হলুদ বসন্ত পর্ব ২৩

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” দাদু, তুমি যাইবা গা? আবার কবে আসবা? কতদিন পর দ্যাশে আসলা কিন্তু একটা মাসও থাকলানা। ” কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে ইশরাককে জিজ্ঞেস করল।
” কতদিন ঘরে বসে থাকব, দাদী! চাকরি না করলে বাবা-মার দ্বায়িত্ব পালন করব কিভাবে? বাবার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছেনা। মা ও অনেক আগে থেকেই অসুস্থ। একজন কাজের মেয়ে দরকার। দাদু তুমি দু’জনেই অসুস্থ। তোমাদের দেখভাল করার জন্য সার্বক্ষনিক একজন নার্স প্রয়োজন। সাদাফের পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি। বাবার একার ইনকামে সবকিছু সামাল দেয়া সম্ভব হবেনা। চাকরিটা হয়ে গেলেই দু’জন কাজের মানুষ রাখব। ”

” তুমি তো সক্কলের জইন্য এত চিন্তা কর, তোমার কতা কয়জন চিন্তা করে? চিন্তা করলে, তোমার মা পড়াশোনা করনের সময়ই তোমার বিয়া দিতনা। পোলার কথা একবার চিন্তা করত। আবার যেই মাইয়াডার লগে বিয়া দিল, সেই মাইয়াডারও তোমার উপ্রে কুন দরদ নাই। তুমি বাঁচলা কি মরলা সেইডা সে দেখেনা। সেইদিন যে তুমি কত ট্যাকা দিয়া বাজার করলা, হেই মাইয়া একটা খাওন ও মুখে তুইলা দেখে নাই। আলু ভর্তা দিয়া ভাত খাইছে। দেমাগ কত ছেমরির। তোমার মত যোগ্য স্বামীরে হেয় পায়ের নিচে রাখবার চায়। দুই পয়সাও দাম দেয়না। ”
দাদির কথা শুনে একটুও অবাক হলোনা। অবনীর রাগ, জিদ সম্পর্কে ওর জানা হয়ে গেছে। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে, দাদী ওকে অবনীর বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চাইছে। তাই দাদীর ফাঁদে পা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
” এটা তেমন কিছুই নয়। একটু মান-অভিমান চলছে আমাদের মধ্যে। কয়দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ। এসব নিয়ে তুমি কিন্তু ওকে বকাঝকা করোনা। তোমার মুখ স্পিডবোটের থেকেও বেশি ছোটে। মুখে লাগাম দেয়ার চেষ্টা কর বুঝলে? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” হ, সব দোষীই তো আমার। কিছু কইলেই আমি খারাপ। আমি বাদে বাকি সক্কলেই সাধু। ”
” এখন এসব কথা শুনতে চাইছিনা, দাদী। যাওয়ার আগে মাথা খারাপ করে দিওনা। রাতটুকু অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে দাও৷ আমি আবারও বলছি, মা, চাচী, অবনীর সাথে মিলেমিশে থাকবে। তারা কষ্ট পায়, এমন কোন কথা বলবেনা। তোমার মেয়েদের নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ? যেই তোমার দ্বায়িত্ব নেয়ার কথা উঠল, ঠিক তখনই তারা তাদের সংসারের দোহাই দিল। কেউই তোমাকে নিতে রাজি হলোনা। কিন্তু তারা একবারও ভাবলনা, আমার বাবা-মা কখনোই তোমাকে অন্য কোথাও পাঠাবেনা। তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। যখন টাকার প্রয়োজন হয়েছে, তখনই এসে দাদুকে প্রেসার দিয়েছে। একবারও ভাবেনি, দাদুর টাকা প্রয়োজন হতে পারে। এতদিন আমার মা এসব বিষয়ে মাথা ঘামায়নি জন্যই যে ভবিষ্যতেও কিছু বলবেনা এটা কিন্তু ভেবোনা। মা যদি একবার বেঁকে বসে, তবে তুমি কোথায় যাবে ভেবে দেখেছ? তুমি নিশ্চিত থাক, তোমার মেয়েরা তোমাকে নিজেদের বাড়িতে নিবেনা। তোমার পেছনে এক পয়সাও খরচ করবেনা। অতীতে যা করেছ সেসব ভুলে যাও। ভবিষ্য সুখকর করতে নিজেকে পরিবর্তন কর। বুঝতে পেরেছ আমার কথা? ”
নাতীর কথাগুলো শুনে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কুলসুম বেগম। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ইশরাকের কথা তার পছন্দ হয়নি। ইশরাকও দাদীর মনোভাব বুঝতে পারল। তিক্ততায় ছেয়ে গেল ওর মন। এই একটা মানুষের জন্য ওদের সংসারে সারাজীবন অশান্তি বিরাজ করেছে। ভবিষ্যতেও হয়তো সেটাই থাকবে।

