চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৩

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৩
ইশরাত জাহান জেরিন

নির্জন রাত। মেঘে ঢাকা আকাশ কান্নার ভার বহন করছে। সারাদেশ জুড়ে অস্থিরতা। কোথাও কালবৈশাখীর আগমন, কোথাও বজ্রসহ বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরের বুকে ইতোমধ্যে সৃষ্ট হয়েছে একটি নিম্নচাপ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্ক বার্তায় মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এসেছে। সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশ জুড়ে একটানা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হয়তো আকাশ নিজেই নীরবে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এমন এক রাতে শহরের অচেনা রাস্তায় মিতালি দাঁড়িয়ে। আশ্রয় নিয়েছে একটি বন্ধ চায়ের দোকানের ভাঙা চাতালের নিচে। ভিজে কাঠ হয়ে যাওয়া এই দোকানটাই তার একমাত্র ঢাল। অটোরিকশা? রাস্তায় কোনো যানবাহনের দেখা নেই।

মেঘাচ্ছন্ন বাতাসে ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেছে তারা। চারদিকে অদ্ভুত স্তব্ধতা। মৃত শহরের মতো নিঃসাড়, নীরব। মিতালির চোখে জল। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিশে তা ঝরে পড়ে চাতালের ফাঁক গলে জমে থাকা পানিতে। সেই পানির ঢেউও যেন তার যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। এই শহরে হাজারো মানুষ থাকলেও, এই মুহূর্তে সে কেবলমাত্র একা। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। হয়তো কোনো ছাউনির নিচে কুঁকড়ে ঘুমাচ্ছে। আজ হয়তো প্রকৃতি নিজেই তার সমস্ত সত্তা গুটিয়ে নিয়েছে। মিতালির হাতের মোবাইল ফোনে একের পর এক বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যাচ্ছে। স্ক্রিনটা নিস্তেজ হয়ে গেছে। বারবার চেষ্টা করেও কাজ করানো যাচ্ছে না। বাড়িতে ফোন করার শেষ আশাটুকুও মিলিয়ে গেছে। প্রকৃতির মন আজ তারই মতো ভারাক্রান্ত। আকাশ কালো, বাতাস ভারী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর এর মধ্যেই খবর এলো তার বাবা ৬২ বছরের জীবন শেষে পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে চিরদিনের মতো চলে গিয়েছেন। মায়ের মৃ*ত্যুর পর থেকে বাবাই তো ছিলেন একমাত্র আপন। যতই দূরে থাকুন যতই কঠিন হোন, বাবা তো শেষ পর্যন্ত বাবা-ই। শহরে আসার পর মিতালির আর বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে একসময় ছোটখাটো কাজে কাটছিলো দিন। এলাহী বাড়িতে কাজ পেয়ে একটু স্বস্তি এসেছিল বটে কিন্তু আজ সেই স্বস্তিটুকুও বিষাদের ভারে দমচাপা। চিত্রা আপার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই ফারাজ এলাহী কঠোর হয়ে উঠেছেন। কথা বলার সুযোগ তো দিলেনই না, উপরন্তু দরজাও বন্ধ করে দিয়েছেন। মিতালি অনেক কিছু বলার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভাবছিল ঢাকায় গিয়ে সব খুলে বলবে। কিন্তু সময় তো আর কারো কথা শোনে না। সময় তার নিয়মেই চলে। এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মিতালি। বৃষ্টির ফোঁটায় তার বাবার নিথর দেহটা হয়তো এখন ভিজছে কোথাও। এক অসহায়, অনুচ্চার কান্না তার চোখে জমে উঠে।

“মানুষ এই দুনিয়ায় থাকে সামান্য, কিন্তু মায়া বাঁধে অসামান্য। যদি একদিন চলে যেতেই হয় তাহলে এত মায়ার কারবার কেন?”
বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মিতালি আজ নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধ শীতল শহর তার শোকের বোঝা একফোঁটাও ভাগ করে না নেয়। মিতালি চোখ বন্ধ করে। চোখের সামনে ভেসে উঠে ফেলে আসা শৈশব। মনে পড়ে যায় তার শেকড় মাইজচর, হোসেনপুরের বুক চিরে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে গড়া সেই অপূর্ব গ্রামের কথা। বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাওয়া মাটির পথঘাট, নতুন ধান গাছের ঘ্রাণে বাতাস ভরে ওঠে স্নিগ্ধতা সবকিছুই ছবির মতো ভেসে উঠে।বাঁশঝাড়ে জলের ফোঁটা লেগে যখন হালকা হাওয়া বইতে থাকে তখন সেই শব্দ এক ধ্রুপদী সংগীত হয়ে উঠত। নদীর কূল বেয়ে ধীরে ধীরে পানি বাড়ত। ঘর থেকে ঘরে মৃদু আলো ঝলমল করত। সবই ছিল প্রকৃতির নিজস্ব দীপাবলির আয়োজন।

