প্রেমপিপাসা পর্ব ২৯

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৯
সুমাইয়া সুলতানা

নিভৃত সকালের কোমলতা ছড়িয়ে পড়ছে আকাশের ক্যানভাসে। আলো-ছায়ার খেলায় স্নিগ্ধ এক সৌন্দর্য। চারদিক প্রশান্ত, পাখির কূজনেও এক ধরণের মুগ্ধতা। কিন্তু সেই সৌন্দর্য হ্যাভেনের কাছে বিষের মতো অসহ্য, যন্ত্রণাময়। কারণ, সারারাত ঘুম আসেনি তার। শুধু একটা শূন্যতা, একটা অভাব যেটা রক্তে বিষ ঢেলে দিয়েছে। তার বউ নেই পাশে। একটা রাত, অথচ মনে হয়েছে শতাব্দীর মতো দীর্ঘ। যতই চোখ বন্ধ করুক, যতই ঘুম ডাকুক বিছানা যেন কাঁটার খাটে পরিণত হয়েছে।

রাতের সময়টা খুবই বেদনাদায়ক ছিল এক প্রেমিক পুরুষের জন্য। তিমিরে ঢাকা শীতল রাত্রি শত চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি হ্যাভেন। করবে কীভাবে? ধানিলংকা তার ঘুম হারাম করেছে। না বউ না ছেলে, কাউকে কাছে পায়নি। রাতটা এপাশ ওপাশ করে কেটেছে। ঘুম না আসায় ভেবেছে কাজে ডুবে রাতটা পার করবে। সেটাও সম্ভব হয়নি। কাজে মন বসেনি৷ পুরোটা রাত্রি অস্বস্তি আর বিতৃষ্ণায় কেটেছে। একবার রুমে পায়চারি করে, একবার বেলকনিতে যায়, একবার টুটুলের রুমের দরজা ধাক্কায়, একবার লিভিং রুমে হাঁটাহাঁটি করে। সবশেষে এত রাতে বন্ধুকে ফোন কলে ডিস্টার্ব করেছে। নিজে ঘুমাতে পারেনি বলে বেচারাকেও ঘুমাতে দেয়নি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অপরদিকে টুটুল অরুর ঘুম ভালো হয়েছে। দুজনই রাজকীয় আহারের ন্যায় তৃপ্তি সমেত আরামে ঘুমিয়েছে। টুটুল মায়ের উষ্ণ বুক পেয়ে পেটের ওপর এক পা তুলে, অন্য হাতে গলা জড়িয়ে আরামে ঘুমিয়েছে। বিশেষ করে অরুর ঘুম সবচেয়ে বেশি ভালো হয়েছে। হবে নাই বা কেন? হ্যাভেনের সাথে বিয়ের পর থেকে একটু শান্তিময় ঘুম দিতে পারেনি। কারণ, হ্যাভেন অরু’কে বুকে নিয়ে তার উরুর উপর এক পা তুলে, আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে জাপটে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। পুরুষালি বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত হাতের বেষ্টনী থেকে অরু চেয়েও নিজেকে ছাড়াতে পারে না। প্রথম প্রথম বাঁধা দিলেও এখন আর ছোটার জন্য ছটফট করে না। শুধু শুধু শক্তি ক্ষয় করে কি লাভ? হ্যাভেন তো ছাড়বার পাত্র নয়। আর ওরও হ্যাভেনের বুকে ঘুমাতে ভালো লাগে। হয়তো অভ্যাস এর জন্য দায়ী!

এখন কথা সেটা না। সমস্যা হলো, রাতে হ্যাভেন একটিবারের জন্যও অরু’কে ওপাশ ফিরতে দেয় না। না মানে না! তার কাটকাট দৃঢ় কথা, অরু’কে বুকেই থাকতে হবে। বুক থেকে সরা যাবে না। অরুর তখন বেহাল দশা! সারা-রাত এক পাশে কাত হয়ে ঘুমানো যায়? উঁহু! অনেক মুশকিল অথচ অরু’কে সেভাবেই ঘুমাতে হয়। এক কাত হয়ে ঘুমানোর দরুন ঘাড়, কাঁধ, বাহু ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে থাকে। এতে অবশ্য হ্যাভেনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। না পেরে একদিন অরু তীব্র মেজাজ খারাপ নিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে, একরাশ লজ্জা সমেত মৃদুস্বরে কাঁদো কাঁদো মুখে আবদার ছুড়ে ছিল,

