আবার বসন্ত গল্পের লিংক || ঝিলিক মল্লিক

আবার বসন্ত পর্ব ১
ঝিলিক মল্লিক

মেজর রুবায়েত নওয়াজ বিবাহিত! তার একটা ছেলে সন্তানও আছে!
এই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যিটা জানার পর থেকে তাজরীন পুরোপুরি স্তব্ধ বনে গেছে। ভাইয়ের বন্ধুর বয়সটা সে এতোদিন হিসাব করে দেখিনি। ভেবে দেখেনি, ত্রিশোর্ধ্ব একজন পুরুষ এতোগুলো দিন কেন অবিবাহিত রয়েছে! একবারের জন্যও ঘুণাক্ষরেও রুবায়েতের জীবনের এই চরম সত্যিটা বুঝতে পারেনি ও। বুঝতে পারবেই বা কী করে? বোনের বিয়ে উপলক্ষে চট্টগ্রামে অতিথি হয়ে তাদের সাথে বেড়াতে যাওয়া এই লোকটার মতিগতিতে টানা সপ্তাহখানেক সময়ের মধ্যে মোটেই আঁচ করা যায়নি যে! তবে, তবে শকটা তাজরীন খেয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে ফেরার দিন। সেদিন রুবায়েতের ফোনে কল আসলো। ফোনটা তাজরীনের হাতের কাছেই ছিল। কয়েক ইঞ্চি দূরে। তার স্ত্রী আসমার কল ছিল। কল রিসিভ করার পরেই রুবায়েতের ছেলের কন্ঠস্বর৷ একমাত্র তাজরীন জানে, সেদিন ঠিক কেমন লেগেছিল ওর। তাহলে ওই রাতে কোন অনুভূতির আভাস পেয়েছিল তাজরীন? সেদিন রুবায়েতের কথাবার্তা এবং কর্মকাণ্ডে তাজরীন মনে করেছিল, রুবায়েতেরও ওর প্রতি বিশেষ একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওই লোক যে অনুভূতিহীন এবং প্রতারক — তা কে জানতো!

ঘটনার প্রায় দেড় মাস কেটে গেছে। তাজরীন এখন নিজের স্বাভাবিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবু মাঝেমধ্যে অতীত স্মৃতি বর্তমানে দুর্ভি-সন্ধি হয়ে হানা দেয়। দুঃস্বপ্নের বেশে ধরা দিতে চায়।
তাজরীন এখন ঢাকায় আছে। ওর বড়ভাই মা আর বৌমণিকে ঢাকা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের আবাসিক কোয়ার্টারে নিয়ে গেছে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হলো। তাজরীন নিজেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে ঢাকাতেই থাকে। ওর আগে থেকেই এখানকার হোস্টেলে থাকা হচ্ছে। তাজরীনের ভার্সিটি থেকে ক্যান্টনমেন্ট অনেকটা দূরত্বে অবস্থিত৷ একারণে তাজরীন আর কোয়ার্টারে তার পরিবারের সাথে গিয়ে থাকছে না। হোস্টেলেই থাকছে আগের মতো।
তাজরীন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য ব্যাগে বইপত্র গুছিয়ে রাখছিল। তখনই টেবিলের ওপর অপাংক্তেয়ভাবে পড়ে থাকা সেলফোনটা ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠলো। অলস ভঙ্গিতে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে টেবিল থেকে ফোনটা তুললো তাজরীন। ফোন স্ক্রিনে একবার কলার-এর নামটা দেখলো। বড়ভাইয়ের নাম দেখতেই সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলো তাজরীন। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেমন আছো ভাইয়া তুমি? আম্মা বৌমণি সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছি আমরা। তুই কেমন আছিস তাজ?”
“এইতো আছি ভালো। ব্যস্ততায় দিন কাটছে। পড়াশোনা আর মিড টার্মের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে যাচ্ছি। এজন্য তোমাদের সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করা হয়ে উঠছে না।”
তাজরীন বেশ আফসোসের সুরে কথাগুলো বলে। ফোনের ওপাশ থেকে রুস্তম বললো,
“কতবার বললাম তোকে, এখানে চলে আয় আমাদের কাছে। দরকার হয় প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করবি৷ বেশি তো না, মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। কিন্তু তুই তো নিজের জেদ ধরেই বসে আছিস। নড়ছিস-ই না। সে যাক। শোন, তুই এখন কোথায় আছিস?”

