কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৯+৪০
মিসরাতুল রহমান চৈতী
চৈতী রাতুলের একটা শার্ট গায়ে দিয়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছে। রাতুল শাওয়ার সেরে এসে চৈতীর পাশে বসে তার হাত দুটো ধরে বললো,
— “আমি জানি না, আমি যা বলবো তুমি বিশ্বাস করবে কি না। কিন্তু আমি আজ সব সত্যি কথা বলবো। সবটা শোনার পর সিদ্ধান্তটা তোমার, চৈতী।”
রাতুল একটু থেমে শ্বাস নিলো।
— “চৈতী, আমি জমিদার বংশের ছেলে— এটা তো তুমি জানো। ছোটবেলায় মা ছিলো না আমার। বাপ-চাচাদের অত্যাচার দেখে আমি বড় হয়েছি। আমাকে কখনো শেখানো হয়নি মেয়েদের সম্মান করার কথা। শিখিয়েছে শুধু নারীদের নরম দেহটাকে ভোগ করার কথা।”
রাতুলের কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠলো।
— “আমি কখনো ভালোবাসা পাইনি, চৈতী। শুধু পেয়েছি আঘাত। সেই সব অনাদর আর অবহেলা থেকে আমার যাতায়াত শুরু হয় আমাদের জমিদারের কুটিবাড়িতে। আমি তখন ছোট ছিলাম। কোনো ভুল করলেই আমাকে চাবুকে মারা হতো। ভালোবাসা কাকে বলে, আমি জানতাম না। এমন করেই বড় হয়েছি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে আজকের এই অবস্থানে আসা।”
রাতুলের চোখে জল টলমল করতে লাগলো।
— “অনেক দিন হলো আমি পতিতালয়ে যাই না। প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন একটা পার্টিতে আমাদের সব রাজনৈতিক নেতা ডাক পেয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। সেইটাই ছিল আমার জীবনের কাল। আমার ড্রিঙ্কে ড্রাগ মেশানো হয়েছিল। ড্রাগের প্রভাবে আমি একজন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। সেই ঘটনার ভিডিও তারা তুলে নেয়।”
চৈতীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। রাতুল কাঁপা কণ্ঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “আমি কখনো এসব তোয়াক্কা করিনি। কিন্তু সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি চ্যানেল, খবরের কাগজে আমাকে নারীসঙ্গ ও খারাপ জীবনযাপনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। তখন থেকে আমি আবারও বিপথে চলে যাই। আবার যাতায়াত শুরু হয় পতিতালয়ে।”
রাতুলের কণ্ঠে অনুতাপের ছোঁয়া।
— “তবে হঠাৎ করেই তোমার সাথে দেখা। সেই প্রথম দেখাতেই আমার হৃদয়ে প্রেমের বাগিচা তৈরি হয়েছিল। সেই বাগিচার প্রথম নীল প্রজাপতি হলে তুমি, চৈতী।”
রাতুলের চোখের জল এবার আর ধরে রাখা যায় না। চৈতী তার হাত শক্ত করে ধরে।
রাতুল কাঁপা কণ্ঠে বললো,
— “চৈতী, আমায় একটু ভালোবাসো। আমাকে একটু ভালোবাসার ভিক্ষা দাও। আমাকে দয়া করো। আল্লাহ্ তায়ালা তো মাফ করে দেন, তাঁর কাছে মাফ চাইলে তিনি ক্ষমা করেন। তুমি কি আমাকে মাফ করবে না?
আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কেউ ছিল না। ঠিক-ভুল দেখানোর কেউ ছিল না। তোমার আগমনে আমার জীবন বদলে গেছে। তুমি এলে, আমাকে ঠিক-ভুল, পাপ-পুণ্য, নীতি-আদর্শের মানে বুঝালে। আমি তোমার চোখে নিজের অপরাধগুলো দেখতে শিখেছি। চৈতী, আমি সত্যিই বদলাতে চাই। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও, প্লিজ।”
রাতুলের কণ্ঠে অনুশোচনা ও ভালোবাসার মিশ্রণ। চৈতী চোখের জল মুছতে মুছতে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চৈতী ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে নিজেকে ধাতস্থ করে তারপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,, আমাকে একটু সময় দিন আমার সময় লাগবে।
তুমি আজীবন সময় পাবে প্রিয়তমা কিন্তু আমার মতো ভালো কেউ তোমাকে ভাসবে না।
চৈতী কি আপন করে নিবে রাতুলকে? জানতে হলে গল্পের সাথে থকুন।
চৈতী কাচুমাচু হয়ে বিছানার এক কোণে বসে আছে। তার গায়ে এখনো হালকা কাঁপুনি। চোখে একটু ঘুম, একটু ভয়, আর প্রচণ্ড দ্বিধা।
রাতুল পাশ ফিরে শুয়ে চৈতীর কোমড়টা হালকা করে জড়িয়ে রেখেছে। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা, যেন সময়টাও থেমে আছে দুজনের মাঝখানে।
চৈতী চোখ বন্ধ করে আবারও ভাবতে লাগলো রাতুলের বলা কথাগুলো—
প্রতিটা কথা যেন কোথাও গভীরে গিয়ে বাজছে।
ভেতরটা এলোমেলো লাগছে ওর।
নিজেকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।
রাতুল আস্তে বলল,
— “এই ছোট মাথায় এত চাপ নিও না, চৈতী।
ভালোবাসা জোর করে হয় না।
হয়তো সময় লাগবে… কিন্তু আমি অপেক্ষা করবো,
যতদিন না মৃত্যু আসছে,
যতদিন না কেয়ামত হচ্ছে—