” অবনী, একটু আমার রুমে আসতে পারবি? ” অবনী নিজের ঘরে পড়ছিল। নাজমা আক্তারের ডাকে পেছন ফিরে চাইল। বড়মার শুকনো মুখ দেখে আপনাআপনি অবনীর ভ্রু কুঁচকে গেল। হাজার কষ্টের মাঝেও অবনী সব সময় বড়মাকে হাসতে দেখেছে। কিন্তু আজকে বড়মার মুখে হাসি নেই।
” আসছি, বড়মা। ”
নাজমা আক্তার আর সেখানে দাঁড়ালেননা। অবনীকে রেখেই চলে গেলেন। বড়মার এমন কাজে যারপরনাই অবাক হল অবনী।
” কেন ডেকেছিলে, বড়মা? তোমার কি শরীর খারাপ? ” নাজমা আক্তারের রুমে এসে জিজ্ঞেস করল অবনী।
” আমি ভালো আছি। তুই আয় আমার সাথে। অবনীকে হাত ধরে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ইশুর রুমে গেলেন নাজমা আক্তার।
অবনী গমনরত বড়মার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এই বড়মা যেন ওর অচেনা।
কয়েক মিনিট পরই নাজমা আক্তার ইশরাকের রুমে ঢুকলেন। তার পিছুপিছু রুমে ঢুকল অবনী। অবনীকে দেখে ইশরাক চোখ ছোট করে তাকাল। ও ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। অবনী ইশরাকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চার বছর পর এই রুমে পা রাখল অবনী। বদলে ফেলা হয়েছে রুমটাকে। আসবাবপত্র আগেরগুলো নেই। সবকিছুই নতুন।

বিছানার কাছে গিয়ে ইশরাককে নিজের একপাশে বসালেন নাজমা আক্তার। অপর পাশে বসালেন অবনীকে। ওরা দু’জনই নাজমা আক্তারের কাজকর্ম কিছুই বুঝতে পারছেনা।
” তোরা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছিস? ভাবছিস, কেন তোদেরকে একসাথে ডেকেছি? ”
অবনী ইশরাক দু’জনই নীরব থাকল। ওদেরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন নাজমা আক্তার।
” আজ তোদেরকে কিছু কথা বলবার জন্য ডেকেছি। আমি মনে করি, তোদের দু’জনের জন্যই কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানরা ভুল করবে এটাই প্রকৃতির অলিখিত নিয়ম। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আমরা যদি সেজন্য সন্তানদের ভুল বুঝি, ওদের সাথে দুর্ব্যবহার করি, দিনশেষে সেটা সকলের জন্যই ক্ষতিকর। ঠিক তেমনি আমার মনে হয়েছে তোদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে, তোদের মুখোমুখি হওয়া দরকার। আমি বুঝতে পারছি তোরা না জেনেই বারেবারে ভুল করছিস। আজকে তোদের যদি শুধরে না দেই, তবে হয়তো তোদের সম্পর্কই শেষ হয়ে যাবে। তাই গত চার বছরেও তোদের সাথে যেই বিষয়ে কথা বলিনি, মাথা ঘামাইনি আজকে সেটা করতে হচ্ছে। এবং আমি মনে করি এটা আমার দ্বায়িত্ব। ”

