অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি আজ বেশ সকাল সকাল ভার্সিটিতে চলে এসেছে। এসেই মারিয়ার সাথে বসে গল্প করছে। আজ তাদের সেরকম কোন ক্লাস নেই। মূলত খুব শীঘ্রই তাদের ভার্সিটিতে বসন্ত বরণ উৎসব হতে চলেছে। সেখানকার প্রস্তুতি নিয়েই আলাপ হচ্ছে। মারিয়া আরুশির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”শোন আরু,আমি একটা কথা ভাবছি। এই বসন্তবরণ উৎসবে তুই আর আমি দুজনেই ম্যাচিং শাড়ি পড়বো, কেমন?”
কথাটা শোনামাত্রই আরুশি বলে ওঠে,”শাড়ি আর আমি! নো ওয়ে! আমি সালোয়ারেই ঠিক আছি।”
মারিয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,”তুই এমন বললে আমি শুনবো না৷ তোকে শাড়ি পড়তেই হবে নাহলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করব।”
আরুশি আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় রাজীব এসে বলে,”কি নিয়ে কথা হচ্ছে?”
রাজীবকে দেখেই মারিয়া খুশি হয়ে যায়। মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে তার পছন্দের শ্যামপুরুষকে। অতঃপর হাসিমাখা মুখে বলে,”আরে দেখুন না ভাইয়া,আমি আরুকে বলছি এই বসন্ত উৎসবে শাড়ি পড়তে কিন্তু ও রাজিই হচ্ছে না।”
রাজীব কথাটা শোনামাত্রই আরুশিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ঠিকই তো বলছে মারিয়া। শাড়ি পড়লে তোমায় অনেক সুন্দর লাগবে।”
রাজীব মারিয়ার কথা সমর্থন করায় মারিয়া অনেক খুশি হয়। অতঃপর বলে,”আর ভাইয়া আমায় কেমন লাগবে?”
“তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগবে।”
এবার মারিয়া ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,”আচ্ছা, আমি একটু যাই দেখে আসি অনুষ্ঠান নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নিলো ম্যানেজিং কমিটি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই সে সামনে যায়। মারিয়া যেতেই আরুশি রাজীবকে বলে,”ওহ ভাইয়া, আপনাকে ধন্যবাদ কালকে সঠিক সময় আমাকে পল্টনে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আসলে কাল এত তাড়ার মধ্যে ছিলাম যে..”
রাজীব স্মিত হেসে বলে,”কোন ব্যাপার না। আমি বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপারটা।”
তারা কথাই বলছিল আর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আরহাম রাগী চোখে তাদেরকেই দেখছিল। আরহামের সাথে থাকা সাগর ব্যাপারটা খেয়াল করে বলে,”কি ব্যাপার আরহাম? তোকে এমন লাগছে কেন?”
“দেখেছিস এই মেয়েটাকে? আমার নামে বাড়িতে অভিযোগ করে, নিজে এমন সাধু সেজে থাকে যেন দেখে মনে হয়, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না আর এখানে একটা সিনিয়রের সাথে কিভাবে হেসে হেসে গল্প করছে।”
“হ্যাঁ, তো এসে অসুবিধা কি? করতেই পারে। এটা তো স্বাভাবিক। তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?”
আরহাম বলে,”আমি মোটেই রেগে যাইনি। আমি তো শুধু বলছিলাম..যাইহোক ওদিকটায় চল৷ দেখি বসন্ত উৎসব নিয়ে কি এনাউন্সমেন্ট করে।”
সবাই মিলে একটা যায়গায় জড়ো হয়। সেখানে ভার্সিটির সাংস্কৃতিক পরিষদের কিছু সদস্য ও সিনিয়র কিছু শিক্ষার্থী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইয়াসমিন নামক এক সিনিয়র শিক্ষার্থী বলে ওঠে,”তোমরা সবাই জানো,আমাদের ভার্সিটিতে প্রতিবছরই ধুমধাম করে বসন্তবরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়৷ এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারের বসন্তবরণ উৎসবের জন্য আমরা একটা থিম সিলেক্ট করেছি। তোমাদের মধ্যে থেকে ১০ জনকে বেছে নেয়া হবে ৫ জন ছেলে আর ৫ জন মেয়ে। অতঃপর তোমাদের একসাথে কাপল ডান্স করতে হবে “বসন্ত এসে গেছে” গানে।”
কথাটা শোনামাত্রই সবাই ভীষণ আনন্দিত হয় এবং হাততালি দেয়৷ একটু পর ইয়াসমিন আবারো বলে ওঠে,”আমরা পাঁচটি জুটিও সিলেক্ট করে নিয়েছি আর তারা হলো…”
একে একে চারটা জুটির নাম বলে ইয়াসমিন শেষে বলে ওঠে,”আর সর্বশেষ হলো আরুশি খন্দকার এবং রাজীব চৌধুরী।”
কথাটা শোনামাত্রই রাজীবের মুখে হাসি ফুটে ওঠে কিন্তু আরুশির মুখ চুপসে যায়৷ আরুশি অবাক স্বরে বলে,”আমি! তাও রাজীব ভাইয়ের সাথে।”
এদিকে মারিয়ার মুখও শুকনো হয়ে যায়। সে ভেবেছিল যদি রাজীবের সাথে তার নাম আসত কতই না ভালো হতো কিন্তু নাম এলো তার প্রিয় বান্ধবীর।
ইয়াসমিন রাজীবের দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করে। রাজীব ইয়াসমিনকে ধন্যবাদ জানায় ইশারা করেই। কেননা সে-ই বলেছিল এই ব্যবস্থা করে দিতে। আরুশি বলে ওঠে,”আমি তো ভালো ডান্স করতে পারি না। আমি কিভাবে..”