ঠিক ততদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
তুমি যদি আমায় কাছে আসতে না দাও,
তাহলে ছায়া হয়ে থাকবো পাশে।
তোমার চারপাশে ভালোবাসা দিয়ে একটা বেষ্টন তৈরি করবো—
যেখানে শুধু তুমি থাকবে, নিরাপদ, শান্ত, আর আপন।”
চৈতী চোখ বন্ধ করেই শুনছিলো।
শব্দগুলো বুকের ভেতর কাঁপন তুলছিলো।
টলমল চোখে তাকালো রাতুলের দিকে।
হুট করে ওর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে জাপটে ধরলো রাতুলকে।
একটা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রাতুল ওকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো।
মনে হলো, সময় হয়তো সত্যিই বদলে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো।
রাতুল চৈতীকে চাদরে মুড়িয়ে রেখে বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলে দিলো।
আসিফ দাঁড়িয়ে, হাতে একটা শপিং ব্যাগ।
— “ভাই, এর থেকে ভালো জামা পাইনি। তবে একদম সুতি, আরাম বোধ করবে ভাবী।”
রাতুল মাথা নাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চৈতীর হাতে ব্যাগটা দিয়ে বলল,
— “তোমার ড্রেস এসে গেছে। পরে নাও।
আমি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকবো।”
চৈতী মাথা নেড়ে ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
সাদামাটা সুতি জামা পড়ে বের হলো কিছুক্ষণ পর।
নীরব পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
— “আপনি বসেন, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি।”
রাতুল ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
— “তুমি রান্নাঘরের আশেপাশেও যাবে না, চৈতী।
কেয়ারটেকারের বউ আছে, ওনার রান্না করার কথা।”
— “ঠিক আছে, আমি শুধু গিয়ে দেখি কী রান্না করেছে। আপনাকে তো খাওয়াতে হবে… তারপর মেডিসিনও খেতে হবে।”
রাতুল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।
চৈতী রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।
গিয়ে দেখে, কেয়ারটেকারের বউ রান্না প্রায় শেষ করে ফেলেছে।
ও একটু হাসিমুখে বলে উঠলো,
— “নতুন বউ সাহেব কি উঠেছে?”
চৈতী হালকা হাসলো,
— “হুম, অনেক আগেই।”
— “ওনি এখন কেমন আছেন?”
— “আল্লাহ্র রহমতে ভালো আছেন।”
চৈতী খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে রুমে ফিরে এলো।
রাতুল উঠে বসতে চাইলে চৈতী থামিয়ে বললো,
— “উঠবেন না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
রাতুল একটু অবাক হলো।
চুপচাপ তাকিয়ে রইলো চৈতীর মুখের দিকে।
নিজের অজান্তেই চোখের কোণে এক চিলতে শান্তির ছায়া খেলে গেলো।
এক জীবনে মানুষ সব কিছু পায় না।
কিন্তু যতটুকু পায়, সেটুকুই হয়ে ওঠে অনেক কিছু।
আজকের এই যত্ন, এই নীরব ভালোবাসা—
রাতুলের কাছে এর চেয়ে বড় কিছু নেই।
চৈতী খুব যত্ন করে এক এক করে তুলে দিচ্ছিলো খাবার।
রাতুল নির্বাক হয়ে খেয়ে নিচ্ছিলো।
ভালোবাসা শব্দে নয়, কাজে প্রকাশ পাচ্ছে আজ।
খাওয়া শেষ হলে ওষুধ খাইয়ে দিলো চৈতী।
ঠিক তখনই রুমে ঢুকলো আসিফ আর ডাক্তার।
ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়লো রাতুলের ড্রেসিং নিয়ে।
আর আসিফ তখন ভিডিও কলে পতিতালয়ের কাজ দেখাচ্ছে রাতুলকে।
রাতুল মন দিয়ে সব দেখছে, সব শুনছে…
তবে তার চোখটা আটকে আছে শুধু এক জায়গায়—
চৈতীর মুখের দিকে।
একটা সময় ছিলো, যাকে সে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো…
আজ সেই চৈতী তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে।
একটু পরই আসিফ আর ডাক্তার রুমে ঢুকলো।
ডাক্তার পেশাদার ভঙ্গিতে ব্যাগ খুলে রাতুলের ড্রেসিং করতে শুরু করলো।
ওদিকে আসিফ ফোন হাতে নিয়ে বললো,
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৮
— “ভাই, ওইখানে যা বলছিলেন সব কাজ প্রায় শেষ। এখন লাইভ দেখাচ্ছি, আপনি একবার দেখে নেন।”
রাতুল মাথা নাড়ল।
আসিফ ফোনের ভিডিও কল অন করে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো পুরো জায়গাটা।
পতিতালয়ের ভাঙচুর, উদ্ধারকৃত মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর প্রক্রিয়া, আর আশেপাশের কিছু ডিটেইল।
রাতুল একদৃষ্টে দেখছিলো।
ডাক্তারের হাতে ব্যথা লাগছিলো ঠিকই, কিন্তু মুখে কোনো ভাঁজ নেই।
তবে চোখে একটা দৃঢ়তা—
অন্যায়কে শেষ করতে হলে এইরকমই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।
আর পাশে যদি কেউ চুপচাপ যত্ন করে রাখে,
তাহলে সেই লড়াইটা কিছুটা হলেও সহজ হয়ে যায়।