অবনী ইশরাক দু’জনেই নাজমা আক্তার কি বলতে চলেছে সেটা বুঝতে পারছে। তাই এবারও তারা নীরব থাকল। নাজমা আক্তার ওদের উত্তরের অপেক্ষা করলেননা৷ তিনি একমনে বলেই চললেন,
” তোরা গত চার বছর ধরে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ আছিস। হয়তো সেই সম্পর্কটা মধুরভাবে শুরু হয়নি। হয়তো বলছি কেন? শুরুটা মধুর ছিলনা। এখনো যে মধুর আছে সেটাও বলবনা। কোন পরিস্থিতিতে তোদের বিয়ে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়, অবনী? বিয়ের কথা শুনে তুইও যেমন অবাক হয়েছিলি, তেমনি অবাক হয়েছিল ইশুও। ইশুর পক্ষে বিষয়টা সহজ ছিলনা। ও জ্বলছিল বেইমানের ছলনার আগুনে। ” নাজমা আক্তারের বলা কথাটা শোনামাত্রই ইশরাক অবনী একযোগে তাকায় তার দিকে। কিন্তু সেদিকে নজর নেই নাজমা আক্তারের। তিনি বলেই চলেছেন,

” নিশ্চয়ই তোদের মনে প্রশ্ন জাগছে, আমি এই কথাটা কেন বললাম? ইশরাক আর রিশার বিষয়টা আমি শুরু থেকেই জানতাম। সময়ে-অসময়ে অবনীর রিশাদের বাড়িতে যাওয়া দেখে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল। একটু চোখকান খোলা রাখতেই জানতে পারি, অবনী ইশরাক আর রিশার পত্রবাহকের ভূমিকা পালন করছে। সেদিন আমার ভিষণ রাগ হয়েছিল, কষ্ট লেগেছিল। আমি সেদিন কেঁদেছিলাম। বিয়ের পর থেকে এই সংসারে এসে কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। পরপর দুই ছেলের মা হলাম। কিন্তু মনের গহীনে একটা কন্যা সন্তানের আফসোস থেকেই গেছিল। যেদিন অবনীর জন্ম হলো, সেদিন যেন হাতে চাঁদ পেলাম। মনস্থির করলাম, দুই ছেলের একজনের বউ করব অবনীকে। দিন যত গড়ালো, ধীরে ধীরে তোরা বড় হতে লাগলি। ইশারাক আর অবনীর মজবুত বাঁধন আমাকে মুগ্ধ করল। একদিন ইশরাকের বাবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, অবনীই হবে আমার বড় পুত্রবধূ।

সময় হলে ওয়াহাবের কাছ থেকে তার আদরের রাজকন্যাকে চেয়ে নেব। কিন্তু রিশার বিষয়টা আমাকে হতাশ করল। গোপনেই নিজের দুঃখ লুকালাম। কাউকে জানতেও দিলামনা। ইশরাকের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথাও বললামনা। জানতাম, তাহলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। অবশ্য আমি জানতাম ওদের সম্পর্ক খুব বেশিদিন টিকবেনা। কারন রিশার পরিবারের লোকজনদের আমি ভালোভাবেই চিনি। ওরা একটু বেশিই লোভী। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, রিশাও ওর বংশের মানুষদের মতই হবে। হলোও তাই। রিশার বিয়ের পাঁচ-ছয়মাস আগেই জানতে পেরেছিলাম, ওর বিয়ের কথা হচ্ছে। রিশারও এতে অমত নেই। ভালো ছেলে পেলেই রিশার বিয়ে হবে। সেদিন আমার খুশি লাগলেও পরক্ষণেই ছেলের কথা ভেবে সেই খুশিটা স্থায়ী হয়নি। কারন আমি জানতাম, ইশু ঐ মেয়েকে কতটা ভালোবাসে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার ছেলেটা বাঁচবে কিভাবে সেই চিন্তাই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। রিশার চাচীর মাধ্যমে সব খবরই আমি পেতাম। তখন থেকেই ইশুকে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতাম। কিন্তু আমার ছেলেটা আমার কথার মর্মার্থই বুঝতনা। ছেলের চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিলাম।

