব্দ আসছে। প্রার্থ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হৃদয়রা সকলে কথা বলছে। প্রার্থ ল্যপটপ হাতে নেওয়ার আগে দেখে গেছে ওরা কথা বলছে। এখনো বলেই যাচ্ছে। প্রার্থ কাউচে গা এলিয়ে ঢুকলো চ্যাটে। সেখানে প্রার্থকে নিয়েই গসিপ চলছে।
হৃদয় বলছে।
“-শা*লা কি আদোও পুরুষ? বউ বাপের বাড়ি রেখে আসছে ১৫ দিন হলো তাও বউয়ের প্রতি কোন মায়া নাই।আরে ভাই রাতের পিনিক সামলাতে না পেরেও তো বউয়ের কাছে ছুটে যাওয়া যায়। আমি বাবা বিয়ের পর এতদিন বউ ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।
সবাই হা হা রিয়েক্ট দিলো হৃদয়ের মেছেজে। প্রার্থ বললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“-এজন্যই তুই হৃদয় আমি প্রার্থ।
“-কিরে ভাই? তুই কখন এলি? আগে বলবি না?
অর্নব বললো।
“-প্রার্থ! কার্তিকের বিয়ে তো সামনে রবিবারেই। প্রিন্সেস কে কেন আনছিস না?
কার্তিকও বললো।
“-হ্যা প্রার্থ পুষ্পকে ছাড়া কিন্তু তুই বিয়েতে আসতে পারবি না। সুস্মিতা বারবার বলেছে প্রার্থ যেন পুষ্পকে নিয়ে আসে। ও তো একবারো পুষ্পকে দেখেনি তোদের বিয়ের পর। বিয়েতে না আনলে আমাকে বকবে।
রকি বললো।
“-ওই নমুটাও আসবে নাকি আবার তোদের বিয়েতে? ও তো আবার সুস্মিতার ভালো বন্ধু।
কার্তিক বললো।
“- নাহ সমৃদ্ধির সাথে এখন সুস্মিতার তেমন সম্পর্কও নেই। আমিও ওকে বলেছিলাম সমৃদ্ধিকে যেন না ডাকে বিয়েতে।ও বলেছে বলবে না।
রকি বললে।
“-তাহলে ঠিক আছে।
সমৃদ্ধি আর সুস্মিতাও ছিলো প্রার্থদের ব্যাচের। কার্তিকের তখন সুস্মিতার সাথে মাখোমাখো প্রেম। বলতে গেলে ওদের গ্রুপের সবাই তখন প্রেম করে। হৃদয় তো কলেজ লাইফ থেকেই মেয়েবাজিতে এক্সপার্ট। রকিরও হৃদয়ের মতো অবস্থা। অর্নব তিনটে প্রেম করলো কিন্তু তিনটাই তিন মাসের বেশি টিকাতে পারেনি। কার্তিক তখন মজে ছিলো সুস্মিতাতে। দুজনেই সনাতন ধর্মাবলম্বী। সুস্মিতার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো সমৃদ্ধি। সমৃদ্ধি যে প্রার্থকে পছন্দ করতো সেটা জানতো সবাই। প্রার্থ নিজেও জানতো। তবে এ নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। কিন্তু তার ইঁচড়েপাকা বন্ধুগুলো আছে না? সবাই প্রেম করছে প্রার্থ করবে না এটা তো খারাপ দেখায়। ইনিয়ে বিনিয়ে ঢুকিয়ে দিলো দুজনকে প্রেমের মাঝে। সমৃদ্ধিও দেখতে সুন্দরী এবং ভদ্র টাইপ ছিলো তখন।সে প্রেম চললো দের বছরের মতো। মাঝে কয়েকবার ব্রেকআপ হতো আবার সমৃদ্ধিই বুঝিয়ে শুনিয়ে সব ঠিক করে নিতো। তখন প্রার্থর কাছে কিছুই নেই। বাবা মারা গেলো। বিজনেস ডাউন হয়ে গেলো। প্রার্থ তো সেখানে কখনো হাতও লাগাবে না তার ভালো লাগে না বিজনেস করা। তখন ব্যাবসার হাল পুরোপুরি পড়লো আশরাফ সাহেবের উপর। প্রার্থ তখন বেকার। ভার্সিটি আসে যায় এই আরকি। সমৃদ্ধির পেছনে ওতো টাকাও খরচ করে না। তখনই সে পায় রাতুল নামের হাই ফাই ক্লাসের ছেলেকে। বাবার অঢেল টাকা। সমৃদ্ধি সুন্দরী হওয়ায় তাকে একবার প্রপোজ করেছিলো। ওই একবারেই সে রাজি হয়ে যায়। ভুলে যায় দের বছরের সম্পর্কের কথা। তখনও প্রার্থ কিছু জানতো না কারন প্রার্থর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সে রাতুলের সাথে ডেট করতো। মানে ডাবল টাইমিং। একুলও চাই তার ওকুলও চাই। প্রার্থ এসব জানতে পেরে সাথে সাথে ছেড়ে দেয় তাকে। যার কাছে সম্পর্কের থেকে টাকার মূল্য বেশি সে অন্তত প্রার্থর আপন মানুষ হতে পারে না।