“হোস্টেলে আছি ভাইয়া। কেন?”
“থাক তুই। তোকে নিতে আসছি আমি।”
“নিতে আসছো মানে?”
“এসে বলছি। আপাতত কয়েকদিনের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় আর জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে রেডি হয়ে থাক। আমার আসতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে।”
রুস্তম কল কেটে দিলো। তাজরীন ফোনটা পুনরায় টেবিলের ওপর রেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো ওর হোস্টেল রুমের ছোট বিছানাটায়। কি হলো ব্যাপারটা! তাজরীন কোয়ার্টারে গিয়েছে মাত্র একবার। তা-ও যখন ওর পরিবার সেখানে শিফট করে; তখন, প্রথম দিন। এরপর আর কখনো ইচ্ছা হলেও যাওয়া হয়নি ওর। এর অবশ্য বিশেষ একটা কারণ রয়েছে। মিরপুর সেনানিবাসে কোয়ার্টারে তার বড়ভাই যেই অ্যাপার্টমেন্টে থাকে, তার পার্শ্ববর্তী অ্যাপার্টমেন্টে নাকি মেজর রুবায়েত নওয়াজ তার পরিবার নিয়ে থাকেন। এই তথ্যটা তাজরীন জেনেছে তহুরার কাছ থেকে। তহুরাসহ তার ভাইয়ের কলিগদের প্রায় সবার ফোন নাম্বার বর্তমানে তাজরীনের ফোনের কললিস্টে সেভ করা আছে, একমাত্র রুবায়েতের নাম্বার বাদে। কালক্রমে মাঝেমধ্যে কথা হয় ওদের সাথে। সোশ্যাল মিডিয়া কম ব্যবহার করে তাজরীন। নাহলে প্রতিদিন-ই ওদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ হতো। তাজরীন-ই বরং দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে সবার থেকে। এতো কাছে গিয়ে কী লাভ? যেচে কে চায় কষ্ট নিতে?

রুস্তম আসলো ঘড়ি ধরা ঠিক ঘন্টা দুই পরে। মহিলা হোস্টেলের ভেতরে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই বড়ভাই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কল দিতেই তাজরীন ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসলো। রুস্তম হাসিমুখে এগিয়ে এসে ব্যাগগুলো টেনে নিজের হাতে নিলো। তাজরীনকে বাইকে বসতে বলে ব্যাগগুলো রেখে সামনে বসলো রুস্তম। তাজরীন তখন আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো,
“আমাকে কোয়ার্টারে কেন নিয়ে যাচ্ছো ভাইয়া? ওখানে কি অনেকদিন থাকতে হবে নাকি আমাকে? তাহলে আমার ভার্সিটি?”
রুস্তম বাইক স্টার্ট দিতে দিতে জবাব দিলো,

“সে আমি ম্যানেজ করে নেব। ভার্সিটিতে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না তোর। মাত্র তো কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছিস ওখানে। এমনিতেও আম্মা তোকে দেখতে চাইছিলেন কয়েকদিন ধরে। তোর বৌমণি তো সারাদিন নিঃসঙ্গ বোধ করছে। এই সময়ে ওর সমবয়সী কেউ থাকা তো জরুরি। তোর কথা খুব মনে করছিল।”
“আর কোনো বিশেষ কারণ আছে ভাইয়া? যার জন্য তুমি এমন জরুরি তলবে আমাকে নিতে চলে এলে। আগে জানালে আমি-ই তো যেতে পারতাম।”
“তহুরা আর আফিমের বিয়ে পাকা হয়েছে, তা জানিস?”
“বিয়ের কথাবার্তা চলছিল— এটুকু জানতাম। যাক, অবশেষে খুশির খবর পাওয়া গেল।”
“হ্যাঁ, খুশির খবর-ই বটে। ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা বেশ বড় করে করা হবে। আমাদেরকে ইনভাইট করে গেছে বিয়েতে। তহুরা তো কল করেছিল তোকে গতকাল রাতে এই সংবাদ জানাতে। তুই নাকি ব্যস্ততার জন্য কথা বলতে পারিসনি।”