একদিন জানতে পারলাম, কোন এক মেজরের সাথে রিশা সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার সাথেই বিয়ের কথা চলছে। হাসিখুশি রিশাকে দেখে বুঝে গেলাম ও কখনোই ইশুকে সত্যিকারের ভালোবাসেনি৷ রিশার বাড়িতে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়েতে ওর মত আছে কিনা। ও একবাক্যে হ্যাঁ বলল। একদিন রিশার বিয়ে হল। অবনীকে ইশুর চিন্তায় ছটফট করতে দেখলাম। বারবার আমার কাছে এসে ইশুর খবর জানতে চাচ্ছিল। ও মানতে পারছিলনা। অনেকগুলো মাস ধরে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া না করায়, ছেলের চিন্তায় আমি বিছানা নিলাম। আমার ছেলে খবরটা পেয়ে ছুটে আসল। সুযোগ বুঝে তার কাছে বিয়ের কথা বললাম। গাঁইগুই করতে করতে একসময় সে রাজিও হলো। অবনীও তাই। আমি জানতাম, প্রথম প্রথম দু’জন দু’জনকে মানিয়ে নিতে সমস্যাই হবে।

কিন্তু ঘটনা যে এতদূর গড়াবে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বাসর রাতেই আমার ছেলে অবনীকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দেবে, এটা আমার কল্পনায়ও ছিলনা। আমি দূর থেকে দেখলাম, ড্রয়িংরুমে পরে গিয়ে ব্যথায় কাতরানো অবনীকে। কাছে গিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলতে চাইনি। জানিনা সে রাতে বদ্ধ দরজার আড়ালে কি ঘটেছিল। অবনীকে কাঁদতে দেখেও ওর কাছে যাইনি আমি। ইশুর ওপর রাগ হয়েছিল, কিন্তু ওর কথা ভেবে সেই রাগের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ ছিলনা। সকাল হতেই অবনীকে আগলে নিলাম বুকের ভেতর। সেদিন থেকেই ভুলের সূচনা। আমার ছেলে একের পর এক ভুল করে গেছে। আর তার খেসারত দিতে হয়েছে অবনীকে। এবার নিশ্চয়ই তোদের মনে প্রশ্ন জাগছে, কেন সেই রাতে আমি সামনে এলামনা? আমি চেয়েছিলাম, তোরা তোদের ব্যক্তিগত বিবাদ, ভুলবোঝাবুঝি নিজেরাই সামলে নিবি। সেই সুযোগও তোদের দিয়েছিলাম।

অবনীকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম। ওকে বুঝতেই দেইনি ও আমার ছেলের বউ। মেয়ে হিসেবে গ্রহন করেছি ওকে। কিন্তু তোরা ইগো দেখাতে গিয়ে কাছে আসার বদলে দূরে সরে গেলি। বিবাহিত হওয়া স্বত্বেও চারটা বছর তোরা দূরে ছিলি। গ্রামের লোকজন নানান কথা বলেছে। সেসব কথাকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে চলতে হয় সেটা অবনীকে শিখিয়েছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমার সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। ভুলের হোক আর অন্যায়ের হোক শুরুটা যেমন ইশু করেছিল, তেমনি একে টেনে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছিস অবনী তুই । কেউ নিজের ভুল বুঝতে পেরে মন থেকে ক্ষমা চাইলে, একটা সুযোগ চাইলে তাকে ক্ষমা করে সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু অবনী তুই সেটা করিসনি। রাগ তোর মনের গভীরে পুষে রেখেছিস। আজ তুই বলেই ফেললি, অন্য কোথাও তোর বিয়ে দিতে। তবে কি আমি ধরে নেব তুই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাস? আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারনে যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল, আমি চাই দু পক্ষের সমঝোতায় এর একটা সমাধান করতে। তুই চাইলে ইশু তোকে মুক্তি দেবে। এটা আমি বলছি। তুই কি চাস অবনী? ইশু, তোর মতামতও আমি জানতে চাই। ”

