কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৭
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
রাত একটা বাজে বোধ হয়। নিস্তব্ধ বাতাবরণ ছুঁয়ে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাক ভেসে আসছে হাওয়াতে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানলার পর্দা মাড়িয়ে হুড়মুড় করে আসা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে ফ্লোর। বৃষ্টি হচ্ছে হয়ত। স্টোর রুমের ছোট্ট জানলা ভেদ করে বাজের ছিটকে পড়া আলোতে সেটুকু বুঝতে পারছে তুশি। মেয়েটার চোখে ঘুম নেই। না আছে মনের কোনে একটুখানি শান্তি। অথচ উঠেছিল কাকভোরে! এতক্ষণে নির্ঘাত ঘুমিয়ে মরে যাওয়ার কথা?
তুশির মাথায় দাদির চিন্তা ঘুরছে। একা একা কী করে থাকছে দাদি? খাওয়া-দাওয়া করছে তো! ওর জন্যে খুব কান্নাকাটি করে নিশ্চয়ই। করবেই তো,ও ছাড়া দাদির তো কেউ নেই। অন্তত বোধ হবার পর দাদির কোনো আত্মীয় স্বজন তুশি দেখেনি। না দেখেছে নিজের বাবা-মাকে। তুশির কাছে যেমন দাদিই সব? দাদির কাছেও তাই।
মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইয়াসির নিঃসন্দেহে একজন সৎ পুলিশ অফিসার। যে সামান্য অপরাধও বরদাস্ত করতে জানে না। আচ্ছা,টাকার লোভে বিয়ে করার অপরাধ ওনার কাছে ঠিক কতটা বড়ো? শাস্তি কি এখনো কমেনি!
তুশিকে কি সারাজীবন এখানেই আটকে রাখবে লোকটা!
মেয়েটার মলিন মুখের মাঝে দুটো বিমর্ষ
চোখ সজাগ হয়ে চেয়ে। নিজেকে এক অসহায় পাখির মতো লাগছে,যাকে ধরেবেধে খাঁচায় পুরে দিয়েছে ইয়াসির। প্রতিনিয়ত যে পাখি ওড়ার আশায় আকাশ দেখে যায়। ছটফট করে মরে!
তুশির দশাও এর কম কিছু নয়। কারওয়ানের ওলি-গলিতে মেতে থাকা মেয়েটা ভাগ্যদোষে কেমন আটকে গেল এখানে। কবে ছাড়া মিলবে কে জানে!
তুশির আর ঘুম এলো না। উঠে বসল দ্রুত। ইউশা রাত জেগে পড়াশোনা করে। তার সামনে পরীক্ষা কী না! ওর ঘরের দিকেই রওনা করল সে।
দরজায় টোকা দিয়ে খুব আস্তে ডাকল,
“ ইউশা,ঘুমোচ্ছো?”
ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ কে?”
তুশির জবাব ফিসফিসে,
“ মি ইজ তুশি। দরজা ওপেন পিলিচ।”
ইউশা হেসে ফেলল।
উঠে এলো টেবিল ছেড়ে।
“ এখনো ঘুমোওনি কেন?”
তুশি ভেতরে ঢুকে বলল,
“ আসছেই না। একটু গল্প করতে এলাম। এ বাড়িতে তো তুমি ছাড়া আমার কথা বলার কেউ নেই।”
নিষ্পাপ স্বীকারোক্তি শুনে ফের হাসল ইউশা। পেলব হাতটা ধরে খাটে এনে বসাল। তুশি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল,
“ জানো,তোমাদের বাড়িতে দুটো পক্ষ আছে। একটা ভালো, আরেকটা খারাপ।”
“ তাই? খারাপ পক্ষে নিশ্চয়ই আম্মু আর মেজো ভাইয়াকে রেখেছ। তাহলে ভালোতে কে কে আছে শুনি!”
তুশি ভ্রু বাঁকাল,
“ মেজো ভাইয়া কে?”
ইউশা দুষ্টুমি করে বলল,
“ কে আবার,তোমার বর।”
গুরুতর চোখে চাইল মেয়েটা।
“ বদ পুলিশটা মেজো? আমি তো ভাবলাম উনিই সবার বড়ো।”
“ না। ভাইয়া মেজো,অয়ন ভাই ছোটো আর ওনাদের সবার বড়ো হচ্ছে সায়ন ভাই। যদিও মেজো ভাইয়ার সাথে ওনার বয়সের গ্যাপ সামান্য। এক-দেড় বছর হয়ত হবে।”
সাগ্রহে প্রশ্ন ছুড়ল তুশি,
“ কোথায় থাকেন উনি? এখানে এসে থেকে তো দেখলাম না।”
ইউশার মুখখানা মলিন হোলো অমনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ মারা গিয়েছেন। ওনার যখন তেরো বছর বয়স? তখন একবার একটা রোগ হয়। তাতেই…”
পরপরই বলল,
“ সেসব অনেক আগের কথা। তখন আমার জন্মও হয়নি বুঝেছ!
ছাড়ো ওসব, তুমি আজ অয়ন ভাইয়ের ঘরে গেছিলে?”
তুশি মাথা নাড়ল,
“ হ্যাঁ।”
ও ব্যগ্র চোখে শুধাল,
“ কেমন লাগল তোমার অয়ন ভাইকে?”
তুশি মিটিমিটি হাসে,
“ ভালোই। আচ্ছা, তোমার বুঝি অয়ন ভাইকে খুব পছন্দ?”
