কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৬

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

সকালের নাস্তার পাঠ চুকেছে মাত্র। রেহনূমা তখন রান্নাঘরে৷ কদিন ধরে গোটা বাড়ির কাজকর্ম একা হাতে সামাল দিচ্ছেন তিনি। আপাতত তনিমাকে কূটোটিও নাড়তে দেয়া হচ্ছে না। কারণ, তুশি। ভদ্রমহিলা
তুশিকে দিয়ে কাজ করাতে নারাজ। কিন্তু ইয়াসিরের জেদ আর রেহনূমার তাল মেলানোর কারণে খুব একটা সুবিধে করতে পারছেন না। সাইফুল,শওকতেরও মৌন স্বায় এতে। তুশি এদের চারজনেরই বড্ড অপছন্দের মানুষ। তনিমা স্বভাবে বেশ নরম গোছের। তারওপর জীবনের একটা প্রবল ধাক্কায় যখন তার সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছিল? ইয়াসিরই তো সঙ্গে ছিল তখন।
তাই চাইলেও ছেলেটাকে কড়া করে কিছু বলতে পারেন না তিনি।
আবার ওর দিক থেকে দেখতে গেলে একটা কথা সত্যি,অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিয়েটা এক ঝটকায় মেনে নেয়া কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়।

সে অনেক আগের কথা,তখন ঢাকার বুকে ওনাদের এই বাড়িটা ছিল না। ইয়াসির স্কুলে পড়তো। বোর্ড স্ট্যান্ড করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গোল্ড মেডেল দিয়েছিল ওকে।
সেই ছেলে কি চাইলেই পড়াশোনায় এমন অজ্ঞ,স্বভাবে চোর মেয়েকে বউ বলে মেনে নিতে পারবে? জীবন কি এতই সহজ! এতই সরল!
এসব তো আর আবেগ দিয়ে হয় না।
তনিমা ইয়াসিরের ব্যাপারটা বোঝেন। আবার তুশির জন্যেও মায়া হয়। কিন্তু তার কথা হচ্ছে,যদি সংসারই না করবে ইয়াসির,বউয়ের সম্মানই না দেবে তবে মেয়েটাকে যেতে দিলেই পারে। এভাবে বাড়িতে জিম্মি করে রাখার তো কোনো মানে নেই। ইয়াসির সৎ,দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার হিসেবে গোটা দেশের কাছে পরিচিত এখন। তার দ্বারা এমন অন্যায় কি তনিমা স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছেন? নেয়া সম্ভব কখনো!
ভদ্রমহিলা ফোস করে শ্বাস ফেললেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিশ্চুপ রওনা করলেন জয়নবের ঘরে। প্রৌঢ়ার হাঁটুর ব্যথা কদিন ধরে মারাত্মক হাড়ে বেড়েছে। হাঁটাচলায় কষ্ট হচ্ছে খুব! তাই ঘরেই খাবার দিয়ে আসা হয়। আজকেও নিয়ে গেলেন তনিমা।
ইউশার পরীক্ষা কদিন পর। সে প্রানপণ চেষ্টা করে ভালো রেজাল্ট করতে। কারণ, তার অয়ন ভাই। অয়ন ছাত্র হিসেবে দূর্দান্ত। ইয়াসির কলেজ পর্যায় থেকে একটু গতি হারালেও,অয়ন কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সে। ইউশার ধারণা
অয়নের দুটো মাথা। একটা মাথা দিয়ে তো মানুষের এত কাজ করা সম্ভব নয় তাই না?
এখন অয়নের বউ হতে গেলে ওকেও তো অমন মেধাবী হতে হবে। অয়ন ভাই ডাক্তার। ইউশা যদি সেখানে লাড্ডুগুড্ডু হয়, লোকে হাসবে না?
মুখের সামনে বই মেলে রাখলেও ইউশার চোখ ছিল অয়নের ওপর। কলা পাতা রঙের টিশার্ট পরা ছেলেটা ঠিক তার নাক বরাবর খাবার টেবিলে বসে।
নাস্তা করল,পানি খেল,হাত-মুখ মুছে রওনা করল সিঁড়িতে৷ পুরোটা সময় ইউশা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইলেও,অয়ন ফিরলও না এদিকে।