“ওহহো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ভাইয়া। রাতে পড়ছিলাম তো, তাই ওকে বলেছিলাম, পরে কল করে সব কথা ধীরেসুস্থে শুনবো। কিন্তু তারপর তো আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আর এখন সকালে উঠে ভুলেই গিয়েছি। দেখি পৌঁছে ওকে কল করে স্যরি বলে নেবো।”
“হু।”
রুস্তম থেমে বললো,
“ওদের বিয়েতে তহুরার পক্ষ থেকে স্পেশাল ইনভাইটেশন তোর জন্য। তোকে মেহেদী অনুষ্ঠান হতে শুরু করে রিসিপশন অবধি থাকতে হবে। এব্যাপারে-ই তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল তহুরা। ক্যান্টনমেন্ট ব্রাঞ্চে ওদের সম্পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তুই কথা বলে নিস ওর সাথে।”
যাত্রাপথে পুরোটা রাস্তা দুই ভাই-বোন নানান বিষয়ে গল্প-গুজব করতে করতে গেল। বহুকাল পরে মনে একদফা প্রশান্তি অনুভব করলো তাজরীন।

আবাসিক কোয়ার্টারটা কয়েক একর জায়গা নিয়ে গঠিত। সম্পূর্ণ কোয়ার্টার-ই বেশ পরিপাটি। এখানে একসাথে পাশাপাশি অনেকগুলো বিল্ডিং। প্রত্যেক বিল্ডিংয়ের প্রতিটি ফ্লোরে দু’টি করে ফ্ল্যাট।
সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার বলে কথা – · গেইট থেকে শুরু করে প্রতিটা বিল্ডিংয়ে শৃঙ্খলার ছাপ স্পষ্ট। প্রবেশপথে নিরাপত্তা রক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারির গার্ড পোস্টটা চোখে পড়বে সবার আগে। তার পাশেই স্টিল গেইট, যেখানে নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
ভেতরে প্রবেশ করলেই প্রশস্ত রাস্তা, দুপাশে গাছের সারি; যেন সাজানো উদ্যান।
গেইট থেকে লম্বা রাস্তা ধরে সামনে এগোলেই আলাদা ব্লক ধরে আবাসিক ভবনগুলো। প্রতিটা ভবন-ই পাঁচতলা বিশিষ্ট। সবগুলো বিল্ডিংয়ের নিচতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

কোয়ার্টারের ভেতরে অনেকটা ফাঁকা জায়গা৷ সব বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটগুলোতেই ঝুলানো লম্বা বারান্দা। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়ালে এক বারান্দা থেকে আরেকটা বারান্দার দূরত্ব হাত পাঁচেকের মতো।
তাজরীন এসেছে ঘন্টা দুয়েক। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মা আর বৌমণির সাথে আলাপ করে মায়ের হাতে খাবার খেয়ে এখন তার রুমের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে পুরো কোয়ার্টার পর্যবেক্ষণ করে দেখছিল। সামনের বিল্ডিংগুলো। খুবই একঘেয়ে লাগছে তাজরীনের৷ এখানে খোলা হাওয়া নেই। এখন ওর খোলা ফুরফুরে হাওয়ার দরকার। বিল্ডিংয়ের সামনের বাগানটাতে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অনেকটা কলোনির মতো। তাজরীনের ইচ্ছা হলো, এখন সেখানে গিয়ে বসতে। জায়গাটার আশেপাশে অনেক গাছপালা। গাছের পাতা নড়ছে, খোলা হাওয়া বইছে। ওই পরিবেশ রীতিমতো আকর্ষিত করছে তাজরীনকে৷ ভাবলো, বৌমণিকে নিয়ে হেঁটে আসবে। সেই মোতাবেক জীমের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, ওর বৌমণি শুয়েছে।

