প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১৭
Drm Shohag
ইরফান সেলুন থেকে চুল কেটে ফিরেছে। ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে। চোখ ঘুরিয়ে খুঁজছে মাইরাকে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে সেদিকে পা বাড়ায়। পায়ের গতি দ্রুত।
রান্নাঘরে মাইরা উল্টোদিক হয়ে ইরফানের ফুপির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত, যদিও একটু পর পর পিছন ফিরে দেখছে৷ তার কথা হলো ফুপির সামনে ওই লোক কিছু করবে না। ইরফানের ফুপি রান্নাঘরের দরজার দিকে চেয়ে বসে তরকারি কাটছে আর মাইরার সাথে টুকটাক কথা বলছে। সামনে চোখ পড়লে মাথা উঁচু করে তাকায় ইরফানের ফুপি। ভদ্রমহিলা কিছু বলতে চাইছিলেন, ই উচ্চারণ করে আর এগোতে পারেনি ইরফানের চুলের অবস্থা দেখে। ইরফান নিজে চুল কাটবে এটা অসম্ভব। এই নিয়ে ইরফানের মায়ের সাথে কত কথা কাটাকাটি হয়েছে। কিন্তুু ইরফান সে তার মতোই। কারো কথা শুনবে না। তার যা মনে হবে সেটাই। তাকে হঠাৎ এভাবে দেখে ভদ্রমহিলা ভূত দেখার মতো চমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মাইরা ইরফানের ফুপির এমন অবাক হওয়া দৃষ্টিজোড়া দেখে নিজেও অবাক হয়। কি তার পিছনে? সে নিজেও পিছন ফেরার আগেই কেউ তাকে ঝট করে কোলে তুলে নিল। মাইরা চিৎকার দেয়। ইরফান গটগট পায়ে তার ঘরের দিকে যায়। ইরফানের ফুপি বোধয় বুঝেছে কাহিনী। তিনি দ্রুত উঠে পড়লেন। ইরফানের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন,
“ইরফান বাবা, কিছু বলিস না ওকে। না বুঝে করেছে।”
ইরফান কিছু বলল না। তার ঘরে গিয়ে পা দিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। মাইরা ইরফানের কোলেই ছটফটায়। ইরফান মাইরাকে ঠাস করে বিছানায় ফেলে সে হাঁটু মুড়ে বসে। মাইরা ভীত চোখে ইরফানকে দু’হাতে ঠেলে সরাতে চায়, তবে ইরফান মাইরার দু’হাত তার বাম হাতের মুঠোয় নিয়ে পিছনে চেপে রাখে। মাইরার গাল ডান হাতে চেপে রাগান্বিত চেহারায় দাঁতে দাঁতে পিষে বলে,
“কোথায় পেয়েছ এতো সাহস? স্টুপিট, স্পিক আপ।”
মাইরা কেঁপে ওঠে। আড়চোখে একটু তাকায়। অতঃপর চোখ নামিয়ে মিনমিন করে বলে,
“আমি মানুষ বানিয়েছি আপনাকে। এখন দেখুন তো কী সুন্দর লাগছে, আগে আপনার মাথা মিনি আফ্রিকার জঙ্গল লাগতো, বুঝলে….”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরফান মাইরার গাল আরও শক্ত হাতে চেপে ধরে। মাইরা ব্য’থা পায়। মৃদু আর্তনাদ করে। ইরফান সেভাবেই বসা থেকে উঠতে নিলে মাইরা ভয়ে নিজের শরীর ছেড়ে দেয়, ফলস্বরূপ খাটের কোণা থেকে নিচে পড়তে নিলে ইরফান দ্রুত মাইরাকে তার সাথে আগলে নেয়। বিচলিত হয়, মাইরার গালে হাত দিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
“হেই গার্ল, হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
ইরফানের কাল রাতের কথা মনে পড়তেই চোখমুখে কেমন ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। বা হাতে মাইরাকে নিজের সাথে আগলে ধরে ডান পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত কল করে কাউকে।
“কেমন আছেন ইরফান ভাইজান?”
ইরফান বোধয় বিরক্ত হলো। ছোট করে বলে, “ভালো। তোমার বাবাকে পাঠাও। টাইম দু’মিনিট।”
ওপাশ থেকে ছেলেটা বলে,
“আপনি শুদ্ধ ভাইদের বাড়ি এসেছেন?”