খাবার টেবিলের কাঠের ওপরে একটা বিশাল কাচ বসানো। এঁটো জিনিসপত্রের ছোঁয়ায় বেশ ময়লা হয়ে গেছে। রেহনূমা বলে গেছেন,সবাই উঠে গেলে মুছে ফেলতে। আর শেষের সেই মানুষটাই হলো অয়ন। তুশি টেবিল মুছতে মুছতে একবার চলে যাওয়া ওর দিকে তাকাল। শুধু ইয়াসির ছাড়া সবাই বাড়িতে আজ। আইরিন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।
অয়নও বের হয়নি বাইরে। এই ছেলেটাকে নিয়ে তুশির মাঝে বিস্তর কৌতূহল। এর মাঝে কয়েক দিন কেটেছে। যবে থেকে তুশি সৈয়দ ভিলায় এলো,অয়নকে পরিবারের কোনো ব্যাপারে থাকতে দেখেনি।
একটা কিচ্ছুতেও নাক গলায় না৷ শুধু সময় মতো খেতে নামে,আবার ঘরে চলে যায়। তবে খাবার টেবিলের ওই টুকু সময় পরিবারের সাথে জমিয়ে কথা বলে সে। কিন্তু বড়োসড়ো ঝামেলার একটাতেও অয়নকে তুশি দেখেনি। বিটকেলটা রোবট হলে, এটা তো ওরও এক কাঠি ওপরে।

অয়নের যাওয়া থেকে তুশি চোখ সরিয়ে আনল। হঠাৎ নজর পড়ল ইউশার ওপর। বইখাতা নিয়ে পড়তে বসেছিল সোফায়। অথচ পড়ার তো নামই নেই,কেমন হাঁ করে চেয়ে আছে মেয়েটা। তার মুগ্ধ দৃষ্টির পথ অনুসরণ করে তুশিও চাইল সেদিকে। অয়নকে দেখেই ভ্রু বাঁকাল অমনি। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে একপল ইউশাকে দেখল পরের বার তাকে। উহুম! মেয়েটা এমন করে তাকিয়ে আছে কেন? ব্যাপারটা তো সুবিধের লাগছে না।
মনের প্রশ্ন করেই ফেলল তুশি,
“ কী দেখছো তুমি?”
ইউশার ধ্যান ছুটল। তাকাল তড়িঘড়ি করে। চেহারা জুড়ে বসতে চাওয়া অস্বস্তির গাঢ় চিহ্ন মুছতে বোকার মতো হাসল মেয়েটা।
মিনসে গলায় জানাল,

“ কই,কিছু না। কিছু না।”
তুশি মিটিমিটি হাসল। তার মন বলছে ঘটনার জল স্রোতের মতো সবেগি। ইউশা কি ওই লোকটাকে পছন্দ করে?
এর মাঝেই রেহনূমা এলেন। মাকে দেখে ইউশা তটস্থ হয়ে বসল। হাতের বইয়ে মাথা নুইয়ে বোঝাল, সে মন দিয়ে পড়ছে।
রেহনূমা চুলায় তরকারি বসিয়ে এসেছেন। হাবভাবে তাড়াহুড়ো। রেশমীও নেই। ছাদে কাপড় নাড়তে গিয়েছে। কাল তুশি যা যা ধুয়েছে? তার একটাও পরিষ্কার হয়নি। বেচারাকে সেসব আজ আবার কাচতে হোলো!
রেহনূমার হাতে চায়ের কাপ। শওকত বলেছিলেন রুমে পাঠিয়ে দিতে। কাকে বলবেন এখন! ভদ্রমহিলা এদিক-ওদিক চাইলেন। ইউশা পড়ছে বলে বিরক্ত করলেন না। তুশির সামনে রেখে বললেন,
“ চা-টা ভাইজানকে দিয়ে এসো তো।”
তুশির কাজ শেষ হয়নি।

তাও গাঁইগুঁই করতে গেল না। যা দর্জ্জাল মহিলা!
কোমরে দু প্যাঁচ দেয়া ওড়নার মাথা ছুটিয়ে পা বাড়াল সে পথে।
রেহনূমা যেতেই ইউশা সাবধানী বানী ছুড়ল,
“ বড়ো চাচ্চু কিন্তু মেজাজি মানুষ তুশি। একটু সমঝে থেকো,কেমন?”
বাধ্যের ন্যায় মাথা নাড়ল ও।
তবে ইউশা নিশ্চিন্ত হতে পারল না। তুশি কি কথা শোনার মানুষ!

তুশি গত কদিনে বাড়িময় এত টুংটুং করে ঘুরেছে, মোটামুটি কয়েকটা ঘর ওর আয়ত্বে এখন। তার মাঝে তনিমার কামরাও আছে। সেই মতো মেয়েটা সোজা চৌকাঠে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলাই আছে। পর্দা দুপাশে গোটানো।
তুশি অনুমতি চাইল না। ঢুকে পড়ল সুড়ুৎ করে। রুমের ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন শওকত। প্রগাঢ় মনোযোগের তোড়ে
তুশির উপস্থিতি বিশেষ লক্ষ্য করেননি তিনি। চায়ের কাপ সমেত মেয়েটা চেয়ারের পেছনে এসে পেছনে থামল।
খবরের কাগজের লেখাগুলো বিড়বিড় করে পড়ছেন শওকত। হঠাৎ পাতা ওল্টালেন। এক পৃষ্ঠা পরেই,বিনোদনের পাতা বেরিয়ে এলো।

মুখ তুলল বড়ো বড়ো তারকাদের ছবি। তার মধ্যে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল তুশির। চ্যঁাচিয়ে উঠল আনন্দে,
“ ইইই শাহরুখ খায়ায়ায়ায়ান।”
কানের কাছে হঠাৎ শব্দে চমকে গেলেন শওকত। পিছু ফিরলেন ধড়ফড়িয়ে।
তুশিকে দেখেই ত্রস্ত দাঁড়ালেন তিনি।
“ এ কী! তুমি এখানে কী কোরছো?”
তুশির ওসবে মন নেই।
আবদার ছুড়ল তৎক্ষনাৎ ,
“ একটু পড়ুন না কাকা,শুনি কী লিখেছে? ইস, আমি যে শাহরুখের কত বড়ো ফ্যান আপনাকে বললেও বুঝবেন না। ঐ যে
ওর একটা গান আছে না ঐশ্বরিয়ার সাথে?
তুশি গাওয়া শুরু করল,
“ kar de mushkil jeena, ishq kameenaaa.
Ishq kameena, ishq kameenaa”
শওকত তাজ্জব,স্তম্ভিত। তুশি শুধু গাইছেই না,হাত পা ছুড়ে নাচতেও চাইছে। তবে মুঠোর টলটলে জল ভরতি কাপটার জন্যে সুবিধে করতে পারছে না। ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
ধমক ছুড়লেন পরপরই,

“ চুপ। থামো বলছি।”
তুশি আঁতকে উঠল। থামল তার নাচ-গান। শওকত হতভম্ব চোখে বললেন,
“ আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি! একজন গুরুজনের সামনে এসব কী ধরণের অসভ্যতা?”
তুশির মুখটা ছোট হয়ে গেল। ভদ্রলোক রেগেমেগে বললেন,
“ যাও,এক্ষুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও।”
ও মিনমিন করে বলল,
“ চা-টা কোথায় রাখব?”
“ কোত্থাও রাখতে হবে না। তোমার হাতে আনা চা আমি খাব নাকি! ”
নিষ্পাপ মনে বলল সে,
“ ওহ, আপনি খাবেন না?
তাহলে আমি খেয়ে ফেলি?”
শওকতের ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল। তব্দা খেলেন এক চোট।
কাকে ধমকালেন এতক্ষণ? এ মেয়ের মাথায় কি একটু বুদ্ধিও নেই।
তুশি সত্যিই কাপ নিয়ে হাঁটা ধরল। মোটা স্বরে বললেন তিনি,
“ এই, দাঁড়াও।”
থামল মেয়েটা।
ভদ্রলোক গজগজ করে বললেন,

“ আমি বললাম খাব না,আর তুমিও আমার সামনে থেকে কাপ নিয়ে চলে যাবে?
গুরুজনদের সাথে কীভাবে কেমন আচরণ করতে হয় না হয়, সেই নূন্যতম সহবোধটাও বাবা মা শেখায়নি তাই তো!”
তনিমা সদ্য শাশুড়ীর ঘর থেকে বেরিয়েছেন। স্বামীর চ্যাঁচামেচি শুনে নিচে আর গেলেন না। জোরালো পায়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
তুশির ভারি মেজাজ খারাপ হোলো। ওকে বলছিল বলুক। বাবা মা টানল কেন? জবাব দিলো মুখের ওপর,
“ না। শিখলে তো আর নিয়ে যেতাম না। আমরা বস্তিতে বড়ো হওয়া,গরিব মানুষ। আমাদের মুখেও যা,মনেও তাই। বড়োলোকদের মতো ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। বললেন নিয়ে যেতে, নিয়ে যাচ্ছি। আপনার মন মাফিক অত ধরিবাজি করতে পারব না বুঝেছেন!”
শওকত হতচেতন, হতবাক! পরপরই ফেটে পড়লেন রোষে,
“ কী বললে তুমি! তোমার এত বড়ো…”
পথিমধ্যেই ভেতরে ছুটে এলেন তনিমা। তুশিকে আড়াল করে ওর সামনে এসে থামলেন। বিগড়ে যাওয়া পরিস্থিতির সামাল দিতে বললেন,