রাজীব আরুশির দিকে এগিয়ে এসে বলে,”মিথ্যা কেন বলছ আরু? মারিয়া আমায় বলেছে স্কুল-কলেজে থাকতে তুমি কত নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়েছ। আর আমাকে তো অনেক ভিডিও দেখিয়েছে তোমার নাচের। আমি নিশ্চিত তুমি পারবে। কি তাই না মারিয়া?”
মারিয়া জোরপূর্বক হেসে বলে,”হ্যাঁ..আরু তুই রাজি হয়ে যা। তুই ভালোই পারবি নাচতে।”
আরুশি বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। এদিকে আরুশির সাথে রাজীব একসাথে নাচবে এই কথাটা ভেবেই আরহামের রাগ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
ইয়াসমিন বলে ওঠে,”তোমাদের যাদের নাম নেয়া হয়েছে তারা জলদি অডিটোরিয়ামে চলে আসো। হাতে বেশি সময় নেই, আমাদের এখন থেকেই সব আয়োজন সেড়ে নিতে হবে।”
রাজীব আরুশিকে যেতে ইশারা করে। আরুশি একবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে যেতে থাকে।
অডিটোরিয়ামে সবাই একে একে ডান্স প্রাকটিস করছিল। এবার রাজীব ও আরুশির পালা আসে। আরুশি ভীষণ নার্ভাস ছিল৷ রাজীব আরুশির কাধে হাত রেখে বলে,”বিশ্বাস রাখো, তুমি এটা পারবে।”
অতঃপর দুজনে মঞ্চে উঠে যায়। আরুশি প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল৷ কিন্তু রাজীব তাকে এপ্রোচ করে যার ফলে সে স্বাভাবিক হয় এবং রাজীবের তালে তাল মিলিয়ে অনেক সুন্দরভাবে নাচতে থাকে। মারিয়া এই দৃশ্য দেখে কেন জানি একদম সহ্য করতে পারে না। ভীষণ ঈর্ষা হয় তার। শুয়ে মারিয়া একা না আরো একজনের বুকে আগুন লেগে যায় এই দৃশ্য দেখে। আরহাম নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পাশে থাকা দেয়ালে ঘুষি দেয়। আর বলে,”এই মেয়ে কি ভেবেছে কি নিজেকে? আমাকে কখনোই পাত্তা দেয়না আর এই ছেলের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে..নাহ,একে একটা শিক্ষা দিতেই হবে।”
নাচ শেষ হতেই সবাই আরুশির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাজীব বলে,”তুমি অনেক ভালো করেছ আরু।”
আরুশি সামান্য হাসে। অতঃপর মারিয়ার দিকে তার নজর যেতেই সে দেখে মারিয়াকে ভীষণ দুঃখী লাগছে। আরুশি মারিয়ার দিকে যেতে নেয় কিন্তু মারিয়া স্থান ত্যাগ করে। আরুশির মারিয়ার পেছন পেছন যেতে নেয়। রাজীব ব্যাপারটা খেয়াল করে ভ্রু কুচকায়। এদিকে আরুশি মারিয়ার পিছু পিছু অডিটোরিয়ামের একটু ভেতরের দিকে যেতেই হঠাৎ করে আরহাম আরুশির হাত ধরে টান দেয়। আরুশি রেগে বলে,”হোয়াট দা হেল..”
“হেল? ঐ রাজীবের সাথে নেচে অনেক আনন্দ পেয়েছ তাইনা? এবার আরো আনন্দ উপভোগ করো।”
বলেই আরহাম আরুশিকে অডিটোরিয়ামের একটি অন্ধকার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আরুশি ভেতর থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে,”প্লিজ দরজা খুলুন..আমার ভীষণ ভয় করছে।”
কিন্তু আরহাম এত বেশি রেগেছিল যে ওকে এভাবেই রেখে চলে যায়। এদিকে আরুশির অন্ধকারে ট্রমা ছিল কারণ ছোটবেলায় জাঈদের এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে অপহরণ করে এভাবেই অন্ধকারে বন্দি করে রেখেছিল। ব্যাপারটা মনে আসতেই আরুশির প্যানিক এট্যাক হতে থাকে।
এদিকে রাজীব আরুশিকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ অডিটোরিয়ামের ভেতরে চলে আসে আর মারিয়ার মুখোমুখি হয়। মারিয়াকে দেখেই বলে,”তুমি এখানে! আরু কোথায়?”
“আরু তো মঞ্চের ওখানেই ছিল।”
“নাহ, ও তো তোমার পেছনে এসেছিল।”
“আমার পেছনে?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩
রাজীব ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। বলে ওঠে,”আরু কোথায় চলে গেল, আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”
“এখানেই কোথাও হয়তো আছে, চলুন একসাথে খুঁজি।”
এমন সময় হঠাৎ একটা ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে রাজীব সেদিকে ছুটে যায়। মারিয়াও তার পিছু পিছু যায়। ঘরের দরজা খুলতেই রাজীব দেখতে পায় আরুশি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে ছুটে গিয়ে আরুশিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আরু? চোখ খোলো আরু। কি হয়েছে তোমার? প্লিজ চোখ খোলো। আই লাভ ইউ, আরু। তোমার কিছু হতে পারে না।”
কথাগুলো শুনে মারিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। তার যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ তার ভালোবাসার মানুষ কিনা তারই প্রিয় বান্ধবীকে ভালোবাসে!