বন্ধুদের মাঝে বেশ অনেকক্ষন আড্ডা দেওয়া হলো। অর্নব প্রার্থকে জালানোর জন্য বললো।
“- আচ্ছা প্রার্থ প্রিন্সেসকে তুই আনতে যাবি নাকি আমি গিয়ে সোজা বিয়েরদিন নিয়ে আসবো কার্তিকের ওখানে।
প্রার্থ শুধু বললো।
“-প্রয়োজন নেই। আমি আছি।
ব্যাস আর কিছু বললো না বলতে দিলোও না। গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে এলো। টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো ফোনটা। মাথা এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করছে। অশান্তি অশান্তি লাগছে। যে শান্তির জন্য তাকে তাড়িয়ে দিলো বাড়ি থেকে সে শান্তিটা পেলোনা প্রার্থ। উল্টো অশান্তি হচ্ছে। ফাকা ফাকা লাগছে সব। কালকে তো প্রার্থর নিজেকে পাগল মনে হয়েছে। রাতে ঘরে ফিরলে মনে হয়েছে পুষ্প ঘরে আছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীর পায়ে গিয়ে যেই ছুতে গেছে তাকে ওমনিই সব হাওয়া হয়ে গেছে। হ্যালুসিনেশন কোন পর্যায়ে চলে গেলে লোকে এরকমটা দেখে!
ওইদিন পুষ্পকে বাড়িতে আনতে তো পেরেছিলো কিন্তু বাড়িতে রাখতে পারেনি। মায়ের সাথে কথা বলে তাকে পরিক্ষার বুঝ দিয়ে চলে গেছে আবার।
সেইযে সেদিনই দেখেছে তাকে তারপরে কতগুলো দিন চলে গেলো না আছে পুষ্পর দেখা না কোন কল। আগে তো এমন হয়নি। সে তো চেয়েছিলো পুষ্প চলে যাক জীবন থেকে। তাহলে এখন এত কষ্ট হচ্ছে কেন?এই অনুভুতির নাম কি?
প্রার্থর আর ভালো লাগছে না এসব। এই কদিনেই মেয়েটা কেমন জাদু করে রেখে গেছে। এমন কোন সময় নেই যখন তাকে মনে পরে না। যেন অভ্যেসে পরিনিত হয়ে গেছে সে। প্রতিবার যখন পুষ্পকে খুব করে মনে পড়ে তখনই লেগে যায় ভেতরের দন্ত। মস্তিস্ক আর মনের দোলাচলে নিজেকে পাগল মনেহয়। মন বলে এক কথা মস্তিস্ক বলে আরেক কথা।
জমা হয় হাজার হাজার প্রশ্ন। যেগুলোর একটা উত্তরও তার কাছে নেই।
এইযে বুকের ভেতর কেমন করছে। খালি খালি লাগছে সব। এগুলো কেন হচ্ছে? ইচ্ছে করছে পুষ্পকে নিজের চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে। তারপর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করতে। কেন হচ্ছে এমন? পুষ্পরও কি এমন লাগে প্রার্থর জন্য? এটাকে কি ভালোবাসা বলে নাকি অন্যকিছু ?
আর ভাবতে পারলো না ছেলেটা। চট করে উঠে দাঁড়ালো। ফোনটা হাতে তুলে দেখলো ঘরিতে রাত প্রায় দশটা। আগে পিছে কোনকিছু না ভেবেই গাড়ির চাবি হাতে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
ঘরিতে রাত তখন সারে দশটা। প্রার্থ এসে পৌছালো পুষ্পদের বাড়ির সামনে। গাড়ি একপাশে পার্ক করে এসে দরজার সামনে দাড়ালো। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে কলিং বেলে চাপ দিলো। বেশ কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলেন পূর্নতা বেগম। হয়তো শুয়ে পড়েছিলো তারা। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর তখনই বেল বেজে উঠে।
প্রার্থকে বাইরে দেখে ভদ্রমহিলা অবাক হয়। অবাকের রেশ নিয়েই বলে।
“-প্রার্থ তুই? এত রাতে এলি। সব ঠিক আছে?