“ থাক থাক ছাড়ো। বাচ্চা মেয়ে কী বলতে কী বলেছে! তুশি,তুমি এখন যাও।”
তুশি আর কথা বাড়াল না। খিচরে আসা তবিয়তের রাশ টানতে কাপটা টেবিলে রাখল চুপচাপ।
তার প্রস্থান দেখে শওকত কটমটিয়ে উঠলেন,
“ কত বড়ো সাহস দেখলে? কীভাবে আমার মুখের ওপর আমাকে ধরিবাজ বলে গেল?”
তনিমার স্বর নরম,
“ আহা থাক না! বাদ দাও। মেয়েটা অত আদব কায়দা জানে না। বাবা-মা নেই। দাদির কাছে কতটুকুই বা শিখেছে বলো। তুমিও বা কেন এসব বলতে গেলে?”
“ আমি কেন বললাম মানে? আমি বলেছি বলেই ও বলবে?”
তনিমা তর্কে যেতে চাইলেন না। প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাও।”

কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ হলো না শওকতের। কথার ভাঁজে তীর্যক তির ছুড়লেন তিনি,
“ তোমার মনে হয় না তুমি মেয়েটাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছো? একটা বস্তির মেয়েকে তো এত মাথায় তোলার কোনো কারণ দেখছি না।”
তনিমার স্বর শান্ত,
“ ও বস্তিতে বড়ো হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তোমাদের মতো আলিশান বাড়ি পায়নি৷ তাই বলে বস্তির মেয়ে ট্যাগটা এভাবে সব সময় ওর সাথে জুড়ে দিও না। এটা তো কারো স্থায়ী পরিচয় হতে পারে না,তাই না? সমাজে অবস্থানের দিক থেকে ছোটো হলেই মানুষটাকেও যে খুব ছোটো করে দেখতে হবে এটাও কিন্তু ঠিক নয়।”
শওকত কঠিন গলায় বললেন,
“ যে যা, আমি তাকে তাই বলতে শিখেছি। ও এমন কেউ নয় যে ওকে আমার সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে।”
তনিমা চ সূচক শব্দ করলেন। বিরক্তি গিলে বললেন,

“ তোমাকে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই৷ আফসোস হলো,আমার ছেলেটা বাকিসব আমার মতো পেলেও,অহংকার পেয়েছে ঠিক তোমার মতোই। যাক গে, এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। নিচে যাই, দেখি।”
তনিমা বেরোতে নিলেই বাক্য ছুড়লেন শওকত,
“ কথা কাটাচ্ছো তনিমা? কাটাও। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ, লাই দিয়ে বাঁদড়কে কখনো মাথায় তুলতে নেই। তাহলে এক সময় তারা চুল ছিঁড়ে নেয়।”
তনিমার উত্তর এলো সাথে সাথে,
“ ও বাঁদড় নয়। ও আমার ছেলের বউ।”
শওকত বিদ্রুপ করে বললেন,
“ ছেলের বউ! ছেলে নিজেইতো ও মেয়ে বউ বলে মানে না।”
“ সেটা এখন মানে না। কিন্তু ভবিষ্যতেও যে মানবে না তার গ্যারান্টি কী? শোনো,