সেই গ্রাম,সেই নিঃশব্দ সৌন্দর্য এখন শুধু মিতালির স্মৃতির খেয়ায় ভাসে। চোখ বন্ধ করলে সে সব অনুভব করতে পারে। সেই কাঁচা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলো। যেগুলোর পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে মর্মর ধ্বণি উঠত সেগুলো আজও তার জায়গাতেই আছে। শুধু মিতালি হারিয়ে গিয়েছে সময়ের ভারে। ভাটার সময় কাদার গন্ধে মিশে থাকা শৈশবের গল্প আজও গল্প হয়েই মগজে গেঁথে আছে। মিতালি ছোটবেলায় পা ডুবিয়ে রাখত নদীতে। মাছরাঙার ডাকে চমকে উঠত। কখনো বা নৌকার দোলায় দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ত। এই নদী শুধু জল নয় এটা ছিল তার একান্ত সহচর, তার গোপন কথা শোনার নীরব বন্ধু। শরতে নদীর তীরে কাশফুলের রাজ্য গড়ে ওঠে। সেই সাদা তুলোর মতো দুলে ওঠা কাশফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হতো যেন সময় থেমে গেছে। বাতাসে ঘাসের ঘ্রাণ, পানির গন্ধ আর শুকনো মাটির গরম শ্বাস মিলিয়ে নেশা তৈরি হতো।

মিতালি এখন সেই স্মৃতির পাহাড়ে বসে আছে। এই শহরে ঠান্ডা চাতালের নিচে আরেকটা ধাক্কা খাওয়ার পর একবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর তখনই নদীর ঢেউয়ের শব্দ কানে বাজল। দূরের মাটির ঘ্রাণ ভেসে এল তার কাছে। ফোন বাজছে। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। পরপর দু’টো কল বাজার পর ৩য়টা ধরতে পারে মিতালি। বাটন যে কাজ করেছে তাই অনেক। মিতালি কল রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই মাটির সেই সোঁদা গন্ধ হঠাৎ করে বদলে যায় সিগারেটের তিক্ত গন্ধে। গন্ধের হদিস করার আগেই পেছন থেকে দুটো অন্ধকার হাত তার মুখ চেপে ধরে। হাত থেকে ফোনটা ছিটকে মাটতে পড়ে যায়। চাপা গোঙানির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠে। তবে সেই শব্দ বৃষ্টির গর্জে উঠা শব্দ আড়াল করে দিয়েছে। পড়ে যাওয়া ফোনের ওপাশ থেকে সৎ মায়ের কান্না ভেজা গলা ভেসে আসে,
“মারে তোর বাপের জানাযা ফজরের সময়। তুই আইবি না বাপরে শেষ দেখা দেখবার?”
মিতালি কোনো জবাব দিতে পারে না। না চাওয়ার এই অপারগতা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে নয়, বরং বাস্তবতার নিষ্ঠুর হাতে বন্দি হয়ে যাওয়ার নীরব স্বীকৃতি। সময়টা সত্যিই তার পক্ষে নয়। কারণ আজ… আজ তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার রাত।

চিত্রা সহজ-সরল এক মেয়ে। অভিমান করে, রাগ করে, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। এইসবই তার ভালোবাসার নিঃশব্দ প্রকাশ। ফারাজ জানে, চিত্রার এমন আচরণের আড়ালে এক গভীর টান লুকিয়ে আছে। ফারাজের দু-হাত বাড়িয়ে এই মানুষটিকে বুকের পাঁজরে আগলে ধরে বলতে ইচ্ছে করে,
❝যে দমবন্ধ রোগে ভুগি আমি,
সেই রোগের একান্ত ঔষধ তুমি!❞

