চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩০

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩০
ইশরাত জাহান জেরিন

লোকটা শক্ত হাতে চিত্রার গলায় ধরে রেখেছে চাকুটার বাঁট। তার ঠান্ডা চোখে হয়তো কোনো অনুভূতির ছাপ নেই। মুহূর্তের মধ্যেই সে এক ঝটকায় চাকুটা টেনে দেয়। ধারালো ফলাটা গলা চিরে ভেতরে ঢুকে যায়। গটগট করে র*ক্ত বেরিয়ে আসে! ঝরনার মতো উষ্ণ, ঘন, টকটকে লাল র*ক্ত। সেটার তীব্র গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভিজিয়ে দেয় চারপাশ। চিত্রার গলা দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। সে গলা থেকে গটগট করে পড়তে থাকা র*ক্ত হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। হাতটা আঠালো র*ক্তে ভিজে একাকার । নিজের র*ক্ত নিজে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি কেমন? চিত্রার চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও সে পেছন ঘুরে তাকায় না। তার ভাঙা দৃষ্টি নিবদ্ধ বারান্দায় পড়ে থাকা নিথর দেহটির ওপর। বাতাসে একটা পরিচিত গন্ধ। মিষ্টি এলাচের গন্ধ হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। চিত্রা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ছলছল নয়নে বিরবির করে নিথর দেহটির দিকে চেয়ে বলল,

“ফারা..জ উ..ঠুন। আমার খু..ব যন্ত্রণা হচ্ছে।”
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চিত্রা। মৃ*ত্যুর কারন জানার আগেই চিত্রার ছোট্ট দেহটির দম ফুরিয়ে আসে। তার চোখ জোড়া বুঁজে যাওয়ার আগে কানে কেবল একটা শীতল গলা ভেসে আসে,
“বিদায় মিসেস ফারাজ এলাহী।”
আধো চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির মুখশ্রী দেখার আগেই ঘুম ভেঙে যায় চিত্রার। চিৎকার দিয়ে চিত্রা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। বুক ধকধক করছে। নিশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। তার চোখে তখনও ভাসছে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য। শ্বাস নিতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে সে। জামার ভেতর দিয়ে ঠান্ডা ঘামের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পিঠ পর্যন্ত ভিজে গেছে পুরোটা। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। তবু সে উঠে বসল। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। স্বপ্ন… এটা একটা স্বপ্ন ছিল! কিন্তু এতটাই বাস্তব, এতটাই জ্যান্ত যে চিত্রার এখনও মনে হচ্ছে তার হাতের তালুতে র*ক্তের উষ্ণতা লেগে আছে।ফারাজ ঘুমের ঘোরে চিত্রার চিৎকার শুনে চমকে ওঠে। তড়িঘড়ি উঠে বসে। আধো অন্ধকার ঘরটায় চোখ ঘুরিয়ে তাকায় চিত্রার দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই বউ! কি হয়েছে? দেখি তাকাও। আমার দিকে তাকাও!” ফারাজের কণ্ঠ উদ্বিগ্ন। ঘুম জড়ানো স্বরেও উৎকণ্ঠা স্পষ্ট। চিত্রা নিঃশ্বাস নিতে হিমশিম খাচ্ছে। বুক ওঠানামা করছে দ্রুত। ফারাজের দিকে একবার তাকায় সে। ভয়, হতাশা আর বিভ্রান্তি মিশে থাকা দৃষ্টিতে। এক মুহূর্ত থেমে থাকার পর হুট করেই সে ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ফারাজ কিছু বোঝার আগেই সে মুখ গুঁজে দেয় ফারাজের বুকে। কান্নার ঢল নামে। শব্দ করে দম বন্ধ হয়ে আসা এক তীব্র হাহাকারের মতো কাঁদতে থাকে চিত্রা। ফারাজ হতভম্ব হয়ে চিত্রার পিঠে হাত রাখে। আর্দ্র শ্বাস তার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। অশান্ত রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চিত্রার কান্না প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে।
“বউ, কী হয়েছে? কিচ্ছু হয়নি তো! আমি আছি…”
কণ্ঠ কাঁপছে উদ্বেগে,”ফারাজ… ফার… ফারাজ! আপনি ঠিক আছেন? দেখি! কোথাও লাগেনি তো? ফারাজ?” চিত্রার চোখের দৃষ্টি অস্থির। নিঃশ্বাসর পতন দ্রুত হচ্ছে। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে ফারাজের গায়ে কোনো ক্ষত, র*ক্তের চিহ্ন, যন্ত্রণার ছাপ আছে কিনা। ফারাজ স্থির হয়ে দুই হাতে চিত্রার ঘাড়ের কাছে হাত রাখল। আলতো করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কি হবে আমার? দেখো, ঠিক আছি আমি!”
চিত্রার চোখে ভয় এখনও জমে আছে। সে দ্রুত চারপাশে তাকায়। যেন কেউ লুকিয়ে আছে, ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে ফিসফিস করে বলল,
“কিন্তু র*ক্ত… র*ক্ত কোথায়? ফারাজ, ওরা আমাদের আলাদা করে ফেলবে… মে*রে ফেলবে!”
ফারাজ এবার গভীর দৃষ্টিতে চিত্রার চোখের দিকে তাকাল। “কেউ নেই বোকা। তুমি স্বপ্ন দেখেছো। কিন্তু তাতে কি? আমাকে মে*রে ফেললেও বা কি? তুমি তো আর আমায় ভালোবাসো না।”
চিত্রা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। ফারাজের কথাটা তার মনের গভীরে ছুরির মতো বিঁধল। চোখ ভরে এলো জলে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফারাজের মুখটা ছুঁয়ে বলল,
“ভালোবাসি… ভালোবাসি আমি! আপনাকে আমি ভালোবাসি! অনেক বেশি!” তার কণ্ঠে আকুতি। হারানোর ভয় আর আবেগ একত্রে মিশ্রিত।

“আপনি ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। ভালোবাসার মতো কেউ নেই। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না!”
চিত্রা শক্ত করে ফারাজকে জড়িয়ে ধরল। যেন কোনো শক্তি তাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে । সে অনুভব করল ফারাজের শরীরের উষ্ণতা, তার বুকের স্পন্দন। সে জানে, যদি এক মুহূর্তের জন্য ফারাজ হারিয়ে যায় সে হয়তো আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। ফারাজ চুপচাপ চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দিল। সে বুঝতে পারছে চিত্রার ভয় এখনও কাটেনি। তবে সে এটাও জানে, ভয় আর অভিমানের মাঝেই লুকিয়ে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসা। ফারাজ মৃদু হাসল। চিত্রার মুখ থেকে “ভালোবাসি” শব্দটা শোনার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করেছে। আজ বোধহয় অপেক্ষারা স্বার্থক।

বাহিরে মুষলধারে বর্ষণের করুণ সুর গর্জে উঠছে নিশুতি রাতের নৈঃশব্দ্যে। প্রকৃতির প্রলয় বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আকাশ থেকে। অঝোর ধারায় নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলি পাথরের মতো আছড়ে পড়ছে ভূমিতে। শিলা বৃষ্টির প্রচণ্ডতায় কেঁপে উঠছে চারিপাশ। অন্ধকারের বুক চিরে বিদ্যুতের ক্ষণিক ঝলক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘনঘোর মেঘের গর্জনে। বাতাসে ক্রুদ্ধ কোনো শক্তির আস্ফালন, অস্থিরতার নৃত্য রচে চলেছে দরজা-জানালার কপাটে। রাতের নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিচ্ছে সময়ের গতি। আর ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে অতিক্রম করছে তৃতীয় প্রহরের সীমানা। চিত্রা ফারাজের প্রশস্ত বুকে মাথা গুঁজে ঘুমাচ্ছে। ঠিক সদ্য ফুটন্ত ফুলের মতো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সেই কখন। ফারাজের চোখে ঘুম নেই। ওই যে ভালোবাসি শব্দটা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে সেই কবেই। ফারাজ ঘুমন্ত চিত্রার কপালে ঠোঁটের পরশ ছুঁইয়ে দিয়ে চিত্রাকে আরো আগলে নেয়। সুই ফেলার জায়গা নেই তাদের মাঝে। এখন আর তাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত তাদের আলাদা করার ক্ষমতা আর কারো নেই। চিত্রা নামক ফুল ফারাজের জন্যই ফুটেছে। ফারাজের হুকুম ছাড়া তার নুড়ে পড়াও নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি হুকুম অমান্য হয়? ফারাজ মৃদু হাসল। হুকুম অমান্য হলে গাছ উপড়ে ফেলতেও তার হাত কাঁপবে না। এলাহীরা আবার শিকড়সহ গাছ তুলতে জন্মগত ভাবেই পারদর্শী।