” প্লিজ, একবার ওপাশ ফিরতে দিন। দরকার হলে আপনি পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান৷ ”
বজ্জাত লোক এটাও মানবে না। একরোখা হ্যাভেনের নিকট তার কাকুতিমিনতি যেন, মৃত গাছে জল ঢালার মতো। অরুর কথা শুনতে নারাজ সে। তার ভণিতা ছাড়া কঠোর আদেশ, বুকে ঘুমাবে মানে বুকেই ঘুমাবে। ঘুমাতে হলে বুকেই শুতে হবে, নয়তো রোমান্স করে রাতের ঘুম হারাম করে দিবে।
অরু তখন স্বীয় কপাল চাপড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একবার তো এমন হয়েছে, হ্যাভেন ঘুমের মাঝে প্রচন্ড জোরে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার দরুন, অরুর নাকমুখ হ্যাভেনের বুকে চ্যাপটা হওয়ার যোগাড়, সেই সাথে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়েছিল। নাকমুখের ছিদ্রপথ বন্ধ থাকলে শ্বাস নেওয়া সম্ভব? মোচড়ামুচড়ি করায় হ্যাভেনের ঘুম ছুটে যায়। পরক্ষণেই অরুর অসহায় ভাবভঙ্গি, ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে, ক্ষুদ্র টুকরো শ্বাস ঝাড়ে। অতঃপর সরি বলে, হ্যাভেন জায়গা বদল করে, অরুর কোমর আর পিঠ শক্ত করে প্যাঁচিয়ে বাম পাশ হতে তাকে ডান পাশে এনে বুকে নিয়ে আলতো করে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। তবুও বুক ছাড়া ঘুমাতে দিবে না।
ঘাড় ত্যাড়া পুরুষকে রাতের কর্মকান্ড জানালে সে ভাবলেশহীন গলায় প্রত্যুত্তরে জানায়,

” ব্যথা করলে ওষুধ খাও। অক্সিজেন লাগলে আমাকে বলো, কিন্তু সিদ্ধান্ত নড়বড় হবে না। যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে। ”
বর্তমানে বালিশ একটার বেশি লাগে না, হ্যাভেনের বুকে অরু ঘুমায় বলে। অবহেলায় একা পড়ে থাকা অন্য বালিশ আর কোলবালিশ অভিমানী মুখে রাগান্বিত হয়ে অদৃশ্য মায়ায় তাকে শাসায়,
” কি রে হ্যাভেন, বউ পেয়ে আমাদের ভুলে গেলি? এতকাল আমাদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে মোহ কেটে যাওয়ার পর দূরে ছুড়ে মারলি? বেঈমান! আর আসিস আমাদের কাছে। নাকমুখ চাপা দিয়ে নিঃশ্বাস আটকে মারবো। ”
তাদের নীরব অভিযোগ আদতে হ্যাভেনের কর্ণগোচর হয়েছে কি না বোঝা মুশকিল! বউ কাছে পেলে দিনদুনিয়া ভুলে বসে থাকে সে। তাকে নিয়ে মত্ত থাকে পুরোটা রাত্রি। সেখানে বালিশের আহাজারি শোনার সময় আছে?

ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে অরু, সায়র। কাজ থাকায় প্রত্যাশ সকাল সকাল বেরিয়ে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে সায়রা ড্রাইভারের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছেন টুটুল’কে দিয়ে আসতে। যাওয়ার পূর্বে যার যার পছন্দানুযায়ী ব্রেকফাস্ট রেডি করেছেন। ড্রাইভার বিশ্বস্ত হলেও হ্যাভেন কোনো প্রকার রিস্ক নেয় না। টুটুল’কে স্কুলে পৌঁছে দিতে বাড়ির কাউকে সাথে পাঠায়।
” অঙ্কিতা করলা ভাজি পছন্দ করে। তাই তো বলি, তার মুখ হতে মধু না ঝরে তেঁতো কথা কেন বের হয়! ”
নাকমুখ বিকৃত করে রুটি দিয়ে করলা ভাজি চিবোতে চিবোতে বলল সায়র। অঙ্কিতা করলা খায়, সেজন্য সায়রও করলা খাবে। অথচ সে এই জীবনে কোনোদিন করলা খায়নি। অরু চুপচাপ খাচ্ছে। সায়র তার জানটুস সম্পর্কে কথার ঝুলি সাজিয়ে বসেছে।
অরুর নিশ্চুপে সায়রের মনঃক্ষুণ্ন হয়। নির্বিকার মেয়েটির মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে কাচের প্লেটে চামচ দিয়ে শব্দ তুলে ফের বলে,

” কথা বলছো না কেন? ”
অরু দুষ্টুমি ভরা নজর তাক করে। পদ্মকুঁড়ি অধরে অমায়িক হাসি টানল,
” কি বলবো? তোমার কথাই ফোরাচ্ছে না। ”
সায়র লাজুক হেসে মাথা চুলকায়। মুখবিবর প্রোজ্জ্বলতায় ভরিয়ে হুল্লোড় বাঁধায় তৎক্ষনাৎ,
” অঙ্কুর কথা উঠলে বলতেই মন চায়। যাইহোক, ভাইয়া কালকে টুটুলের দরজায় জোরে জোরে কশাঘাত করছিল কেন? ”
মুহুর্তে মেয়েটির প্রৌঢ় ঠোঁটে তারার ন্যায় বিভাসিত চমৎকার হাসি ফুটল। অন্তঃপট বিশ্বজয়ের মতো তৃপ্তিতে বাক-বাকুম করে উঠে। দ্বিধাহীনভাবে মিষ্টি কন্ঠে ঢালল নিদারুণ উচ্ছ্বাস,