ইরফানের ইচ্ছে করল এই ছেলের কানের গোড়ায় কষিয়ে একটা থা’প্প’ড় দিতে। ধমকে বলে,
“না আসলে তোমার বাবাকে কেন আসতে বলছি? তোমার বাবাকে যাস্ট দু’মিনিটে এখানে দেখতে চাই।”
“বাবা তো বাথরুমে গেল। বের হলে বলছি।”
“হোয়াট? এক্ষুনি বের কর তাকে। ইট’স আর্জেন্ট।”
ওপাশে ছেলেটা মাথা চুলকালো। ভাবছে বাথরুম না করেই সে কীভাবে বের করবে তার বাবাকে। গ্রামের একখানা ভালো ডাক্তার তার বাবা। তাই সবাই তার বাবাকে একটু বাথরুম টাও সারতে দেয় না ঠিক করে। ইরফান কোনো সাড়া না পেয়ে গমগমে স্বরে ধমক দিয়ে বলে,
“কথা বলছো না কেন? কোথায় তোমার বাবা?”
এতো জোরে ধমক খেয়ে ওপাশের ১৩ বছরের ছেলেটা লাফ দিয়ে ওঠে। এপাশে ইরফানের বুকে মাথা রাখা মাইরা কেঁপে ওঠে। ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকায়। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ মাইরার পানে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
“তোমার বাবাকে প্রয়োজন নেই।”
“ভাইজান আপনি রাগ করলেন? বাবা বের হলেই….”
ইরফান কল কেটে দেয়। ডান হাতে ফোন মুঠো করে শক্ত করে ধরে। আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলন্ত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। রাগে তার হাতে থাকা ফোন ছুঁড়ে ফেলল। চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। একটু আগেও এতো রাগেনি যতটা এখন রেগেছে। শরীর মৃদু কাঁপছে রাগের চোটে। ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘনঘন শব্দ করে শ্বাস ফেলছে।
মাইরা ঢোক গিলে। এই লোক এমন স্ট্যাচু হয়ে আছে কেন? আজকে শুধু বেঁচে যাক, আর জীবনেও এই লোকের পিছে লাগবে না। এক্টিংও করবে না। কিন্তুু এর কি হলো? তাকে শুইয়ে দিয়ে চলে গেলেই তো হয়। এই লোকটার শরীর এতো গরম। মাইরার গরম লাগছে, আবার কেমন কেমন অনুভূতিও নাড়া দেয়। বারবার ভীতি ঢোক গিলে।
ইরফান হঠাৎ-ই মাইরাকে ঝটকা মেরে তার থেকে দূরে সরিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মাইরার ডান গালে থা’প্প’ড় মারে। মেয়েটা খাট থেকে ঠাস করে পড়ে যায়। বেডসাইড টেবিলের কোণার সাথে কপালের ধাক্কা লাগে।
ইরফান মাইরাকে ঝটকা মেরে মেঝে থেকে তুলে হুংকার ছেড়ে বলে,
“এক্টিং করছিলি আমার সাথে? তোর জন্য আমার ঘাম ছুটিয়ে এক্টর হওয়ার প্রাকটিস করছিলি?”
কথাটা বলে ডান গালেই আগের চেয়েও শক্তি খাঁটিয়ে আরেকটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। মাইরা আবারও উল্টে পড়ে যায় মেঝেতে।
ইরফান জ্বলন্ত চোখে মাইরার পৃষ্ঠদেশের ছড়ানো চুলোগুলোর দিকে চায়। মাইরার পাশের বেডসাইড টেবিলেই জোরেসোরে এক লাথি দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
মাইরার মাথা ঝিমিঝিম করছে। চারদিকে কেমন অন্ধকার দেখছে। মেঝের সাথে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। কিছুই বলে না। ইরফান দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তার ফুপি ঘরের ভেতর আসে। মাইরাকে মেঝেতে এভাবে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন। এরপর মাইরাকে টেনে তুলে মেয়েটার অবস্থা দেখে কেমন আঁতকে ওঠে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ফর্সা গাল মনে হচ্ছে চিঁড়ে গিয়েছে। ইরফানের ফুপি কি বলবেন বুঝলেন না। ইরফান মেয়েটাকে এভাবে মারে না-কি! মাইরা যে বাচ্চামি করে এটা তিনি জানেন। আর ইরফানের রাগ ও জানেন। কিন্তুু এভাবে মারার ব্যাপারে তার মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো। মাইরাকে ধরে ধরে বিছানায় বসালে মাইরা নিজেই এক কোণায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। একটা কথাও বললো না।
শুদ্ধর মা অবাক হয়। মাইরার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“মা, জানিস তো ইরফান রাগী। কেন ওর পিছনে লাগতে গেলি?”