মাহদী আজকাল একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে। দিন কিংবা রাত তাকে কাজের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখা যায়। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে সে সঙ্গত কারণ দেখিয়ে বলে, “ওভারটাইম, যত কাজ তত বোনাস।” মারিয়ার এসব শুনে আর কিছু জানতে চাইতে মন চায় না।
সকালের সোনালি রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে আসতেই আলো এসে পড়ল মারিয়ার মুখে। চোখ মেলে তাকাতেই দেওয়াল ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতে দেখল সে। শরীরটা যেন ভারী হয়ে এসেছে। মাথার ভেতর এক ধরনের ঝিমঝিম ভাব। সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। বমি আর তীব্র মাথাব্যথায় পুরো শরীর অবস হয়ে গেছে। মাহদী পাশে নেই। কাল রাতে হঠাৎ করেই ফোন করে জানিয়েছিল, তার ম্যানেজার করিম সাহেব স্ট্রোক করেছেন। করিম সাহেবের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে, সেখানে তার পরিবার থাকলেও কিশোরগঞ্জে তিনি একা থাকেন। পাশে থাকার মতো আপনজন কেউ নেই দেখে মাহদী তাকে মানবতার খাতিরে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সারা রাত সেখানেই কাটায়। যাওয়ার আগে সে ফোন করে মারিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিল সবটা। বিয়ের পর এই দুই বছরে মাহদী এক রাতের জন্যও তাকে ছেড়ে বাইরে থাকেনি। এটিই প্রথমবার।

তবে এতে অভিমান করেনি মারিয়া। একটা জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। ধীরে ধীরে মারিয়া উঠে বসল। শরীর দুর্বল হলেও সংসারের সব দায়িত্ব এখন তারই কাঁধে। মার্জিয়া দুই দিন হলো বোনের বাড়িতে গেছেন। তার বোনের ছোট ছেলে মা*রা গিয়েছে। সেই শোক সামলাতে হবে না তাকে? এখনো ফেরার নাম নেই। তাই তো শ্বশুরবাড়ির সব দায়িত্ব তাকেই সামলাতে হচ্ছে। জান্নাতকে সব বুঝিয়ে দেওয়া যতটা কঠিন, তার চেয়ে বরং নিজে সব সামলে নেওয়াই সহজ মনে করে মারিয়া। বড় ভাবী হওয়ার পরও জান্নাতের সঙ্গে খুব একটা কথা হয়নি তার। কখনো জিজ্ঞেসও করেনি জান্নাতের বাড়ি কোথায়, পরিবারে কারা আছে। যখন শুনেছিল, জান্নাতও তার মতো ভালোবাসার টানে ঘর ছেড়েছে, তখন আর অপ্রিয় প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করতে ইচ্ছে হয় নি। কারণ এই যন্ত্রণার অনুভূতি সে নিজেও জানে। নিজের পরিচিত সব ছেড়ে অন্য কোথাও নতুন করে জীবন শুরু করা কতটা কষ্টের, তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরতেই মারিয়া দেখতে পেল মাহদী বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার নিচে হাত রেখে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। কী যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।

“কি গো? কখন আসলা?” মারিয়া জানতে চাইলো।
মাহদী তার দিকে তাকাল। ক্লান্ত গলায় বলল, “মাত্রই। তোমার চেহারার এই অবস্থা কেন? রাতে ঘুমাও নাই?”
মারিয়া এড়িয়ে গিয়ে বলল, “এমনিই… তুমি খাইছ কিছু? করিম সাহেব এখন কেমন আছেন?”
মাহাদী চুপ করে রইল। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে।
“এই? শুনতাছো?”
মাহদীর হুঁশ ফিরতেই কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “না মানে, কী যেন বলছিলা? কিছু জিজ্ঞেস করেছিলা?”
মারিয়ার মনটা একদম খারাপ হয়ে যায়। একরাশ দুঃখ খেলে গেল তার চোখেমুখে। কিন্তু মাহদী তা টের পেল না। নিজেকে সামলে নিয়ে মেকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিছু খাইছ?”
“না… আজকে একটু গমের রুটি বানাইবা?”
মারিয়া হাসিমুখে মাথা নাড়াল। কারণ মেয়েদের জন্য ক্লান্তি, অসুস্থতা কিংবা কষ্ট প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। যদি সম্ভব হতো, তবে এই সমাজ মৃ*ত নারীর কাছ থেকেও এক কাপ চায়ের আবদার করত।

এলাহী বাড়ির কর্মচারীদের থাকার জায়গাটিতে আজ চাপা উত্তেজনা। নিস্তব্ধ ঘরটিতে শুধুই চাপা গুঞ্জন। একেবারে শেষ কোণের ঘরটায় রাজন উপস্থিত। বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চোখ স্থির হয়ে রয়েছে বিছানায় পড়ে থাকা নিথর দেহের ওপর। সাদা শার্টের ভাঁজে ঢেকে থাকা দেহটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফর্সা গায়ের রঙের সঙ্গে শুভ্র শার্টটা মিশে একাকার। চোখের নিচের সুরমার কালো রেখা। রাজন সবসময় গায়ে আতর মাখে, চোখে সুরমা দেয়। তাকে দেখলে সহজেই কেউ বাঙালি বলে ভাবতে পারে না। তার চেহারায় ভিন্ন কোনো দেশের আভিজাত্য লেগে আছে। এক অদ্ভুত সুশোভিত, অভিজাত সৌন্দর্যের অধিকারী সে।
কপাল চুলকে রাজন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে গভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“রাতে তুই কোথায় ছিলি? খোকন মর*ল কেমনে?”
লোকটা গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল, “জানিনে ভাই… রাতে আমি আর হেয় তো বাগানে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। তখন তো ভালাই ছিল!”

“জানোস না কেন? একলগেই তো থাকোস!” স্বরে চাপা রাগ।
“থাকি। কিন্তু ঘুমাই তো আলাদা ঘরে। আমায় মনে হয় ঘুমের পাতালে বোবায় ধরছে। হেরে প্রায় ওই বোবা জ্বীনে ধরে।” কন্ঠে ভয়, অথচ রাজন তা গায়ে মাখল না।
“বা*লের পেঁচাল পারিস না। তোর আব্বারা ধরছে না?”
লোকটা চুপ করে গেল। কিছু বলতে গিয়েও গলার কাছে আটকে গেলো। ঘরের বাতাস থমথমে। কুয়াশার মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ফারাজ সিগারেট ধরিয়েছে। ধোঁয়ার আড়াল থেকে একবার লা*শের দিকে তাকায় সে। নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে দেখে বলল,
“ভাই, আপনার লোকের কি হয়েছে জানেন?” সকলের দৃষ্টি ফারাজের দিকে। সে নিঃশব্দে এক টান দেয়। তারপর নরম স্বরে বলে,
“কষা হয়েছে। দামড়ায় একমাস ধরে হাগতে না পেরে উপরে চলে গেছে। এখন সেখানে হাগতে হাগতেই দিন কেটে যাবে। পেছন দিয়ে যেই সিলিন্ডার ঢুকাবে তাতে হাগা একেবারে ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার কথা।” বলেই হো হো করে হেসে উঠে ফারাজ।

রাজনের চোখ ধাক্কা খায় রাগে। বিরক্তির সুর গলায় ফুটে ওঠে, “দেখ ফারাজ, এইডা ফাইজলামির সময় না। এই নিয়া এই বাড়ির তিনজন লোক ম*রছে।”
“ইয়েচ ব্রো।” ফারাজ আবার হাসল।
অভ্র মাঝ থেকে হুট করে বলে উঠল, “আর তিনজন লোকই আপনার আর রোশান ভাইয়ের লোক ছিল। কি ভুল বলেছি?”
রাজনের মুখ শক্ত হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে ব্যথার এক রেখা ফুটে ওঠে। “আমার লোক মাইরা নায়ক সাজার কিছু নাই। যখন ধরমু একেবারে টান দিয়া ছিঁইড়া ফেলমু।”
রাজন একটু থেমে ফারাজকে আবার বলল, “এইপাশে সিসিটিভি লাগাস না কেন?”
ফারাজ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে অবশিষ্ট সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পায়ের নিচে পিষে দেয়। ধোঁয়ার শেষ কুণ্ডলীটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে ঠান্ডা গলায় বলে,

