পারমিতা পর্ব ৫৫

পারমিতা পর্ব ৫৫
Nabila Ahmed

চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মায়া চৌধুরী আর ওয়াহিদ চৌধুরী রাতের খাবার খেয়েই নিজেদের বাড়িতে চলে যাবেন।
চট্টগ্রাম থেকে মিতাদের সাথে অরিয়ন আসেনি। তার মানে যে অরিয়ন আগেই চট্টগ্রাম চলে গেছে তা বুঝা হয়ে গেছে মিতার।
রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে সবাই। সোফায় বসে নিউজ দেখছেন বাড়ির বড়রা। আবরার আর আফরিন যার যার রুমে। মিতাও তার রুমে।
বাড়িতে ঢুকেই সবাইকে একসাথে দেখে একটু খুশি হয় অরিয়ন। আবরার আর হাবিব চৌধুরী না থাকাতে ব্যবসায়ে অনেকগুলো কাজ জমে গেছে। একা অরিয়নকে তা সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই তো সবাই সন্ধ্যা করে চট্টগ্রাম চলে আসলেও অরিয়ন সকালেই চলে এসেছে।
–তোমরা কী আজ চলে যাবে?
দরজার সামনে ব্যাগ দেখে বলে অরিয়ন।

–হ্যাঁ।
জবাব দেন মায়া চৌধুরী।
–দেখ না, কত করে বললাম আজ রাতটা থাকতে তাও রাজি হচ্ছে না।
বলেন হাবিব চৌধুরী।
অরিয়ন গিয়ে হাবিব চৌধুরীর পাশে দাঁড়ায়।
–বাড়িটা একদম খালি ভাইয়া। মানুষের ভরসায় বাড়ি আর কতদিন খালি রাখবো।
ওয়াহিদ চৌধুরী বলেন।
–এখন কেমন লাগছে তোমার বাবা?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–ভালো আছি। তোর শরীরের কি অবস্থা? ক্ষতগুলো ভালো হয়েছে?
অরিয়নের হাত ধরে বলে হাবিব চৌধুরী। তার কন্ঠে ছেলের জন্য মায়া প্রকাশ পাচ্ছে।
–আমি ও ভালো আছি। একটু একটু ব্যথা ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–চলো চাচ্চু, তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আসি আমি।
সোফায় বসতে বসতে ওয়াহিদ চৌধুরীকে বলে অরিয়ন।
–তুই যাবি? আচ্ছা যেতে পারিস।
ওয়াহিদ চৌধুরী কথাটা বলে ২য় তলার সিড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–চলো।
উঠে দাঁড়িয়ে বলে অরিয়ন।
–একটু অপেক্ষা কর। এক্ষুনি মিতা চলে আসবে।
মায়া চৌধুরী বলে উঠে।
–পরী চলে আসবে মানে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–মিতা বললো ও যেতে চায় আমাদের সাথে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–ও যেতে চায়? কই আমাকে তো এই বিষয়ে কিছু বললো না।
–তুই ব্যস্ত বলে হয়তো বলার সময় পায়নি।
হাবিব চৌধুরী বলে।
–ওহ, আচ্ছা।
কথাটা বলেই হাঁটা শুরু করে অরিয়ন।