” টুটুলের রুমে রাত্রিযাপন করেছি। তোমার ভাইকে রুমে অ্যালাউ করিনি। ”
সায়র বসা অবস্থায় ঈষৎ লাফিয়ে উঠল। খুশির স্রোত লাগাম ছাড়া তখন। উৎফুল্ল চিত্তে তালি বাজালো হাতে। চনমনে গলায় বাহবা দিল,
” সাব্বাশ! ভাইয়ের জন্য কাল আমার জানটুসের সঙ্গে কথা বলায় ব্যাঘাত ঘটেছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল। আ’ম প্রাউড অফ ইউ। ”
ফিক করে হেসে ফেলল অরু। ডান ভ্রুটা একটু উঁচুতে তুলে শুধায়,
” টুটুল’কে মিথ্যা বলে পাঠিয়েছিলে, তাই না? ”
সে জবাব দিল দায়সারা,
” তা নয় তো কী! ”

অরু এবার সশব্দে হাসল। দুজনের অট্টহাসি নিয়ে কথা চলছে অবিরত। খাওয়ার ফাঁকে গ্রীবা বাঁকিয়ে বারংবার হ্যাভেনের রুমের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অরু। সাহেবের এখনো দেখা মেলেনি। সে এত লেট করে না। বরং অরু লেট করে ঘুম থেকে ওঠে। আজ কি হলো?
অরুর ভাবনার মধ্যিখানে, অপেক্ষার ইতি টেনে কিছুক্ষণ পরই প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষার পুরুষের আগমন ঘটলো। দিশেহারা হর্ষণে তার গতিবিধি দৃষ্টিগোচর হয় তৎক্ষনাৎ। পড়নে রাতের ট্রাউজার, টিশার্ট। এলোমেলো চুল ললাটের অগ্রভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মুখখানা শুকিয়ে আছে। চক্ষু জোড়া রক্তিম। বোঝা যাচ্ছে, রাতে ঘুমায়নি। মুখমন্ডল জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। গুরুগম্ভীর বদনে, নিরুদ্বেগ সহিত বেজার মুখ এসে অরুর পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। অরু তাকে একপল পরখ করে, গ্লাসে ম্যাংগো জুস ঢেলে প্লেটে পরোটা, সিদ্ধ ডিম, স্যালাড তুলে দিল। সে বিনাবাক্যে খাওয়া শুরু করে।

ভাইকে দেখা মাত্র অর্ধেক খাবার রেখেই নিঃশব্দে কেটে পড়ে সায়র। ভাবীর সামনে কানের পিঠে থাপ্পড় খাওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। যতই হোক একটা মেয়ের চক্ষু সম্মুখে মার খাওয়া লজ্জাজনক।
হ্যাভেনের নৈঃশব্দ অরুর মন বিক্ষিপ্ত। তবে ঠোঁটে মিটিমিটি হাসির ঝলক। চট করে মাথার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম চিন্তা জেগে উঠল। সহসা কন্ঠ খাদে নামায় ও। তোতাপাখির ন্যায় বিলম্বহীন শুধাল,
” রাতে চিৎকার করে ছিলেন কেন? ”
সিদ্ধ ডিম সবে অর্ধেক মুখের ভেতর ঢুকিয়েছে হ্যাভেন। কামড় দেয়নি। অরুর কথায় থেমে যায়। মুখ হতে ডিম বের করল। কপাল কুঁচকে ফেলল নিমিষে। সরু তীক্ষ্ণ চাহনি বর্তায় ঔৎসুক মেয়েটির উপর। অতঃপর জানালো সোজাসাপটা,
” নিউমোনিয়া আক্রমণ করতে এসেছিল। ”
বলেই খেতে মন দেয়। অরু চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করে,
” বাঁচলেন কি করে? ”
” তুমি বাঁচিয়ে ছিলে। ”
অরু হতভম্ব! চোখ বড়ো করে তাকায়। অবুঝ ফ্যালফ্যাল চাউনি। জানতে চাইল সচকিত হয়ে,

” আমি! ”
হ্যাভেনের ভারাক্রান্ত নিষ্প্রভ জবাব,
” তোমার কাপড়চোপড় সুরক্ষা কবজ হিসেবে কাজ করেছে। ”
” কীভাবে? ”
অরুর সন্দেহী কন্ঠ। হ্যাভেন পাত্তা দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টায় অবলীলায়,
” আমাকে নিয়ে সায়রের সঙ্গে কি ষড়যন্ত্র করছো, শুনি? ”
অরু উঠে দাঁড়ায়। অধরের হাসি উবে গিয়েছে। ছোট্ট একটি তাচ্ছিল্য বাক্য শুনে মনগহীন উদগ্রীব হয়ে পড়ল। চিনচিন ব্যথা অনুভব করল অন্তঃকরণে। নাজুক মেয়েটি ভাষাহীন শূন্য অনুভূতি নিমিষে অচিরেই ফাটল ধরাল নিরুৎসাহিত লোকটা। ক্ষুদ্র শ্বাস টানল ও। বলল স্ফূর্ত কন্ঠে,