নাজমা আক্তারের কথা শুনে অবনী ইশরাক দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। অবনী ছলছল চোখে বড়মার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড়মা সবকিছুই জানত! অথচ এত বছরেও ওকে সেকথা জানতে দেয়নি। কিন্তু ও বড়মার প্রশ্নের উত্তর কি দেবে? কি চায় ও, সেটা আজ-অব্দি ভেবে দেখেনি। তবে একটুকু জানে, ও কোনদিনও বড়মাকে কষ্ট দিতে পারবেনা।
নাজমা আক্তার জবাবের অপেক্ষা করছেন। তিনি পালাক্রমে দু’জনের দিকেই তাকালেন। দু’জনকে উদ্দেশ্য করেই বললেন,

” জবাব দিচ্ছিসনা কেন? আজ রাতের মধ্যেই আমি জবাব চাই। আগামীকাল ইশু ঢাকা যাওয়ার আগেই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাই। অবনী, তোরও নিজেরমত করে বাঁচার অধিকার আছে। তোর যদি মনে হয়, এই সম্পর্ক তোকে পদে পদে অপমানে জর্জরিত করছে, তবে তুই নিঃসংকোচে বলতে পারিস। তোকে কেউ দোষী করবেনা, এটা আমার প্রতিশ্রুতি। সসম্মানে তোর মুক্তির ব্যবস্থা আমি করব। ইশু কাল ঢাকা যাওয়ার আগেই তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা আমি করব। ইশু, এবার বল তুই কি চাস? অবনী চাইলে ওকে মুক্তি দিবি? অবশ্যই তুই অন্যায় করেছিস। সেই হিসেবে জোর তুই করতে পারিসনা। তবে ক্ষমা চাইতে দোষ নেই। ”

বড়মার কথা শুনে অবনী কাঁপছে। এতগুলো বছর ধরে মনের ভেতর সেই প্রথম রাতের দুর্বিষহ স্মৃতিই ঘুরপাক খেয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইশরাকের প্রতি রাগ জন্মেছে মনে। কিন্তু কখনো ডিভোর্সের কথা ভাবেনি।
” আমি আরেকটা সুযোগ চাই, মা। প্রয়োজনে আমি নিজের দোষ স্বীকার করে পুরো দুনিয়ার সামনে আমি অবনীর কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি আছি। ও চাইলে, যেকোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। কিন্তু সেটা আমার স্ত্রীকে দূরে রেখে নয়। আমি চাই ও আমার কাছে থেকে আমাকে শাস্তি দিক। তবুও আমি আমার স্ত্রীকেই চাই, সেটা পুরো দুনিয়ার বিনিময়ে হলেও। ”