তাজরীন আর বিরক্ত করলো না তাকে। ভাই ইতিমধ্যেই ওকে পৌঁছে দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে৷ তাজরীন রান্নাঘরে গেল। ডলি বেগম রান্না করছিলেন। রান্নাঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়েই তাজরীন বললো,
“সকাল দশটায় বৌমণি ঘুমিয়েছে কেন আম্মা? শরীর খারাপ নাকি? কিছুক্ষণ আগেও তো ভালোই আড্ডা দিচ্ছিল।”
“শরীর একটু খারাপ বটে। আর কাল রাতে নাকি ওর ভালো ঘুমও হয়নি। তাই এখন বরং একটু ঘুমিয়ে শরীর চাঙ্গা করে নিক।”
“আমি আরো ভাবলাম, বৌমণিকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তাটা থেকে ঘুরে আসবো। দম বন্ধ লাগছে এই আটকা ফ্ল্যাটের ভেতর।”
“তুই একাই যেতে পারিস তো মা। যা গিয়ে ঘুরে দেখে আয়।”
মায়ের কথায় তাজরীন একাই বেরিয়ে পরলো। বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে সামনের কংক্রিটের রাস্তা ধরে হেঁটে বাগানের মধ্যে নামলো। এখানে ধাপে ধাপে গাছপালা রোপণ করা। সামনে একটা বসার জায়গা। গোল সিঁড়ির মতো চারিপাশে, ওপরে কংক্রিটের ছাতা। তাজরীন গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে সেখানে বসলো৷ দূরে ক্যান্টনমেন্ট। সেদিক থেকে প্যারেডেে বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে। বিশাল কোয়ার্টার চত্বর ঘিরে বয়স্ক ব্যক্তিরা হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন। তাজরীন বসেছে সবে দুই মিনিট হলো৷ তখনই পেছন থেকে একটা বাচ্চার চঞ্চল কন্ঠ শুনে চমকে ঘুরে তাকালো ও। একজন মুরব্বি মহিলার সাথে খুব সম্ভব বছর তিনেকের একটা বাচ্চা ছেলে চটপটে ভাবে হেঁটে আসছে এদিকেই। চঞ্চল কন্ঠে কথাও বলছে অনর্গল। কন্ঠস্বর কেমন যেন আগে শোনা শোনা লাগলো তাজরীনের কাছে। কৌতূহলী ও উঠে দাঁড়ালো৷ এগিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে ব্যস্ত মহিলাটি এবার মুখ তুলে ভালোভাবে তাকালেন তাজরীনের দিকে।৷ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে রইলেন তিনি। মুখ হাঁ করে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলেন তাজরীনের দিকে। তার অমনভাবে তাকানো অদ্ভুত লাগলো তাজরীনের কাছে। অস্বস্তি হলো। তাজরীন অনুরিক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

“কোনো সমস্যা আন্টি?”
মহিলাটির এবার ধ্যান ভাঙলো। তড়িঘড়িতে তিনি বললেন,
“না তো! কোনো সমস্যা হয়নি। কে তুমি মা? এখানে আগে তো কখনো দেখিনি!”
মহিলা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করতেই তাজরীন জবাব দিলো,
“আজ-ই এসেছি এখানে। এই-যে সামনের ফ্ল্যাট, ওখানেই থাকছি।”
“তোমার কে আছে এখানে?”
“আমার বড়ভাই। মেজর শাহবীর রুস্তম।”
“ওহহো! তুমি তাহলে রুস্তমের বোন? রুস্তমকে তো চিনি অনেকদিন। আমার ছেলে রুবায়েতের খুব ভালো বন্ধু। তোমাদের ওখানেই ছুটি কাটাতে গিয়েছিল না মাঝে?”
তাজরীন এক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলো সামনে দাঁড়ানো মহিলার কথা শুনে। এরপর ভালোভাবে ছোট ছেলেটিকে দেখলো। এই তাহলে রুবায়েতের ছেলে?আর সামনে দাঁড়ানো মহিলাটি রুবায়েতের মা! তাজরীন কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই পেছন থেকে রুবায়েতের মায়ের বয়সী একজন মহিলা ডাক দিলেন রুবায়েতের মা আয়েশা খানমকে। তাজরীনকে ইশারায় তিতানকে খেয়াল রাখতে বলে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হলেন আয়েশা খানম। তাজরীন এবার ভালোভাবে খেয়াল করে তিতানকে দেখলো। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে। চুলগুলো সোনালি রঙের প্রায়, ত্বকের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা দেখতে কিছুটা বিদেশিদের মতো। গোলগাল একটা বাচ্চা। সাইজে খুব ছোট্ট। তাজরীনের এক হাতের সাইজ৷ তাতে বেশ ভালোভাবে এঁটে যাবে।বাচ্চাটা মুখ উঁচু করে এতোক্ষণ তাজরীনকেই দেখছিল গাল হা করে। তাজরীন এবার হাঁটু মুড়ে বসলো ঘাসের ওপর বাচ্চাটার সামনে। নাম জানা সত্ত্বেও আলাপ শুরু করার জন্য তিতানের মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