” আমি আর খাবো না। ”
জুস খেতে খেতে পিটপিটিয়ে অরুর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল, রেগে বোম হয়ে থাকা হ্যাভেন। পরপরই পুরু জোড় ভ্রু যুগল নাচাল,
” কেন? খাবে না কেন? ”
অরু একগাদা ঘৃণায় নাক ছিটকায়,
” এই মাত্র আলু ভাজির উপর দিয়ে একটা আরশোলা হেঁটে গিয়েছে। ”
ললাটের টানটান চামড়ায় প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল তার। হ্যাভেনের বাড়িতে আরশোলা? অবিশ্বাস্য! ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক নজর বোলায়। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর দেখল, আরশোলার নবজাতক ছোট্ট একটা বাচ্চা পিঁপড়ার গতিতে হাঁটছে ডাইনিং টেবিল জুড়ে। হ্যাভেন সেটা ফেলে দিল না। রুবিনা’কে ডাকল না। উল্টো অরুর হাত টেনে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। শান্ত চোখে চেয়ে কটাক্ষ সমেত আদেশ করলো,
” খেয়ে নাও। আরশোলা তো আর জুতো পড়ে যায়নি, খালি পায়ে হেঁটে গিয়েছে। ”
মেয়েটির হতবিহ্বল অক্ষিপট চড়কগাছ! পাতলা ওষ্ঠ ছড়িয়ে গেল দু’পাশে। নাক ফুলিয়ে তাকাল। বিতৃষ্ণায় গলা ভিজল। বিগড়ে গেল ফুরফুরে মেজাজ। রাতের আচরণে এমন করছে বজ্জাতটা, ঢের বুঝতে পেরেছে। অমনি কটমটিয়ে রেগে আঙুল তুলল এবার,
” আপনার রুচিসম্মত হলে আপনি খান! ”

ভেজা হাত ওড়নার কোণে মুছতে মুছতে রুমে আসলো অরু। বিছানায় নজর পড়তেই নাক সিকায় উঠল। চাদর, বালিশ, কম্বল অগোছালো হয়ে বিশৃঙ্খলে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার! হ্যাভেন অপরিষ্কার, এলোমেলো একদম পছন্দ করে না, অথচ বউয়ের শোকে পরিপাটি হ্যাভেন এক রাতে সর্বত্র বদলে দিল।
ফোঁস করে নিরাশ দম ফেলল সে। চঞ্চল কদম বাড়িয়ে খাটের নিকট এগিয়ে যায়। বালিশ ঠিক করে কম্বল ভাঁজ করার সময় দৃষ্টি পড়ল কাপড়ের দলার উপর। নেত্রদ্বয় সংকুচিত করল সহসা। হাতে তুলে নিলো সেটা। পাকানো কুন্ডলী খুলে দেখল, সবগুলো ওর জামাকাপড়। ইনারও রয়েছে সেখানে। প্রচুর রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে কাপড়গুলো ভাঁজ করে বকতে বকতে ওয়ারড্রবে যথাস্থানে রাখল।

ঠাস করে দরজা আটকানোর শব্দে অরু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। হ্যাভেন এসেছে। তবে এ সময় দরজা বন্ধ করার মানে বোধগম্য হচ্ছে না। লোকটার উপস্থিতি মানে একটা বজ্রনির্ঘোষ আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। সে জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে এগিয়ে আসছে অরুর দিকে। তার লুকটা রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে আসা এক প্রলয়ংকরী ঝড়ের ন্যায়। চোখ দুটো এতটাই তীক্ষ্ণ, অন্ধকারের বুক চিরে আগুন ছুড়তে জানে। নিগূঢ় ধূসর চাহনিতে একধরনের ভয়াবহ স্থিরতা, যা দেখে সাহসী মানুষও পেছাতে বাধ্য হয়। সেই চোখে রাগ জমে থাকে ঠান্ডা, নিঃশব্দ অথচ ধ্বংসাত্মক।
হ্যাভেনের প্রকট চাহনি জরাজীর্ণ মেয়েটির সত্তা নাড়িয়ে দিল। ভীতিগ্রস্ত হয়ে চেয়ে থাকল সম্মুখের মানুষটার আদলে। সে সামনে এলেই অরুর এমন খুইয়ে যাওয়া নতুন নয়। গোটা বিষয়ে আদ্যোপান্ত রপ্ত তার। আগে বিরক্ত লাগত, এখন ভালো লাগায় ছুঁয়ে যায় বক্ষঃস্থল। তবে এই মুহূর্তে ভয় লাগছে। হ্যাভেনের যা রাগ, বোধশক্তি হারিয়ে অবান্তর ঘটনা ঘটানো অবিশ্বাস কিছু না।