বিয়ের কালেমা তো আর মিথ্যে নয়। হয়ত এভাবে একসাথে একই ছাদের নিচে থাকতে থাকতে ওরা একে অন্যের মায়ায় জড়িয়ে পড়বে। হয়ত সংসার ধর্ম নিয়ে অজ্ঞ মেয়েটা একদিন ঠিক বুঝবে এ বাড়িতে তার অধিকারের কথা।
তোমরা যে যাই ভাবো না কেন,বিয়ের মতো একটা পবিত্র ব্যাপারকে শুধুমাত্র সমাজের এই ছোটো-বড়ো ভেদ থেকে আমি অন্তত নিচু করে দেখতে পারব না।”
শওকত হাসলেন। ফের সেই তুচ্ছ হাসি।
“ ছেলেকে চেনা নিয়ে প্রায়ই খুব অহংকার করো। এই তোমার চেনার নমুনা?
তোমার ছেলে ঐ অশিক্ষিত, মূর্খ চোর মেয়েটার মায়ায় পড়বে? এসব কখনো সম্ভব!”
তনিমা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,
“ তা অবশ্য ঠিক। সবার মনে মায়া-মমতা থাকবে এমনটা তো নয়।
শত হলেও বাপের রক্ত আছে গায়ে।”
শওকত ফুঁসে উঠলেন অমনি,
“ তনিমা! আবার সেই এক কথা?
আমার দুর্বলতা ধরে বারবার খোঁচা দেয়াটা দেখেছি। তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তা
কি বলবে এখন, তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।
এসবই তো তাই না? বলো,বলো। তর্ক জেতার খাতিরে ওসব পুরোনো অস্ত্রের প্রয়োগ ছাড়া আর কীই বা পারবে তুমি!”
তনিমা কাষ্ঠ হেসে বললেন,

“ আমি কিছু না বলতেই তুমি বুঝে গেলে? তাহলে তো আর আমার বলার কোনো দরকারই পড়ল না। আসলে, আমি বলতে চেয়েছিলাম সার্থ ছোটো থেকে দেখেছে ওর বাবা ওর মাকে সম্মান করেনি। তাহলে সেই ছেলে নিজের বউকে কি করে সম্মান করবে বলো! যতই হোক, ছেলেরা তো বাবাকে দেখেই শেখে।”
ভদ্রলোক আশ্চর্য চোখে বললেন,
“ তুমি তোমার সাথে ওই মেয়েটার তুলনা করছো? ওই মেয়েটা একটা চোর। অমন রাস্তার মেয়ের সাথে নিজে তুলনা করছো তনিমা?
আমাকে যুক্তিতে হারানোর জন্য নিজেকে অন্তত এত ছোটো জায়গায় নামিও না যেখান থেকে আর ওঠা না যায়।”
তনিমার পরিষ্কার উত্তর এলো,
“ আমি কখনো পয়সা দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করতে শিখিনি। আমার কাছে সবাই মানুষ! আর নানান পরিস্থিতিতে সেই মানুষের স্বভাব বিগড়ে যায়। হতে পারে তুশির সাথেও এমন কিছু হয়েছে।
যাই হোক না কেন,আমি এখন আর ওর অতীত জানতে চাই না। ও আমার সার্থের স্ত্রী, আর এটাই এখন ওর একমাত্র পরিচয়। যেদিন মেয়েটা সংসার নিয়ে একটু সিরিয়াস হবে? সেদিন আমি নিজে ওর অধিকার বুঝিয়ে দেবো ওকে।
তুমি বরং তোমার ব্যবসা নিয়ে ভাবো। এসব সংসারের ব্যাপারে তো আগে কখনো মাথা ঘামাওনি। তাই আজও ঘামিও না। অনুরোধ! ”
তনিমা বেরিয়ে গেলেন। ক্ষোভে কিড়মিড় করে উঠলেন শওকত। টগবগে রক্তের ধাচ নিয়ে চায়ের কাপটাকে তুলেই আছাড় মারলেন মেঝেতে।

তুশি হেলেদুলে হাঁটছে। গুনগুন করে গান তুলেছে গলায়। সদ্য সদ্য থ্রিপিস পরছে বলে, ওড়না খুব একটা গায়ে থাকতে নারাজ । বারবার ঢলে ঢলে হাতে খসে পড়ছে। তুশির অবশ্য ওড়না নিয়ে মাথা ব্যথা কম।
ইউশা ওকে নিজের থেকে আরো ৫টা জামা দিয়েছে। আর বড়োই আশ্চর্যের ব্যাপার, রেহনূমা এ নিয়ে কিচ্ছু বলেননি। ভদ্রমহিলার বোধ হয় একটাই লক্ষ্য,তুশিকে দিয়ে কাজ করানো।
তুশি ওড়নার মাথা হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাঁটছিল। ও ঘরে এক দম্পতির
মাঝে যাকে নিয়ে একটু আগেই ঝড় বয়ে গেল,সেই মেয়ের এমন ফুরফুরে মেজাজ বাড়ির পাপোসগুলো নিতে পারেনি বোধ হয়।
হাঁটার ফাঁকেই পা-টা বাধল ওতে। ব্যস,তুশি হুমড়ি খেল। মেঝেতে থুবড়ে পড়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে দু হাত দিয়ে আকড়ে ধরল বিশাল দরজার কপাটটাকে।
কাঠের সাথে শুকনো শরীরের সংঘর্ষে শব্দ হলো কিছু। অমনি ঘাড় ফিরিয়ে চাইল অয়ন। তুশি কোনোরকম ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও বলল,