প্রার্থ স্বাভাবিক স্বরে বললো।
“-সব ঠিক আছে ছোট মা। পুষ্প কোথায়?
“-ও তো ঘরে। এত রাতে আসলি কিছু হয়নি তো সত্যি করে বল। তোর আঙ্কেল কি যেন বললো তোদের মাঝে নাকি কি হয়েছে। সব ঠিক আছে তো সত্যি?
“-ছোট মা এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবো না ভেতরে ঢুকবো?
“-হ্যাঁ হ্যাঁ আয় বাবা ভেতরে আয়।
প্রার্থ ভেতরে ঢুকলো। প্রত্যয় সাহেব নিজেদের ঘরে ছিলো। প্রার্থর শব্দ পেয়েই বেড়িয়ে এলো। সামনাসামনি দাড়াতেই প্রার্থ সালাম দিলো তাকে।
সে সালামের উত্তর নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো।
“-তুমি এতরাতে এখানে কি করছো।
“- আর্জেন্ট কাজ ছিলো আঙ্কেল। পুষ্প কোথায়?
“-কেন? ওকে দিয়ে তোমার কি কাজ?
প্রার্থ সৌজন্যতা স্বরূপ হেসে বললো।
“-সেটা আপনাকে এখন বলতে পারছি না। আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় আরকি। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি।
ভদ্রলোক একটু কেশে সরাসরি বললো।
“- তুমি তো আমার মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মানো না তাহলে কিসের ব্যক্তিগত?
“-আমি আপনাকে বলেছিলাম বুঝি একথা? সে তো দিব্বি আমার বউ হয়ে ঘুরছে। বাধা দিয়েছি কখনো? আমার মনে হয় না আমার আর আমার বউয়ের মাঝেকার বিষয় নিয়ে আপনার কথা বলা উচিত।
জামাই শশুড়ের নিরব যুদ্ধ চলছে। আগে থেকেই তাদের দুজনের কম বুনে। সব সময় একটা নিরব যুদ্ধ চলের দুজনের মাঝে। পূর্ণতা বেগম বিষয়টা বুঝতে পেরে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললো।
“-তুমি থামো তো। ও এসেছে মাত্র তুমি শুধু প্রশ্ন করেই যাচ্ছো। যেতে দাও ওকে পুষ্পর কাছে। কাজ তো থাকতেই পারে। প্রার্থ বাবা তুই উপরে যা। পুষ্প রুমেই আছে।
প্রার্থ আর থামলো না। হেটে উপরে চলে গেলো। প্রত্যয় সাহেব চোখ মুখ আধার করে বললো।
“-তোমার বোনপো এক নাম্বারের বেয়ারা একটা ছেলে।
তিনি ফুসে উঠলেন।
“-কেন? আমার বোনপো তোমার কি করলো? তুমিই তো আসার পর থেকে আজব আজব প্রশ্ন করে যাচ্ছো। এখন ও শুধু আমার বোনপো না তোমার মেয়ের জামাইও। এখন তোমার এমন ব্যাবহার শোভা পায় না।
পূর্নতা হন হন করে হেটে চলে গেলো রুমে। ভদ্রলোক হেরে যাওয়ার মতো তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেও চলে গেলো।
প্রার্থ শেষ সিঁড়িতে উঠার সময় দেখা হলো প্রিয়ার সাথে। প্রিয়া নিচেই নামছিলো বোধহয়। প্রার্থকে নিজের সামনে দেখে অবাক চোখে তাকালো। সন্দিহান গলায় বললো।
“-প্রার্থ ভাই! তুমি এখানে? কিছু হয়েছে?
প্রার্থ স্বভাবতই বললো।
“-না।
“-তাহলে তুমি এখানে এত রাতে?
“-তোর বুবু কোথায়?
“-বুবু তো ঘরেই। কিছু হয়েছে? হঠাৎ এত বুবুর খোজ করছো। বুবুকে নিতে এসেছো?
“-হুম।
প্রিয়া উৎফুল্লতায় বলে উঠলো।
“-কি! সত্যি? তোমাদের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে?