অপ্রতিভ দৃষ্টিতে একপল হ্যাভেন’কে দেখে নিজেকে ধাতস্থ করল অরু। মস্তক নিচুতে নামিয়ে রয়েসয়ে মুখ খুলল,
” দানবের মতো এগিয়ে আসছেন কেন? ”
উত্তর আসলো না। অরুর কাছাকাছি এসে ধীর পদযুগল থামাল সে। অরু শুষ্ক ঢোক গিলে মাথা উঠায়। পূর্ণ দৃষ্টিপাত ঘটাল কাঠিন্য মুখাবয়বের হ্যাভেনের পানে। তার চিবুকটা কঠিন, হাড়ে মোড়া। দাঁতে দাঁত পিষছে। যার দরুন চোয়ালের রেখাগুলো তীব্র হয়ে উঠল। প্রতিটা শিরায় যেন আগুন বয়ে যাচ্ছে। কপাল কুঁচকে রইল, সেটা কৃত্রিম কোনো অভিব্যক্তি নয়, ভেতরের ক্ষোভ। না বলা অসন্তোষ আর নিয়ন্ত্রণে রাখা আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
হ্যাভেন পলকহীন সূঁচালো চাউনিতে অবলোকন করছে অরু’কে। সেভাবে চেয়েই আওয়াজ উঠায় গমগমে গলায়,
” আমার সাথে থেকে চালাক ভালোই হয়েছো। বাটপারি ভালোই শিখেছো! ”
অরু ভয়ার্ত দৃষ্টি ফেলল। বিস্ফোরিত ছুটন্ত বাক্যে ঘাবড়ে গেল। উচাটন শরীর বিধিবাম কম্পমান। এসব বলছে কেন লোকটা?

হ্যাভেন আয়েশ করে খাটে বসে। বেড-সাইড টেবিল হতে একটা ফাইল হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকল। ভাবভঙ্গি কেমন যেন মরা মরা এবং ক্ষুদ্ধ! নাকটা কুঁচকে রাখল, অথচ তাতে একটা অভিজাত উদ্ধত ভঙ্গি লুকিয়ে আছে। নিম্ন ঠোঁট কামড়ে আছে। সেই ঠোঁটে সবসময়ের মতো একটা অদ্ভুত, রহস্যময় লুকিয়ে রয়েছে। যা নিরীহ নয়, বরং ধ্বংসের অঙ্গীকার করা এক নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি। মনে হয়, সে হাসে শুধু তখনই, যখন কাউকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
অরুর পিলে চমকে উঠল হ্যাভেনের মুখমন্ডলের কাঠিন্য রূপ আর ঠোঁটের ক্রুর হাসি দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা হ্যাভেন’কে। কুচকুচে কালো চুলগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে কপালের উপর, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিটি চুলে জমে আছে বিদ্রোহ। তার রাগ দাহ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র বুলিতে। কিন্তু অরু সেটা বুঝতে সক্ষম হলো না। হাজারো প্রশ্ন জমে জমে ভেতরটা উথালপাথাল করছে।
বুকে সাহস সঞ্চয় করে বহু কষ্টে ইতস্তত কন্ঠে জানতে চাইল অরু,

” কি করেছি আমি? ”
” ভয়ানক কান্ড ঘটিয়েছো আমার দৃষ্টির অগোচরে। ”
” সেটাই জানতে চাইছি। বলুন। ”
হ্যাভেন ফাইলের কাগজে সাইন করা শেষে, কাগজ ফাইলে ঢুকিয়ে তা ফিক্কা মেরে টেবিলে রেখে দিল। সদ্য ঘুম থেকে ওঠার মতো আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আচানক বোমা ফাটাল। ফট করে বলে বসলো,
” তোমার পছন্দের ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি। জানি সে কে। ”
অরু চিন্তায় বিভোর। সায়র’কে নিয়ে সন্দেহ করল কী? মেয়েটির মনে হঠাৎই ঝড় নেমে আসে। একপ্রকার নিঃশব্দ দুর্যোগ। চারপাশের শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সময় থমকে দাঁড়িয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে আসলো। চোখের পলকে আতঙ্ক তার স্নায়ু জড়িয়ে ধরল। হৃদকম্পন অসহনীয়ভাবে বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে বক্ষফাঁটা শব্দে নিজেকেই ভয়ে ভেঙে ফেলবে।
হাঁসফাঁস মিশলে মন্থর গতিতে নাজুক মেয়েটি সরল দৃষ্টি ফেলল। নিঃশ্বাসে আক্ষেপ ঝাড়িয়ে চাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল অতি আগ্রহ নিয়ে,

” কবে থেকে জানতে পেরেছেন? কাল হসপিটাল থেকে ফেরার পর জানিয়েছি। এত দ্রুত জানলেন কীভাবে? ”
হ্যাভেন বাঁকা হাসল। চাহনি তীর্যক। বলল ফিচেল স্বরে,
” কালকেই জানতে পেরেছি। কি ভেবেছো আমি জানতে পারবো না? ”
মিইয়ে গেল সে। নিমিষে হরিণী নেত্র টলমলে নির্মল জলে টইটম্বুর হলো। কালকে থেকেই সায়রের সঙ্গে কথাবার্তা অন্য দিনের তুলনায় বেশি বলেছে ও। ব্রীড়ায় নড়েচড়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় বুঁদ হয়ে শশব্যস্ত দৃষ্টি নামায়। বক্ষ ফুঁড়ে হতাশা নামে। শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত, যেন বায়ু অকস্মাৎ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে তার ফুসফুসে। গলবিল শুকিয়ে কাঠ। জিভ তালুতে লেগে আসে। হাত-পা কাঁপে অবিরাম, নিছক ভয় নয় এ এক উৎকন্ঠার চূড়ান্ত রূপ। মস্তিষ্ক শূন্যতায় ভাসতে থাকে চিন্তার কোনো সুনির্দিষ্ট রেখা নেই। শুধু দিগ্বিদিক জুড়ে অসহায় নীরবতা।
ঠোঁট ফোলায় অরু। জোরে জোরে শ্বাস টানল। আতঙ্কিত হয়ে অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। থেমে থেমে হড়বড়িয়ে ধরা গলায় উন্মাদের মতো বলতে লাগলো,

” আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সায়রের সাথে আমার তেমন কিছু নেই যা আপনি ভাবছেন। আমরা জাস্ট বন্ধু। ভাই বোনের মতো চলি। ”
আকস্মিক কান্নায় বাকরুদ্ধ হ্যাভেন। চোখে ঝলসে উঠল একরাশ অস্থিরতা। বিচলিত বক্ষপট। কাঁদছে কেন মেয়েটা? এসব কথা বলছে কেন? সময় ব্যয় করল না। ত্বরিত কাছে এসে মেয়েটির বাহু ঝাঁকাল। কন্ঠে তার গভীর উদ্বেগ,
” আর ইউ ওকে? কি উল্টাপাল্টা বলছো? ”
মিষ্টি কথা অরু আমলে নিলো না। নিখিল’কে নিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর কোনো কলঙ্ক মাথায় সে নিতে পারবে না। একটা অচেনা শঙ্কা যেন ঘিরে ধরে পলকে। মুখাবয়বে নিস্পৃহা ভীষণ! তিরতির করে ঠোঁট কাঁপে। কন্ঠ বুজে এলো,

” আপনি মনে করছেন আমার পছন্দের ছেলে সায়র, রাইট? কিন্তু এটা সত্যি নয়, বিশ্বাস করুন। ”
হতভম্ব হ্যাভেন। বিস্ময়ে স্তব্ধ, নির্বিকার। সহজ-সরল নিষ্পাপ ড্যাবড্যাব চাহনি। অরুর ডুকরে কান্নার তোড়ে হুঁশ ফিরল। সহসা স্তম্ভিত আওড়ায়,
” সায়র’কে নিয়ে সন্দেহ করেছি কবে? ”
” করেছেন। ”
” কখন করলাম? ”
অরু থমথমে খায়। অসুস্থ মানুষের ন্যায় নিভুনিভু তাকায়। কেঁদেকেটে আরক্ত মুখখানা রক্তিম আভা বানিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে ফরসা নাক একটু বেশি লাল হয়ে আছে। হ্যাভেনের ইচ্ছে করছে কুটুস করে নরম নাকে কামড় বসাতে। দমিয়ে রাখল না। প্রশ্রয় দিল। ছোট্ট করে আলতো কামড় বসায় অরুর নাকে। অরু চোখ খিঁচে বুজে ফেলল।

হ্যাভেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর কথার ভুলভাল অর্থ বের করেছে এই মেয়ে! তার উপর সায়র’কে নিয়ে? এরকম ভাবনার কারণ কি? নিগূঢ় শীতল চাউনি নিক্ষেপ করল উৎকন্ঠিত রমণীর উপর। অঞ্জলিপুটে আঁকড়ে ধরল ক্রন্দনরত মুখশ্রী। কন্ঠনালি হতে তৎক্ষনাৎ ধ্বনিত হলো গভীর বাক্যবহর,
” আমি জানি না, সায়র’কে নিয়ে এসব কথা কেন বলছো। আমার মনে তো দূরে থাক, মস্তিষ্কের ভেতরও এমন কুৎসিত ভাবনা আসেনি। একটা সম্পর্ক টিকে থাকে বিশ্বাসের মাধ্যমে। ভালোবাসা স্রেফ দুজনের সম্পর্কটাকে আরেকটু মজবুত করে। এর বেশি ভালোবাসা শব্দটার আর কোনো ভূমিকা নেই। প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে সর্বপ্রথম দরকার বিশ্বাস, ভালোবাসা নয়। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালো সম্পর্ক কখনোই গড়ে উঠতে পারে না। আমি তোমাকে বিশ্বাস, ভরসা দুটোই করি। ”
অরুর কান্না থেমে যায়। ঘনপল্লব বিশিষ্ট সংকুচিত হরিণী নেত্রদ্বয় প্রসারিত হয়। বারকয়েক পলক ঝাপটায়। সচকিত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন ছুড়ল,
” আর ভালোবাসা? ভালোবাসা নেই আমার প্রতি? ”
হ্যাভেন হাত সরিয়ে নিলো। ঠোঁটের কোণ মেলে এক চিলতে হাসে। ব্যাকুল চোখে তাকায়। কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা ঢালল,

” এটার উত্তর তুমি জানো। তবুও ড্রামা করছো? ”
” আমি কীভাবে জানবো? মুখ ফুটে বলেছেন কখনো? ”
হ্যাভেন ফিচেল হাসে। তপ্ত শ্বাস ঝাড়ে। কৌশলে এড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টায় মুহুর্তে,
” সায়র আর তোমাকে নিয়ে সন্দেহ করলে কষ্ট পেতে? ”
অরু চমকায়। থমকায় তার কম্পিত বুক। মলিন চোখে চেয়ে ভণিতা ছাড়া মাথা নাড়ল,
” অনেক যন্ত্রণা হতো অন্তঃকরণে। ”
সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস সমেত বলে ওঠে হ্যাভেন,
” তুমি যদি ভুল করেও সায়রের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে, আমি তোমাকে ছাড়তাম না। প্রিয়জনের ছোট ছোট টুকটাক ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে না পারলে, কিসের প্রিয়জন হলো? তোমাকে বিশ্বাস করে মরণ কবুল, অরু পাখি। চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো। শুধু শর্ত একটাই, আর যাইহোক, কখনো বুকে ছুরি মেরো না। আমাকে অবিশ্বাস করো না। ভালোবাসতে না পারলেও, ঘৃণা করো না। তোমার হরিণী চোখে আমার জন্য ঘৃণাটা বড্ড পোড়ায়। আগুন জ্বলে উঠে এখানে।

তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বুকের বাম পাশ দেখাল। ওর ঠোঁটে প্রাণবন্ত হাসি। সুগভীর লোচনে দৃঢ়তা। সেখানে সুস্পষ্ট প্রকাশিত অরুর প্রতি তার অঘাত বিশ্বাস। একটুও মিথ্যা নেই সেথায়। অরুর বক্ষপিঞ্জরে প্রশান্তির ঢেউ খেলল। আবেগ-প্রবণ হয়ে তৎক্ষনাৎ হ্যাভেন কে জড়িয়ে ধরল। পুনরায় ডুকরে কেঁদে উঠে।
হ্যাভেন ঈষৎ ভড়কে যায়। নিজেও আগলে নিলো স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীকে। ধড়ফড়িয়ে অস্থির গলায় শুধায়,
” মাই লিটল বার্ড, হোয়াট’স রং? হোয়াই আর দোজ জেন্টল আইজ ফিল্ড উইথ টিয়ার্স? ”
হেঁচকি উঠে গিয়েছে নাজুক মেয়েটির। কাঁদতে কাঁদতে অভিমানের, আহ্লাদী অভিযোগের পসরা সাজায়। বুকে মিশে থেকেই নাক টেনে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জবাব দিল,
” আমি ভেবেছিলাম আপনি ভুল বুঝবেন। সায়র’কে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করবেন। ”

হ্যাভেন অধর কামড়ে হাসে। নিটোল ওষ্ঠ নামিয়ে চুমু আঁকল মাথায়। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে আলগোছে দপ করে বিছানায় পড়ে গেল। সেভাবেই বালিশ ছাড়া শুয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ এনে নিজের মাথার নিচে রাখল। অতঃপর বুকে থাকা অরুর কেশবহুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
” এসব কথা যেন আর না শুনি। আমাকে এতটা লেইম মনে হয় তোমার? আমি ছোট থেকেই সায়র’কে দেখছি। বলতে গেলে ওর শৈশবের বেশিরভাগ সময় আমার সাথে কেটেছে। আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। ওর হাবভাব, চলনবলন, অভিব্যক্তি সম্পর্কে অবগত আমি। ভাই, বউ দুজকেই চেনা আমার। তাহলে এসব কেন ভাবতে যাব? আমি বুঝতে পারছি না সায়রের কথা কেন বলছো? অন্য ছেলের কথা কেন বললে না? ”
অরু ফের নাক টানে। সরল কন্ঠে জানায়,
” আমাদের দুজনকে একসাথে অনেক কথা বলতে, হাসাহাসি করতে দেখেছেন। প্রতিবারই আপনি কেমন রাগান্বিত চোখে তাকাতেন। ”

” সেজন্য তোমার মনে অদ্ভুত কথা বাসা বেঁধেছে? ”
অরু প্রত্যুত্তর করল না। নির্বিকার থাকল। লজ্জা পেয়েছে খুব। আরও নিগূঢ় ভাবে প্রসস্থ বক্ষপটে মিশে রইল। পরক্ষণে কানের নিকট একটি উষ্ণ ঠান্ডা স্বর শুনতে পেলো,
” এই যে শহরে এত এত মানুষ বাস করে, তবুও মানুষ কেন মানুষের অভাবে মরে? মানুষ কেন মানুষের অভাবে ছটফট করে? শহরে এত এত মানুষ থাকাও সত্ত্বেও মানুষ কেন নির্দিষ্ট একজন মানুষের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়? কেনই বা তারই জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসায়, আত্মহত্যা পর্যন্ত করে? ”
অরু মাথা উঠায়। স্বীয় পুরুষের বুকে চিবুক ঠেকিয়ে ভাবুকতা গলায় জানতে চায়,
” আই হ্যাভ নো আইডিয়া। ”
” আসলে মানুষের যখন কোন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য মায়া হয়ে যায়, তখন ওই মানুষটি ছাড়া আস্ত একটা পৃথিবীও জঞ্জাল মনে হয়। ওই নির্দিষ্ট মানুষটি ছাড়া একটি দিনও, এক বছরের সমান মনে হয়। ”
নজরে নজর মিলিয়ে শুধায় অরু,
” আপনি কখনো কারো মায়ায় জড়িয়েছেন। ”
হ্যাভেন শব্দ করে একপেশে হাসল। সূর্যের উত্তাপে প্রখর খরায় মাটির ফাটল ধরার পর, হুট করে অপ্রত্যাশিত এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় অরুর অন্তরে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দিতে, এই প্রথম রহস্যময় পুরুষ মোহনীয় স্বরে ঢালল অমায়িক জাদু,
” তোমার মায়ায় না পড়লে আমি কখনোই জানতাম না, আমি মানুষটা কতটা অসহায়। ”
অবাক হলো বিপরীত পক্ষ। কৌতূহলি অক্ষিপট বৃহদাকার হতে সময় নিলো না। সুর তুলল আপন ছন্দে,
” আমার মায়ায় জড়িয়েছেন আপনি? কবে থেকে? ”
আশানুরূপ জবাব এলো না। সে চোখের পলকে অরু’কে বুকের নিচে ফেলে, মুহুর্তে শরীরের অর্ধেক ভর ছেড়ে দিল তার উপর। একপল ফুরসত না দিয়ে হম্বিতম্বি মেয়েটির ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। কেঁপে উঠল রমণী। শিরশির করছে মেয়েলি কায়া৷ নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে। পেলব হস্তে ভারিক্কি শরীরটা ঠেলতে ঠেলতে বলল,

” আরে এ কেমন পাগলামি? সরুন। ”
অরুর গলায় নাক ঘষতে ঘষতে ঘোর লাগা গলায় অনুনয় করল হ্যাভেন,
” সারা-রাত ঘুমাতে পারিনি। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাতে দাও। ”
” ঘুমান। আমাকে যেতে দিন। ”
” তুমি ছাড়া ঘুম আসবে না। ”
” বাচ্চাদের মতো করছেন কেন? এতকাল কি আমি ছিলাম? ”
হঠাৎই কেমন করে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া অসহায় পুরুষের ন্যায় আওড়াল হ্যাভেন,
” তখন চোখে ঘুম ধরা দিতো না। একটা রাতও শান্তিতে কাটত না। মনে মনে একটা ভরসা-যোগ্য বুক চাইতাম। নিভৃতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে একটা আদুরে কোল চাইতাম। অথচ পেতাম না। ”
ভঙ্গুর লোচনের আকুল কন্ঠ অরুর বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে মিহি স্বরে বলে,
” ঘুম থেকে কিছুক্ষণ আগে উঠেছি। অলরেডি লেট হয়ে গিয়েছে। ভার্সিটি যেতে হবে। ”
লম্বা শ্বাস টানল সে। ত্যাড়া উত্তর দিল,
” আমি ঘুমালে চলে যেও। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৯

সহসা চিড়বিড়িয়ে গর্জে উঠে অরু। ক্ষেপে উঠল তৎক্ষনাৎ। রাগত্ব দৃষ্টি ফেলল। ভার্সিটি যেতে হবে, সেটার পাশাপাশি হ্যাভেনের নৈকট্য ওর সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। জবর্দস্তি ছাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে দূরত্ব বাড়াল। ড্রেস নিয়ে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।
হ্যাভেন ঠোঁট উল্টায়। গ্রীবা বাঁকায়। একপল চঞ্চল রমণীর ছুটে চলা দেখে গোমড়া মুখে আওড়াল,
” নির্দয় রমণী। আমার ষোলোটা বাচ্চা তোমার কপালে উঠে নাচবে। অভিশাপ দিলাম! ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০