“ কে?”
মেয়েটা ভয় পেলো।
শিরদাঁড়া সোজা করে ভাবল,
এই রে! এটা কার ঘর?
ওই ডাক্তারের নাকি!
বিটকেল পুলিশের ভাই তো নির্ঘাত আরেক বিটকেল হবে। তুশি বিপদ বাড়াতে চাইল না। ছুটতে নিলো হুড়মুড়িয়ে, সহসা ডাক ছুড়ল অয়ন,
“ অ্যাই দাঁড়াও।”
থামল মেয়েটা। জিভ কাটল চোখ বুজে।
অয়ন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ এদিকে এসো।”

তুশি তৎপর চিবুক নামিয়ে নিলো বুকে। একটা অপরাধী ভাব করে, ঢুকল ঘরের ভেতর। যদিও মনে হচ্ছে অয়ন বদ পুলিশের মতো অতটা জাদরেল হবে না।
প্রথম দিন যখন ও পড়ে গেল? কী সুন্দর ওষুধের কথা বলেছিল লোকটা! তারপর ঐদিন গাড়ির দরজা খুলে বের করল ওকে। তাও তুশির বুক দুরুদুরু করছে। এমন করে ডাকল,কী বলবে কে জানে!
অয়নের রুম সাদামাটা। অত আহামরি,বাড়তি জিনিস নেই। খাটের পাশেই একটা মাঝারি কাউচে বসে পড়ছিল সে। হাতে মোটা বই,চোখে চশমা। তুশি সামনে এসে দাঁড়াতেই,
চশমা খুলে বন্ধ বইয়ের ওপরে রাখল অয়ন।
প্রশ্ন করল ওভাবেই,
“ ঘরে উঁকি মারছিলে কেন? কিছু চুরি করবে?”
সজোরে মাথা ঝাঁকায় তুশি,

“ না না।
আমি তো হোচট খেয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। দরজাটা সামনে পেয়ে ধরলাম,আর তাতেই…”
অয়নের ভ্রু উঁচাল,
‘’ তাই? কীভাবে বিশ্বাস করব তুমি সত্যি বলছো?”
এর আগে তো একবার আমার ওয়ালেট চুরি করলে!”
তুশি লজ্জা পেলো।
বিব্রতকর লজ্জা। খুব আস্তে করে বলল,
“ ওটাতে বেশি টাকা ছিল না।”
“ সে না থাকুক, কিন্তু চুরি তো করেছিলে। কারো এক টাকা চুরি করাও অন্যায়।”
মহাবিরক্ত মেয়েটা, হু-হা করল না। এটা এমন এক বাড়ি,যেখানে ন্যায়-অন্যায় নিয়ে চার বেলা জ্ঞান দেয়া হয়।
তুশি মনে মনে অয়নের কথা ভ্যাঙাল,

“ কারো এক টাকাও চুরি করা অন্যায়! উহ, এলেন আমার জ্ঞানের পিতা! নিজেদের বেলায় এত অন্যায় বুঝিস, তাহলে আমার বেলা কী? আমাকে যে এভাবে বাড়িতে গুম করে রেখে সব কাজ করাচ্ছে সেটা বুঝি খুব আনন্দের ব্যাপার, তাই না?”
মুখে মেয়েটা বলল না কিছু। চোখদুটো ঘোরাতেই,
নজর বিধল অয়নের ঘরে। দেওয়ালের একটা বিশাল অংশ জুড়ে বইয়ের তাক। তুশির মুখ হাঁ হয়ে গেল।
চোখ কপালে তুলে বলল,
“ এত বই! এসব আপনার?”
কপালে ভাঁজ ফেলল অয়ন। বিভ্রান্ত হলো তুশির আলোকিত মুখখানা দেখে। চোররা কখনো বই নিয়ে ভাবে!
তুশি শুধু ভাবলই না, চপল পায়ে বইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ভেলকি। মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে সে। অয়ন প্রচুর বই পড়ে। ফিকশন-নন ফিকশন থেকে সবকিছু।
তুশি হাত বাড়াতে নিয়েও গুটিয়ে আনল। পিছু ফিরে বলল,

“ বইগুলো আমি একটু ছোঁব?”
অয়নের বিভ্রম প্রগাঢ়।
বলল তাও,
“ হু।”
চটপট একটা বই হাতে নিলো তুশি। বানান করে করে লেখকের নামখানা পড়ল। সময় লাগল তাতে। পরপর প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
“ হূমায়ুন আহমেদ?
উনি বুঝি বইও লেখেন?”
আকাশ থেকে পড়ল অয়ন।
“ তুমি ওনাকে চেনো?”
তুশি তুরন্ত মাথা নাড়ে,
“ হ্যাঁ। বস্তিতে রাবেয়াদের ঘরে সাদা-কালো টিভি ছিল একটা। প্রত্যেক শুক্র-শনি করে সিনেমা হতো। ওনার বানানো কতগুলো সিনেমা যে দেখেছি আমি!

অয়ন মনোযোগ দিয়ে দেখল তরুণীর ঝলমলে মুখটা। সেদিন সুযোগ পেয়ে তার পকেট কাটা তুশি,আর বাচ্চাদের মতো একেকটা বই হাতে নিয়ে ছোঁয়া তুশির মাঝে আজ যেন বিস্তর ফারাক। তাহলে এর কোন সত্তাটা আসল?
তাকের এক পাশে ইংরেজি গল্পের বই রাখা। তুশি একটার পাতা উলটে বলল,
“ এগুলো তো ইংরেজি! আপনি ইংরেজি বইও পড়েন? আমার না ইংরেজি শেখার খুব শখ! ওই যে বিদেশীরা ঝরঝর করে বলে না? অমন। বস্তিতে তো উল্টোপাল্টা বলতাম, কেউ ধরতেই পারত না। কিন্তু আপনাদের বাড়িতে সবাই এত পড়াশোনা জানা! অভ্যাসে দুটো ভুলভাল বের হলেও খুব একটা কিন্তু বলি না এখন।”
বলেই ফিক করে হেসে ফেলল তুশি। যেন ভারি মজার কথা শুনিয়েছে। অয়ন হাসল না। বরং,সূক্ষ্ণ নজরে মেপে নিলো ওকে। বসা থেকে উঠে এলো এবার। জিজ্ঞেস করল কোমল স্বরে,

“ তুমি বই পড়বে?”
তুশি ভ্রু কপালে,
“ আমি? না না।”
“ ইংলিশ বইয়ের কথা বলিনি। হুমায়ূন আহমেদকে চেনো তো। পড়বে একটাও?”
তুশি মাথা নোয়াল। মেকি ইজ্জতের ব্যাপার-স্যাপার দূরে ঠেলে বলল,
“ আমি তো অত পড়াশোনা জানি না। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলাম। এত কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ বুঝবই না কিছু।”
অয়নের মায়া হলো।
ভালোও লাগল কিছুটা।
এ বাড়িতে তো ও ছাড়া তেমন কেউ বই -টই পড়ে না। তাই তুশির আগ্রহ একটা তীক্ষ্ণ শব্দে কড়া নাড়ল মনে।
বলল,
“ আচ্ছা বেশ।
চাইলে আমি তোমাকে পড়ে শোনাতে পারি।”
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে চাইল তুশি।
“ আপনি পড়ে শোনাবেন?”
“ শোনাব। তবে সব সময় হবে না। যখন ফ্রি থাকব,তখন। আর সেটাও আমার মুডের ওপর ডিপেন্ড করবে। চলবে?”
তুশির অত ভাবনাচিন্তা নেই। যা পায়,তাই সই। সজোরে ঘাড় নাড়ল,

“ হ্যাঁ হ্যাঁ।”
অয়ন চেয়ার দেখাল,
“ বোসো।”
তুশি বসল। দৃষ্টির ওই অভিভূতি নিয়ে শেল্ফে চেয়ে রইল তখনো।
অয়ন পরের প্রশ্ন ছুড়ল,
“ কফি খাবে?”
তুশির কাছে কফি দামি খাবার। ছোটো থেকে জেনেছে ওসব বড়লোকদের জিনিস। চুলায় জাল করা রং চা,কিংবা টঙের দুধ চা-টাই বড়োজোর খেয়েছে সে।
এক কথাতেই মাথা ঝাঁকাল,
“ হ্যাঁ।”
তুশি ভেবেছিল অয়ন কফির জন্যে বাইরে যাবে। অথবা রেশমীকে বলবে এনে দিতে।
কিন্তু ওকে রুমের কোনার দিকে পা বাড়াতে দেখে ভ্রান্ত হোলো কিছু ।
এ ঘরে একটাই বড়োসড়ো জানলা। হুরহুর করে যা আলো আসে,তাতেই ঝকঝক করে সব। জানলার পাশ ঘেঁষে একটা কফি কর্ণার বসিয়েছে অয়ন।
ছোটো একটা টেবিলের ওপর সব সরঞ্জাম রাখা। কফি মেকারে হাত দিতেই কৌতূহলে এগিয়ে এলো তুশি।
পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“ এটা দিয়ে বানাবেন?”
“ হ্যাঁ।”
“ এই মেশিনটাকে আমি অনেক দোকানে দেখেছি। আপনারা কত বড়লোক! ঘরের ভেতরেও কফি বানানোর মেশিন থাকে।”
অয়ন হেসে ফেলল।
বলল,
“ তোমাকে প্রথম দিন আমি যতটা চালাক আর ধূর্ত ভেবেছিলাম, তুমি তার আশেপাশেও নও।
পকেট মারতে তোমার হাতটা পাকা হলেও মাথাটা কিন্তু এখনো খুব কাঁচা।”
তুশি কথার মারপ্যাঁচ ছাড়াতে গেল না। মন দিয়ে দেখল মেশিনের সরু ট্যাপ গড়িয়ে কফি পড়ার দৃশ্য। অয়ন খেয়াল করে বলল,
“ এখন বোলো না যে এটাও শিখতে চাও।”
তুশি চোর চোর মুখে তাকাল।
কণ্ঠ মৃদূ,
“ না মানে কিভাবে বানায় এটা দিয়ে?”
শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল অয়ন।
ফিল্টার হোল্ডার দেখিয়ে বলল,
“ এটা ধরো।”

তুশি উৎফুল্ল চিত্তে হাত বাড়াতে গেল,ওড়নার ঝাপটা লাগল পাশের খালি কাপের গায়ে। কাচের তৈরি মগটা উলটে পড়তে নিলে,ঘাবড়ে গেল অয়ন। মারবেল মেঝেতে পড়লে কাচ নিশ্চিত ভাঙবে। টুকরো টুকরো হয়ে গড়াবে এদিক-সেদিক। সতর্কতায় ছেলেটা ছিটকে এক পা সরল পেছনে।
তবে কাপটা মেঝে অবধি পৌঁছাল না। চট করে এক হাত পেতে ধরে ফেলল তুশি। চোখ তুলে অয়নের দিকে চাইল তারপর। ছেলেটার মুখে ভড়কে যাওয়ার ছাপ বসেছে। গোল চোখে হতবুদ্ধিভাব। একটু আগেই
ওকে বোকা বলা মানুষটার চেহারায় এমন তব্দা খাওয়া চিহ্ন দেখে মজা পেলো তুশি। খিলখিল করে হেসে উঠল জোরে ।
অয়ন ধাতস্থ হলো। গলার শ্লেষা কাটাতে মুখের সামনে হাত নিয়ে কাশল একটু। তুশি তখনো হাসছে।
কীসে এত আনন্দ পেয়েছে কে জানে!
কপাল গুছিয়ে রেখেই মেয়েটার পানে ভালো করে চাইল অয়ন। খেয়াল করল,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৫

জানলার গ্রিল মাড়িয়ে নরম সূর্যের একটা আড়াআড়ি কিরণ তুশির ফরসা মুখে বসেছে। ক্ষুদ্র গভীর গর্তের মতো টোল পড়েছে গালে। লালচে ঠোঁটের সাথে
হাসছে ডাগর চোখ। দৃষ্টিতে অপার দীপ্তির সঙ্গে মুখশ্রীতে খুব আশ্চর্য মায়া।
অয়নের কেন যেন মনে হলো এতটা মায়া বোধ হয় অন্য কিছুতে ও কক্ষনো দেখেনি। শিশির ভেজা শিউলির মতো, বা ভোরের আলোতে ফুটতে চাওয়া পুষ্পের মনোরম যে সৌন্দর্য?
মেয়েটা কি সেই সৌন্দর্যের মতোই সুন্দর!

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৭