“কয়দিন পর দেখা যাবে, আমাকে বাথরুমেও ক্যামেরা লাগাতে বলবেন। বলা তো যায় না, কমোডের মধ্যে থেকে যদি আমার এক্স ভাবীগন্স বেরিয়ে এসে আপনার জায়গামতো ছোবল বসিয়ে দেয়?”
রাজন বিরক্তিতে লুঙ্গির গিঁট শক্ত করে বাঁধে। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। তারপর রাগচাপা ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তবে যাওয়ার আগে মিতালির দিকে চোখ পড়ে তার। মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে, ভয় আর দমবন্ধকরা আতঙ্কে জমে গেছে ।রাজনের খটকা লাগে। পরক্ষণেই মাথায় আসে আয়েশার কথা। আচ্ছা সে কোথায়? ঘরে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একে একে বেরিয়ে গেলে ফারাজ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা তার ভাইসহ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“এই মৃত্যুর খবর যেন এই ঘরেই বন্দী থাকে। অন্দরমহলে বা চিত্রাঙ্গনার কানে যেন না যায়। আমার মিসেস এমনিতেই অসুস্থ। এসব শুনে যদি আবার কোনো ঝামেলা হয় তাহলে খোকনসোনার সাথে বাকিদেরও কবরের ফ্রি টিকেট কাটিয়ে দেবো।” ফারাজের স্বর এতটাই স্থির যে কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়াই কথাগুলো চাপা হুমকির মতো কানে বাজল সবার। যাওয়ার আগে ফারাজ রাজনের কাঁধে হাত রেখে শীতল কন্ঠে বলে,
“লা*শটা পরীক্ষা করাতে হবে। শরীরে তো একটাও ক্ষত নেই। ম্যাংগোর নাতি উপরে গেল কেমন করে সেটা জানতে হবে না? উপরে যাওয়ার তরিকা পছন্দ হলে পরে আমিও নয় হয় কারো উপর এপ্লাই করে দেখবো।”
রাজন কোনো উত্তর দেয় না। মুখ শক্ত করে ফারাজের সামনে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। ফারাজ অভ্রকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে। মিতালিও তাদের পিছু নিতে উদ্যত হয়। তবে ঠিক তখনই রাজনের কণ্ঠ থমকে দেয় তাকে।
“তুমি দাঁড়াও তো, মেয়ে।”
মিতালির গা হিম হয়ে আসে। সে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় রাজনের দিকে। বড় করে নিশ্বাস ফেলে শুধায়, “এসবে তাকে না জরালেই কি নয়?”

চিত্রার ঘুম ভাঙতেই প্রথমে তার চোখ পড়ল ফারাজের দিকে। ফারাজ চুপচাপ বসে আছে তার মাথার কাছেই। চিত্রার চোখ-মুখ মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন ফারাজ ঘুম ভাঙার পর দেখা প্রথম সকালের আলো।
সে তড়িঘড়ি উঠে বসতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ একটা যন্ত্রণার শিহরণ বয়ে গেল শরীরের ভেতর দিয়ে। সর্বনাশ! এতক্ষণ ধরে সে ঘুমিয়েছে? কখনো তো এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠেনি সে। বাম হাতটা নাড়াতে গিয়ে সূঁচ গেঁথে দেওয়ার মতে যন্ত্রণা অনুভূত হলো। ফারাজ দ্রুত তার হাতের উপর নিজের হাত রাখল।
“আস্তে… ব্যথা করছে? দেখি?” আলতো করে চিত্রার হাতের আঙুল ছুঁয়ে দিল এক নরম চুমোয়।
“এখন ওঠার দরকার নেই,” ফারাজ শান্ত স্বরে বলল, “তবে প্রেসারটা মাপা দরকার।”
চিত্রা কিছুটা ক্লান্ত স্বরে ফিসফিস করে জানতে চাইল, “আপনি কখন উঠেছেন?”
ফারাজ তাকাল জানালার দিকে। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল, “মধ্যরাতে।”