“-না। সর তুই যেতে দে।
প্রিয়া জায়গা করে দিলো। বললো।
“-আচ্ছা যাও। সব ঠিক করে নিও হ্যাঁ। বুবুকে আর কষ্ট দিও না।
প্রিয়া যেতে নিলে প্রার্থ ডেকে উঠলো ওকে। গম্ভীর স্বরে শুধালো।
“-প্রিয়ু!
প্রিয়া থেমে বললো।
“-হুম।
“-অন্ত’র সাথে কথা হয়েছে তোর?
প্রিয়ার মুখে নিমিষেই আঁধার নেমে এলো। মুখ আমাবস্যার অমানিশায় ঢেকে গেলো মুহুর্তেই। বললো।
“-না আমি কথা বলি না ওর সাথে।
“-কেন?
প্রার্থর স্বর গম্ভীর থেকে গম্ভীর হচ্ছে। প্রিয়া ঘাবড়ে যায় তাতে। আমতাআমতা করে বললো।
“- ও তোমার কাছে আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে।
প্রার্থ ভ্রু উচিয়ে বললো।
“-ও কখন কি বললো আমার কাছে?
“-বলেছে। আমার আর হৃদয় ভাইকে নিয়ে বলেনি কিছু?
“-না তো।
প্রিয়া ঢোক গিলে। বলে রয়েসয়ে।
“-ওইদিন তুমি যে বললে হৃদয় ভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে।
“-তো? আমি কিসের জন্য দূরে থাকতে বলেছি তুই কিকরে জানলি?
“-না মানে তুমি বললে তাই ভাবলাম অন্ত ভাই বুঝি বানিয়ে কিছু বলেছে তোমাকে?
“-অন্তকে আমাকে কিছু বলতে হবে কেন? আমি কি অন্ধ? আমার চোখের সামনে কি কি হয় আমি বুঝিনা? হৃদয় তোর জন্য ঠিক নয়। দূরে থাকবি ওর থেকে।
“-কেন?
একবুক সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রশ্নটা। যেখানে প্রার্থ হাতেনাতে ওকে ধরে ফেলেছে সেখানে ওর আর এগুলো বলার সাহস থাকবে না তবুও মনে সাহস জুগিয়ে প্রশ্নটুকু করলো।
প্রার্থ চোখ বুজে কপালে দু আঙ্গুল ঘষে। শান্ত গলায় বলে।
“-তোদের দুই বোনের নজরে কি আমার বন্ধুদের ছাড়া আর কাউকে পরে না? আর তুই? তোর সাহস বেশি বেড়ে যাচ্ছে না? আমি যেটা বলছি সেটা চুপচাপ শুনবি বাড়তি কথা পছন্দ না আমার। ফের যদি তোকে হৃদয়কে নিয়ে মাতামাতি করতে দেখি তাহলে পড়ালেখা সব বন্ধ করে দেবো। টাকলা বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। তারপর করিস সংসার।
প্রিয়াকে ওয়ার্ন করেই চলে গেলো সামনে থেকে। প্রিয়া প্রার্থর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কেদে দিলো। প্রেম হওয়ার আগেই সবকিছু শেষ করে দিলো তার ভাই। আরো কত কী বলে গেলো। প্রিয়া কান্না করা ছাড়া আর কিছুই উপায় পাচ্ছে না। বুক ফুরে শুধু কান্নাই আসছে।
প্রার্থ পুষ্পর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। দরজা টা হাট করে খোলা। এতক্ষণ ঠিকই ছিলো কিন্তু দরজার সামনে এসে হার্টবিট বেড়ে গেলো। ভেতরে একপ্রকার যুদ্ধ চলছে যেন। খোলা দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে আরেকটু খুলে দিলো। দরজা খুলতেই নজরে এলো পুষ্প। পুষ্প খাটে উপুর হয়ে সুয়ে আছে। সামনে বই রাখা। পা দুটো সমানে দুলছে। আজ আবার সেই শাড়ী পরেছে। পা দুলানোতে শাড়ী উঠে ফর্সা পায়ের কিছুটা অংশ দৃশ্যমান । তার পাশেই সুন্দর করে ভদ্র হয়ে বসে আছে এলাচি। পুষ্প বই পড়ছে আর এলাচির সাথে টুকটাক কথা বলছে। অনেকদিন পর আবার পুষ্পকে দেখায় ভেতরে একটু শান্তি অনুভব হলো কি? হয়তো হলো। বেড়ে যাওয়া হৃদযন্ত্রের গতি ক্রমশ কমে আসছে। ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজ নিজের কানে এসেও লাগছে। গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। দুটো ঠোক গিলে গলাটা শুকিয়ে নিলো আগে। তামাকের আগুনে পোড়া ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে ডাকলো তাকে।
“-ফুল!
