প্রণয়ের অমল কাব্য গল্পের লিংক || Drm Shohag

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১
Drm Shohag

“আমি একজন ভার্সিটির লেকচারার, আর তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করেছ ক্লাস টেন এর একটা মেয়ের সাথে। তোমাদের মাথা ঠিক আছে?”
ইরফানের কথায় তার মা বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমাকে কেন এসব বলছো? তোমার বাবাকে গিয়ে বলো। তাছাড়া মেয়েটার আর একমাস পর এসএসসি এক্সাম। এরপর কলেজে উঠে যাবে। চিন্তা কর না।”
ইরফান রাগে কথা বলতে পারছে না ঠিক করে। ২৭ বছরের তাগড়া যুবক সে। বিয়ে করবে না এমন তো বলেনি। কিন্তুু তাই বলে একটা বাচ্চাকে বিয়ে? ভাবতেই পারছে না। অসম্ভব।
ডান হাতের দু’আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে লাগলো। মেজাজী চুলগুলো কপাল ছুঁইয়ে নেমে এসেছে। কনুই পর্যন্ত গুটানো হাতা। কনুই থেকে হাতের কব্জি পর্যন্ত হাতের রগ গুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছে রাগের প্রভাবে। কপাল থেকে আঙুল সরিয়ে ঝাঁকড়া চুলের ভাঁজে একবার হাত চালিয়ে নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালালো। তবে তাতে সফল হলো না বিন্দুমাত্র।
হঠাৎ-ই বসা থেকে দাঁড়িয়ে কিছুটা আওয়াজ তুলে রাগ মিশ্রত কণ্ঠে বলে,

“আই থিংক, তোমার আর বাবার ব্রেইন ড্যামেজ হয়েছে। তাই একটা বাচ্চাকে আমার কোলে তুলে দিতে চাইছ। রেডি হয়ে থেকো। আমি তোমাদের ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। ওকে?”
ইরফান নেওয়াজ এর মা রুমা নেওয়াজ ছেলের কথায় তব্দা খেয়ে চেয়ে আছে। তার ছেলে মেয়েটাকে বিয়ে করবে না বলে তাদের মেন্টাল বানিয়ে দিচ্ছে? অতঃপর রেগে বলল,
“তুমি লিমিট ক্রস করছ ইরফান। এটা কি ধরনের কথা। তোমার বাবা আর মেয়ের বাবা ছোটবেলায় একসাথে পড়েছে। খুব ভালো বন্ধু ছিলেন তারা। এরপর হঠাৎ-ই মেয়েটার বাবা মারা গেল। মেয়ের মা তাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। তাছাড়া তোমার বাবার বন্ধু তোমার বাবাকে অনেক হেল্প করেছে। তার সামান্য প্রতিদান এভাবে দিতে চাইছে। তুমিও মেনে নাও।”
ইরফান দু’হাতে মাথার চুল টেনে বলল,
“উফ! বাবা ঋণ শোধ করবে, তো আমাকে কেন বলির পাঠা বানাচ্ছে? যেহেতু বাবার ঋণ শোধ করতে হবে, তো বাবাই বিয়েটা করে নিক। আমি কোনো বাচ্চাকে বিয়ে করে তাকে কোলে তুলে ফিডার খাওয়াতে পারব না। স্যরি।”
ছেলের কথায় রুমা নেওয়াজ বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। ইরফানকে ধমকে বলল,
“কি বলছ, বুঝে বলছ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইরফান নিজেও থতমত খেয়ে গিয়েছে কথাটা বলে। রাগে কি বলে ফেলেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মাথা নিচু করে চোখ বুজে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। পিছন থেকে ইরফান এর বাবা তারেক নেওয়াজ গম্ভীর গলায় বলে,
“তোমাকে বিয়েটা করতে হবে ইরফান। তোমার কোনো ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করতে চাইলে করতে পারো। আগামীকাল রাতের মধ্যেই আমরা বউমাকে নিয়ে রওয়ানা হব ইনশাআল্লাহ।”
ইরফান অদ্ভুদভাবে তার বাবার দিকে তাকালো। দু’দিন হলো গ্রামে এসেছে তারা। মূলত ইরফানের ফুপুর বাড়ি গ্রামে। মাঝে মাঝে আসা হয়। তবে এইবার এসে তার গলায় বাচ্চা ঝুলিয়ে দিবে জানলে এই গ্রামে পা রাখত না। বাবার দিকে তাকিয়ে রেগে বলল,
“বাবা, তুমি কি জানো? তোমার ফ্রেন্ড এর মেয়ের জন্য আমার চাকরি চলে যেতে পারে? এরপরও তুমি আমার সাথে একটা বাচ্চাকে জড়াতে চাইছ?”
তারেক নেওয়াজ ভাবলেন ছেলের কথা ফেলে দেয়ার নয়। সময় নিয়ে কি যেন ভাবলেন। এরপর গম্ভীর গলায় বললেন,

“তোমার ভার্সিটিতে কেউ না জানলেই তো হলো। ও আমার মেয়ের পরিচয়ে থাকবে। মেয়ের বয়স হলে তোমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। তোমার ভার্সিটির সবাই তো বাসায় এসে তোমার বউকে দেখছে না, তাই না?”
ইরফান হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। রাগে তার শরীর কাঁপছে। বাবার কথার পিঠে শুধু বলল,
“আমি কোনো বাচ্চাকে বিয়ে করতে পারব না। স্যরি বাবা। আমি আজকেই ব্যাক করব।”
এই বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
~
“তোর বাইকের চাবি টা দে।”
ইরফানের কথায় শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। মূলত বাজারের দিকে যাবে বলে। বাইক নিয়েই যাবে। ইরফান শুদ্ধর মামাতো ভাই। শুদ্ধ, ইরফান একই ইউনিভার্সিটির লেকচারার। শুদ্ধ ঢাকাতেই থাকে চাকরির সুবাদে। ছুটি পেয়ে ইরফানদের সাথে নিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছে। আগামীকাল একসঙ্গেই আবার ব্যাক করবে।
পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“বাজারের দিকে যাব। তুই বাইক চালাবি?”
ইরফান কোনো কথা বলল না। শুদ্ধর হাত থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দেয়। শুদ্ধ ভ্রু কোঁচকালো। ইরফানের কি হয়েছে? মনে হচ্ছে রেগে আছে। বাইকে উঠে বসার জন্য এক পা তুললে ইরফান বাইক এক টান দেয়। শুদ্ধর ডান পা ঠাস করে মাটিতে পড়ে যায়। ছেলেটা তব্দা খেয়ে চেয়ে থাকে ইরফানের হাওয়ার বেগে চলে যাওয়ার পথে। উল্টে পড়তে পড়তে বেঁচেছে। এতো বড় ছেলে হয়ে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়লে মান-ইজ্জত কিছু থাকত না। দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে রইল ইরফানের অদৃশ্য হওয়ার পানে। কার উপর রেগে আছে কে জানে। সেসব রাগ তার কাছে এসে ঝেড়ে গেল।

মামার ডাকে শুদ্ধর হুঁশ ফিরে। তারেক নেওয়াজ গম্ভীর গলায় বলে,
“তোমার ভাইকে বোঝাবে, আগামীকাল যেন আমাকে অপমান হতে না হয়। বুঝেছ?”
শুদ্ধ মাথা নাড়ল, মানে বুঝেছে। কিন্তুু কি বোঝাবে সেটাই তো বুঝলো না। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,
“মামা বলছিলাম, ইরফানকে কি বোঝাবো?”
তারেক নেওয়াজ যেতে যেতে বলল,
“আগামীকাল তোমাদের গ্রামের এক মেয়ের সাথে ইরফানের বিয়ে।”
শুদ্ধ মুখ গোল করে বলল,
“ওওওওও এইবার বুঝেছি ব্যাপার। বাপ-বেটা এই নিয়ে ঝামেলা করছে। বাপ বেটাকে বিয়ে করাবে। কিন্তুু বেটার তো বিয়ে করার সাধ নেই। বাপ তা বোঝে না। দু’জনেই যে এক গোয়ালের গরু। দু’জনের রাগ জেদ সমান সমান। বাপ বলেছে বিয়ে দিবে, মানে দিবেই। বেটা বলেছে বিয়ে করবে না মানে করবে না। তাহলে জিতবে টা কে? হু????
একটু থেমে গভীর ভাবনা নিয়ে বলল,
মামা আমাকে বোঝাতে বলে গেল। ট্রিকস তো বলে গেল না! বেটাকে নিজের মতো ঘাড়ত্যাড়া বানিয়ে বোঝানোর দায়িত্ব দিচ্ছে আমার উপর। এসব মানা যায়? আমার মামিটাকে জ্বালিয়ে খায়। ইশ কি কষ্ট আমার মামির জীবনে দুই ঘাড়ত্যাড়া টুপ করে এসে কোথা থেকে যে পড়লো!
কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বলে নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরল। আজ এতো বেফাঁস কথা বের হচ্ছে কেন তার মুখ দিয়ে? বাপ বেটা তাকে একসাথে ধরলে সে পালাবে কোথায়?

স্কুল থেকে এসএসির এডমিট নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ রাস্তার ওপাশে ফুচকা-চটপটির দোকান চোখে পরল মাইরার। অনেকদিন পর এই বুড়ো দাদুকে দেখল। কোথায় হারিয়েছিল কে জানে। যদিও তার স্কুলে আসা হয় না। ফাইনাল এক্সামের খুব বেশি দেরি নেই।
যাক আজ তো সে আর এই দাদু দু’জনেই হাজির তার পছন্দের ফুচকা-চটপটি নিয়ে। পেট পুড়ে খেয়ে তবেই আজ বাড়ি ফিরবে। যদিও বাড়ি গেলে তার মা তাকে আরও কিছু আপ্যায়ণ করে খাওয়াবে, যা খেলে পেট ভরে না, গা ভরে যায়, মায়ের হাতের স্পেশাল খাবার, যার নাম মার ছাড়া আর কি-ই বা হবে! এসব ভাবনা আপাতত বাদ রাখল। ফুসকার দিকে তাকিয়ে জিভেয় জল চলে আসলো। কার্টুন এর মতো জিভ বের করে শব্দ করতে ইচ্ছে করল। কিন্তুু এটা তো রাস্তা। এসব বাদ দিয়ে রাস্তার ওপাশে যাওয়ার জন্য দ্রুত কদম ফেলে দৌঁড় লাগাল।
রাস্তার মাঝ বরাবর গেলে হঠাৎ দ্রুতগামী একটি বাইক দ্রুততার সহিত ব্রেক কষল রাস্তার মাঝে সাদা হিজাব পরিহিত এক রমনীকে দেখে।

মাইরা বাইকের শব্দ পেয়ে ডান দিক ফিরে তাকালে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বাইকের সামনের চাকা মাইরার পায়ের সাথে লাগলে মেয়েটা ধপাস করে উপুড় হয়ে পড়ে যায় পিচ ঢালা রাস্তার উপর। ঠিক যেমন ছোটবেলায় বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি খেলতে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে।
বাইকে বসা ছেলেটি মেয়েটির ওপর বাইক চালিয়ে দেয়া থেকে রোধ করতে পারলেও, মাইরার পায়ের সাথে হালকা বেঁধে যায় বাইকের সামনের চাকা। ডান পায়ের গিরার একটু উপরে চাকা দ্বারা বারি খেয়ে মাইরা কুঁকড়ে উঠল। ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে নিল। পেটে হালকা চাপ পড়ায় মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। আজ বোধয় তার উপরে যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েই গেছে। মনে মনে আওড়াল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।’
একটু পর নিজের দিকে খেয়াল করে দেখল, নাহ সে বেঁচে আছে। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ল।
রাস্তা পিচ এর হওয়ায় বেশ ভালোই ব্যাথা পেয়েছে।
দুই হাঁটুতে বোধয় ছিলে গেছে। যেখানটায় চাকা লেগেছে সেখানে বোধয় কেটে গিয়েছে। ব্যাথায় আঁখি পল্লব পানিতে ভরে উঠেছে যেন টোকা দিলেই টপাটপ পানি ঝরবে। মাইরা ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করল। দুই হাতের তালু জ্বলছে।
ইরফান বাইক থেকে নেমে দ্রুত পায়ে মাইরার নিকট এসে দাঁড়াল। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হেই! আর ইউ ওকে?”

ততক্ষণে মাইরা বেশ কষ্ট করে উঠে সোজা হয়ে বসেছে। দাঁড়াতে পারবে কিনা তাই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। ইরফানের কথার কোনো উত্তর করল না। এই বেয়া/দব লোকটার জন্যই তার এই অবস্থা।
ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করছে মাইরা। অর্ধেক দাঁড়িয়েও পায়ের সাথে বড় হিজাব বেঁধে আবারও ঠাস করে পড়ে যায়।
মাইরার মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। কোমড়ে কত ব্য/থা পেল।
ইরফানের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। রাগ এবং অহমিকা সত্ত্বেও সে মেয়েটিকে যেচে প্রশ্ন করল, কিন্তু মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। ইরফানের মনের মধ্যে এক অদম্য ক্ষোভ জেগে উঠল, যেন মুহূর্তে সে মেয়েটির মুখে একটি থাপ্পড় দিতে পারলে শান্তি পেত।
মাইরা ভাবছে এই লোকটা যাচ্ছে না কেন?
ভাবনার মাঝেই তার সামনে একটা হাত নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মাইরা ভীত হয়। এই লোক তাকে ধরতে আসছে কেন? তার দিকে এভাবে হাত এগিয়ে আনছে কেন? রেগে গেল মেয়েটা। ভয়কে তাড়িয়ে, ছেলেটার বাড়ানো হাতের দিকে দৃষ্টি রেখে কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

“একদম আমাকে ছোঁবেন না। মেয়েদের ছোঁয়ার অভ্যেস নিয়ে বাইরে বের হন কেন? অসহ্য লোক, যত্তসব।”
ইরফান বাইক থেকে নেমে আসলে তার পকেট থেকে বাইকের চাবিটা রাস্তায় পড়ে যায়। সেটা তুলতেই হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তুু মাইরার কথা শুনে তার হাত থেমে যায়। অর্ধেক উপুড় হয়ে শক্ত চোখে একবার মাইরার দিকে তাকায়। ইচ্ছে করছে এই মেয়েকে থাপড়িতে গাল লাল করে দিতে। এমনিতেই তার বাবা মা এক বাচ্চাকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাইছে বলে তার মাথা ঠিক নেই, মাথা ঠাণ্ডা করতে বের হলো, এখানে আরেক বাচ্চা এসে জুটলো। আবার তাকে ভুলভাল পদবি দিচ্ছে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। শক্ত মুখায়বের গম্ভীর চাহনীর যুবকটি দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ায়,
“ইডিয়েট!”

এরপর রাস্তায় পড়ে থাকা চাবিটা তুলে নিল।
মাইরা ইরফান এর ইডিয়েট বলা কথাটা শুনেছে। কিন্তুু হাত, পা, কোমড়ে ব্য/থা পেয়েছে ভালোই। তাই আপাতত শরীরের ব্য/থায় জর্জরিত হয়ে রইল।
মাইরা মাথা নিচু করে লোকটার পায়ের জুতোর দিকে চেয়ে আছে। চাবি তুলে নিয়ে এখনো এমন
খাম্বার মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন বুঝল না।
কিছুক্ষণ পর মাইরা মাথা তুলে তাকায়, ছেলেটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। পা থেকে গলা পর্যন্ত তো একদম ঠিক আছে, ধূসর কালার প্যাণ্ট, শরীরে কালো শার্ট জড়ানো। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো।
কিন্তুু মাথার দিকে নজর পড়তেই মাইরার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ঠোঁট দু’টো আপনা-আপনি ফাঁক হয়ে গেল। এটা মানুষ? মানে সুস্থ মানুষ? না-কি পাগল? পা থেকে গলা পর্যন্ত তো সুস্থ-ই লাগে। কিন্তুু মাথার চুল এতো বড় কেন? মাইরা এভাবে কাউকে দেখেনি। ছোটবেলায় হয়তো পাগলদের দেখেছিল। এও কি পাগল না-কি?
ছেলেটার চোখের মণি বাদামী। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। কালো, কিচকিচ চাপ দাঁড়ি, গাড় সমান মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। মুখাবয়বে গাম্ভীর্যের ছাপ।

ইরফান ফোন কানে নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। মাইরা বিরক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বেশ কসরত করে উঠে দাঁড়ালো। ভালোই ব্য/থা পেয়েছে মেয়েটা। ডানহাত তুলে কোমড়ের একপাশে রেখে বাম পায়ের উপর সব ভর দিয়ে দাঁড়ালো।
ইরফান বাম হাত পকেটে গুঁজে ডান হাতে ফোন কানে নিয়ে কথা বলছে খুব সিরিয়াস মুডে। অবশ্য ইরফান মানেই সিরিয়াস। তার সামনে কেউ জোক্স বললেও তার শক্ত মুখাবয়ব থেকে নড়চড় হয় না। মাইরার কেন যেন রাগ লাগলো। চেঁচিয়ে উঠল,
“লাইসেন্স বিহীন বাইক চালাতে এসেছেন কেন মিস্টার? ইশ! আমার হাত পা কোমড় সব ভেঙে দিল।”
মাইরার কথায় ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো মাইরার দিকে। গম্ভীর গলায় বলল,
“ওকে বাই।”
এরপর কল কেটে ফোন পকেটে রাখে। মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হোয়াট?”
মাইরা রেগে বলে,

“বধির না-কি? একটা মেয়ের এক্সিডেন্ট ঘটিয়েছেন আপনি। আর এখন হোয়াট ফোয়াট করছেন।”
ইরফান আঙুল উঁচিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“হেই লিসেন, যাস্ট স্টপ।”
মাইরা বিরক্ত হলো। বাদামি চোখের মণি, চাপ দাঁড়ি, জঙ্গলিদের মতো ঘাড় সমান বড় বড় ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ছেলেটা ইংরেজ দের মতো শুধু ইংলিশ ঝাড়ছে। মাইরা কণ্ঠে ঝাঁঝ ঢেলে বলে,
“এই বিদেশি বিলাই বাংলাদেশে ইংরেজদের কোনো জায়গা নেই। বাংলাদেশে থাকতে হলে বাংলা বলুন।”
ইরফান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ে আছে মাইরার পানে। মাইরা একটু ভয় পেল হয়তো। ইরফান শক্ত কণ্ঠে বলে,
“আর একটা বাজে কথা বললে থাপড়িয়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ইস্টুপিট গার্ল।”
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে মাইরার পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
মাইরা কোমড়ে হাত দিয়ে পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে,
“শালা ঘুষদাতা, নিশ্চয়ই ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছে। আর এখন রাস্তায় এসে আমার মতো বাচ্চার কোমড় ভাঙছে, আমাকে ছুঁতে আসছে। শালা বেয়া/দব।”
ইরফান বোধয় মাইরার বলা প্রথম দু’টো শব্দ শুনতে পেয়েছে। বাইকের স্পিড বাড়িয়েছে। ইচ্ছে তো করছে এই মেয়ের উপর বাইক তুলে দিতে। উফ! এতো চাপ নিতে পারছে না।
মাইরার খাওয়ার মুড নষ্ট করে দিয়েছে লোকটা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। বিড়বিড় করে লোকটাকে বকতে লাগলো।

“মেয়েটা ভালো। অনেকের কাছে শুনেছি। একটু চঞ্চল, তবে ভদ্র। বাবা নেই, বুঝতেই পারছিস, দেখবি মেয়েটা ছোট হলেও ইয়া বড় বুঝদার হবে।”
চায়ের টঙ দোকানের পাশে বাইকে বসে আছে ইরফান। তার সামনে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ তার মামাতো ভাই ইরফানকে বোঝাচ্ছে। ইরফানের গম্ভীর মুখাবয়ব এর কোনো পরিবর্তন নেই। একমনে ফোন স্ক্রোল করছে। শুদ্ধ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে দোকান থেকে দু’কাপ চা এনে এক কাপ ইরফানের দিকে এগিয়ে দিলে ইরফান গম্ভীর গলায় বলল,
“ব্ল্যাক কফি আন।”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এই গ্রামে তোর জমিদারি ব্ল্যাক কফি কোথা থেকে আমদানি করব? এটা দিয়ে চালিয়ে নে।”
ইরফান কিছু বলল না। শুদ্ধ বুঝল এ খাবে না। নিজেই দু’কাপ চা সাবার করল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এরপর কাপ দুটো রেখে এসে বলল,
“বলছিলাম, বিয়ে তো হবেই, মেয়েটাও বাচ্চা। তুই চুলগুলো এবার নাহয় কেটেই ফেল। নয়তো বাচ্চাটা ভয় পাবে।”
ইরফান কথাটা শুনেই শক্ত চোখে শুদ্ধর দিকে তাকালো। রাতের অন্ধকারে চায়ের দোকানের মৃদুভাব আলো ইরফানের মুখে এসে পড়েছে। শুদ্ধ দেখল ইরফান তার দিকে খেয়ে ফেলা চোখে তাকিয়ে আছে।
শুদ্ধ মেকি হেসে বলল,
“মিস্টেক মিস্টেক, তোকে তামিল মুভির নায়কদের মতো লাগছে রে। বাচ্চাটা তোকে দেখে কেরাস (ক্রাশ) খাবে। সত্যি বলছি।”
ইরফান তার ডান হাতে শুদ্ধর কলার ধরে মেজাজী গলায় বলে,
“আমি কোনো বাচ্চাকে বিয়ে করব না। আর একটা বাড়তি কথা বললে তোর গ্রামেই তোকে বালি চাপা দিয়ে দিব।”
শুদ্ধ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
“ওকে ওকে। আমার কলার ছাড়। তোকে বিয়ে করতে হবে না।”
ইরফান শুদ্ধর কলার থেকে হাত সরিয়ে বাইকের দু’পাশে পা দিয়ে বসে টান দিয়ে চলে গেল। শুদ্ধ বিরক্ত হলো। এ আবার কই যায়?

ইরফান কবুল বলে উঠে দাঁড়ালো। অতিরিক্ত রাগে তার পুরো শরীর থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।
সে গাড়ি নিয়ে প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে গিয়েছিল। তার মা না-কি অসুস্থ হয়ে গিয়েছে, এসে দেখেছে সত্যিই অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। প্রেশার ফল করেছিল। কিন্তুু এভাবে তাকে বিয়ে করানোর জন্য তার বাবা মা এমন উঠেপড়ে লেগেছে কেন বুঝল না। বিয়ে করিয়েই ছাড়লো। এইখানে বেশিক্ষণ থাকলে একটা অঘটন ঘটবে।
কোনোদিকে তাকালো না। হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তারেক নেওয়াজ ও রুমা নেওয়াজ ছেলের ব্যবহারে বেশ বিব্রতবোধ করলেন।

মাইরার মা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ছেলেটা তার সাথে একবারও কথা বললো না। তিনি কি ভুল করলেন? তারেক নেওয়াজ এর দিকে চোখ পড়তেই এসব ভাবনা দূর হয়ে গেল। লোকটা তার প্রাক্তন স্বামীর বন্ধু কম, ভাই বেশি। তার মেয়ে এই লোকটার বাড়ির বউ এখন। সেও চিন্তামুক্ত। মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিতায় ছিলেন।
মাইরা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তার মা তাকে এতো তাড়াতাড়ি কেন বিয়ে দিল? তার বাবা নেই। তাই বলে সে এতোই বেশি হয়ে গেল? এসএসসি পরীক্ষা টা পর্যন্ত দিতে দিল না। তাকে বিদেয় করিয়েই ছাড়লো।
তার বোনদের থেকে শুনেছে, তার বর তার থেকে অনেক বড়। তার মা তার সাথে এমনটা কি করে করতে পারল? নিজের বাবা নেই বলে বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে?
ভাবনার মাঝেই মাইরার মা মাইরার ঘরে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলায়। মাইরা ফুঁপিয়ে ওঠে। মোহনা বেগম মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলেন,

“আমি তোর মা। খারাপ চাই না তোর। তোর দায়িত্ব টা কারো হাতে দিয়ে আমি এবার নিশ্চিন্ত হলাম। ও বাড়ি গিয়ে আমার মান রাখবি, কেমন? সবার সাথে মিলেমিশে থাকবি। তোর সুখী মুখ টা দেখতে চাই। তাই এই বিয়ে টা মেনে মন দিয়ে সংসার করবি, কেমন?”
মাইরার চোখ থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় মাথা নিচু করে আওড়ায়,
“আমার নিজের আব্বু বেঁচে থাকলে আজ এই দিন দেখতে হতো না, তাই না মা? সৎ আব্বুরা বুঝি মেয়েদের তাড়ানোর জন্য এভাবেই উঠেপড়ে লাগে?”
মাইরার মা কিছু বলতে পারলেন না। মাইরা নাক টেনে বলল,
“চিন্তা কর না মা। আমি আর তোমার সংসারে ঝামেলা বাড়াবো না। তোমরা ভালো থেকো।”

কথাটা বলে নিজেই বেরিয়ে গেল। মাইরার মা ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাইরার দিকে। মাইরার বাবা মারা যাওয়ার দুই বছরের মাথায় তাকে আবারও বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাসা থেকে। মাইরা তখন ক্লাস ফোর-এ পড়ে। বিয়ের আগে সে বলেছিল তার একটি মেয়ে আছে। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল। কিন্তুু যত দিন যেতে লাগলো, তার স্বামীর যেন মাইরার প্রতি বিরক্তির মাত্রা বাড়তে লাগলো। মাইরাকে সে ভালো রাখতে পারেনি মা হয়েও। এখন মেয়ের একটু সুখের আশায় মেয়েটাকে ভালো ফ্যামিলির হাতে তুলে দিতে পেরে হাজার কষ্টের মাঝেও ভালো লাগলো। অন্তত এই বাসায় মাইরা যেভাবে থেকেছে এর চেয়ে তো ভালো থাকবে। মা হয়ে আর কি-ই বা চায় মেয়ের জন্য!

“আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করিয়েছ, ভালো কথা। তবে এর সাথে সংসার টা আমি করতে পারব না। এটা মাথায় রেখ। বিয়ে করিয়ে ছেলের বউ পেয়েছ। এবার তোমরা দু’জনেই ওর সাথে সংসার কর বসে বসে। এই বাচ্চাকে যেন আমার আশেপাশে না দেখি। আই রিপিট, ওকে আমার আশেপাশে যেন না দেখি।”
কথাগুলো বলেই হনহন করে নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল ইরফান নেওয়াজ।
রুমা নেওয়াজ, তারেক নেওয়াজ দু’জনেই হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল তাদের ছেলের পানে।
মাইরার মাথায় ঘোমটা টানা। মাথা নিচু। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার মুখটাই দেখেনি। তার আগেই এমন তিক্ত বাক্য শুনে মাইরার ছোট্ট হৃদয়টা ব্য’থায় ভরে উঠল।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ২