আবার বসন্ত পর্ব ১০

আবার বসন্ত পর্ব ১০
ঝিলিক মল্লিক

“আমাকে অবলা মনে হয় মেজর? দয়া দেখাচ্ছেন? এমন দয়া আমার চাই না। কখনোই চাইনি। যদি তাই-ই হতো, তবে ওই এশরাককে বিয়ে করতে কোনোপ্রকার দ্বিরুক্তি করতাম না। আর না তো এই পর্যন্ত আসতে হতো আমার। স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমাকে দয়া দেখানোর চেষ্টা করবেন না। আমার আত্মসম্মানে আ’ঘাত লাগলে আমি সেখানে এক মুহূর্তও থাকি না। আপনার সৌভাগ্য, এখনো আমি এখানে বসে আছি। লাড্ডুর সামনে কোনোরকম সিনক্রিয়েট হোক, তা চাইছি না। পথ ছাড়ুন আমার, বাসায় যাবো।”
কাজী অফিসের ভেতরের কক্ষে দাঁড়িয়ে রুবায়েতের সামনে আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বলছিল তাজরীন। রুবায়েত ওর কথা শোনার সাথে সাথে ওর পেছনের সোফায় লাড্ডুকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাজরীনকে অনুরোধ করলো,

“আস্তে কথা বলো প্লিজ। লাড্ডু শুনবে।”
তাজরীন এবার চুপ হয়ে গিয়ে সোফায় বসে পরলো ধপ করে। কাজী সাহেব একটা কাজে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছেন। রুবায়েত অনেকটা জোরাজুরি করেই তাজরীনকে ভেতরে এনেছে। ও তো ভেতরে আসতেই চাইছিল না। রিক্সায় বসেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল। কাজী অফিসের সামনে রিক্সা থামতেই রুবায়েত ওকে রাস্তাঘাটে হাঙ্গামা না করার অনুরোধ করে ভেতরে নিয়ে এলো। কাজী সাহেব বেরিয়ে যেতেই তাজরীন আবারও ঝামেলা শুরু করেছে।
রুবায়েত পায়চারি করছিল। তাজরীন ওর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো, “এভাবে হয় না রুবায়েত। জীবনটা ছেলেখেলা নয়। অন্তত আমার জীবন নিয়ে আমি কাউকে ছেলেখেলা করতে দেবো না।”
কথাটা কানে বিঁধে আসা মাত্র রুবায়েত এগিয়ে গিয়ে তাজরীনের সামনে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললো,
“পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে থাকো প্লিজ। আমার একটা স্টেপের পরে তোমার যদি যেতে মন চায়, তখন আটকাবো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুবায়েত দ্রুত অফিস ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সেখানে গিয়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফোন বের করে রুস্তমের নাম্বার ডায়াল করলো। কল রিসিভ হলো দু’বার রিং বাজার পরে। রুবায়েত সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, “রুস্তম, কোথায় তুই?”
“বাসায় আছি। কেন?”
“কী করছিস?”
“খেতে বসেছি। কোনো দরকার রুবায়েত?”
“খাওয়া ছেড়ে বেসিনে গিয়ে হাতটা ধুয়ে বেরিয়ে পড়। পাঁচ মিনিটে আমাদের এখানকার কাজী অফিসে আয়।”
“কেন?”
রুস্তম খাওয়া ছেড়ে উঠতে উঠতেই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। রুবায়েত ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলো,
“ইট’স ইমার্জেন্সি। আয়, তারপর বলছি।”

তাজরীন ঘড়ি দেখছে বারবার। এতো কী কথা বলছে তার ভাই আর রুবায়েত! ভেবে পাচ্ছে না তাজরীন। এতো নাটক-তামাশা খাঁড়া করার কোনো দরকার ছিল না। ভালোভাবে মেনে নিয়ে তাজরীনকে যেতে দিলেই হয়ে যেতো। তাজরীন আরো একবার যাওয়ার জন্য হাঙ্গামাও লাগিয়েছিল। কিন্তু রুবায়েত অনেক অনুরোধ করে ওকে বসিয়ে দিয়েছে।
রুস্তম আর রুবায়েত গিয়েছিল পাশের কক্ষে। ফিরলো মাত্র। দু’জনের মুখের হাবভাব স্বাভাবিক। তাজরীন তা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তার ভাইয়ের এখানে আসাটা অপ্রত্যাশিত ছিল। তারওপর আলাদাভাবে রুবায়েতর সাথে আলাপ করা। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা মোটেও সুবিধাজনক নয়। এ কোন গ্যারাকলে ফেঁসে গেল?
রুবায়েত তিতানকে কোলে তুলে নিয়ে সরে দাঁড়ালো। রুস্তম ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার ছোট বোনের দিকে। সোফায় বোনের পাশে বসে পরলো। রুবায়েত অগোচরে ইশারা করতেই রুস্তম বোনের হাত দু’টো হঠাৎ জড়িয়ে ধরে আকুতিভরা স্বরে বললো,

