আবার বসন্ত পর্ব ৭

আবার বসন্ত পর্ব ৭
ঝিলিক মল্লিক

রুবায়েতরা বসলো দ্বিতীয় বৈঠকে। আয়েশা খানম তিতানকে নিয়ে আগেই ভেতরে চলে এসেছিলেন। স্টেজে বধূ বেশে বসে থাকা তহুরার সাথে কথা বলছিলেন। রুবায়েত আসতেই টেবিলে এসে বসলেন। রুবায়েত চেয়ারে বসে তিতানকে নিজের পায়ের ঊরুর ওপরে বসালো। ক্যাটারিং বয় এসে খাবার সার্ভ করতেই রুবায়েত তিতানকে আগে খাইয়ে দিতে লাগলো একেকটা লোকমা। তাজরীন আয়েশা খানমের পাশে বসেছে। আড়চোখে দেখতে লাগলো।
তখনই তহুরার বাবা নিজাম উদ্দিন এসে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রুবায়েতের সাথে কথাবার্তা শুরু করলেন। রুবায়েত হাসিমুখে তার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হলো। তাজরীনের কানে কথাগুলো আসছিল। নিজাম উদ্দিন রুবায়েতকে জিজ্ঞাসা করছেন, “তা তুমি বিয়ে করছো কবে বাবা?”

রুবায়েতের মুখ কিঞ্চিৎ বিবর্ণ হলো একথায়। মনে হলো, প্রশ্নটা ঠিক ওর পছন্দ হয়নি। তাজরীন উঁকি দিয়ে খেয়াল করলো। রুবায়েত হাসার চেষ্টা করে জবাব দিলো তখন,
“বিয়ে-শাদি আর করছি না আঙ্কেল। একটাই করেছিলাম জীবনে। ব্যস, ওই অবধি-ই।”
নিজাম উদ্দিন আর কথা বাড়ালেন না। ব্যস্ততা দেখিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন মেহমানদের খাতির-যত্ন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তা দেখতে। বাকিটা সময় রুবায়েত গম্ভীর মুখেই খাওয়া শেষ করে উঠলো৷ একটা কথাও বললো না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ তাজরীন তিতানদের বাসায় এসেছে। মূলত আয়েশা খানম-ই আসতে বলেছেন। তাজরীন হোস্টেলে ফিরে যাবে সামনের সপ্তাহে। তিতানের সাথে গত কয়েকদিন যাবত সাক্ষাতটা বেশি হয়েছে ওর। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পর টানা চারদিন তিতানের সাথে সকাল-বিকাল কোয়ার্টারের আড্ডাস্থলে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেকটা সময় নিয়ে গল্প-আড্ডা চলেছে। তিতান এখনো জানে না, তাজরীন কিছুদিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাবে। তবে আয়েশা খানম জানেন। এজন্য তিনি তাজরীনকে নিজেদের বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাজরীন এসেই তিতানকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে গেছে লুডু খেলতে। লুডুর ছক এবং লুডুর গুটি তাজরীন-ই এনেছে। আগে কখনো লুডু খেলেনি তিতান। এ সম্পর্কে জানেও না তেমন। তাই নতুন খেলাটা ওকে বেশ কৌতূহলী করে তুলেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সবটা। তাজরীন ওকে খেলার নিয়ম শিখিয়ে-পড়িয়ে দিচ্ছে। তখন সকাল সাড়ে দশটা। রুবায়েত প্যারেড শেষ করে বাসায় এসেছিল মিনিট বিশেকের জন্য। নিজের রুমে ছিল। আবারও ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হতেই ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তার ছেলেকে এবং সামনাসামনি একজন দামড়িকে বসে থাকতে দেখে ভ্রূদ্বয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুঁচকে গেল তার। ঘড়ির বেল্ট লাগাতে লাগাতে রাশভারী স্বরে আদেশের সুরে বললো,

“ফ্লোরে বসতে বহুবার নিষেধ করেছি আমি৷ তারপরও ফ্লোরে বসেছো তুমি।”
বাবার কন্ঠস্বর শোনামাত্র চমকে তাকালো তিতান। তাজরীন মাত্র এসেছে বিধেয় জানতো না, রুবায়েত বাসায় আছে। এসময়ে তো ক্যান্টনমেন্টের থাকার কথা। তিতান নিজে উঠে দাঁড়িয়ে তাজরীনের হাতের বাহু ধরে টেনে তাগাদা দিলো ফ্লোর ছেড়ে উঠে পরার। তাজরীন একনজরে রুবায়েতকে দেখতে দেখতে লুডুর ছক ও গুটি নিয়ে উঠে সোফায় গিয়ে বসে পরলো। তিতান ওর সামনে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“পাপা, আমলা লুডু খেনচি৷ আতো না। আমাদেল ছাথে লুডু খেলু।”
“না সোনা। আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে।”
“না পাপা, আতো।”
তিতান হাত-পা ছড়িয়ে বসলো। এখনই কান্না শুরু করবে বোধহয়। রুবায়েত পকেটে হাত রেখে কিছুক্ষণ ছেলের ভাবভঙ্গি দেখলো ঠোঁট চেপে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে সোফার সামনের ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে তাজরীনের হাত থেকে লুডুর গুটি নিতে নিতে বললো,

“ওকে, জাস্ট এক দান।”
“না পাপা। উনিকগুনো দান। ইয়েএএ!”
তিতান হাততালি দিতে লাগলো। প্রথম চালটা রুবায়েত দেওয়ার পরে আনাড়ি হাতে দ্বিতীয় চালটা তিতান দিলো। তারপরের চালটা তাজরীন দিলো। এ-পর্যন্ত কারো-ই ছক্কা পরেনি। পরবর্তী চালটা রুবায়েত দিতেই ছক্কা পরলো ওর। তিতান খেলার মানে ভালোভাবে না বুঝলেও এটুকু জানে, ছয় পোকা পরা মানেই বিশাল কিছু। তাই, খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো ও। রুবায়েত ছেলের হাসি দেখে মুচকি হেঁসে গুটি কোর্টে বের করতে লাগলো। তাজরীনের জাগতিক কোনো খেয়াল নেই। একদৃষ্টিতে থোতমায় হাতের উল্টোপিঠ মুঠো করে ঠেকিয়ে রেখে রুবায়েতকে পলকহীন দেখছে ও। লোকটাকে হাসলে বেশ সুন্দর লাগে৷ তবে এই হাসি দেখার সৌভাগ্য হয় খুব কম।
তাজরীনের ধ্যান ভাঙলো তিতানের খিলখিল হাসিতে। ওর-ও ছক্কা পরেছে। তা দেখে তাজরীনও আনন্দে হাসলো। রুবায়েত উঠতে যাবে, তখন-ই তাজরীন ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

“আপনি এখন ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন?”
রুবায়েত উঠতে যেয়েও উঠলো না। তাজরীন যেখানে বসেছে, সেখানে সোফার সামনের অংশে হাত ঠেকিয়ে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ।”
“দুপুরে আসবেন না?”
“না। কেন?”
“আপনার আম্মা তো আজ অনেককিছু রান্না করছেন।”
“আমি সন্ধ্যায় ফিরে খাবো।”
“না মানে আমি তো এসেছি. . .”
“জি, তুমি এসেছো, তারপর?”
“মানে আপনি থাকলে ভালো হতো। তিতানও খুশি হতো!”
তাজরীন ঝটপট জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো উল্টোদিকে। অস্বস্তি কাটিয়ে যে কথাটা বলে ফেলেছে— অনুধাবন করতেই পিটপিট করতে থাকা চোখের পাতা বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলো। রুবায়েত কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
“তিতান কেন খুশি হবে?”
“জানি না!”

অন্যদিকে মুখ করে রেখেই জবাব দিলো তাজরীন। রুবায়েত উঠে দরজার বাইরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে গেল,
“সম্ভব হলে আসবো।”
ওর যাওয়ার পানে তাকিয়েই তাজরীন মুচকি হাসলো। তিতানকে জড়িয়ে ধরে হেলতে-দুলতে হাসতে হাসতে বললো,
“লাড্ডু রে, তোর বাপ তো সেই একটা মাল রেহ!”
“কিতা?”
তিতান বুঝলো আনন্দের কিছু ঘটেছে। কিন্তু তা ঠিক কি, সেটা বুঝতে পারেনি। তাজরীনের কথার মানেও নয়। তাই তাজরীন জড়িয়ে ধরা অবস্থায়-ই ছোট্টো গোলগাল মুখখানা তুলে ঠোঁট উল্টে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নটা করলো। মুহূর্তেই তাজরীন থতমত খেয়ে স্বাভাবিক মুখ করে ছটফটে কন্ঠে জবাব দিলো,
“না তো! কিছু না। আয়, খেলতে বসি৷”

তাজরীন হোস্টেলে ফিরবে আর দু’দিন পরেই। বেশিরভাগ পোশাক-আশাক এবং জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে রাখা হয়ে গেছে। এ’কদিন তাজরীন দিনের বেশিরভাগ সময়-ই তিতানের সঙ্গে কাটিয়েছে। হয় ওকে নিজেদের ভবনে নিয়ে এসেছে, না-হয় আয়েশা খানমের অনুরোধে ওদের ভবনে গিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন-ই বেশ কয়েকবার করে সন্ধ্যার সময়টাতে রুবায়েতের সাথে দেখা হয়েছে ওর। রুবায়েত নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে বেশিরভাগ সময়। দেখা হলেও সৌজন্যতাবোধে হাসিমুখে দু-একটা কথা বলে। ওগুলোকে-ই বিশাল কিছু ভেবে বসে আছে তাজরীন। মাথা থেকে সরাতেই পারছে না। বরং যত বেশি সরাতে চাইছে; ততই আরো মস্তিষ্কে গেঁথে যাচ্ছে, প্রতিটা নিউরনের মাঝে মিশে যাচ্ছে। তাজরীন নিজ ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল।

এখন সবে সন্ধ্যা ছয়টা। মনের ছটফটানি কোনোভাবেই দূর করতে পারছে না তাজরীন। রুবায়েত কী ফিরেছে কোয়ার্টারে? হয়তো হ্যাঁ। তাজরীনের ফোনে রুবায়েতের নাম্বারটা সেভ করা ছিল। কমিউনিটি সেন্টারের সেই ঝামেলার পরেই রুবায়েত নিজে নাম্বার দিয়েছিল তাজরীনকে। তবে, সেই ঝামেলার কথা ওর বড়ভাইকে বলেছে কিনা; তা জানে না তাজরীন। কারণ, পরবর্তীতে বড়ভাইয়ের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখেনি ও।
তাজরীন এতোক্ষণ অনবরত করতে থাকা পায়চারি থামালো। বেডসাইড টেবিল থেকে বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি পান করলো। পুরো বোতলের পানি শেষ করে ক্ষান্ত হলো। এরপর বিছানার ওপর বসে অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করলো। নিজেকে নিজে বোঝালো। প্রশ্ন করলো। কোনোভাবেই মন মানতে পারলো না। সবাইকে বুঝ দেওয়া যায়, কিন্তু মনকে কোনো বিভ্রান্তিকর বুঝ দিয়ে থামানো যায় না। এই বিভ্রম থামারও নয়। মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে অতঃপর তাজরীন গুরুতর সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললো। বালিশের পাশ থেকে সেলফোনটা তুলে রুবায়েতের নাম্বারটা কললিস্ট থেকে বের করে চটজলদি কল দিয়ে বসলো ঝোঁকের বশে। প্রথম দু’বার রিং বেজে কল কেটে গেল। পরবর্তীতে আবারও কল করতেই রিসিভ হলো। তাজরীন কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠস্বর শোনা গেল, “হ্যালো, কে বলছেন?”

“আসসালামু আলাইকুম। আমি তাজরীন বলছিলাম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। ওহ তুমি! কল দিয়েছো কেন?”
“আপনি কোথায় এখন?”
“বাসায়।”
“দেখা করবেন একটু?”
“কেন?”
রুবায়েত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে। তাজরীন লম্বা শ্বাস টেনে জবাব দেয়,
“খুব দরকার। একটিবার দেখা করুন।”
“কীসের দরকার?”
“গুরুতর সমস্যা। এই মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কোয়ার্টারের লেকপাড়ে আসুন।”
রুবায়েত ভাবলো, হয়তো এশরাককে নিয়ে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে বা অন্য কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। সম্ভবত বড়ভাইকে বা বাসার মানুষদের বলতে পারছে না বিধেয় ওর সাথে দেখা করে বলতে চাইছে।
আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে রুবায়েত। এশরাক ঘটিত কোনো ঘটনা হলে সরাসরি গিয়ে রুস্তমকে বলবে৷ গতদিন তাজরীনের অনুরোধে কিছু বলেনি, আজ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। রুবায়েত শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জবাব দিলো,

“আমি মাত্র এসেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। ফ্রেশ হয়ে পনেরো মিনিটে আসছি। ওকে?”
“ওকে।”
তাজরীন কল কেটে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পরনে একটা কালো সালোয়ার-কামিজ। ওয়াশরুমে গিয়ে পরনের পোশাক চেঞ্জ করে একটা গোলাপি ফ্রক পরিধান করে আসলো তাজরীন। কাজল ছিল ড্রয়ারে। বের করে এমনভাবে চোখে টেনে দিলো, যাতে চোখদুটো আরো গভীর বোঝাবে; কিন্তু কাজলরেখা নিখুঁতভাবে খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না।
নীল রঙের দোপাট্টা মাথায় পেঁচিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু বলেও গেল না। এমনকি ওকে কেউ দেখেওনি।

আবার বসন্ত পর্ব ৬

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাজরীন একমুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পরলো কিছু একটা ভেবে। তারপর ‘যা হবে, দেখা যাবে’- এই কথায় মনকে বুঝ দিয়ে আবারও লেকপাড়ের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সামনে কোনো খাদ আছে কিনা— তা সম্পর্কে অবগত নয়।

আবার বসন্ত পর্ব ৮