পুষ্পর বক্ষঃস্থল ধ্বক করে উঠে। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে। দরজার পানে তাকিয়ে দেখে প্রার্থ দাড়িয়ে।
প্রার্থ মুখ ফসকে বেড়িয়ে যাওয়া শব্দটা শুনে নিজেই আঁতকে উঠলো। পরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে গম্ভীর্যতা ফিরিয়ে আনলো। একটু কেশে বললো।
“-পুষ্প!
পুষ্প অবাক লেহনে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ও শুনেছে প্রার্থ ফুল বলেছে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রার্থ যে এখানে দাঁড়িয়ে তাও বিশ্বাস করতে চাইছে না। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো সে। পুষ্প কিছু বলবে তার আগে প্রার্থ বললো। কন্ঠ তার শান্ত।তুষারে জমা একখন্ড বরফের ন্যায় শীতল তার স্বর৷
“-বাড়িতে চল।
পুষ্প ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সন্ধি ঘটিয়ে বলে।
“-মানে?
প্রার্থ ভনিতা হীন জবাব দেয়।
“-বাড়িতে চল।
“-বাড়িতে যাবো মানে? আপনি এখানে কেন? কি চাই? কেন এসেছেন?
প্রার্থর শান্তমূর্তি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বললো রাগত্ব স্বরে।
“-তোকে নিতে এসেছি। চল বাড়িতে। ব্যাগ গোছা।
পুষ্পর বুঝলো না প্রার্থ এরকমটা কেন বলছে। তাই প্রশ্ন করলো।
“-হঠাৎ আপনি কেন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছেন? আপনি তো নিজে আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিলেন।
এই মেয়েকে এখন কি করে বুঝাবে সে কেন নিতে এসেছে সেটা নিজেও জানেনা। হৃদয়মাঝে অশান্তির ঝড় হচ্ছিলো। সে ঝড় দমন করতে এখানে আসা। সেটা হয়েছেও বোধহয়। এইযে এখানে এসে ভেতরে কেমন শান্তি অনুভব করছিলো। কিন্তু পুষ্পর অতিরিক্ত প্রশ্নে রাগ হচ্ছে।
প্রার্থ আদেশ সরূপ বললো।
“-আমি তাড়িয়েছি এখন আমিই নিয়ে যেতে চাইছি। চল বের হ।
পুষ্প বাকা হাসে। হেয়ালি গলায় বলে।
“-আপনার কি মনে হয়? আমি কাঠের পুতুল? যখন চাবি যেদিকে ঘুরাবেন আমি সেদিকেই ঘুরে যাবো?
প্রার্থ হয়তো তাই ভেবেছিলো। ভেবেছিলো ওকে যেতে বললে বুঝি সত্যিই চলে যাবে তার সাথে। কিন্তু পুষ্পর ভাবমূর্তি দেখে অন্যকিছু মনে হচ্ছে। প্রার্থ স্বাভাবিক ভাবেই বললো।
“-তুই কি যাবি আমার সাথে?
“-কখনোই না। ওইদিনের করা অপমানের একটা কথাও ভুলিনি। প্রতিটা কথা গায়ে এখনো হুল ফোঁটায়। পুষ্প ভালোবাসার কাঙ্গালি ছিলো। এখন সে ভালোবাসার কাঙ্গালি নয়।
প্রার্থ শক্ত হাতের থাবায় আঁকড়ে ধরে পুষ্পর বাহু। একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। টাল সামলাতে না পেরে বাড়ি খায় প্রার্থর প্রশস্ত বুকে। প্রার্থ দুহাতে ওকে সোজা করে। রক্তাভ চোখে তাকিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বলে।
“-এখন নয় কেন? এখন অন্যকেউ এসেছে জীবনে। তোর তো আমার প্রেমতৃষ্ণায় ভোগার কথা ছিলো। তাহলে কি হলো? মিটে গেছে তৃষ্ণা? কাকে দিয়ে মিটিয়েছিস?