“এখানে আমি রুবায়েতের অনুরোধে এসেছি তাজ। জানতাম না, তুই এখানে আছিস। আম্মা বলছিল ভিন্ন কথা। সে যাইহোক, রুবায়েতের সাথে আমার কথা হয়েছে। পুরো ঘটনা শুনেছি। তুই তো আমাকে কখনো একটিবারও মুখ ফুটে বলিসনি এশরাকের এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে। আমার বোনকে অপমান করা! পিঠের ছাল-চামড়া তুলে ফেলতাম ওর। আচ্ছা তাজ, একটা কথা বল তো?”
তাজরীন বুঝতে পারছে, তার ভাইয়ের মতিগতি। তাই ভ্রু কুঞ্চিত রেখেই জিজ্ঞাসা করলো,
“কী?”
“তোকে আমরা কখনো অবহেলা করেছি?”
“না?”
“তোকে কোনোদিন বুঝতে দিয়েছি তোর ত্রুটি?”
“না তো।”
“তাহলে তোকে আমরা সবাই ভালোবাসি কিনা বল?”
“হ্যাঁ বাসো।”

“এটাই। তোকে আমরা সবাই ভালোবাসি। কেউ কখনো তোকে অনাদর, অবহেলা করেনি। কিন্তু সোনা, জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে আমাদের প্রত্যেকের-ই মোড় নিতে হয়৷ তোকে আমি কখনো বিয়ের জন্য জোরাজুরি করিনি। কিন্তু সবসময় মনেপ্রাণে দোয়া করেছি, তোর একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হোক। তোর অতীত কলুষিত ছিল না কখনো। তোর বিয়ে ভেঙেছিল— এটাও তোর দোষ ছিল না। বরং, তাদের নোংরা মানসিকতার নিদর্শন। তুই বন্ধ্যা — এটাও তোর দোষ না। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত- এটাকে হেয় করা উচিত না। এশরাক তোকে কটুকথা শোনায়, অপমান করে, তোর দোষে না। ওর মানসিক সমস্যার কারণে। এসবকিছুর জন্য তুই নিজেকে দোষারোপ করবি না, বা যারা সত্যিই তোর ভালো করতে চায়; তাদের কর্মটাকে দয়া বা সহমর্মিতা দেখাচ্ছে— এমন ভাবনায় নেওয়াও ঠিক না।”
তাজরীন এবার মুখ তুলে তাকায় বড়ভাইয়ের দিকে। এতোক্ষণে বুঝতে পারে, ওকে ঠিক কি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রুস্তম আবারও বলতে থাকে,

“এসব আবেগের কথায় না গিয়ে বরং বাস্তবিক কথায় আসি— রুবায়েত তোকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করছে না তাজ। বরং, তোর সম্মান রক্ষার্থে এবং তোকে ভালোবেসেই বিয়েটা করছে। ওর-ও তোকে পছন্দ, এজন্যই বিয়ে করছে। তোর অপমান নিতে পারেনি ও। আর কত সহ্য করা যায় বল? পছন্দের মানুষের অপমান কেউ-ই সহ্য করতে পারে না। তাই এই বিয়ের সিদ্ধান্ত। আমিও প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু, রুবায়েতের দিকটা ক্লিয়ার হওয়ার পর-ই সবদিক বিবেচনা করে রাজি হয়েছি।”
ভালোবাসার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তাজরীন। এবার জোরেশোরে বললো,

“আমাকে তোমরা কী পেয়েছো ভাইয়া? সারাজীবন অন্যের নির্দেশনায় চলতে হবে আমাকে? নিজের মর্জিমতো কিছু করতে পারবো না? যখন খুশি ধরে বিয়ে দিচ্ছো, যা ইচ্ছা করছো আমাকে নিয়ে। আমাকে যাতে কেউ দয়া না দেখাতে পারে— এজন্য বিশ বছর বয়স থেকে সবার কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেছি। নিজের একটা প্রাণখোলা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। কখনো দেখেছো, নিজ ইচ্ছায় তোমাদের কাছে এসেছি? আসিনি, কারণ আমি চাইনি আমার জন্য তোমাদের ভোগান্তি পোহাতে হোক। তোমাদের কাছ থেকে নিজের ভরণপোষণের কানাকড়ি অর্থ কখনো চাইনি, তোমরা যেচে দিয়েছো, তবু না করেছি। নিজে টিউশনি করে পড়াশোনা করছি, ক্যারিয়ার গোছানোর চেষ্টা করছি। এরমধ্যে আমার একটা অন্যতম ভুল ছিল, আমি নিজের অবস্থান ভুলে অযোগ্য মানুষদের মন দিতে শুরু করেছিলাম।”

শেষোক্ত কথাটা তাজরীন গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা রুবায়েতের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে বললো। রুস্তম এবার যারপরনাই অস্থির হয়ে বললো,
“রাগে না বোন আমার। জানি, তোর মনে অনেক কষ্ট। রুবায়েতকে আমি অনেকদিন যাবত চিনি। আমাকে বিশ্বাস কর, ও যখন বলেছে; তখন অবশ্যই তোকে বিনা স্বার্থে-ই বিয়ে করছে। তোর সব কষ্ট দূর করে দেবে দেখিস। এই যুগে, এমন পরিস্থিতিতে রুবায়েতের মতো ছেলে তুই আর পাবি না। কখনো তো তোর কাছে কোনোকিছু চাইনি। আজ একটা অনুরোধ করি, রুবায়েতকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা। আজ এখানে, এখুনি কাজী সাহেবের তদারকিতে শরীয়াহ মোতাবেক বিয়ে পড়ানো হোক। তারপর না-হয় আমরা বড় পরিসরে ব্যবস্থা করবো।”
রুস্তম কথাগুলো এমনভাবে বললো, যে তাজরীন আর একটা কথা বলারও শক্তি পেল না। শুধু বিরবির করলো, “ভুল করছো ভাইয়া। তোমরা সবাই মিলে আমার ভালো করতে গিয়ে আমাকে অকূল সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে চাইছো অজান্তে।”

রুবায়েতের ইশারায় রুস্তম সোফা ছেড়ে উঠে এলো। রুবায়েতের কোল থেকে লাড্ডুকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। রুবায়েত এগিয়ে এসে তাজরীনের সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললো,
“ভাইয়ের কথা মেনে নাও তাজ। সহজ বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো।”
তাজরীন কিঞ্চিৎ চেঁচিয়ে উঠে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,
“সহজ বিষয়? সেদিন আপনার অপমান করে বলা একটা শব্দও ভুলিনি আমি। আপনি আমাকে কাঁদিয়েছেন। আমাকে হৃদয় ভাঙার প্রতিদানে আপনাকে আমার কী ফিরিয়ে দেওয়া উচিত? অবজ্ঞা, ঘৃণা——রাইট? সেখানে আমার আপনাকে বিয়ে করতে হবে! সৎ মা কোনোদিন আপন হতে পারে না। আমাকে বিয়ে করলে আপনার আর লাড্ডুর জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। ছাড়ুন না রুবায়েত! কী দরকার যেচে নিজেদের ফ্যামিলিকে বরবাদ করার? এখন আপনার সমাজ ছিঃ ছিঃ করবে না? এখন আমার মান-সম্মান যাবে না? এক বাচ্চার বাপ আপনি৷ তারওপর বিয়ে করতে চাইছেন আরেকজন বাচ্চা স্বভাবের হাঁটুর বয়সী মেয়েকে। এ-তো ভারী লজ্জার কথা!”
তাজরীনের ব্যাঙ্গাত্মক কথায় রুবায়েত ভ্রু বাঁকিয়ে হাত উঠিয়ে বললো,

“শান্ত হও তাজ। চেঁচামেচি কোরো না। তুমি রাজি না হলে এই বিয়ে হবে না। তবে শুনে রাখো একটা কথা, সেদিন আমাকে এশরাক কল দিয়ে অনেক কথা বলেছিল। তোমাকে নিয়ে এবং আমার ফ্যামিলি তুলে অনেক বাজে কথা বলেছিল। এজন্য আমার মেজাজ খারাপ ছিল। তারওপর তোমার হুটহাট এমন সরাসরি কথাবার্তা— সবকিছু মিলিয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তাই রাগের মাথায় অনেক কথা বলে ফেলেছি। তবে, তোমাকে কাঁদানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। ভালোবাসার মানুষের কান্না কারো-ই সহ্য হয় না। তোমাকে ভালোবাসি আমি। এই সহজ বিষয়টা বোঝো।”

রুবায়েতের চোখে আকুতিভরা। মুখের ভাব অনেকটা অস্থির। ভালোবাসার কথা শুনে তাজরীন একটানা রুবায়েতের মুখে দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলো। তারপর বললো, “আপনার মতো পাষাণ হৃদয়ের মানুষের মুখে এসব কথা মানায় না মেজর। ভাববেন না, আমি গলে যাব। অপমান কখনো ভোলা যায় না। ইমম্যাচিউর হতে পারি, কিন্তু যথেষ্ট আত্মসম্মান আছে। আপনার জন্য খুইয়েছি, আবার গড়েও নিচ্ছি।”
রুবায়েত এবার তাজরীনের পায়ের কাছে ধপ করে বসে পরলো। ওর হাতদুটো টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“মাফ চাইছি আমি। তুমি আমার ছেলের যোগ্য মা হতে পারবে— একথা আমি স্বীকার করি। মানুষ তো খু’নের দায়েও মাফ পেয়ে যায়। অনেকতো সাজা দিয়েছো। এবার একটু না-হয় দয়া করো।”

তাজরীন এবার থতমত খেয়ে গেল। রুবায়েত যে এমন একটা কাজ করে বসবে, তা বুঝতে পারেনি। ইতিমধ্যে কাজী সাহেব চলে এসেছেন। তিনি এসে দেখলেন, পরিবেশ স্বাভাবিক। হবু স্বামী-স্ত্রী দু’জন বসে আলাপ করছে। কনে সোফায় আর পাত্র ফ্লোরে হাত ধরে বসে আছে নিজের হবু স্ত্রী-র। রুবায়েত কাজী সাহেবকে দেখে তাজরীনকে চোখের ইশারায় আর কোনো ঝামেলা না করতে অনুরোধ করলো। তাজরীন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ওর হাত ধরে টেনে অফিস রুমে নিয়ে এলো রুবায়েত। রুস্তম এবং আরো একজনের উপস্থিতিতে কাজী সাহেব রুবায়েত এবং তাজরীনের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। তাজরীন তাগাদায় কবুল বলার পরেই রুবায়েত লাড্ডুকে কোলে নিয়েই কবুল বললে। দেনমোহর ধার্য করা হলো এক লাখ এক টাকা। তাজরীন ঘটনার পরিক্রমায় এখনো বেচঈন হয়ে আছে। বারবার বড়ভাইয়ের দিকে তাকাতে লাগলো ও। পুরোটা রাস্তা চুপচাপ ছিল। কোয়ার্টার পর্যন্ত আসার পরে রুস্তম তাজরীনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“এখন তোমার আগে নিজের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া উচিত। আমি আম্মা’কে ম্যানেজ করে আগে বাসার পরিবেশ ঠান্ডা করি। তারপর নিজে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।”
তাজরীন টলটলে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। কিন্তু ওর ভাই বুকে কষ্ট চেপে রেখে কঠিন হয়ে একা-ই চলে গেল নিজেদের ফ্ল্যাটে। রুবায়েত তাজরীনের হাত ধরে ওকে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো।

আয়েশা খানম অপেক্ষা করছিলেন ছেলে ও নাতির জন্য। দেরি হচ্ছিল বিঁধেয় দুশ্চিন্তা করছিলেন তিনি। কলিংবেল বাজা মাত্র দ্রুত এগিয়ে এসে দরজা খুলে সামনের দৃশ্য দেখে মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে রইলেন। কিছু বুঝছেন না তিনি। রুবায়েত জুতা খুলে তাজরীনের হাত ধরে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে টুপি, ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো, “আম্মা খাবার দাও৷ একটা প্লেট এক্সট্রা রেখো, তোমার বৌমার জন্য।”
“বৌমা মানে?”
এগিয়ে গিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করলেন আয়েশা খানম। রুবায়েত একবার ঘরের এককোণে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে থাকা তাজরীনকে দেখে বললো,
“তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে এনেছি। নতুন বউয়ের খাতির-যত্ন করো। বিয়ে করাকরির চক্করে প্রচন্ড খিদে পেয়ে গেছে। কী বাপ? খিদে পেয়েছে না?”

