আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৫
তানহা ইসলাম বৈশাখী
ভালোবাসায় মোড়ানো এক শুদ্ধতম সকাল। আকাশও বুঝি আজ ভালোবাসাময় দিনটির সাক্ষী দিচ্ছে। রাতভর বৃষ্টির পর সকালে শরৎের আকাশটা মেঘ মুক্ত সচ্ছ এক নীল আকাশে পরিনত হয়েছে। রাতে ভিজে যাওয়া মাটির সুবাস এখনো সুরভিত করছে চারিপাশ।
সকালে সূর্য উঠে গেছে অনেকক্ষণ। টিকটিক করা দেওয়াল ঘড়িটায় সময় এখন ৮:৪৫ মিনিট। প্রার্থ তখন পিটপিট করে চোখ খুলছে। ভালোভাবে ঘুম কেটে গেলো কিছুক্ষনের মধ্যে। সামনে তাকিয়ে দেখে পুষ্প তার বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। প্রার্থ দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে আছে তাকে।
পুষ্পর মুখে কান্নার জরিপে বয়ে যাওয়া জলের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। বুজে রাখা চোখ দেখেই ঠাওর করা যাচ্ছে চোখ ফুলে গেছে। নাকটা এখনো লাল টকটকে হয়ে আছে। সাদা ব্যান্ডেজটাও এখনো কপালেই আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে, মুখে আছড়ে পরেছে। সবকিছুর মিল মিশেলে দারুন লাগছে তাকে দেখতে।
সকাল সকাল এরকম স্নিগ্ধ মুখটা দেখে প্রার্থর ভেতরটা জুরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর ঠোঁট বাড়িয়ে ছুয়ে দেয় শুভ্র ব্যান্ডেজে ঢাকা কপালটা।
প্রার্থ কি কখনো ভেবেছিলো এই মেয়েটাকে সে এতটা ভালোবাসবে? সে কি ভেবেছিলো পুষ্প ছাড়া প্রার্থর পৃথিবী অন্ধকার হবে কখনো। সে তো চেয়েছিলো পুষ্পর জীবন অন্ধকারে ভরিয়ে দিবে অথচ সেই মেয়ে তাকেই ঘোল খাইয়ে দিলো। যাক দিয়েছে ভালোই হয়েছে তা না হলে যে এত সুন্দর অনুভুতিগুলো মিস করে যেত।
মনে মনে এসব ভেবে নিজে নিজেই হাসে প্রার্থ। আবারও ঠোঁট বাড়ায় চুমু খেতে। এবার সেটা বসায় পুষ্পর গোলাপি রঙে রাঙানো পাতলা অধরভাজে।
দু চোখের পাতাতেও দুটো চুমু খায়। রাত কয়টা পর্যন্ত যে কেঁদেছে মেয়েটা সে নিজেও জানে না। বাঁধাও দেয়নি তাকে। পুষ্প কেঁদেছে প্রার্থ হেসেছে। দারুন মজা লেগেছে তার। এরকম ভালোবাসা দেখলেও তো সুখ। তাই প্রার্থ থামায়নি তাকে। প্রার্থর বুকে তাকে পাওয়ার খুশিতেই তো কাঁদবে। এটাতে বাধা দেওয়া যায়?
সকালে মনের আশ মিটিয়ে তাকে দেখে নিলো। এখন থেকে রোজ রোজ পুষ্পর এমন পুষ্পরঞ্জিত মুখখানা দেখতে পাবে এটা ভেবেই মন উতলা হচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রার্থর এক হাত রাখা পুষ্পর মাথার নিচে অন্য হাত তার পিঠের নিচে। মোটকথা বুকের সাথে জাপটে ধরে আছে তাকে। পুষ্পও মুখটা একেবারে তার বুকে ঠেকিয়ে রেখেছে। এখানে ঢুকে যেতে পারলে বোধহয় ভালো হতো।
প্রার্থ একহাত এনে রাখলো পুষ্পর মসৃণ গালে। আলগোছে ডাকলো তাকে।
“-ফুল! ঘুম হয়েছে? ওয়েক আপ মাই ফ্লাউয়ার।
পুষ্প ঘুমের মাঝেই নড়ে উঠলো। আরো গভীরভাবে ধরে রাখলো তাকে। প্রার্থর ডাকতে ইচ্ছে করছে না পুষ্পকে। তবুও ডাকতে হবে।
সে আবারও একইভাবে নরম স্বরে ডাকলো।
“-ফুল! এই ফুল।
দুই ডাকেই বান্দা উঠে গেছে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। প্রার্থ বললো।
“-গুড মর্নিং মাই ফ্লাওয়ার।
পুষ্প প্রার্থর দিকে তাকালো। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সাথে সাথে। আজ প্রথমবার মনেহয় প্রার্থকে দেখে তার এত লজ্জা লাগছে। প্রার্থর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। লজ্জায় আবার মুখ গুজলো তার বুকে।
আচানক ছিটকে সরে এলো সেখান থেকে। মাত্রই মুখ গুজেছিলো প্রার্থর বুকে কিন্তু হঠাৎই ঝটকা দিয়ে দূরে সরে এলো।
চোখে লজ্জা নেই। সেখানে কেমন ভয়।
প্রার্থর ভ্রু কুচকে গেলো। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো।
“-কি হয়েছে?
পুষ্প সন্দেহ নিয়ে বললো।
“- আপনি কে?
প্রার্থ ধরফরিয়ে উঠে বসলো।
“- আমি কে মানে?
“-আপনি কে মানে আপনি কে?
প্রার্থ আবারও সরু দৃষ্টিতে তাকালো। বললো।
“-আমি তোর হাসবেন্ড। আর কোন পরিচয় লাগবে?
“-আপনি প্রার্থ ভাই নন। প্রার্থ ভাই আমার সাথে এভাবে কথা বলে না। বলতে পারে না। আপনি কে বলেন?
প্রার্থ আর অবাক হলো না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। প্রার্থর ভালোমানুষি হজম হচ্ছে না পুষ্পর। সে গা ছাড়া ভাবে বললো।
“-আমাকে প্রার্থ না মনে হওয়ার কারণ?
“-বললাম তো প্রার্থ ভাই এভাবে কথা বলে না। সে তো ওত পেতে থাকে কখন আমাকে অপমান করবে, কখন আমাকে তুলে আছার মারতে পারবে সে নিয়ে। সে কখনোই ভালোবাসার কথা বলবে না।
প্রার্থ উঠে দাঁড়ালো। টিশার্ট ঠিক করে চপল পায়ে এসে দাঁড়ালো পুষ্পর পাশে। সে বিছানায় বসে আছে। প্রার্থ বিছানায় দু-হাত রেখে ঝুকে পরলো তার উপর।দুটি মৃগ নয়নের সন্ধি ঘটিয়ে বলে উঠলো।
“-আচ্ছা আমি প্রার্থ নই। তো সেটা এখন কি করে বুঝলি? রাতে কেন বুঝলি না? রাতে তো চুমু খাচ্ছিলি কাঁদছিলি বুকের মাঝে ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলি। তখন মনে হলো না আমি প্রার্থ নই? ছিঃ! ফুল। পর পুরুষের সাথে কাটালি সারারাত? আমার কথা একবারও ভাবলি না।
প্রার্থর কন্ঠে নাটকীয়তা। পুষ্প নাক মুখ কুচকে বললো।
“- চুমু আমি খাইনি আপনি খেয়েছেন। আর তখন আবেগে কেঁদে ফেলেছি এখন উপলব্ধি করছি আপনার দ্বারা ভালোবাসা সম্ভব না।
“-চুমু তুই খাস বা আমি বিষয়টা একই। হোয়েদার আই কিসড ইউ অর ইউ কিসড মি, আওয়ার লিপস স্টিল এনডেড আপ টুগেদার, রাইট?
পুষ্প লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সুন্দর গালদুটো ব্লাশ করলো লজ্জায়। পেছনে হেলে গেলো খানিকটা। মাথা তুলে কোনমতে বললো।
“-এএরকম কথাও প্রার্থ ভাই বলে না।
প্রার্থ আরেকটু ঝুঁকে পরলো। নেশাতুর কন্ঠে বললো।
“-তোর প্রার্থ কি কি বলতে পারে তা এখনো তুই জানিস না। আস্তে আস্তে জেনে যাবি।
প্রার্থ উঠে দাড়ালো। ফ্রেশ হতে যাওয়ার জন্য ঘুরে পা বাড়াতেই পুষ্প পিছু ডাকলো।
“-শুনুন!
প্রার্থ দাঁড়ায়। পেছনে ঘুরে বলে
“-হুম শুনছি।
পুষ্প পাশের জায়গা দেখিয়ে বললো।
“-বসুন এখানে।
প্রার্থ বসলো। পুষ্প রয়েসয়ে বলতে শুরু করলো।
“-আপনার হঠাৎ কি হয়েছে সত্যিই করে বলবেন? আমার কেন আপনাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখুন আমার মন নিয়ে খেলবেন না। অনেক কষ্টে মনটাকে শক্ত করেছিলাম। আপনি সেটা আবার নরম করে দিচ্ছেন। এভাবে নরম করে একেবারে ভাঙবেন না দয়া করে। আপনার কি চাই বলুন? ডিভোর্স চাই নাকি দেহ চাই?
প্রার্থ হুট করে উঠে দাঁড়ায়। পুষ্পর কোমড় টেনে তাকে দাঁড় করায় সামনা সামনি। নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে।
“-থাপ্পড় দিয়ে গালের সবগুলো দাত ফেলে দেবো আর একবার যদি এই দুটোর কথা উচ্চারন করিস। তোর দেহ চাইলে এখন কেন প্রথম রাতেই পেয়ে যেতাম। তবুও তোর যদি এতই সন্দেহ জাগে তবে তোকে ছুবোনা। তুই না বলা অবদি তোকে গভীরভাবে কখনোই ছুবো না। আর রইলো ডিভোর্স? সেটার কথা ভুলে যা। এই জনমে তোর আমার থেকে মুক্তি পাওয়া হবে না। ইহকালেও তুই আমার পরকালেও তুই শুধু আমারই থাকবি।
পুষ্পর চোখ জলে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। সে নাক টেনে বললো।
“-এতদিন তো খুব ঘৃণা ছিলো এখন হঠাৎ প্রেম হয়ে গেলো শুনলে কে বিশ্বাস করবে শুনি?
প্রার্থর রাগ কমে এলো। একহাত তুলে পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কন্ঠ যথাসম্ভব মোলায়েম রেখে বলল
“-তুইই তো বলতি ঘৃণা থেকেও প্রেম জন্মায়। প্রথম দেখাতেও ভালোবাসা হয়। ভালোবাসার কোন কারন লাগে না। এগুলো তো তুইই বলতি। ভুলে গেলি? আমাদের মাঝের লড়াইয়ে তোর জিত হয়েছে তাহলে জিত মেনে নিতে পারছিস না কেন?
পুষ্প অশ্রুমাখা চোখে তাকিয়ে আটকে আসা গলায় বললো।
“-এত তাড়াতাড়ি জিতে যাবো ভাবিবি তো। এজন্য বোধহয় মানতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে ভালোবাসতে পারেন এটা আমার কাছে অভাবনীয় বিষয়।
প্রার্থ পুষ্পর কপোল বেয়ে পরা একফোঁটা জল আঙুল দিয়ে মুছে বললো।
“-শোন ফুল, এই শেষবার বলছি ,ভালোবাসি তোকে। ভালোবাসি আমার সেই ফুলকে যেই ফুলের প্রতিটি নিশ্বাসে আমার বসবাস, যেই ফুলের সমস্তকিছুতে শুধু আমারই অধিকার!
এই লাস্টবার বললাম এরপর আর কখনো বলবো না ভালোবাসি। ভালোবাসা বেশি প্রকাশ করতে নেই বুঝেছিস?
পুষ্প ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলো। প্রার্থ তার কপালে দীর্ঘ চুম্বন একে দেয়। পুষ্পর মাথা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো।
বেলা বাজে নয়টার উপরে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি লাট সাহেবের ব্যাটা অর্নব। তার মা এসে দুবার দরজা ধাক্কিয়ে গেছে তবুও উঠাতে পারেনি তাকে। অর্নবের মা অন্তরা বেগম আবার এসে দরজা ধাক্কিয়ে ডাকলেন ছেলেকে।
“-এ্যাই অর্নব। দরজা খোল। ওঠ বাবা কখন থেকে ডাকছি। তোকে দিয়ে দরকার আছে তো আমার। অর্নব।
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আসলো ছেলেটার। এমনিতেই রাতে সে ঘুমাতে পারেনা। কিছুতেই ঘুম হয়না তার উপর সকালেও একটু শান্তিতে ঘুমানো যায় না। অসহায় ছেলেটা শেষমেশ মায়ের এত ডাকে উঠেই পরলো। এলোএলো অবস্থায় চপল পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।
অন্তরা বেগম ছেলেকে ঘুমে টলতে দেখে বললেন।
“-রাতে ঘুম হয়নি?
অর্নব দুপাশে মাথা নাড়লে তিনি আবার বলেন।
“-এজন্যই বলি বিয়ে কর। বিয়ে করলে সব ঠিক হবে।
বিরক্তিতে মুখটা তেতো হয়ে গেলো তার। মুখে চ সূচক শব্দ করে বললো।
“-আম্মু বিয়েই কি সবকিছুর সলিউশন? সারাক্ষণ বিয়ে বিয়ে কেন করো বলোতো? যখন আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তখন বললে আমার বিয়ের বয়স হয়নি এখন কেন এত জোর করছো?
“-তো তখন তোর বয়স কত ছিলো? এখন তুই বিয়ের যোগ্য এখন বিয়ে করলে সমস্যা কি ? যা ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে আয়৷ তোর বাবা কথা বলবে তোর সাথে।
অর্নব ” আসছি” বলে মুখটা বাংলার পাচের মতো করে বাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো। বিয়ে বিয়ে প্যারা আর ভাল্লাগে না তার। শান্তিতে ব্যাচেলার লাইফ কাটাচ্ছিলো তাও কাটাতে দিচ্ছে না কেউ।
কিছুক্ষণ পর সে ফ্রেশ হয়ে উপস্থিত হয় বাবার সামনে। খাবার টেবিলে বসে আছেন আনোয়ার সাহেব।
অর্নব চেয়ার টেনে বসে বললো।
“-কি হয়েছে আব্বু? ডেকেছিলে কেন?
ভদ্রলোক বললেন।
“-বয়স তো কম হলো না। বিয়ে শাদি কি করবে না?
“-এখন আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই আব্বু।
অন্তরা বেগম প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন।
“-এখন করবি না তো কখন করবি? বয়স হচ্ছে না আমাদের? ছেলের বউ, নাতি নাতনি কি দেখবো না? তোর সব বন্ধুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কার্তিক সেদিন বিয়ে করলো। প্রার্থর মা শা আল্লাহ কি সুন্দর বউ। হৃদয়ের হবু বউটাও কি সুন্দর। এখন বাকি শুধু তুই আর রকি। তোরা কি বিয়েই করবি না বলে পন করেছিস?
অর্নব বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে বললো।
“- আহ আম্মু! সবসময় বিয়ে নিয়ে কেন পরে থাকো? বিয়ে করলে কি সব ঠিক হবে? সব ঠিক হওয়ার কি আছে সব তো ঠিকই আছে। আমার লাইফ আনার মতোই চলছে। বিয়ে করার কোন প্রয়োজন আছে ?
অর্নবের বাবা বললেন।
“-অবশ্যই আছে। তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমার পরেও তো এই পরিবারের কোন উত্তরাধিকার লাগবে। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।
অর্নব হাল ছেড়ে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
“-ঠিকাছে যা ইচ্ছে করো। তোমাদের যাকে পছন্দ হয় তাঁকেই গলায় ঝুলিয়ে দাও।
অন্তরা বেগম বললেন।
“-গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া আবার কি কথা? বিয়ে হলে বউয়ের দায়িত্ব নিবে না?
“-বললাম তো যা ইচ্ছে করো।এ নিয়ে আর প্রশ্ন করো না তো। যেদিন বিয়ে সেদিন জানিয়ে দিয়ো গিয়ে বিয়ে করে চলে আসবো। চলবে?
সে রাগ করে উঠেই চলে গেলো। খাবারে হাতও দিলো না। তার মা তাকে কত ডাকলো তাও কাজ হলো না। বাইকের চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি ছেড়ে।
সকালের খাবার খাওয়া শেষ সকলের। প্রিয়া একেবারে কলেজ ড্রেস পরেই বেড়িয়েছে। খাবার খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। কলেজে যাবে এখন। অন্তও বেরিয়েছে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
প্রার্থ সোফায় বসে ফোন দেখছিলো। কিছু জরুরী কাজ আছে তার।
প্রিয়াকে ডেকে বললো।
“-একা যাস না অন্তর সাথে যা। বাড়িতে এখন গাড়ি নেই। ও ভার্সিটি যাওয়ার পথে দিয়ে যাবে তোকে।
প্রিয়া মুখ গোমড়া করে বললো।
“-লাগবে না ভাই। আমি একাই যেতে পারবো। রাস্তায় অনেক রিক্সা আছে।
প্রার্থ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে রাখলো প্রিয়ার উপর। গম্ভীরমুখে বললো।
“- একা যেতে বারন করেছি আমি। অন্ত পৌঁছে দিবে।
এরপর অন্তত দিকে তাকিয়ে বললো।
“-ওকে ঠিকঠাক নামিয়ে দিয়ে তুই ভার্সিটি যাবি। টাকা আছে কাছে? নিয়ে যা আমার থেকে।
অন্ত প্রিয়ার হাত ধরে বললো।
“-লাগবে না ভাই আছে আমার কাছে।
প্রিয়াকে চল বলেই টানতে টানতে নিয়ে গেলো। পুষ্প তখনই এলো ড্রয়িংরুমে। পেছন থেকে ওদের সাবধান করে বললো।
“-সাবধানে যাস দুজন।
ততক্ষণে দুজন সদর দরজা পেরিয়ে গেছে। প্রার্থ ফোন রেখে ডাকলো পুষ্পকে।
“-এদিকে আয়।
পুষ্প ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার কাছে। সকাল থেকেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে সে। প্রার্থর কাছাকাছি ঘেষতে পারছে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। হুট করেই যেন সব লজ্জা ঘিরে ধরেছে তাকে। এতদিন তো এত লজ্জা লাগেনি। এখন কেন এমন লাগছে!
সে গিয়ে প্রার্থর সামনে দাঁড়ালো। প্রার্থ তার পাশের জায়গা দেখিয়ে বসতে বললে পুষ্প গিয়ে বসলো তার পাশে। প্রার্থ তৎক্ষনাৎ মাথা ঠেকিয়ে দিলো পুষ্পর কাধে। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো কোমড়। চোখ বন্ধ করে পরে রইলো। পুষ্প চোখদুটো বড় বড় করে ফেললো। আশেপাশে সতর্ক নজরে দেখলো কেউ আছে কিনা। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে প্রার্থর এমন ব্যাবহারে।
কথারা গলায় আটকে আসছে। তবুও মেরুদণ্ড সোজা করে রয়েসয়ে বললো।
“-আপনি স্টুডিওতে যাবেন না?
প্রার্থ অলস ভঙ্গিতে বললো।
“-হু।
“-কখন? দেরি হচ্ছে না?
“-উহুম।
পুষ্প চুপ হয়ে গেলো। কি বলবে মাথায় আসছে না। গলা শুকিয়ে আসছে। রোবটের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। প্রার্থ একই ভঙ্গিতে বলে উঠলো।
“-তোকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। কি জাদু করলি বলতো?
পুষ্প বিষম খায়। শুকনো ঢোক গিলে কোনরকমে বলতে যায়।
“-আমি আবার কি করলাম?
তখনই তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় প্রান্ত। ছোট ছোট চোখদুটো ইয়া বড় বড় করে অবাক হয়ে বলে।
“-এই তোমরা দুজন মিলে গেছো?
প্রার্থ চোখ খোলে তবে উঠে না। একই ভাবে থেকে বলে।
“-তুই এখানে কেন? স্কুলে যাস নি?
প্রান্ত হাসিখুশি মুখে বললো।
“-আগে বলো তোমরা মিলে গেছো? প্রার্থ ভাই তুমি ফুল আপুকে আর কষ্ট দিবে না?
প্রার্থ সরু চোখে তাকিয়ে বলে।
“-তোর কিসের ফুল? ফুল আমার। আমি ওকে ফুল বলে ডাকবো। তুই ডাকবি না।
প্রান্ত এটিটিউট নিয়ে বলে।
“-হুহ! কালও তো পুষ্প পুষ্প করছিলে। আজ কেন ফুল আপু তোমার হবে? ফুল আপু আমার আগে থেকেই।
“-দুরে যা। ফুল আমার।
পুষ্প পড়লো মহা বিপদে। দুই ভাই মিলে কি এখন ঝগড়া করবে নাম নিয়ে! ছোট বাচ্চার সামনেও কেমন নির্লজ্জ কথা বার্তা বলছে। সে প্রার্থকে আস্তে করে বললো।
“-কি করছেন? ছাড়ুন। প্রান্তর সামনে এগুলো কি বলছেন? বাচ্চা না ও?
প্রার্থ মুখ তুলে পুষ্পর দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো।
“-তো? আমার বউ আমি যা ইচ্ছে করবো।
“-আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি আপনার লজ্জা শরম সব ধুয়ে খেয়ে ফেলেছেন।
“-খেলে খেলাম। বউয়ের সামনে কিসের লজ্জা?
“-আপনি সত্যিই নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন। ছাড়ুন এবার।
প্রার্থ ছাড়লো না। প্রান্ত সামনে এসে পুষ্পর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো।
“-প্রার্থ ভাই কি সত্যিই ভালো হয়ে গেছে ফুল আপু।
ছোট ছোট কথাগুলোও প্রার্থ শুনে ফেললো। ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
“-আমি খারাপ ছিলাম কবে?
“-এতদিন তো ছিলে। শুধু শুধু আপুকে কষ্ট দিতে।
“-ওটা ভুলে হয়ে গেছে। এবার থেকে আর কষ্ট দিবো না দেখিস। এখন যা এখান থেকে। একটু প্রেম করতে দে।
প্রান্ত যেতে যেতে বললো।
“-হ্যা হ্যা করো প্রেম। আমি বিয়ে করলে আমিও তোমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করবো।
প্রার্থ পুষ্প দুজনেই অবাক হয়। প্রার্থ বলে।
“-দেখেছিস কি বেয়াদব হয়ে গেছে। এইটুকু বয়সে কিসব কথা বলে।
পুষ্প নিজেকে প্রার্থর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
“- সব আপনার জন্য হয়েছে। কি দরকার ছিলো বাচ্চাটার সামনে এমন নির্লজ্জ মার্কা কথা বলার?
প্রার্থ আয়েস করে বসলো। চোখ টিপে দুষ্টু হেসে বললো।
“-প্রেমে পড়লে মানুষ নির্লজ্জ হয়। ওটা ব্যাপার না।
সকালের তেজী সূর্য মাথায় করে দুজন মানুষ হেটে যাচ্ছে। দুজনের পায়ের গতি সমান নয়। প্রিয়া হনহনিয়ে সামনে হেটে যাচ্ছে। অন্ত তার পিছু পিছু হাটছে। রাস্তায় গাড়ি নেই বলে আর দাঁড়িয়ে থাকেনি। প্রিয়া দেমাগ দেখিয়ে একা একাই হাটা ধরেছে। অন্তও তার পিছনে ছুটছে। প্রিয়ার হাটার গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে রাগে হনহন করে হেটে যাচ্ছে। অন্ত দুপাশে মাথা নেড়ে ডাকলো তাকে।
“-প্রিয়া! প্রিয়া দাঁড়া। আস্তে হাট।
সে কি আর বারন শোনার মানুষ? সে তার মতো হেটে যাচ্ছে।
অন্ত পেছন থেকে দৌড়ে এসে তার ব্যাগ টেনে ধরলো। প্রিয়া পেছন ঘুরে দিলো এক ঝারি।
“-কি হয়েছে? এমন করছো কেন?
অন্ত উল্টো প্রশ্ন করলো।
“-তুই এমন করছিস কেন? এত রাগ আমার উপর? তোর কি ক্ষতি করেছি? ভালোবাসাই তো চেয়েছি।
প্রিয়া দাঁত চেপে ধরলো। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করলো। পরপর বলে উঠলো।
“-একটা কথা বলো, আমি তো এমন কিছুই করিনি যাতে তুমি আমার উপর মন দিতে পারো। সবসময় তো ঝগড়া করি আমরা। তোমার সব জিনিস কেঁড়ে নেই। তাহলে আমার মতো মেয়েকে কি করে মন দিয়ে বসলে?
অন্ত বিবস মনে বললো।
“-তোর আমার সাথে ঝগড়া করা, আমার উপর অধিকার খাটানো, আমার সবকিছু কেঁড়ে নেওয়ায়ই আমাকে ডুবিয়েছে। সবকিছু কেঁড়ে নেওয়ার সাথে মনটাও কেঁড়ে নিলি। মনের উপর কি আমাদের বস থাকে? তোর মনও একদিন আমাতে মজবে দেখে নিস। তুই শুধু আমার হবি।
“-কখনোই না।
প্রিয়া মুখ ঝামটে কথাটা বলে আবার হাটা ধরলো। অন্ত পেছন থেকে আবারও টেনে ধরলো তার ব্যাগ। এবার কন্ঠে খানিক গম্ভীরতা আনলো। চোখ মুখ গম্ভীর করে বললো।
“-চুপচাপ দাঁড়া।
সামনে থেকে একটা রিক্সা ডাকলো। রিক্সাটা তাদের সামনে আসতেই প্রিয়াকে উঠালো তাতে। নিজেও উঠে বসলো তার পাশে। রিক্সার সিট ছোট হওয়ায় দুজনের শরীর মিশে গেলো। প্রিয়া ইতস্ত বোধ করলো। নড়েচড় একেবারে কোনায় ঘেঁষে বসলো। অন্ত একহাতে প্রিয়ার কাঁধ জরিয়ে ধরে টেনে এদিকে নিয়ে এলো। সামনে রাস্তায় তাকিয়ে বললো।
“-এত ফর্মালিটি পালন করতে হবে না। শেষে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পরবি। বাড়িতে মারামারি করার সময় আমার উপরে উঠেই আমাকে মারতি। তখন অনেক টাচ লাগতো। এখন এটুকু ছোয়া লাগলে মরে যাবি না।
প্রিয়া কি যে লজ্জা পেলো! এরকম লজ্জা কখনো পেয়েছে কিনা সন্দেহ। আগের কথা আর এখনকার কথা কি এক? আগে মারামারির সময় কি এত কিছু খেয়াল করতো। অন্তকে মারতে পারলেই হতো শুধু। এখন কি আর তা করা যাবে? এখন তো সম্পর্কের মাঝে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরী হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে সম্পর্কের ভিত।অন্তর মনের খবর সে জানে। এখন কি আর আগের মতো ব্যাবহার সাজে?
প্রিয়া কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। অন্তর গম্ভীর মুখটা দেখে চুপ হয়ে গেলো। ছেলেটা আজকাল একটু বেশিই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলেও কাজে লাগছে না। অন্ত আগেই তার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। মুখটা সামনেই রেখেছে। ওমন মুখ দেখে আর কিছু বলার সাহস হলো না প্রিয়ার
সময়টা সন্ধ্যার একটু পর। পুষ্প প্রিয়া নিজেদের রুমে বসে কথা বলছে। পুষ্পর আবার অভ্যেস আছে কিছু হলেই প্রিয়াকে শেয়ার করা। তার জীবনের এমন কোন ঘটনা মনেহয় বাকি নেই যা প্রিয়া জানে না। শুধু প্রার্থর বিষয়টাতে একটু হেলাফেলা করে। পুরোপুরি কিছু বলতে চায় না। কিন্তু প্রিয়ার ক্ষেত্রে পুরোই আলাদা। সে ভুলেও বড় বোনের কাছে কিছু বলে না। কত অকাজ করে বড় বোনকে কখনো বলে না। বড় তো ভয় পায়। বড় বোন শাসন করবে বকবে এজন্য সব বলে না। যেগুলো বলা চলে সেগুলো বলে।
এইযে হৃদয় বা অন্ত। তাদের কারো কথাই সে কাউকে বলে না। এসব কথা কি বলার মতো কোন কথা? তবে পুষ্প এতক্ষণে বলে ফেলেছে প্রার্থর বিষয়টা। প্রার্থ যে তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কথা স্বিকার করেছে সবকিছুই বলেছে। তবে পুরোপুরি নয়। তাদের স্বামী স্ত্রীর পার্সোনাল সব বিষয়ে তো আর বলা যায় না। যেটুকু বলা চলে সেটুকুই বলে দিয়েছে।
এখন দুবোনের খুশির জোয়ার দেখে কে। খুশিতে আত্মহারা দুইবোন গল্প করেই যাচ্ছে।
তখনই দরজায় টোকা পরলো প্রার্থর। সে একটু কেশে বললো।
“-ভেতরে আসতে পারি?
প্রিয়া ওকে দেখে ফট করে বললো।
“-কেন নয়। আসুন দুলাভাই ভেতরে আসুন।
প্রার্থ ভেতরে এসে বললো।
“-তুই আমার বউয়ের সাথে কি করছিস? পড়াশোনস নেই তোর?
প্রিয়া মুখ বাকিয়ে বললো।
“-শুনুন। সে আপনার বউ হওয়ার আগে আমার বোন হয়। আমি আমার বোনের ঘরে থাকবো না তো কোথায় থাকবো?
“-নিজের ঘরে থাকবি।
পুষ্পর দিকে তাকিয়ে আবার বললো।
“-তোদের জন্য সারপ্রাইজ আছে।
পুষ্প ভ্রু গুটিয়ে বললো।
“-কি সারপ্রাইজ?
তখনই ভেতরে প্রবেশ করলো রুবি। প্রৌঢ়ার হাতে ব্যাগ তার ভেতরে এলাচি গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। পুষ্প প্রিয়া দুজনেই লাফিয়ে উঠলো। প্রিয়া আগে গিয়ে ব্যাগ থেকে বের করলো তাকে। রুবি খালি ব্যাগটা পাশে রেখে চলে গেলো।
পুষ্প প্রার্থকে বললো।
“-আপনি এনেছেন? আমি তো আনতেই বলিনি।
প্রার্থ হাত দুটো গুটিয়ে বুকের উপর ভাজ করে বললো।
“-তোর কি পছন্দ সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। তোর বলার আগেই হাজির করবো তোর কাছে।
প্রিয়া ঠেস মেরে বললো।
“-বাব্বাহ! ভাই তো দেখছি প্রেমে পরে একেবারে মাখন হয়ে গেছে। তুমি কি যাদু করলে গো বুবু?
পুষ্প কিছু বললো না। হেসে এলাচিকে কোলে তুলে নিলো। বিড়ালটাকে আদর করে বললো।
“-এলাচি বাবু আমার। মিস করেছো আমাকে? বাচ্চা আমি তোমাকে রেখে এসেছিলাম? এবার থেকে আর রাখবো না। তুমি আমার কাছেই থাকবে। লাভ ইউ বাচ্চা।
প্রার্থ চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। কেন যেন হিংসে হচ্ছে বিড়ালটার উপর। বিড়ালের দিকে চোখ বাকিয়ে তাকালো। বিড়ালকে কে লাভ ইউ বলে? এটা তো স্বামীকে বলার জিনিস। সে কপাল কুচকেই বললো।
“- ওটা বিড়ালকে কেন বলছিস?
পুষ্প বুঝলো না। বললো।
“-কোনটা?
“-লাভ ইউ তুই বিড়ালকে কেন বলছিস? ওই শব্দের উপর আমার অধিকার।
পুষ্প লাজুক হাসে। প্রার্থ যেন ওকে লজ্জায় ফেলতে পারলেই খুশি। প্রিয়া চোখদুটো বড় বড় করে বলে।
“-প্রার্থ ভাই তুমি সেই প্রার্থ ভাইই তো? তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
প্রার্থ চোখ পাকিয়ে বললো।
“-তোকে চিনতে হবে না। তুই এলাচিকে নিয়ে যা এখান থেকে। বিড়াল নিয়ে আমার সামনে থাকবি না বেশি।
পুষ্পর দিকে তাকিয়ে আবার বললো।
“-এটাকে দিয়ে দে প্রিয়ুর কাছে। রাতে আমাদের ঘরে থাকবে না ও। তোর জন্য এনেছি শুধু। কিন্তু আমার সামনে বেশি রাখবি না। তোর কোলেও বেশি রাখবি না।
পুষ্প সরু চোখে তাকিয়ে বলে।
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৪
“-আমার এলাচিকে নিয়েও আপনার জ্বলছে।
“-তো জ্বলবে না? একটা বিড়াল আমার বউয়ের কোলে চড়ে নাচবে সারাদিন আমি তাই মেনে নিবো নাকি?
পুষ্পর যে কি করতে ইচ্ছে করছে এখন। প্রার্থ সত্যিই নির্লজ্জ হয়ে গেছে। মুখের ভেতর সবসময় বাজে কথা লেগেই থাকে। সে চোখ পাকিয়ে বললো।
“-ঠিক আছে এত জ্বলতে হবে না। আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। ওকে প্রিয়াই নিয়ে যাবে।