ফারাজ প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করে রুমে আসতে বলল। কথা শেষে আবারও চিত্রার দিকে ফিরে তাকালো। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। সে চোখের ভাষায় কিছু বলতে চায়। রুমের টেবিলে খাবার সাজানো, ওষুধগুলো গুছিয়ে রাখা। এ সবই ফারাজের যত্নের নিদর্শন। চিত্রা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। লোকটার ভালোবাসা বুঝতে কি অনেক দেরি করে ফেলেছে সে? তাকে কি বেশিই অপেক্ষা করিয়েছে?
ফারাজ নরম স্বরে বলল, “গোসল করলে ফ্রেশ লাগবে। আজকে তো ঢাকায় যেতে হবে। মিতালিকে ডেকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতে বলছি। তুমি না হয় মুখে মুখে একটু বলে দিও কি কি প্যাক করতে হবে। বিছানা থেকে উঠার দরকার নেই।”

চিত্রা মাথা নাড়িয়ে মৃদু হাসল, “বিছানায় বেশিক্ষণ থাকলে আমার শরীর ব্যথা করে। এখনো করছে।”
ফারাজ কিছু বলার আগেই চিত্রা হঠাৎ তার দিকে এগিয়ে এলো। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ফারাজের ওষ্ঠে ছড়িয়ে দিল গভীর ভালোবাসার মাদকতা। ফারাজ হতবাক! চিত্রা নিজ থেকে এতটা কাছে এল? তার বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল। হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ গতিতে বাড়ল। এতদিনের অপেক্ষার পর চিত্রার এই স্পর্শ বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ফারাজ নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না। চিত্রার সাথে তাল মিলিয়ে আরও কাছে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় সরে গেল। শ্বাস কিঞ্চিত দ্রুত হয়ে এসেছে তার। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেল না। মাথা নিচু করেই কাঁপা কণ্ঠে বলল, “কে যেন এসেছে।”
ফারাজ এক মুহূর্ত চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই মুহূর্তের উষ্ণতা সে মনে গেঁথে রাখতে চায়। “আমি দেখছি।”

চিত্রা ওড়নাটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিল। মাথার ওপর টেনে দিল ঘোমটা। ফারাজ দরজা খুলে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। আর তার ঠিক পেছনেই রুমে ঢুকল এক লম্বা, চওড়া, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের পুরুষ। লোকটির চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য। তবে তার দৃষ্টি সোজাসুজি চিত্রার দিকে পড়ল না। চিত্রা এক নজর তাকিয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। ফারাজ হাত বাড়িয়ে লোকটাকে বসার জায়গা দেখিয়ে বলল, “এখানে বসো। চিত্রা! উনি নিউরোসার্জন ডক্টর বজ্র কায়সার। আর বজ্র, এ হচ্ছে আমার মিসেস। মিসেস চিত্রা এলাহী ।”

বজ্র চিত্রার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসল। “আপনার কথা অনেক শুনেছি, ভাবী।” বজ্র বলল নরম কণ্ঠে।
চিত্রা অবাক হয়ে এক মুহূর্ত বজ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কার কাছে শুনেছেন?”
বজ্রের উত্তর দেওয়ার আগেই ফারাজ বলে উঠল, “আমার কাছে। বজ্র আমার বন্ধু। ডেনমার্কে ওর একটা প্রাইভেট হাসপাতাল আছে। দেশে এসেছে একটা জরুরি কাজে। যতদিন কাজ শেষ না হয়, ততদিন এখানেই থাকবে।”
বজ্রের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ এক হাসি ফুটে উঠল।সেই হাসির ব্যাখা নেই। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠার আগেই মিলিয়ে যায়। চিত্রা আলতো হেসে বলল,

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৯

“তাহলে তো এখন থেকে রোজ আমাদের দেখা হবে।”
বজ্র তার গাঢ় কালো চোখে চিত্রার দিকে একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। সেই একই রহস্যময় নীরব হাসি হেসে মৃদু স্বরে বলল, “হ্যাঁ, রোজ। যাক অবশেষে আমাদের সাক্ষাৎ তো হলো।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩১