প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৩
Drm Shohag
ইরফানের, সারারাত বসে, হেঁটে, নয়তো এপাশ-ওপাশ পায়চারি করে কেটেছে। সারারাতে মোটামুটি এক প্যাকেট সিগারেট পোড়ানো শেষ।
ইজি চেয়ারে বসে লাস্ট সিগারেট ডান হাতের দু’আঙুলে ধরে বার দুয়েক টোকা দিল। এরপর আবারও ঠোঁটের ফাঁকে ছেড়ে কয়েকবার শূণ্যে ধোঁয়া ছুঁড়লো। সিগারেটের অবশিষ্ট ছোট্ট অংশটা ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আবারও খানিক পায়চারি করল।
ফজরের আজানে ইরফান দাঁড়িয়ে যায়। আকাশপানে চেয়ে আজানের প্রতিটি ধ্বনি শুনলো। সারারত এমন ঠাণ্ডা পরিবেশে উদাম গায়ে থাকায় শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। তবে ইরফানের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই।
আজান শেষে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে বের হলো। ঘরেই নামাজ পড়ে শুদ্ধ কে ঠেলতে লাগলো। শুদ্ধর নড়চড় নেই। বিরক্ত হয়ে জোরেসোরে একটা লাথি দেয়। শুদ্ধ ঘুমের মাঝেই ঠাস করে পড়ে যায় বিছানা থেকে। কোমড়ে হাত দিয়ে ঘুমঘুম চোখে বলে,
“কোন বেয়া’দব আমায় ফুটবল ভাবছিস রে? আরে ভালো করে দেখ, আমি মানুষ।”
ইরফান পাত্তা দিল না শুদ্ধর কথা। সে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
এদিকে শুদ্ধর ঘুম উবে যায়, ধড়ফড় করে উঠে বসে। কাল রাতে একবার পড়েছিল, এখন আবার। ঘুমঘুম চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখল ইরফান আয়েশ করে শুয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুই আমায় ফেলেছিস? এই মীরজাফর দের মতো আচরণ করা বন্ধ করবি তুই? ইশ! কোমড় টা গেল আমার!”
ইরফান চোখ বুজে বলে,
“দুই ঘণ্টা পর ডেকে দিবি। ঘুম থেকে উঠে যেন এক কাপ ব্ল্যাক কফি পাই।”
শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমাকে তোর কাজের মাসি মনে হচ্ছে?”
“নাহ, কাজের মামা মনে হচ্ছে। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।”
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো। ইচ্ছে করল ইরফানের পা’ছা’য় এক লাথি দিয়ে একদম এর বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। শালা বেয়া’দব তার জীবনটা ভেজে খায়। সাধে কি আর বলে তার মামির কপাল পুড়েছে। এমন ঘাড়ত্যাড়া জামাই ছেলে নিয়ে যে কীভাবে সংসার করল তা ভেবেই শুদ্ধর মনে হয় তার মাথার চুলে পাক ধরে যাবে।
এসব রেখে সেও নামাজ পড়তে গেল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাইরা সকালে উঠে নামাজ পড়ে নিল। মাথা ব্য’থায় ঘুম ভালো হয়নি। কিন্তুু সকালে ওঠার অভ্যাসে তার, তাই বিছানায় সারাদিন চোখ বুজে থাকলেও আর ঘুম আসবে না সে জানে। ভোরের আলো ফুটেছে। ঘরের দরজা খুলে মাইরা চুপিচুপি এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি দিল। ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরলে তার সামনে শ্বাশুড়ি কে দেখে স্ট্যাচু হয়ে যায়।
রুমা নেওয়াজ গম্ভীর মুখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা তার শ্বাশুড়ির তাকানোয় মাথা নিচু করে নিল। রুমা নেওয়াজ গম্ভীর গলায় বলে,
“ইরফান কোথায়?”
মাইরা মাথা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। নামটা আজকেই প্রথম শুনলো। এই বাড়িতে কে কে থাকে সে তো জানে না। এই ব্যাটা আবার কে। আর তাকেই বা জিজ্ঞেস করছে কেন? রুমা নেওয়াজ কর্কশ কণ্ঠে বলে,
“কি হলো কথা বলছো না কেন?”
মাইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। আমতা আমতা করে বলে,
“জ্বি, আসলে আমি তাকে চিনিনা। আপনি যদি বলতেন সে এই বাড়ির কোন সদস্য।”
রুমা নেওয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল,
“নিজের স্বামীর নামটাও জানো না? বিয়ে করেছ কেন তাহলে?”
মাইরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আসলেই স্বামীর নাম জেনে নেয়া উচিৎ ছিল। তবে মুখ নিশপিশ করল কিছু কথা বলার জন্য। ‘ওমন বেয়া’দব বরের নাম জানার দরকারও নেই তার। কালকে রাতের কথা মনে পড়ল। লোকটা বাইরের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ওতো রাতে ভালো ছেলেরা তো বাইরে যায় না। মুখ ফসকে বলে দেয়,
“আমার মনে হয়, আপনার ছেলে খা’রা’প কাজে জড়িত। আপনার খোঁজ নেয়া উচিৎ।’
রুমা নেওয়াজ ধমকে বলেন,
“থাপ্পড় খাবে আমার ছেলের নামে আর একটা বাজে কথা বললে।”
এরই মাঝে তারেক নেওয়াজ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন,
“ওকে এভাবে বকছ কেন?”
“ও আমার ছেলের নামে উল্টাপাল্টা বলছে। একে তো স্বামীর নামধাম, খোঁজখবর কিছুই জানে না, তার উপর আবার অপবাদ দিচ্ছে।”
তারেক নেওয়াজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি রান্নাঘরে যাও। আমি ইরফানের খোঁজ নিয়েছি। ও শুদ্ধর বাড়ি আছে।”
রুমা নেওয়াজ গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মাইরা মাথা নিচু করে মুখ বাঁকালো। মা ছেলে এক গোয়ালের গরু। মুখ থেকে শুধু নিম পাতার রস ঝরে।
তারেক নেওয়াজ মাইরাকে বলে,
“নামাজ পড়েছ আম্মু?”
মাইরা অমায়িক হেসে বলল,
“জ্বি আঙ্কেল।”
“আমি এখনো আঙ্কেল? বাবা হই তোমার। বাবা বলবে।”
মাইরা এক কথায় রাজি হয়ে মাথা নেড়ে বলে,
“জ্বি আচ্ছা বাবা।”
~
বিকেলবেলায় মাইরা তার শ্বশুরের সাথে বের হয়েছে। তারেক নেওয়াজ মাইরাকে নিয়ে বের হয়েছে, মূলত মেয়েটা গ্রামের মেয়ে, সারাদিন ঘরে বসে আছে। তাই ভাবলেন বাইরে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাক, তার ছেলের তো খোঁজ নেই। একটা ব্যাপার ভাবলেন মাইরার কাছে ফোন নেই। তাই প্রথমে মাইরাকে নিয়ে ফোনের দোকানে গেলেন। মোটামুটি ভালো একটা ফোন কিনে দিলেন মাইরাকে। মাইরা চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। তাকে কেউ চকলেট দিলেও সে খুশি হয়ে নিবে। কিন্তুু ফোন নিতে কেমন যেন সংকোচবোধ করছিল। সে বাড়িতে তার মায়ের ফোন চালাতো টুকটাক।
তারেক নেওয়াজ মাইরার সংকোচ বুঝতে পারলে তিনি সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন, তিনি মাইরার বাবা। মাইরা খুশি হয়ে তার শ্বশুরের থেকে ফোন নিয়ে নেয়। খুশিতে একবার লাফ দিতে চায়। কিন্তুু আশেপাশে এতো মানুষ দেখে নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নেয়। এরপর তারেক নেওয়াজ মাইরাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে মাইরার দুই বান্ধবীর সাথে দেখা হয়। তারা আগে গ্রামে থাকতো। ক্লাস নাইনে ওঠার পর শহরে চলে এসেছে। প্রায় দুই বছর পর দেখা হলেও একে অপরকে দেখে চিনতে পারে।
“তুই মাইরা না?”
কারো কণ্ঠে মাইরা পাশ ফিরে তাকালে তার প্রিয় বান্ধবীকে দেখে একপ্রকার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বান্ধবীদের দেখে নিজের চাঞ্চল্য ভাব চেপে রাখতে পারেনি। রাইসা হেসে মাইরাকে আগলে ধরে। এ তো আগের মতোই আছে। শুধু লাফিয়ে বেড়ায়। পাশ থেকে মাইশা হেসে বলল,
“তুই এখানে কেন? গ্রাম থেকে কবে আসলি?”
মাইরা রাইসাকে ছেড়ে বলে,
“আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
মাইশা, রাইসা একসাথে অবাক হয়ে বলে,
“কিহ?”
মাইরা পাশ ফিরে তার শ্বশুরের দিকে একবার তাকায়। তারেক নেওয়াজ গলা ঝেড়ে বলে,
“আম্মু তুমি তোমার বান্ধবীদের সাথে এখানে বসো। আমার কাজ আছে। আমি কাজ সেড়ে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব কেমন?”
মাইরা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আচ্ছা বাবা।”
তারেক নেওয়াজ বেরিয়ে গেলে তিন বান্ধবী রেস্টুরেন্টের এক কোণার ফাঁকা টেবিলে গিয়ে বসে। রাইসা প্রশ্ন করে,
“গল্পটা বল। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল? ইটিশপিটিশ করতিস নাকি?”
মাইরা রেগে বলল,
“একটা থাবড়া খাবি। আমার খেয়েদেয়ে কাজ নাই। আম্মু বিয়ে দিয়ে দিল। সৎ বাবা আমায় দেখতে পারে না, তাই।”
মাইরার কথা শুনে দুই বান্ধবীর একটু খারাপ লাগলো। তারা জানে মাইরার বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা আরেকটা বিয়ে করে। মাইরার মা যদিও মাইরাকে আগলে রাখত, তবে পরের সংসারে আগের পক্ষের মেয়েকে চাইলেও সেভাবে দেখতে পারতো না। রাইসা, মাইশা মন খারাপ করে বলল,
“বুঝেছি। আচ্ছা বাদ দে। বিয়ে তো শহরে হয়েছে। ফ্যামিলি ভালোই হয়তো। জামাই কি হ্যান্ডসাম নাকি টাকলু মামা?”
মাইরা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলল,
“জানিনা। শুধু জানি বুড়ো।”
মাইশা গালে হাত দিয়ে বলল,
“শেষমেশ বুড়ো? তুই দেখিস নি কেন?”
মাইরা এতোসব বলতে চাইলো না। ব্যাপার টা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“তোদের খবর বল। পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?”
তারা টুকটাক কথা বলতে লাগলো।
ইরফান, শুদ্ধ ভার্সিটির ক্লাস শেষে একটা রেস্টুরেন্টে আসে। তাদের সাথে আরেকজন কলিগ রিপন ও এসেছে। ইরফান গম্ভীর মুখে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করে, এদিকে শুদ্ধ, রিপনদের কথার শেষ নেই। ইরফান যেমন স্বল্পভাষী, গম্ভীর স্বভাবের। শুদ্ধ আর রিপন তেমনি ইরফানের উল্টো ক্যরেক্টার। ইরফানেরা মাইরাদের ডান পাশের ঠিক একটা টেবিল পরের টেবিলে গিয়ে বসে।
শুদ্ধ আর রিপন মাইরাদের থেকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছে। অপর পাশে ইরফান। এদিকে মাইরার দুই বান্ধবী ইরফানদের থেকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছে, আর মাইরা বসেছে ইরফানের মুখোমুখি হয়ে। মাঝে খুব বেশি ব্যবধান না নেই। মাইরা কথা বলতে বলতে হঠাৎ-ই সামনের দিকে চোখ পড়লে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ভীত কণ্ঠে বলে,
“বান্ধবী এখানে পাগল এসেছে, পাগল। চল পালাই।”
মাইশা বলে,
“কোথায়?”
মাইরা ডান হাতের আঙুল দিয়ে ইরফানের দিকে ইশারা করে দেখালে মাইশা, রাইসা দু’জনেই উল্টো ঘুরে তাকালো।
মাইরার ভয়েস মোটামুটি জোরে ছিল। যার ফলে কথাটা ইরফানদের কানে পৌঁছায়। শুদ্ধ আর রিপন উল্টো ঘুরে তাকায়। ওদিকে ইরফানও মাইরার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। মাইরা ইরফানের দিকে তাক করে রাখা আঙুল এখনো নামায়নি। মাইশা, রাইসা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আরে কোথায় পাগল? ভদ্র-ই তো লাগে। আরে এমন বড় চুল কতজন তো স্টাইল করে রাখে। আবাল।”
কথাটা বলে এদিক ফিরে মাইরার দিকে তাকালে দেখল মাইরা এখনো হাবার মতো ইরফানের দিকে আঙুল তাক করে আছে। রাইসা নিজের কপালে একটা বারি মেরে মাইরার হাত নামিয়ে দিয়ে বলে,
“আরে এভাবে আঙুল তুলে আছিস কেন? কি বলবে মানুষ, আজব!”
ইরফান শক্ত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,
“যাক কেউ একজন তো চিনতে পারল আমাদের সাথে এক পাগল ঘোরাঘুরি করে।”
ইরফান হঠাৎ-ই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। রিপন শুদ্ধর পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,
“এমনিতেই রেগে গেছে। শুনলে তোর বারোটা আগে বাজাবে।”
কথাটা বলে নিজেও দাঁড়িয়ে ইরফানের পাশে এসে দাঁড়ায়। ইরফান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাইরার দিকে চেয়ে। যেন টুপ করে গিলে খাবে।
মাইরা ভীত চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে কাঁপছে। পাগলকে পাগল বলে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। এখন তার কি হবে?
শুদ্ধ একবার মাইরার দিকে তাকালো আরেকবার ইরফানের দিকে। মাইরাকে দেখে বাচ্চা-ই লাগলো। এই বাচ্চাটা না বুঝে বলেছে। কিন্তুু তার ভাইটা না বুঝে এই বাচ্চাকে এখন কি করবে সেটাই তার ভাবনায়। ইরফান মাইরার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে শুদ্ধ দ্রুত ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“মেয়েটা ছোট। এখানে সিনক্রিয়েট করিস না। বাদ দে। না বুঝে বলে ফেলেছে। আমি তো বলেছি তুই তামিল মুভির নায়ক।”
ইরফান রেগে চিৎকার করে বলে,
“ওর সাহস কি হয় আমাকে এভাবে বলার?”
মাইরা চোখ বড় বড় করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ইরফান শুদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে মাইরার দিকে এগিয়ে আসলে মাইরা ভয়ে একদম কোণায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে নিচে লুকাতে চায়। কিন্তুু লুকনোর মতো জায়গা না পাওয়ায় একদম কোণায় গুটিশুটি মেরে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। মাইশা, রাইসা দু’জনেই আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইরফান মাইরার পাশ বরাবর দাঁড়িয়ে বলে,
“হেই ইডিয়েট গার্ল, বাইরে বেরিয়ে এসো।”
মাইরা কেঁদে দিবে প্রায়। ভীত স্বরে বলে,
“দোস্ত আমায় বাঁচা। এই পাগলটা আমায় মেরে ফেলবে।”
ইরফানকে আবারও পাগল বলায় রাগে টেবিলের উপর ধুপ করে একটা পাঞ্চ মারে। আশেপাশে মানুষ সার্কাস দেখছে বসে বসে। ইরফান রেগে বলে,
“বেরিয়ে এসো। নয়তো…”
মাইরা মাথা উঁচু করে রেগে বলে,
“একদম এগোবেন না। আমার কিন্তুু বেশি বয়সের একটা জামাই আছে। বয়স বেশি তাই বুদ্ধি ও বেশি। আপনাকে একদম উড়িয়ে দিবে বলে দিলাম।”
মাইরার কথায় শুদ্ধ, রিপন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
“হোয়াট?”
মাইরা বিড়বিড় করে বলে,
“শালা ইংরেজ, আবার ইংলিশ ঝাড়ছে। এই ব্রিটিশ কে কেউ বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয় না কেন?”
রাইসা, মাইশা দু’জনের মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। এই মাইরা আর শুধরালো না। বিয়ে হয়েছে তবুও এমনই থেকে গিয়েছে। এর বুড়ো জামাই একে সামলায় কীভাবে? রাইশা ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া ওর হয়ে আমরা স্যরি! আসলে ও, না বুঝে বলে ফেলেছে।”
মাইরা রাইসার কথায় রেগে বলল,
“আরে তোরা স্যরি বলছিস কেন? জানিস এই পাগল দু’দিন আগে আমায় এক্সি’ডেন্ট করিয়েছিল। আরে এ তো ইংরেজ। বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে হবে, আর তোরা স্যরি বলছিস। মূর্খের দল সব।”
মাইরার কথা শুনে তার দুই বান্ধবী তার দিকে রেগে তাকালো। উফ! এই মেয়েটার মুখ বন্ধ হয় না কেন, বুঝে পায় না।
ইরফানের শরীরে যেন আগুণ ধরিয়ে দিচ্ছে মাইরার প্রতিটি কথা। শুদ্ধ ঢোক গিলে ইরফানকে জোর করে টেনে কয়েক পা পিছিয়ে নিয়ে আসে। মাইরা যখনই দেখল ইরফান একটু পিছিয়েছে ওমনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে কোণা থেকে বেরিয়ে আসে। এক দৌড়ে চলে যাবে, তার আগেই ইরফান এগিয়ে এসে মাইরার হিজাব টেনে ধরে। মাইরার পা থেমে যায়। কি সুন্দর করে হিজাব বেঁধেছিল, সব পিন ছুটে গেল বোধয়। মাথা থেকে হিজাব ছুটে গেলে তার শরীরে তো কিছুই থাকবে না। সে ভয়ে মাইরার পা থেমে যায়। শুদ্ধ পাশ থেকে ইরফানের শরীরে হাত বুলিয়ে বলছে,
“ছেড়ে দে রে। দেখ মানুষ তাকিয়ে আছে।”
ইরফান রেগে বলে,
“এই ইডিয়েট আমায় ভুলভাল পদবি দিয়েই যাচ্ছে, ওকে আমি ছাড়ব না। ওর লাইফটা যাস্ট হেল করে দিব আমি। স্টুপিট গার্ল।”
মাইরা ইরফানের কথার মাঝেই সুযোগ বুঝে একটু এগিয়ে এসে ইরফান যে হাত তার হিজাব টেনে ধরেছে। সে হাতে তার দু’হাত দিয়ে গায়ের জোরে খামচি দিয়ে ধরে। ইরফান রাগান্বিত চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ভেবেছিল এই কাজ করলে লোকটার হাত আলগা হবে, সেই সুযোগে সে পালাবে। কিন্তুু এই লোকটা তো নির্বিকার। মাইরার নিজেরই হাত ব্য’থা হলো। এই লোকের কোনো ভাবান্তর নেই। মাইরা অবাক চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে ইরফানের হাত থেকে তার হাত সরিয়ে নিল। আজ সে শেষ। ঢোক গিলল। মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আপনার চামড়া বুঝি গণ্ডারের?”
বলেই নিজের মুখ চেপে ধরল। তার বেফাঁস কথা যে শুধু মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। জম এর সামনে দাঁড়িয়েও কথার লাগাম টানতে পারে না। ইরফান মাইরার হিজাবের কোণা ছেড়ে মাইরার বাম হাত শক্ত করে ধরে। মাইরার মাথায় কিছু আসছে না। ওদিকে মাইশা, রাইসা নিজেরাও বুঝতে পারছে না কি করবে। এই মেয়েটার এসব বদ অভ্যাস আগে গ্রামে দেখাত, তা নাহয় মানা যায়। শহরে এসে অপরিচিত একজনের সাথে এমন কেন করছে, ভয়ডর কিছু নেই না-কি!
মাইরা ভয়ে ভয়ে ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“দেখুন, আমায় ছাড়ুন বলছি। আমার বুড়ো জামাই আপনাকে ছাড়বে না বলে দিলাম।”
ইরফান মাইরাকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। এই ইডিয়েটকে আজ সে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে।
মাইরা হঠাৎ-ই মেঝেতে বসে পড়ে। ইরফান মাইরার হাত শক্ত হাতে ধরে রেগে তাকায়।
শুদ্ধ আর রিপন হা করে চেয়ে আছে মাইরার দিকে। এটা কি ভাই?
মাইরা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি হাই লেভেলের ভালো। দয়া করে আমায় বাঁচান আপনার পাগল বন্ধুর হাত থেকে।”
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকালো মাইরার দিকে। কী সাংঘাতিক মেয়ে! কনটিনিউয়াসলি ইরফানকে পাগল বলে যাচ্ছে। আবার তাকে পাম-ও দিচ্ছে যেন বাঁচিয়ে দেয়। শুদ্ধ মনে মনে হাসল। কোন বুড়োর বউ এই মেয়ে? তার তো দুঃখ হচ্ছে সেই বুড়োর জন্য। ভাবনা রেখে ইরফানের হাত ধরে বলে,
“আরে বাচ্চা মেয়ে, ছেড়ে দে।”
ইরফান মাইরার হাত ছাড়লো ঠিকই, কিন্তুু আবারও মাইরাকে ধরতে গেলে মাইরা দ্রুত বসা থেকে উঠে এক দৌড় দেয়। ছাড়া পেয়েছে এক সেকেণ্ডের জন্য। সে সুযোগ কাজে লাগাবে না? কোনোদিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। ইরফানের হাত ফসকে যায়। মাইরা ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে গিয়েছে। ইরফান শক্ত চোখে মাইরার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শুদ্ধ হা করে মাইরার দৌড়ে পগারপার হওয়ার দৃশ্য দেখল। বাঁদর এর দৌড়ের স্পিড এই মেয়ের চেয়ে কম হয়তো। চোখের পলকে হাওয়া।
ইরফান রাগে গজগজ করতে করতে শুদ্ধর শার্ট এর কলার ধরে বলল,
“ওকে ছাড়ব না আমি।”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার শার্ট ধরে বলছিস, ওকে ছাড়ব না। এসব কোন নীতি ফলো করে করিস বলবি?”
ইরফান বিরক্তি, রাগে শুদ্ধর কলার ছেড়ে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। রিপন টেবিলে বসে এদের সার্কাস দেখছিল এতোক্ষণ। শুদ্ধ পাশ ফিরে একবার মাইরার বান্ধবীদের দিকে তাকালো। মাইশাও এদিকে তাকালে শুদ্ধর সাথে চোখাচোখি হয়। শুদ্ধ চোখ সরিয়ে নিয়ে রিপন এর পাশে গিয়ে বসে। রিপন একটা সেন্ডউইচে কা’ম’ড় বসিয়ে বলে,
“তোর ভাই কই গেল?”
শুদ্ধ ডান হাতের শার্ট এর হাতা গুটাতে গুটাতে বলে,
“যেখানে খুশি যাক, আমার পেট আগে ভরাই। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি।”
রিপন অপর পাশে খেয়াল করলে দেখল সেই মেয়ের দুই বান্ধবীর মাঝে একজন শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। রিপন মিটিমিটি হেসে বলল,
“আই থিংক, তোকে দেখে একজন ক্রাশ খাইছে মামা।”
শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলে,
“খেতে দে।”
রিপন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুই একটা চান্স নে। বাচ্চা মেয়ে, পুরাই মাখ…..”
শুদ্ধ রেগে তাকায় রিপনের দিকে। রিপন মুখের লাগাম টানে। শুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলে,
“মেয়েদের রেসপেক্ট করতে না জানলে ওদের নিয়ে কথাই বলবি না।”
রিপন বোঝানোর সুরে বলে,
“আরে আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলছি। নেগেটিভ মিন করে কিছু বলিনি।”
শুদ্ধ খেতে খেতে বলে,
“তোকে চেনা আছে। নতুন না। আর আমাকে এসবে জড়াবি না। সময় মতো সোজা বিয়ে করে নিব।”
রিপন ভ্রু কুঁচকে কিছু বলার আগেই শুদ্ধ আবারও বলে,
“আন্সার পাবি না। তাই চুপচাপ খেয়ে নে। আমাকেও খেতে দে।”
রিপন আর কিছু বলল না।
মাইরা রেস্টুরেন্ট থেকে দৌড়ে বেরিয়ে দেখে তারেক নেওয়াজ রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকছে। মাইরা দ্রুত তার শ্বশুরের হাত ধরে বলে,
“বাবা আমাদের কথা শেষ। বাড়ি চলুন।”
তারেক নেওয়াজ কিছু বলার আগেই মাইরা নিজেই টেনে নিয়ে যায় তার শ্বশুরকে। তারেক নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“বিল দিয়ে আসি আম্মু?”
মাইরার পা থেমে যায়। পিছন ফিরে দেখল রেস্টুরেন্টে এর দরজার পাশে ইরফান দাঁড়িয়ে। অসম্ভব আর ওদিকে যাওয়া যাবে। মেকি হেসে বলল,
“বাবা ওদের আমি পরে দিয়ে দিব। আপনি আমায় বাড়ি নিয়ে চলুন। প্লিজ!”
তারেক নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“তোমার কি কোনো প্রবলেম হয়েছে আম্মু?”
মাইরা আমতা আমতা করল। সে কি বলবে? তার ছেলের বউ বাইরের এক ছেলের সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছে? হঠাৎ-ই পেটে হাত দিয়ে বলল,
“বাবা আমার মারাত্মক বাথরুম পেয়েছে। প্লিজ চলুন।”
তারেক নেওয়াজ থতমত খেয়ে বলল,
“আচ্ছা আম্মু চলো।”
মাইরা একবার উঁকি দিয়ে দেখল ইরফান এদিকেই আসছে। তাকে এখনো দেখেনি। সে দৌড়ে গাড়ির অপর পাশে গিয়ে বসল। তারেক নেওয়াজ মাইরার ব্যবহারে খানিকটা অবাক হয়েছে। মেয়েটা বেশ চঞ্চল। গ্রামের মেয়ে একটুআধটু এমন হয়, তবে মাইরা কয়েক ধাপ এগিয়ে মনে হলো। ছেলের বউ হিসেবে খা’রা’প লাগলো না। এরপর তিনি গাড়িতে উঠে ড্রাইভার কে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলেন।
মাইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। হনহন করে তার সাইড করে রাখা গাড়িতে উঠে বসে। তখন-ই তার ফোনে রিং হয়। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলে দেখে তার মা। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রিসিভ করে।
“বলো।”
এপাশ থেকে রুমা নেওয়াজ বলে,
“তোমার খালামণিরা এসেছে। বাসায় এসো।”
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কোনো আন্সার করে না। তার মা আবারও বলে,
“বাচ্চাদের মতো পাগলামি করবে না। তোমার খালামণি তোমাকে দেখতে চেয়েছে, আশা করি আজ শুদ্ধর বাসায় না গিয়ে এখানে আসবে।”
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ২
ইরফান এবারেও চুপ। গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত হাতে চেপে ধরে। রাগ কমেনি বিন্দুমাত্র। একটু আগের রাগ কমার আগেই মনে পড়ল বাড়িতে এক বাচ্চা আছে যাকে তার গলায় তার বাবা মা ঝুলিয়ে দিয়েছে। সেই রাগে কথা বেরচ্ছে না। রুমা নেওয়াজ ভেজা গলায় বলে,
“তোমরা বাবা ছেলে পেয়েছ টা কি বলবে? তোমার বাবা আমার কথা শোনেনি। এখন যখন বিয়েটা হয়েই গিয়েছে, তুমি আমার কথা শুনছো না।”
মায়ের ভেজা কণ্ঠে ইরফান কিছুটা দমে গেল। চোখ বুজে শ্বাস ফেলে বলল,
“আসছি।”
এই বলে কল কেটে তার বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরায়।