পাশে চুপচাপ বসে তাজরীনকে দেখে বোঝার চেষ্টা করতে ব্যস্ত লাড্ডুকে প্রশ্নটা করলো রুবায়েত। লাড্ডু চটপটে ভাবে জবাব দিলো,
“হু পাপা। ও প্পা, তাজ বাবুউও আমাদেল থাতে কাবে না?”
“হ্যাঁ সোনা। তবে তাজ বাবুউ নয়, তাজ মামনি বলবে।”
“তাজ মামুনি?”
“হ্যাঁ।”
লাড্ডু খুশি হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দৌড়ে তাজরীনের কাছে গিয়ে ওর পায়ের ঊরূ জড়িয়ে ধরে বললো,
“তাজ মামুনি তোমি কী আচকি তেকে আমাদেল থাতে তাকবা?”
তাজরীন কোনো জবাব না দিয়ে সামান্য হাসার চেষ্টা করে তিতানকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এদিকে আয়েশা খানম রুবায়েতের দিকে তাকাতেই রুবায়েত নিচু স্বরে বললো,
“তোমাকে পরে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো আম্মা। এখন খেতে দাও।”
আয়েশা খানম ডাইনিং টেবিলে সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তাজরীন এগোচ্ছে দেখে জোর করে টেনে এনে খেতে বসালেন। মুখে ইচ্ছাকৃত একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব থাকলেও মনে মনে ভীষণ খুশি তিনি। তবে সেটা এই মুহূর্তে প্রকাশ করছেন না। পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলছেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা।
রুবায়েত ঘরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, ফোন স্ক্রলিং করে তারপর তাজরীনকে বসিয়ে রেখে লাড্ডুকে নিয়ে গিয়েছে পাশের ঘরে। তাজরীন নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। তাকে এখন থেকে এখানেই থাকতে হবে। যা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি, সেই সবকিছু আজ হয়েছে তার সাথে। রুবায়েতের ওপর থেকে রাগটা এখনো পরেনি তাজরীনের। তবে রুবায়েত স্বীকার করেছে, ক্ষমা চেয়েছে তাজরীনের কাছে। এটুকু না করলে তাজরীন আরো ঝামেলা করতো। কিন্তু ঝামেলার কারণে সত্যিটা যে এভাবে বেরিয়ে আসবে, তা ভাবতে পারেনি। রুবায়েত ওকে সত্যিই ভালোবাসে! হৃদয়ে আরো একবার ক্ষত সেরে উঠতে চাইলো তাজরীনের। ঠিক সেই মুহূর্তেই রুবায়েতের ফোনটা চোখে পরলো ওর মেসেজ টিউনের শব্দে। তাজরীন এগিয়ে গেল৷ টিভি কেবিনেটের ওপর ফোন রাখা। তাজরীন এগিয়ে গেল অজানা এক আকর্ষণে। দেখলো, রুবায়েতের ফোন স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে। ওপরে নোটিফিকেশন ভেসে উঠেছে একটা। সেখানে হোয়াটসঅ্যাপের একটা মেসেজ দেখা যাচ্ছে। “দোস্ত” সম্বোধনে সেভ করা নাম্বারটা থেকে মেসেজটা সামান্য চোখে পরলো তাজরীনের। সেখানে লেখা— “তাজরীন যদি জানতে পারে কোনোভাবে, তখন কী হ. . .”