অরিয়ন যখন রুমে প্রবেশ করলো মিতা তখন সুটকেসে নিজের কাপড় রাখতে ব্যস্ত। অরিয়নকে দেখেও না দেখার মতো করে কাপড় গুছাতে মন দেয় মিতা।
–আমাকে বলিস নি কেন?
মিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–তুমি বাসায় ছিলে না।
স্যুটকেসের চেইন লাগাতে লাগাতে উত্তর দেয় মিতা।
–কতদিনের জন্য যাচ্ছিস?
মিতার একটু কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলে।
–একেবারের জন্য।
স্যুটকেস নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে জবাব দেয় মিতা।
–মানে?
–মানে আমি চলে যাচ্ছি। এখানে থেকে আর কারো সমস্যা বাড়াতে চাই না।
কড়া কন্ঠে জবাব দেয় মিতা।
–সমস্যা বাড়াচ্ছিস মানে? কে বলেছে তোর জন্য সমস্যা হচ্ছে?
অরিয়নের কথা শুনে মিতা দু পা এগিয়ে আসলো।
–তুমি কি তাই বুঝাচ্ছো না? আমার জন্য যদি সমস্যা নাই হতো তাহলে তো আর এভাবে দিনের পর দিন আমাকে ইগনোর করতে না তুমি।
–পরী…
–কি রিয়ন? কি চাও তুমি? আমার ভুল ছিলো তা তো আমি মেনে নিয়েছি। তার জন্য তিলে তিলে ম*রছি আমি আর কি করলে খুশি হবে তোমরা?
কথাগুলো বলতেই মিতার চোখে পানি চলে আসে।
–আমি বাবকে আর চাচ্চুকে কবির রহমানের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁরা মিথ্যে বলেছে সেটা কী আমার দোষ? তোমাকে বার বার ভালোবাসি বলার পরও তুমি আমাকে বুঝিয়েছো তোমার মন অন্য কারোর। কিন্তু সেদিন..
–পরী..
অরিয়ন কথার মাঝেই মিতার দিকে এগিয়ে যায়।

–না।
হাত দেখিয়ে অরিয়নকে থামতে বলে মিতা।
–কিন্তু সেদিন তুমি আমাকে হুট করেই ভালোবাসি বলেছো। বিশ্বাস করতে পারিনি আমি,সেটা কী আমার দোষ? আমার ভালোর জন্য তোমরা সবটা লুকিয়েছো কিন্তু আমার ভালোটা কথায় হলো?
–যা হয়েছে তার জন্য আমি ক্ষমা চেয়েছি রিয়ন। কিন্তু তোমার….কিন্তু তোমার এই ব্যবহার আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার ভুলের কী কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই? নাকি সেদিন আমি ম*রে গেলেই তোমরা খুশি হতে?
আবারও বলতে থাকে মিতা। মিতার সহ্যের বাধ যেন ভেঙ্গে গেছে।
অরিয়ন চুপ করে মিতার কথা শুনলো।

–তোমার ব্যবহার, তোমার কথায় মনে হচ্ছে সব কিছুর সমাধান আমার ম*রণ ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের খেলা তো অন্যরকম। যেহেতু আমি ম*রিনি সেহেতু তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো। তুমি যে আমার সাথে আর থাকতে চাও না তা আমি বুঝতে পেরেছি রিয়ন। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না।
কথাগুলো বলতে বলতে বিছানায় গিয়ে বসে মিতা। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে।
মিতা বিছানায় বসতেই অরিয়ন ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। মিতার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে। মিতার চোখ কান্নার ফলে লাল হয়ে আছে।
–তোর বয়স তখন ৪। একদিন তোর আম্মু আব্বুর সাথে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলি তুই।
বলতে থাকে অরিয়ন। হঠাৎ করে অরিয়ন কি বলছে মিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে অরিয়নের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল।
–আমি ঘুমিয়েছিলাম। বুকের উপর কিছুর ভার অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকাই। ঘুম ঘুম চোখে আমার দেখতে পাই আমার বুকের উপর বসে আছিস তুই। পরণে সাদা রঙের একটা জামা। চাচ্চু পরীর ডানা কিনে এনেছিলো। সেটাই পড়াও পড়া ছিলি। হাতে ম্যাজিক্যাল স্টিক আর সেই স্টিক দিয়ে কি একটা বলে আমাকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করছিলি তুই।
কথাটা বলতেই হেসে দেয় অরিয়ন।

–তোকে দেখে সেদিন আমার মনে হয়েছিলো তুই সত্যিই একটা পরী। এরপর থেকেই তোকে পরী বলে ডাকতাম আমি।
মিতা শুধু অরিয়নের দিকে তাকিয়েই রইল।
–আফরিনের জন্য আমার অনুভূতি তো কোনো ছলনা ছিলো না। আমি আমার সব দিয়েই ওকে ভালোবেসেছিলাম। তাহলে আমি কিভাবে বলে দেই যে, আমি তোকে ভালোবাসি?
নিজের হাত দিয়ে মিতার চোখের পানি মুছে দেয় অরিয়ন।
–আফরিনকে এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে ভুলে গেলাম আমি জানিনা! তবে শুনেছিলাম, বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত। হয়তো তাই খুব তাড়াতাড়িই তোকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
–ভালোই যদি বাসো তাহলে এখন কেন আমার সাথে থাকতে চাচ্ছো না তুমি?
প্রশ্ন করে মিতা।
–আমরা যাকে বেশি ভালোবাসি তার উপর আমার অভিমানও বেশি থাকে।
মিতার মুখ থেকে চুল সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দেয় অরিয়ন।
–সবাই তোকে খুব ভালোবাসে। হ্যাঁ আমি জানি মা তোকে পছন্দ করে না। কারণটাও এখন তোর সামনে পরিষ্কার। এখন বলতে পারিস আমরাও কী তার মতো ভাবি? না ভাবি না। তাহলে কেন মাকে কোনোদিন কিছু বললাম না? কারণ মা মানুসিক ভাবে অসুস্থ। অহনার মৃত্যুর পর উনি প্রায় পাগল। মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তোকে দেখলেই তার ট্রমার কথা মনে পড়ে, না চাইতেও আর কন্ট্রোল করতে পারেনা।

–আন্টির ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি রিয়ন।
জবাব দেয় মিতা।
–বাবা, আরিয়ানকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার মাতগা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তোকে ওরা কতটা নির্যাতন করেছে তা তো নাই বললাম। গু*লিটা তোর লাগতে পারতো! তোকে আমি সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতে পারতাম। বাবা বা আরিয়ানকেও পারতাম। তাহলে আমার কি রাগ করার কারণ নেই? তাহলে আমি কী আমার পরীর উপর একটু অভিমান করতে পারিনা?
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মিতা।
–তাহলে কেন ভাববি আমি তোর সাথে থাকতে চাই না? আমার পৃথিবী জুড়ে শুধু তুই আর তুই।
মিতার ঠোঁটে আলতো করে এক চুমু এঁকে দেয় অরিয়ন।
–সরি।
–আমিও সরি। অনেক কষ্ট দিয়েছি আমার পরীকে তাই।
অরিয়নের সব কথা শুনে অভিমান কাঁটে মিতার। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে। অরিয়নও জড়িয়ে ধরে মিতা।
পরক্ষণেই মিতার ঠোঁটের উপর আক্রমণ চালায় অরিয়ন। কতদিন পর মিতার এতোটা কাছে এসেছে তা যেন ভুলে গেছে রিয়ন। মিতার ঠোঁটের সাথে অরিয়নের ঠোঁট স্পর্শ করতেই হাসি ফুঁটে অরিয়নের মুখে। মিতাকে কাছে পেয়েই সেই স্বস্তির আর মানুসিক শান্তির অনুভূতিটা ফিরে এসেছে।
–আহ..

কামড়ে ধরে মিতার ঠোঁট।
কোমলতার সাথে চুমু খেতে থাকা অরিয়ন যেন ক্ষনিকের মধ্যেই রাফমোডে যেতে সময় লাগে না।
–সরি।
হুট করেই বলে উঠে অরিয়ন।
–সরি কেন?
বুঝতে না পেরে বলে মিতা।
–এরপর যা হবে তার জন্য!
কথাটা বলেই মিতার গলায় চুমু দিতে থাকে অরিয়ন।
–মিতা? মিতা?
দরজায় কড়া নাড়ে শায়লা।
লাফিয়ে উঠে একে অপরের সাথে সরে যায় দুজনেই।
–জ্বি, শায়লা আপু।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দেয় মিতা।

পারমিতা পর্ব ৫৪

–তোকে ডাকছে। সবাই নিচে অপেক্ষা করছে।
বাইরে থেকে শায়লার কথা ভেসে আসে।
–আচ্ছা আসছি আমি।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় মিতা।
–এখন নিচে গিয়ে “যাবি না বলে” আয় যা৷
বলে অরিয়ন।
–ওকে।
জবাব দেয় মিতা।

পারমিতা পর্ব ৫৬