মাইরার চোখ থেকে বাঁধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় বলে,
“আর লাগবো না।”
শুদ্ধর মা মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“একটু উঠে পড়। মলম লাগালে ঠিক হবে। তুই দাঁড়া। আমি শুদ্ধকে আনতে বলছি। ঘরে মনে হয় নেই।”
মাইরা কিছুই বললো না। বাম কাত হয়ে শুয়ে চোখ বুজে রইল। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে। ইরফান প্রায় অনেক দিন হলো একদম মারে না। সে এর মাঝে কত দুষ্টুমি-ই করলো, মারেনি তো। এতোদিন পর হঠাৎ এভাবে মার খেয়ে মেয়েটা ভীষণ ক’ষ্ট পায়। সে ভেবেছিল তার কাজে মাইরা মার খেতে পারে, ওই লোক তো ভালো না। কিন্তুু সত্যি সত্যি মার খাওয়ার পর কেন যেন মানতেই পারছে না। কথাও বলছে না কোনো। একা একাও কথা বলছে না।
শুদ্ধর মা ঘর থেকে বেরিয়ে শুদ্ধর ঘরে যায়। শুদ্ধ ঘর থেকে বেরচ্ছিল। ইরফানের ওমন চিৎকার শুনেই মূলত আসছিল। মাকে দেখে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
“কি হয়েছে মা?”
শুদ্ধর মা মন খারাপের ছাপ লেপ্টে বলে,
“ইরফান মাইরাকে এভাবেই মারে? তুই জানিস কিছু?”
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল,
“আবার মেরেছে?”
“হুম। ওষুধ আর মলম এনে দে। কেটে, ফেটে গিয়েছে পুরো। মাইরাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। ওর কপালে এসব মানা যায় না। ভাইজান আমার কথাও শুনলো না। বিয়েটা তো দিয়ে দিয়েছে। ভাইজান জানতোই মাইরা এরকম, আমি অনেকবার বলেছিলাম মাইরা খুব কথা বলে, আর খুব চঞ্চল। তার ছেলে বিপরীত মেরুর। তবুও শুনলো না।
এখন তো মনে হচ্ছে মেয়েটা মার খেতে খেতেই আধমরা হয়ে যাবে।”
শুদ্ধ শরীরে শার্ট জড়াতে জড়াতে গম্ভীর গলায় বলল,
“এজন্য মামার উপর আমার অনেক রাগ আছে। আমার সামনে এসব বলো না।”
কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দোকানের উদ্দেশ্য।
ইরফান তার গাড়ি হাই স্পিডে চালায়। গ্রামের ধুলোর রাস্তা। এখানে হেঁটে যাওয়ার মতো করে গাড়ি চালাতে হয়, সেখানে ইরফান ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। আশেপাশের মানুষের অবস্থা খা’রা’প। পুরো রাস্তা জুড়ে ধুলোমাখা হয়ে গিয়েছে।
রাস্তা গ্রামের হওয়ায় ছোট বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। ইরফানের গাড়ির স্পিড হাই। আশেপাশের মানুষ ভয় পায়। বাচ্চার মা চিৎকার দেয়। আজ হয়তো তার বাচ্চা শেষ। ইরফান বাচ্চাটাকে খেয়াল করতেই দ্রুত ব্রেক কষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
সব মানুষের যেন জানে পানি এসেছে। বাচ্চাটার মা দ্রুত তার বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়। অনেকজন ছেলে এগিয়ে এসে ইরফানকে বকতে থাকে। ইরফান সেসব কানে নিল না। বিরক্ত হয়ে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানে। এরপর গাড়ি এগিয়ে নিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে শুদ্ধর বাড়ির দিকে ব্যাক করে।
শুদ্ধ ব্য’থার ওষুধ আর মলম সাথে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ এনেছে। দ্রুত পায়ে মাইরার ঘরের দিকে যায়। তার মা ওখানেই আছে। ঘরের ভেতর পা রাখতে নিলে পিছন থেকে ইরফান শুদ্ধর কলার টেনে ধরে। শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে পিছু ফিরে বলে,
“টানছিস কেন? ছাড়। বউ কে মেরে কেটে ফেটে দিস। আমাদের সেবা করা লাগে। কি জামাই তুই, সর, ভাগ।”
কথাগুলো বলে ইরফানের দিকে বড় বড় চোখে তাকায়। ওমা এর চুল এতো সাইজ হলো কীভাবে? হিসাব মিলল মনে হয়। এর জন্যই মাইরা মেয়েটা মার খেয়েছে? শুদ্ধর মাইরার জন্য মায়া লাগলো মার খাওয়ায়, কিন্তুু একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য তো মেয়েটার। কি সাহস ভাবা যায়!
ইরফান রেগে গম্ভীর গলায় বলে,
“বউ আমার, মারব আমি, মলমও লাগাবো আমি। তুই কে?”
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকায় ইরফানের দিকে। একদিনে এতো চেঞ্জ ছেলেটা হজম করতে পারছে না। এটা তো ইরফান-ই। কিন্তুু কথাগুলো এমন অপরিচিত লাগছে কেন?
ইরফান বিরক্ত হয়ে শুদ্ধ কে ঠেলে সরিয়ে দেয়। শুদ্ধ নিজেকে সামলে তার হাতের প্যাকেট ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে থমকানো কণ্ঠে বলে,
“এগুলো নে। নয়তো মলম লাগাবি কিভাবে?”
ইরফান শুদ্ধর হাত থেকে নিয়ে প্যাকেট টা ছুঁড়ে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ওর দিকে…
বলতে গিয়েও থেমে যায়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রেগে বলে,
“ভেতরে যাবি না। এখান থেকে যা।”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইরফানের দিকে। কথাটা বলে ইরফান ঘরের ভেতরে যায়।
শুদ্ধ মাথা চুলকায়। হিসাব তো মিলছে না এখন। কি হচ্ছে এসব? মেঝেতে পড়ে থাকা প্যাকেটটার দিকে তাকালো। এটা ফেলল কেন? ভ্রু জোড়া কোঁচকালো। কিছু ভাবতেই কোঁচকানো ভ্রু খানিক শিথিল হয়। ইরফান জেলাস এটা তো আগেই বুঝেছে সে আর ফাইজ। কিন্তুু এতোটা? আরে সে তো মানবতার খাতিরে ওষুধ আনলো মেয়েটার জন্য। সারাদিন ঠাস ঠাস করে লাগাবে, আবার অন্যদের সেবাও করতে দেবে না। বিড়বিড় করল,
“দাঁড়া তোকে সোজা করছি আমি। মাইরার পিছনে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবো। শা’লা বেয়া’দব।”
শুদ্ধর মা ইরফানকে দেখে এগিয়ে এসে কিছুটা রেগে বলে,
“এভাবে মেরেছিস কেন মেয়েটাকে?”
ইরফান তার ফুপির থেকে চোখ সরিয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে থাকা মাইরার দিকে তাকায়।
কিছু না বলে চুপচাপ একটা চেয়ার নিয়ে মাইরার মাথার কাছে বসে পড়ে। শুদ্ধর মা ইরফানকে দেখে অবাক হলো। ছেলেটার চোখ এমন লাল কেন? ইরফান চুপচাপ এক ধ্যানে মাইরার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আর কিছু বলল না। যেতে যেতে বলল,
“আর মারবি না ওকে, এরকম করলে আমি আমার শ্বশুর বাড়ির ওইদিকের কারো সাথে মাইরাকে বিয়ে দিয়ে দিব।”
বলে তিনি নিজেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। ইরফান রাগে স্বল্প আর দীর্ঘ সময়ের মাঝামাঝি সময়ের জন্য। এখন ওকে ঠাণ্ডা লাগলো বলেই তিনি নিজেই একা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
ইরফান তার ফুপির কথায় পিঠে কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইরার দিকে চেয়ে থাকে। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে বুঝল মাইরা ঘুমিয়েছে। ঠোঁটের কিনারায় র’ক্ত আধা শুকনো হয়ে লেপ্টে। ডান হাত বাড়িয়ে বুড়ো আঙুলের ছোঁয়ায় কিছুটা মুছে দিল। মাইরা ঘুমের ঘোরে কেঁপে ওঠে। শব্দ করে শ্বাস ফেলে। ব্য’থায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ইরফান দেখল মাইরার মুখের ভাব।
পকেট থেকে মলম বের করে বা হাতের সাহায্যে আলতো হাতে ডান গালে মলম লাগায়। মাইরার কপালে বিরক্তির ভাঁজ। তবে ঘুম ভাঙে না।
ইরফান পকেট থেকে বেশ কিছু ওষুধ বের করে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে। এরপর মাইরার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয়। গলার ভাঁজে চোখ পড়লে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কেমন কালচে দাগ। একটু ঝুঁকে ডান হাত বাড়ালে মাইরা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ইরফানকে তার এতো কাছে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইরফানকে তার দিকে হাত এগিয়ে আনতে দেখে দ্রুত ইরফানের হাত ধরে ভীত স্বরে বলে,
“কি করছেন?”
ইরফান মাইরার দিকে তাকায়। কিছু না বলে মাইরার থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। গলার সে কালচে জায়গায় বুড়ো আঙুল ছোঁয়ালে মাইরা মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। দু’হাতে ইরফানের হাত সরিয়ে দেয়। ইরফান মাইরার কাজে বিরক্তি ঢেলে বলে,
“এখানে কি হয়েছে?”
মাইরা অবাক হয়ে তাকালো ইরফানের দিকে। নিজে মেরে গেল। এখন ঢং করছে, গাল মুখ সব ফেটে দিয়ে গলায় পোড়ার দাগ চোখে পড়েছে। মাইরা কিছুই বলল না। ইরফান আবারও হাত এগোলে মাইরা রেগে ইরফানের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। মেজাজ খা’রা’প লাগছে তার এই লোককে দেখে। শোয়া থেকে উঠে বসে বিছানার এ মাথা থেকে ও মাথায় গিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ে। একটা কথাও বলে না।
ইরফান তব্দা খেয়ে চেয়ে আছে। কি হলো ব্যাপারটা? এই মেয়ে তাকে এভোয়েড করল? আবার রেগে যাচ্ছে। দ্রুত বিছানার উপর উঠে মাইরাকে টেনে শোয়া থেকে ওঠালো। মাইরা রেগেমেগে চিৎকার করে বলে,
“ছাড়ুন আমায়। জীবনে কথা বলবো না আপনার সাথে।”
কথাগুলো বলতে বলতে ইরফানের গলা, বুক, মুখ খামচে দিল। ইরফান মাইরার দু’হাত পিছনে শক্ত হাতে ধরে গম্ভীর গলায় বলে,
“আমায় রাগিয়ো না।”
মাইরার এতো রাগ লাগছে, বলার বাহিরে। খু’ন করতে ইচ্ছে করছে এই লোককে। মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছাড়াতে চায়। ইরফান বা হাতের শক্তহাতে মাইরার দু’হাতসহ পেট নিজের সাথে চেপে ধরে।
ডান হাতে মাইরার কাঁধের চুলগুলো সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে, মাইরা মাথা নিচু করে নেয়। দেখতে দিবে না কিছুতেই এই লোককে। ইরফান বিরক্ত চোখে তাকায়। বা হাতে ধরে রাখা মাইরাকে ছেড়ে সে হাতে মাইরার মাথা উঁচু করে বা দিকে হেলে রাখে।
মাইরা ছাড়া পেয়ে আবারও ইরফানের থেকে নিজেকে সরাতে চাইলে ইরফান ডান হাতে মাইরাকে নিজের সাথে চেপে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“স্টুপিট, দেখতে দাও আমায়।”
মাইরা কিছু বলে না। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে জল গড়ায়।
ইরফান মাইরার দিকে একবার তাকায়। মেয়েটা কাঁদছে। তবে নিরব। ইরফান ডান হাতে গলার পোড়া জায়গায় মলম লাগিয়ে দেয়। কিন্তুু মাইরাকে ছাড়ে না। মাইরা বিড়বিড় করে,
“জীবনে যদি কথা বলেছি এই জ’ল্লা’দ এর সাথে, তাহলে আমার নাম আমি নিজেই চেঞ্জ করব।”
মাইরার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো ইরফান শুনলো। শান্ত চোখে চেয়ে থাকে মাইরার দিকে। কি মনে করে ঠোঁট বাঁকিয়ে সূক্ষ্ম হাসে। মাইরা বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকালে ইরফান গম্ভীর মুখায়ব করে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ইরফানের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলে ইরফান নিজেই ছেড়ে দেয়।
মাইরা ইরফানের দিকে তাকায় না। চুপ করে গিয়ে উল্টো ফিরে শুয়ে পড়ে। ইরফান বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়। মাইরা মাথা উঁচু করে দেখল। এরপর বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ইরফান শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানা ফাঁকা দেখে ঘরের চারপাশে চোখ বুলায়। মাইরাকে না দেখে বিরক্ত হলো। এগিয়ে গিয়ে দ্রুত শার্ট প্যাণ্ট গায়ে জড়ালো। হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফুপির ডাকে থেমে যায়।
“কোথায় যাচ্ছিস ইরফান? বাসায় যাচ্ছিস না-কি?
খেয়ে যা।”
ইরফান পিছু ফিরে আশেপাশে চোখ বুলায়। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে বলে,
“নামাজ পর যাব ফুপি। এখন একটা কাজে যাচ্ছি।”
কথাটা বলে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তার এক ডক্টর ফ্রেন্ডকে কল করে বেশ অনেকক্ষণ কথা বললো।
“তোর ছোট বোনের প্রবলেম না-কি? আমার চেম্বারে নিয়ে আয়। তাহলে ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতে পারব। আপাতত এই ইনহেলার ইউস করতে বল।”
ইরফান গম্ভীর মুখায়বে ছোট করে বলল, “বাই।”
এরপর কল কেটে দেয়।
গ্রাম থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. দূরে এক ফার্মেসীতে আসে ইরফান। তার ফ্রেন্ড যে ইনহেলারের কথা বলেছে সেটা কিনে পকেটে রাখে। একজায়গা থেকে প্রায় হাফ বস্তার কাছাকাছি বিভিন্নরকম ফলমূল কিনে গাড়ির ব্যাক সিটে রেখে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
একটু পর পর হাতঘড়িতে সময় দেখছে। জুম্মার দিন বলে বারবার সময় দেখে। গ্রামে গিয়ে জুম্মার নামাজ পড়বে বলে।
প্রায় ৩০ মিনিটের মতো ড্রাইভ করে ইরফান শুদ্ধর বাড়ি পৌঁছায়। ব্যাকসিট থেকে দু’হাতে ফলমূলের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে আসে। গ্রামের বাড়ি, গেইট বেশিরভাগ সময় খোলাই থাকে। ইরফান হাতের ব্যাগগুলো টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরপর দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায় মসজিদের উদ্দেশ্যে।
মাইরা গোসল করে নামাজ পড়ে শুদ্ধর মায়ের ঘরে শুয়ে পড়ে। শুদ্ধর মা নামাজ পড়ে এসে মাইরাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। মেয়েটা সকালেও খায়নি। মাইরা খেতে চায়নি, কিন্তুু শুদ্ধর মা শোনে নি। জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর মাইরা কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে যায়।
ইরফান দু’হাত প্যাণ্টের পকেটে গুঁজে ঘুমন্ত মাইরার দিকে চেয়ে আছে। নামাজ পড়ে এসে তার ঘরে মাইরাকে না দেখে এই ঘরে এসেছে। মাইরাকে ঘুমের মাঝেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে দেখে ইরফান ভ্রু কুঁচকে নিল। খানিক নিচু হয়ে মাইরার কপালে হাত দিয়ে চেক করে শরীরের তাপমাত্রা। স্বাভাবিক দেখে হাত সরিয়ে নেয়।
ফোনে কল আসলে ইরফান পকেট থেকে ফোন বের করে বাবার কল দেখে রিসিভ করে।
“বেরিয়েছো?”
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
“নো।”
তারেক নেওয়াজ রেগে যায়। এই ছেলের প্রবলেম কি। এমন তো নয়, বউ এর আঁচলের তলা থেকে বেরোয় না। এই ছেলে তো বউকে দেখতেই পারে না। উল্টে আজ না-কি মাইরাকে মেরেছে। তার বোন কল করেছিল কিছুক্ষণ আগে। রেগে বলে,
“তুমি ওই বাসা থেকে বের হও। মেয়েটাকে একটু স্বস্তিতে থাকতে দাও।”
ইরফান বিরক্ত হয় বাবার কথায়। মাইরার মুখের দিকে চেয়ে থাকে চুপচাপ। ওপাশ থেকে তারেক নেওয়াজ রেগে বলে,
“তুমি খাওয়াদাওয়া করে বের হও এক্ষুনি। সকালের মিটিং ক্যান্সেল করে বিকেলে দিলাম। তুমি এখনোও রওয়ানা দাওনি। উল্টে ওখানে থেকে মেয়েটাকে মারছ।”
ইরফান কিছুই বলে না। তারেক নেওয়াজের মেজাজ খা’রা’প হলো। রেগে বলল,
“আমি তোমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি। তোমাকে আর মারতে হবে না ওকে। এবার রওয়ানা দাও। আর মিটিংয়ে জয়েন কর।”
ইরফান রেগে তার ফোন কান থেকে সরিয়ে সুইচ অফ করে পকেটে রাখে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে একবার মাইরার মুখের দিকে তাকিয়ে গটগট পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ডাইনিং-এ তার ফুপিকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তার ফুপির সামনে দাঁড়ায়। পকেট থেকে ইনহেলার বের করে তার ফুপির দিকে বাড়িয়ে দিলে শুদ্ধর মা অবাক হয়ে বলে,
“আমার তো এসব প্রবলেম নেই বাবা। এটা কার?”
ইরফান থতমত খেয়ে তাকায় তার ফুপির দিকে। মাইরার নাম বলতে চাইলো। কিন্তুু মনে পড়ছে না। অনেকবার শুনেছে। কিন্তুু মন ছিল না, তাই মনে নেই। শুদ্ধর মা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইরফানের দিকে। ইরফান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“ওই মেয়েটার অ্যাজমার প্রবলেম আছে। এটা ওকে দিও।”
শুদ্ধর মা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কোন মেয়ে?”
ইরফানের বিরক্ত লাগছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। শুদ্ধ চেয়ার টেনে বসে বলে,
“তুমি এতো কম বোঝো মা, ওর বউ ছাড়া আর কে আছে, বলো তো?”
ইরফান বিরক্ত চোখে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধর মা অবাক হলো। সবাই যে বলে, ইরফান মাইরাকে দেখতে পারে না। মেনে নেয় না। যেভাবে মারলো তারও সকালে এমনটাই মনে হয়েছিল। এখন তো তেমন লাগছে না। টেবিলের উপর রাখা ওতোগুলো ফল আনার কারণ বোধয় বুঝল। ইরফান এখানে আসলে তাকে প্রতিবার-ই ফলমূল কিনে দিয়ে যায়। কিন্তুু কখনো এতো বেশি আনে না। এইবার হয়তো মাইরার আর তার জন্য এনেছে বলে এতোগুলো হয়েছে। শুদ্ধর মা মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা দিব। খেতে বস।”
ইরফান বাইরে যেতে যেতে বলে,
“এখন যেতে হবে। আসছি।”
“মানে? আমি তোর জন্য রাঁধলাম। সকালেও তো কিছু খেলিনা।”
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
“আসছি। বাই।”
কথাটা বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। শুদ্ধ চেয়ার থেকে উঠে ইরফানের পিছু পিছু যায়। তার মা তাকে বলে,
“ওকে আনতে পারলে আনিস তো। সারাদিন না খেয়ে আছে।”
শুদ্ধ মাথা নাড়ালো। ইরফান গাড়িতে বসে চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে রোখেছে। বা হাত স্টিয়ারিং-এ। ডান হাত গাড়ির জানালায় রেখে কপাল স্লাইড করছে। শুদ্ধ অপর পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
“বেশি বিরহে পুড়লে থেকে যেতে পারিস। হাজার হোক বউ তোর, মলম ও তু-ই লাগাবি!”
ইরফান বিরক্ত হলো। তাকালো না শুদ্ধর দিকে। চোখ মেলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। শুদ্ধ দ্রুত একটু পিছিয়ে গিয়ে পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১৬
“আরে খেয়ে যা রে! এতো বিরহে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তখন তো মেয়েটার জামাই অন্যকেউ হয়ে যাবে।”
ইরফান বোধয় শুনলো না। সে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে অনেক আগেই চলে গিয়েছে। শুদ্ধ হাসল। বিড়বিড় করল,
“ভাঙবে, তবু মচকাবে না।”