প্রার্থর এমন ব্যাবহারে বেচারী এলাচিও ভয় পেয়ে যায়। নিজের মালকিনকে এভাবে দেখে শব্দ করে ডেকে উঠে।
পুষ্প প্রার্থর হাতে ছাড়াতে চায় কিন্তু পারে না। প্রার্থ তাকে আরো চেপে ধরে। পুষ্প এবার নিজের তরফ থেকে সাফাই গাইতে চাইলো না।প্রার্থর ভাষায়ই বললো তাকে।
“-যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে মিটাবো। আপনার কোথায় সমস্যা? আমি তো চলে এসেছি আপনাকে ছেড়ে। মুক্ত করেছি আপনাকে। তাহলে এখনো কেন আমাকে নিয়ে মাথাব্যাথা আপনার?
প্রার্থ ওকে টেনে আরো কাছে নিয়ে আসে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
“-হ্যা মাথাব্যাথা আমার। তোকে নিয়েই মাথাব্যাথা। শুধু তাই নয় সবখানে ব্যাথা আমার।(বুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে) এখানে, এখানেও ব্যাথা করে আমার। কেন করে বল? কেন করে এমন ব্যাথা?
রাগে বিছানায় ছুড়ে মারে পুষ্পকে। আর কোন বাক্য ব্যায় করলো না। প্রশ্ন করলো তবে উত্তরের আশায় রইলো না। ওকে রেখেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
পুষ্প বিছানায় বসেই স্তব্ধ তাকিয়ে রয় প্রার্থর যাওয়ার পথে। বিমূঢ় হয়ে ওভাবেই বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ। চোখে আবছা জল। প্রার্থর কথাগুলো এখনো কানে ঝংকার তুলছে। কি বলে গেলো সে? ব্যাথা করে? বুকে? কেন করে? বক্ষপটে তো পুষ্পরও ভীষন ব্যাথা। সেটা তো তার ভালোবাসার জন্য। কিন্তু প্রার্থর! তার বক্ষ পাঁজরে কিসের ব্যাথা?
প্রার্থ ক্ষিপ্র গতিতে নিচে নামছে। পূর্নতা তার নামার শব্দ পেয়েই বেড়িয়ে এলো রুম থেকে।
ততক্ষনে প্রার্থ ডয়িংরুম পেরিয়ে সদর দরজার কাছে পৌছে গেছে প্রায় । তিনি পেছন থেকেই হাক ছুড়লেন।
“-প্রার্থ! কোথায় যাচ্ছিস? কিছু খেয়ে যা বাবা। কি হয়েছে।
কে শুনে কার কথা। সে তার নিজের মতো করে চলে গেলো এখান থেকে। পূর্নিমার মাথায় ঢুকলো না হঠাৎ হলোটা কি। এক্ষুনি তো আসলো আবার এখনই চলে যাচ্ছে?
গভীর অমানিশায় ঢাকা রাস্তা। দূরে থাকা নিয়ন বাতির আলো খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। অন্ধকারই হয়ে আছে জায়গা টা। রাস্তার মাঝেই একটা কালো গাড়ি দাঁড় করে রাখা। গাড়ির ভেতর প্রার্থ বসা। সিটে মাথা এলিয়ে দুচোখ বুজে আছে। এতক্ষণের রাগত্ব মেজাজটা আপনাআপনিই শান্ত হয়ে আসছে। এখন রাগ বর্তাচ্ছে গিয়ে নিজের উপর। একদন্ডও রাগ ছাড়া কাটাতে পারে না। কথায় কথায় ছ্যাৎ করো উঠে। কি দরকার ছিলো পুষ্পর সাথে ওমন ব্যাবহার করার। সুন্দর মতো বললেই তো হতো। গেলো কি করতে করে আসলো কি। সম্পর্ক আরো বিগড়ে দিলো।
এখন বুকের মাঝে যে কি নিদারুন ব্যাথা হচ্ছে তা সহজেই বুঝে আসছে তার।
পুষ্পর ইগনোরেন্স হয়তো বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে পুষ্পর জায়গায় ও নিজে দাঁড়িয়ে আছে। সব কেমন বিষাদময় লাগছে। পুড়ে যাচ্ছে ভেতরের সবকিছু।
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৭ (2)
এই পোড়া অনুভুতির কি নাম দেওয়া যায়? ভালোবাসা!
নিজের ভাবনাতেই আঁতকে উঠলো ছেলেটা। বরাবরের মতো এড়িয়ে যেতে চাইলো অনুভুতির দাবানল কিন্তু পারলো না। ভেতরে একই সুর বেজে যাচ্ছে কেন বারবার?