ছেলের কথায় যেন স্বস্তির পরশ নামল নাজমা আক্তারের চোখমুখে। এবার তিনি তাকালেন অবনীর দিকে।
” শুনলিতো ইশুর সিদ্ধান্ত? এবার তোর সিদ্ধান্ত জানা আমাকে। নির্ভয়ে বলতে পারিস। কেউ তোকে জোরজবরদস্তি করবেনা। ”
তবুও অবনী কোন উত্তর দিতে পারছেনা। ও মাথা নিচু করে ঠাঁয় বসে থাকল। ওর কানে বাজল ইশরাকের বলা কথাগুলো।
” কিছু বলছিস না কেন? যা বলবার তাড়াতাড়ি বল। তোর উত্তর যদি না হয়, তবে আমি আজকেই উকিলের সাথে কথা বলব। কাল সকালের মধ্যেই তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব। আর যদি তোর উত্তর হ্যাঁ হয় তবে, আমি দুইদিনের মধ্যেই পুরো গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করব তোদের বিয়ে উপলক্ষে। যা বলবি তাড়াতাড়ি বল। ইশুর বড় ফুপুর ইচ্ছে ছিল তার ছোট মেয়ের সাথে ইশুর বিয়ে দেবে। মেয়েটা খারাপ নয়। দেখতে শুনতেও ভালো। ওর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে ওরা এক পায়ে রাজি হবে। ” অবনীকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন নাজমা আক্তার।

এতক্ষন অবনী কাঁপলেও সেটা গোপনেই ছিল। কিন্তু বড়মার কথা শুনে সেটা আর গোপন থাকলনা। নাজমা আক্তার বুঝতে পারলেন অবনী কাঁপছে, সেই সাথে কাঁদছেও। তবুও তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন অবনীর দিকে।
ইশরাক নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে অবনীর দিকে। অবনীর ওপর নির্ভর করছে ওর সুখ-দুঃখ, ভালোমন্দ সবকিছু। কিন্তু অবনী নিরুত্তর রইল।
” অবনী, তাড়াতাড়ি কর। রাত হয়ে গেছে। ঘুমের ঔষধ খেয়েছি অনেকক্ষণ আগেই। আমি আর জেগে থাকতে পারছিনা। ”
” তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? আমার কষ্ট হচ্ছে তো। ” অবনী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
” আমার এতকিছু দেখার সময় নেই। আমি চাচ্ছিনা তোরা দু’জনেই আমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাক। যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্ক মিছেমিছি আঁকড়ে ধরে রেখে কি লাভ? কেটে দে এই বাঁধন, ছিঁড়ে ফেল সম্পর্কের মিছে মায়া। ”
মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশরাক। মা এসব কি বলছে? কেন সে অবনীকে এভাবে জোর করছে? মা ও কি চায়না অবনী ওর থাকুক?

” কি রে কিছু বল? এভাবে মুখে কুলু পেতে আছিস কেন? তবে কি আমি তোর মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ ভেবে ধরে নেব, তুই এই সম্পর্কে থাকতে চাসনা? ইশু, তোর বাবার কাছে গিয়ে উকিলের সাথে কথা বলতে বল। ”
” নাহ্। ” এতটুকুই বলতে পারল অবনী। ও আঁকড়ে ধরেছে বড়মার হাত। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে।
অবনীর সামান্য না উচ্চারণ শুনেই হাসি ফুটল নাজমা আক্তারের মুখে। ইশরাকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নাজমা আক্তার অবনীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

হলুদ বসন্ত পর্ব ২২

” ঠিক আছে। তবে আমি এই রুম থেকে অন্য কোথাও তোকে যেতে না দেখি। যত মান-অভিমান আছে সব মিটিয়ে ফেলবি। আমার ছেলে দেবদাস-এর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা আমি দেখতে চাইনা। আবার তোর অসহায় চোখ দেখতেও আমার কষ্ট হয়। ইশু, দরজা বন্ধ কর। আর হ্যাঁ, আমি যেন আর কোনদিন অবনীর চোখে পানি না দেখি। ” নাজমা আক্তার সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অপেক্ষা করলেন ইশরকাকের দরজা বন্ধ করার৷ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেতেই তিনি জোরে শ্বাস ছাড়লেন। প্রানখোলা হাসিতে উদ্ভাসিত হল তার মুখাবয়ব। ছেলেমেয়ে দুটোর স্বার্থেই এতটুকু কঠোরতার অভিনয় তাকে করতে হয়েছিল।

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৪