এরপর আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। তাজরীন ফোনটা হাতে নিয়ে টাচ করতেই বুঝতে পারলো, আনলক করা। ডাবল ট্যাপ বা সুইচ বাটনে চাপ দিয়ে হয়তো অফ করে যেতে ভুলে গেছে রুবায়েত। সেটিংস হতে এমন সিস্টেম করা। এটাকে নিজের সৌভাগ্য ধরে নিলো তাজরীন। কারণ, ওকে এখন এই কনভারসেশন যেকোনোভাবে হোক পড়তে হবে। যেহেতু ওর সম্বন্ধে কথা হচ্ছে, তা-ও আবার বন্ধুর সাথে! তাহলে নিশ্চয়ই রুবায়েত তাজরীনের প্রতি নিজের মনের গোপন অনুভূতি শেয়ার করেছে বন্ধুর সাথে। এই ভেবে উচ্ছ্বসিত হলো তাজরীন। দ্রুত হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে শুরুতেই কনভারসেশনটা চোখে পরলো ওর। ভেতরে যেয়ে নিচের মেসেজগুলো না দেখে সোজা ওপরে একটা টান মারলো। স্ক্রল করতেই ওপরের মেসেজগুলো চোখে পরলো। তাড়াহুড়োয় তাজরীন ওপর থেকে পরতে লাগলো। রুবায়েত তার বন্ধুকে এশরাকের নাম-ফোন নাম্বার দিয়ে ওর কল ডিটেইলসসহ, সব ধরনের ডিটেইলস এবং ওর চলাফেরার সকল খবর চেয়েছে মেসেজ করে। বন্ধুটিও আন্তরিকভাবে সাহায্যের কথা বলেছে। তাজরীন সেসব নিয়ে মাথা ঘামালো না। একেবারে নিচের দিকে এসে কিছু মেসেজ চোখে পরলো ওর। যেখানে রুবায়েতের বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছে,

“তুই মেয়েটাকে কোন বিশেষ কারণে বিয়ে করেছিস? শুধুমাত্র সম্মান রক্ষার্থে? নাকি ভালোবেসে?”
রুবায়েত সেখানে জবাবে লিখেছে,
“আরেহ না। ভালোবাসাবাসির প্রশ্ন আসছে কেন? ভালোবাসা আর আমি? নতুন করে এসব আমার দ্বারা সম্ভব না ভাই। শুধুমাত্র সম্মান রক্ষা এবং ওই এশরাক নামক ছেলেটাকে জব্দ করার জন্য তাজরীনকে বিয়ে করেছি আমি। এর বেশি কিছু নয়। যদিও ও এসব কথা জানে না। ওকে রাজি করাতে অনেক মিথ্যা বলতে হয়েছে, যা আমি এ জীবনে কখনো বলিনি।”
“তারমানে এটাকে দয়া দেখানো ধরে নেবো?”

বন্ধুর প্রশ্নে রুবায়েত জবাব দিয়েছে, “এজ ইওর উইশ। তবে ওকে নিয়ে সংসার করা হবে। ওর একটা ফ্যামিলির দরকার ছিল। হয়ে গেছে। ব্যস, এটুকুই। ও এখানে সম্মানের সহিত সারাজীবন থাকতে পারবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ভালোবাসতে আমি পারবো না। এটা আমার ব্যর্থতা।”
এরপরে-ই বন্ধুর লাস্ট মেসেজ, যেটা মাত্র এসেছে— “তাজরীন যদি জানতে পারে কোনোভাবে, তখন কী হবে ভেবে দেখেছিস?”

তাজরীনের নিঃশ্বাস আঁটকে রইলো কিছু সময়ের জন্য। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো ওর। এতোবড় ধোঁকা! এমন মিথ্যাচার! সেই তো দয়া দেখানো হলো। যেই দয়া থেকে তাজরীন বাঁচতে চাইছিল, পালিয়ে বেড়াচ্ছিল; সেই দয়া-ই ওকে ওর অজান্তে করা হলো! আবারও তাজরীন বোকা বনে গেল; প্রতারিত হলো। সবথেকে বড় কথা, রুবায়েতের প্রস্তাব দেওয়া, ক্ষমা চাওয়া, ভালোবাসার কথা বলা, আকুতিভরা কন্ঠে অনুরোধ করা, ওর সামনে ফ্লোরে প্রেমিকের মতো বসে ওকে প্রেমিকার বেশে ট্রিট করা—— এই সবটা মিথ্যা! পুরোটা অভিনয়!

আবার বসন্ত পর্ব ৯

তাজরীন পেছাতে পেছাতে বিছানার ওপর গিয়ে বসে পরলো ধপ করে। ধাক্কা খেয়েছে ও। চরম ধাক্কা। একটা বালিশ টেনে এনে তাতে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে অনবরত চোখের জল ফেলতে লাগলো, মাঝেমধ্যে হিচকি উঠতে লাগলো। তাজরীন আরো একবার ভেবে নিল— তাকে শুধু এই পৃথিবীতে দয়া-ই দেখানো হয়!

আবার বসন্ত পর্ব ১১