“তোমার নাম কী সোনা?”
“আমাল নাম টিটান নুউয়াজ উরপে, লাড্ডু। তুমাল নাম কী আন্টি?”
“আমার নাম. . . আমার নাম তাজরীন। তুমি বরং তাজ বাবু বলতে পারো৷ এটা সুন্দর না? তোমার মুখে মানাবে ভালো।”
“আত্তা তাজ বাবুউ।”
তাজরীন কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে তিতানের সামনে৷ বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে ওর। এতো সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা থাকতে কিনা রুবায়েত! ছিঃ! আর ভাবতে পারে না তাজরীন। এবার ও দুষ্টুমির ছলে তিতানকে বলে বসে,
“তুমি কী জানো সোনা, তোমার বাবা কে?”
“কে আবাল? মেজল। আমাল পাপা তু মেজল।”
“না, তোমার বাবা আসলে অন্যকিছু।”
তাজরীন গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে। তিতানকে কৌতূহলী দেখা গেল বেশ৷ ও চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলে,

“কী?”
“তোমার বাবা একটা রাক্ষস।”
“তাক্কশ?”
তিতানের চোখ আরো বড় বড় হয়ে যায়। দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেশ আশ্চর্যান্বিত সে। টিভিতে কার্টুনে সে ভয়ংকর তাক্কশ দেখেছে। যাদের বড় বড় দাঁত, লম্বা লম্বা শিং থাকে। তিতান ঘাবড়ালো। তাজরীন বললো,
“তোমার রাক্ষস বাবা কেমন দেখতে জানো?”
“কেমন?”
“বড় বড় ধারালো দাঁত তার, লম্বা লম্বা শিং। চোখগুলো ভয়ংকর হয় দেখতে। তোমার বাবা সেরকম একজন রাক্ষস। শুধুমাত্র রাতে দেখা যায় তার রাক্ষস রূপ। শুধু রাক্ষস বললে ভুল হবে। গাম্বু দৈত্যও বটে।”
তাজরীন কিছুটা ভয়ার্ত স্বরে বললো। তিতান এবার পুরোপুরি ঘাবড়ে গেল। পিছু হটতে হটতে কান্নারত, ভয়ার্ত স্বরে বললো,
“পাপা তাক্কশ, গাম্বু দুইততো!”
তিতান দৌড় দিলো তাদের বিল্ডিংয়ের দিকে। পেছনে তাজরীন ওর কান্ড দেখে মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো।

“পাপা তুমি আমাকে বুকা দিচচু কিনু? উই আন্টি টিকি বুলিচে। তুমি কুউব পতা। তুমি নাকি তাক্কশ। তুমার ইয়া বোড়ো বোড়ো দাঁত। তুমি এ্যাততা গাম্বু দুইততো।”
ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মনোযোগ সহকারে ওর কান্নারত মুখশ্রীর দিকে চেয়ে কথাগুলো শুনছিল রুবায়েত। বোঝার চেষ্টা করছিল, কি বলতে চাইছে তার লাড্ডু। তিতান তখনও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেই চলেছে। রুবায়েত ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য ইউনিফর্ম পড়ে তৈরি হয়ে বের হচ্ছিল সবে। হাতঘড়িটা পরেছে মাত্র। তখনই বাইরে থেকে দৌড়ে বসার ঘরে ছুটে এলো তার ছেলে। কাঁদছিল। রুবায়েত কোলে তুলে নিতেই আরো জোরে কান্না শুরু। তারপর-ই এহেন উদ্ভট কথাবার্তা৷ রুবায়েতের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মহাবিরক্ত সে। তিতানকে আরো একটা ধমক দিতেই চুপ হয়ে গেল ও। রুবায়েত রাশভারী স্বরে বললো,

“কে আন্টি? কোথায় গিয়েছিলে তুমি? দিদা কোথায় তোমার? –– আম্মা, আম্মা. . .”
তিতানকে প্রশ্ন করেই দরজার বাইরে চোখ রেখে তাঁরস্বরে নিজের আম্মাকে ডাকতে ব্যস্ত হলো রুবায়েত। তিতান তখন তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো,
“দিদা তো আমাল মিত্তি আন্টির ছাথে কুথা বুলে। উই নিচতলায়।”
রুবায়েত কৌতূহলী হলো। কার কথা বলছে তার ছেলে!

আয়েশা খানম প্রতিবেশীর সাথে কথা বলা শেষ করে তিতানকে এসে খুঁজতে লাগলেন। তাজরীন জানালো, তিতান বিল্ডিংয়ের দিকে গেছে। তা শুনে স্বস্তি পেলেন আয়েশা খানম। তাজরীনের সাথে টুকটাক আলাপ জুড়লেন। তাজরীনের মা, বৌমণির সাথে তার আলাপ হয়েছে, প্রায়শই গল্প করা হয়— এহেন আরো নানান কথাবার্তা। এরমধ্যে কয়েকবার রুবায়েত আর নাতির কথাও তুললেন তিনি। বেশ আফসোসের সুরে বলছিলেন,
“জানো না মা, নাতনিকে একা হাতে মানুষ করা যে কি কষ্টের! শত হোক আমার রুবায়েতের একমাত্র ছেলে। আমার ছোট ছেলেটা থাকে রংপুরে। ওখানে চাকরি করে। আমি বছরে একবার যাই ছোট ছেলের কাছে। ছোট ছেলের তো পরিবার-পরিজন গোছানো আছে। কিন্তু বড়ছেলে আর নাতিকে একা ফেলে আমি মা কীভাবে যাই বলো? আমার হয়েছে যত জ্বালা। আমি মরলে যে কি হবে ওদের। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।”
আয়েশা খানমের কথাগুলো ঠিক তাজরীনের মাথায় ঢুকলো না সম্ভবত। কথার গভীরতা ও বুঝতে পারলো না। তাই, সহসা ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ । তারপর কৌতূহল দমন করতে না পেরে এতোক্ষণ মনের মধ্যে বহুকষ্টে ধামাচাপা দিয়ে রাখা প্রশ্নটা আয়েশা খানমকে জিজ্ঞাসা করলো,

“আন্টি, আপনার বৌমা কোথায়? উনি আছেন তো। তাহলে আপনি এতো দুশ্চিন্তা করছেন কেন?”
“বৌমা, বৌমা কোথা থেকে আসবে?”
“মানে?”
তাজরীন হতভম্ব না হয়ে পারে না। কথা পরিষ্কার নয়৷ সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে। ওর ধোঁয়াশা কাটাতে আরো একবার চমকে দিয়ে আয়েশা খানম বলে উঠলেন,
“আমার ছেলের বউ তো বেঁচে নেই। আমাদের আসমা তিন বছর আগে মারা গেছে। এজন্যই বাপ-ছেলেকে নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা আমার।”

তাজরীন পুরো কথা কানে নিলো না৷ ওর কানে শুধু এই কথাটা বাজছে, “আমার ছেলের বউ তো বেঁচে নেই।”
বিরবির করে তাজরীন নিজ মনে বলতে লাগলো,
“রুবায়েতের ওয়াইফ আসমা জীবিত নেই!”

আবার বসন্ত পর্ব ২