এই মুহূর্তে চিত্রা ঘুমিয়ে আছে ফারাজের বুকের উপর মাথা রেখে। শরীরটা খারাপ। গাড়িতে উঠলেই তার মাথা ধরে, বমি পায়। প্রতি সফরেই এমন হয়। আর ফারাজের বুকের মধ্যে তখন হাহাকার জাগে—ইশ! যদি এই কষ্টটা ভাগ করে নেওয়া যেত! চিত্রার এমন অসহায় অবস্থায় ফারাজ কখনোই চাই না তাকে একা ফেলে গাড়ি চালাতে। যদিও ড্রাইভ করা তার খুবই পছন্দ, আজকে ইচ্ছে ছিল তবে সে ড্রাইভ করে নি। কারণ ব্যাকসিটে একা চিত্রাকে রেখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার মতো শক্তি তার নেই।
আভ্র আর আয়েশা পিছনের গাড়িতে আছে। সামনের গাড়িটা বজ্রের। মাঝখানে তারা দুজন।ফারাজ আর চিত্রা। ফারাজকে জলদি কাজ শেষ করে আসল ঠিকনায় ফিরতে হবে। তাহলে মিথ্যা দুনিয়ায় এত মায়া কুড়িয়ে কি হবে? ভালোবাসা দিয়ে দুঃখ কিনেই বা লাভ কি? ফারাজ চিত্রার কপালে চুমু দেয়। চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলে, “আমাদের মাঝে একটা সুতো আসলেও আমি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিবো। আমার থেকে বেশি গুরুত্ব তুমি যাকেই দিবে আমি তাকেই তোমার থেকে কেড়ে নিবো আগুন সুন্দরী।”

ব্যাকসিটে বসে আছে আয়েশা। জানালা দিয়ে হা করে ঢাকাশহর দেখছে। অভ্র গাল ফুলিয়ে সামনের সিটে বসে আছে। মেজাজ তার টুঙ্গে। ঢাকায় কত জরুরী কাজে তারা এসেছে সেটা কেবল সে জানে। মাঝ দিয়ে এই গুওয়ালী মাতারিকে আনার দরকার কি? ঢাকার মেনশনে কি মেইডের অভাব? আয়েশা জানে না গাড়ির ডোর গ্লাস কি করে নামাতে হয়। সে অনেক কষ্টে এদিক ওদিক চেপে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মাথা বাহিরে থেকে বের করে। অভ্র পেছনে ঘুরে এহেন দৃশ্য দেখে চোটে যায়। এই মেয়ের মানসিক অবস্থা এত খারাপ কেন? যদিও ভালো হওয়ারও সুযোগ কই? গুষ্টিই মনে হয় পাগলের। দাদি একটা ইংলিশ বুড়ি, আর নাতনির গু তো মাথায় উঠে গেছে।
“এই চাকরানি তুই গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কল্লা বাহিরে বের করেছিস কেন?”
” কিডনি চাইছে তাই বের করছি। ঠ্যাংও বের করবো দরকার হলে। ইউর সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা? ওই জিনিস আমার কোথাও নেই। ওইটা তোর মাথায় । আর তোর দাদির মতো বালের ইংরেজি মারাবি না। মাথা গরম হয়।”

” আমি ইংরেজি শিখতাছি। আপাতত একটু একটু শিখছি। এখনো চর্চা করতাছি। পুরোটা যেদিন শিখবো না রে সরকার সেদিন আমার ইংরেজি শুনে তোর পাছার রগ অব্ধি কেঁপে উঠবে।
“দেখ মেয়ে পাছার কথা বলবি না। ওইটা কি দুনিয়ায় আমার একাই আছে? তোর নাই? আমি বলা শুরু করলে কিন্তু ভ্যাড়ার মতো কেঁদে দিবি। আর ওইটা আমার বউয়ের ব্যক্তিগত সম্পদ সো ডোন্ট কল ইট অ্যা পাছা কল ইট মাই ফিউচার ওয়াইফস পার্সোনাল প্রোপার্টি। ওকে?”
“দূরে গিয়ে মর। আইসে আমার সম্পত্তি ওয়ালা মিসকিন।”

“দেখ ছোটোলোক বেশি কথা বলছিস কিন্তু তুই। আর তুই-তুকারি করা বাদ দে। আমি মালিক আর তুই চাকরানি। মালিককে সম্মান দিতে পারে না আবার আসছে তর্ক করতে। শালী ডাব চুন্নী!”
“ভালো হইছে। তুমি শালা আমার মাথা না খাইয়া আমারে থুক্কু হারপিক খা।” আশেয়া আবারো মাথা বের করল।
“গাড়ি এসে বারি মেরে মাথাটা আলাদা করবে তখন বিষয়টা কিন্তু জোস হবে। না দে শালী, মাথাটা আরেকটু বেশি করে বাহিরে বের করে দে। আপদ বিদায় হবে অনন্ত।”
আয়েশা মাথা গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে জানালা লাগানোর চেষ্টা করল। তবে পারল না। এদিকে সেদিকে চাপাচাপি করেও লাভ হচ্ছে না। অভ্র সাইড-মিররে আয়েশার এই নড়াচড়া লক্ষ করছিল অনেকক্ষণ ধরে। শেষে বিরক্তি আর চাপিয়ে রাখে না। হঠাৎ করেই সিট ঘুরিয়ে পেছনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে সে।

“দে, তোকে কনট্রোল বাটন খুঁজতে হবে না।” বলেই হাত বাড়িয়ে দেয়।
হঠাৎই তাদের দুজনের কাঁধ একসাথে ঠেকে যায়। অভ্রর মুখটা আয়েশার মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। তার নিঃশ্বাস আয়েশার কানের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। মুহূর্তটা থমকে দাঁড়ায়। বাহিরের বাতাসে আয়েশার এলোমেলো রুক্ষ কেশগুলো উড়ছে। শ্যামবর্নের আয়েশার নরম ঠোঁটজোড়া কারন ছাড়াই কাঁপছে। অভ্র আয়েশার ঠোঁটের দিকে একবার তাকায়। দ্রুতই নিজেকে সামলে নিচু গলায় বলে,
“এইভাবে হাত-পা ছুঁড়ে কিছু হবে না। গাড়ির গ্লাস তো গ্রামে ওঠানামা করা গরুর দড়ি না। বাটন চাপতে হয়।” সে নিজের দিক থেকে বাটন চাপল। এক ক্লিকেই গ্লাস উঠে উপরে উঠে গেল।
অভ্র আর কিছু বলল না। নিরবতা তার ঠোঁটে তালা বসিয়ে দিল যেন। আয়েশাও আর কোনো উত্তর দেয়নি। শব্দহীন একটা সমঝোতা তাদের মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ল। গাড়ি চলছে, কিশোরগঞ্জের সীমানা পেরিয়ে প্রবল ব্যস্ততায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু আয়েশার মন আটকে আছে কিছুক্ষণ আগের সেই মুহূর্তে। যখন অভ্র হঠাৎ কাছে এসে পড়েছিল। স্পর্শ হয়নি, অথচ যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেই ঘন নিঃশ্বাস, চোখের ফাঁকে চোখ পড়ার এক সেকেন্ড… কেন যেন তার ভিতরটা তখন থেকেই অস্থির হয়ে আছে।

সে জানে না কেন ভাবছে বিষয়টা নিয়ে। ভাবনার দরকার ছিল না। অভ্র তো বিরক্ত, উদ্ধত, অহংকারী। তবু বুকের ভেতর একটা অনিয়মিত ঢেউ উঠছেই। টেউয়ের ওঠা-নামা, আবার ওঠা…। নিজেকে বারবার বোঝাতে চেয়েছে ‘ভুল ছিল, তাৎক্ষণিক কিছু ছিল, গুরুত্বহীন।’ কিন্তু হৃদয় কি কখনো যুক্তির কাছে মাথা নত করে? তার বুকের এই ওঠা-নামা কি কেবল তার একার? নাকি অভ্রর দিকেও কিছু একটা বয়ে যাচ্ছে? কোনো অস্বস্তি? কোনো চাপা আকর্ষণ?
জানার উপায় নেই। অভ্র জানালা গড়িয়ে মুখ ফেরিয়ে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু কখনো কখনো, আয়েশা দেখতে পায় সামনের আয়নায় অভ্রর চোখ এক পলকের জন্য হলেও তার দিকেই ফিরছে। সত্যি কি তাই? নাকি কেবলই তার কল্পনা?

বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে সোহাগ। মারিয়ার শরীর খারাপ। তাই দরজা খুলেছে জান্নাত। ভেজা শরীর দিয়ে দরজার সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে সোহাগ।
“আয় খোদা নেশা করছেন আপনি? এই কি অবস্থা?”
সোহাগ চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে দেখছে। জান্নাতকে দেখে সে খানিক্ষন তাকিয়ে থেকে হুট করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। জান্নাত নিজের তাল সামনে বলে উঠে,
“কি হইলো? নেশা করছেন?
” উঁহু বিশ্বাস করো। আমি একটু নেশা করে নাই।” বলেই সোহাগ হাসে।
জান্নাত তাকে ধরে রুমে যায়। রুমে নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দেয়।
“কেন এসব খাইছেন? এসব খারাপ মানুষ খায়। আপনি কি খারাপ?”
“আমারে তোমার ভালো মনে হয়? জগতে আমার থেইকা খারাপ মানুষ একটাও নাই।”
“চুপ করেন। আহারে পেটটা পইরা আছে। আমি খাওন আনতাছি। আব্বার কি অবস্থা?”
“ভালো।”

জান্নাত যেতে নিলে সোহাগ তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয়। সোহাগ তার হাত শক্ত করে ধরল। টেনে নিয়ে এসে নিজের কাছাকাছি আঁকড়ে ধরল। সোহাগ জান্নাতের উদরে মাথা রাখতেই জান্নাতের শরীর খানিকটা কেঁপে উঠল। সোহাগ কি তাকে স্পর্শ করেছে? নাকি তার অনুভূতি কল্পনার কোনো ফলস্বরূপ? জান্নাত সোহাগের চুলে হাত বুলিয়ে ঘাড়ের কাছের চুল গুলো মুঠোয় পুরে নেয়।
বাহিরে বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করছে। সেই বৃষ্টির মাঝে সোহাগের স্পর্শ এক অবাধ্য ছোঁয়ার মতো জান্নাতের শরীরে পৌঁছাচ্ছে। উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেই স্পর্শ! যা কোনো নির্দিষ্ট সীমা বা অনুশাসন মেনে চলে না। কিছুটা অবাধ্য খানিকটা আবার বেপরোয়া।

ইতালির নাপলস শহরের অন্ধকার গলিতে রাজকীয় বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির বাইরের দেয়ালগুলো কালো পাথরের মতো মসৃণ। গ্রানাইট পাথরের বাড়ি। বাড়িটি শহরের একেবারে কেন্দ্রে নয় বরং শহরের পাশের এক নির্জন এলাকায়, শহরের সীমানার অদূরে অবস্থিত। যেখানে রাতে অন্ধকার এবং সিকি লাল আলোই একমাত্র পথপ্রদর্শক। বাড়ির পেছনে একটি অবহেলিত বাগান রয়েছে। যেখানে গাছপালার অপ্রকৃতিগত বৃদ্ধি এবং ভাঙাচোরা পাথরের পথ দিয়ে তৈরি একটা রাস্তা আছে।এখানকার বাগানটি একরকম পার্কিং এরিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্যারেজও আছে। যেখানে উচ্চমানের গাড়ি রাখা থাকে। কিন্তু গ্যারেজের দরজা প্রায় সব সময় বন্ধ থাকে। বাড়ির সামনে একটা পুল আছে। পুলটি মার্কেল পাথর দ্বারা খোদাই করা। রোজ ফ্রান্সিসকা পুলের সামনে বসে ওয়াইন পান করছে। রক্তের মতো লাল দেখতে তার রং। পাশে চারজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটু গেড়ে বসে থাকা একটা লোককে শক্ত করে ধরে আছে দু’জন। রোজ ফোনটা হাতে তুলে একটা কল করে,
“কবে দেশে ফিরবে? তোমাকে ছাড়া আমার সময় যায় না। জলদি ফিরে এসো। না ফিরলে নিজের কাছে আমাকে নিয়ে যাও।”
ওপাশের ব্যক্তির কথায় রোজের মন খারাপ হয়ে যায়। সে কলটা রেখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,

“মুডটা ভালো নেই। মুডটা ভালো থাকলে তোমাকে আরো সুন্দর মৃ*ত্যু উপহার দিতাম।”
রোজ উঠে দাঁড়াতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ধারালো চাপাতি তুলে দেয় তার হাতে। মেয়েটি চাপাতি হাতে এগিয়ে যায় লোকটির দিকে। একটা লোককে ইশারা করতেই মুখ থেকে টেপ খুলে দেওয়া হয়। মুহুর্তেই লোকটা বলে উঠল,
“ঈশ্বরের নামে জীবন ভিক্ষা দাও।”
তাতে কাজ হয় না। সুন্দরী মেয়েটা এগিয়ে আসে লোকটার দিকে। গলায় ধারালো চাপাতি বলে,
“মৃ*ত্যুর আগে ঈশ্বরকে স্মরণ করা ভালো। করে নাও।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩২

কথাটা বলতে না বলতেই চাপাতির এক টানে লোকটির মাথা ঝুলে যায়। গলার রগ অব্ধি বেরিয়ে আসে। আঠালো র*ক্ত ছিটকে এসে মেয়েটির পুরো শরীর মুখ লাল হয়ে যায়। মেয়েটির মুখেও খানিকটা র*ক্ত চলে গিয়েছে। রোজ হাসে। হাসতে হাসতে আদেশ করে,
“ওকে পুলে ফেলে দাও। র*ক্তাক্ত পানিতে গা না ভিজালে কেনো জানি নিজেকে অপবিত্র লাগে।” রোজ আবারো হাসে। সেই হাসি ভয়ানক সুন্দর ঠিক তারই মতো দেখতে।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৪