সোজাসুজি প্রশ্নে ইউশা হকচকাল,থতমত খেল।
আমতা-আমতা করে বলল,
“ না, তা হবে কেন? আমি সেজন্য বলিনি। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”
তুশি শব্দ করে হেসে ফেলল এবার। এত লজ্জা পেলো মেয়েটা!
মাথা নোয়াতেই ও চিবুক ছুঁয়ে বলল,
“ উনি খুব ভালো মানুষ! আমাকে কফি করে খাওয়ালেন জানো!
তোমার পুলিশ ভাইয়ের মতো তো একেবারেই নন। কী সুন্দর ব্যবহার! ওনার ঘরে না অনেক বই আছে! আমি তো প্রথম দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। ”
ইউশার লজ্জা তখনো কাটেনি। মিহি স্বরে বলল,
“ হুঁ, ভাইয়া অনেক বই পড়ে। কীভাবে যে পড়ে! আমি তো একাডেমিক বইয়ের বাইরে কিছু পড়তেই পারি না। মাথা চক্কর দেয়।”
তুশি ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“ আমার ভাগ্যে তো একটাও নেই। আমার না পড়াশোনার করার খুব ইচ্ছে ছিল! কিন্তু, অভাবের কারণে দাদি পড়াতে পারেনি। তাই কাউকে পড়তে দেখলে,বা কোথাও বই দেখলে?
খুব অদ্ভুত টান কাজ করে আমার। এই যে, মাঝেমধ্যে তোমাকে দেখে ভাবি,ইস আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম। আমিও যদি একটু কলেজ যেতে পারতাম!”
ইউশার মুখে আঁধার নামে। হাতটা ধরে বলল,
“ মন খারাপ করো না। তুমি খুব স্বচ্ছ তুশি। একটা আয়নার মতো স্বচ্ছ। পড়াশোনা জেনেও সবাই এত স্বচ্ছ হতে পারে না।”
তুশি চোখ সরু করল,
“ তুমি কী করে বুঝলে?”
“ জানি না। তবে তোমার প্রতি আমার ভীষণ মায়া কাজ করে। মনে হয়, একদম আমার নিজের কেউ।”
তুশি আবার হাসল। খিলখিল করা মুক্ত বাতাসের মতো হাসি।
“ আমার মতো বস্তির মানুষ তোমার কাছের? এসব তোমার মা শুনলে আবার বকা খাবে।”
ইউশা কিছু বলতেই যাচ্ছিল,আচমকা
দরজায় টোকা দিলো কেউ একজন।
আধভেজানো দোরের ওইপাশে ইয়াসিরকে দেখেই শশব্যস্ত দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটা।
তুশি উল্টোঘুরে বসেছিল তখন। ইউশার হাবভাব দেখে কৌতূহলে চাইল ঘুরে। পর্বতের মতো সটান দেহের ইয়াসির,ঘাবড়ে দিলো তাকেও। উঠল ধড়ফড়িয়ে।
ইউশার কণ্ঠ মৃদূ,
“ ভাইয়া,কিছু লাগবে?”
ইয়াসির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। তুশিকে দেখে ভেতরে আর এলো না। এমনকি এক পল চাইলও না ওর দিকে।
ওভাবেই বলল,
“ তোকে সেদিন একটা ফাইল রাখতে দিয়েছিলাম না?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ । লাগবে?”
নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল সে। ত্রস্ত কাবার্ডের দিকে পা বাড়াল
ইউশা।
ঘরে আপাতত পিনপতন নীরবতা। কোত্থাও কোনো শব্দ নেই।
তুশির মনে হলো ওর নিঃশ্বাস বড্ড বেশি ভুসভুস করছে।
ইয়াসিরের সামনে শ্বাস নেয়াও দুষ্কর। দম আটকে ঠোঁট টিপে রাখল তাই। ইউশা ফাইল নিয়ে ছুটে এলো মিনিটে।
হাতে দিতেই হাঁটা ধরল ইয়াসির। এক পা এগিয়ে থামল ফের। বলল মেঘমন্দ্র স্বরে,
“ রাত অনেক হয়েছে। নিজেও ঘুমা,অন্যদেরও ঘুমোতে যেতে বল।”
মেয়েটা বাধ্যের ন্যায় মাথা কাত করল,
“ আচ্ছা।”
ইয়াসির চলে গেল। দেহটা নিরুদ্দেশ হতেই ভেংচি কাটল তুশি। বিড়বিড় করল মনে মনে,
“ উহ,হুকুম নিয়ে এসেছেন। নিজেও ঘুমা,অন্যকেও ঘুমোতে বল। ঘুমোবো না। নো সিলিপ!
তোর কী রে বিটকেল? তুই গিয়ে সিলিপ কর।”
ইউশা দরজা আটকে বলল,
“ ভাইয়াকে দেখলেই আমার অনেক ভয় লাগে।”
তুশি আবার জায়গায় বসে পড়ল। বলল,
“ লাগবে না? কেমন একটা বাসি রুটির মতো মুখ করে রাখে। তোমার ভাইয়ের মতো এমন দস্যু মার্কা ছেলে আমি কক্ষনো দেখিনি। উহু,নট সী।
একটু গল্প করছিলাম তাও সহ্য হয়নি? বলে কী না অন্যকেও ঘুমোতে যেতে বল?”
ইউশা মাথা নেড়ে হাসল।
প্রসঙ্গ কাটাতে বলল,
“ আচ্ছা, তুমি সব সময় চুলগুলো এমন কাকের বাসা করে রাখো কেন বলোতো! আচড়াতে পারো না?”
“ না। আগে দাদি বেঁধে দিত। আমি পারি না। এসব রংঢং হয় না আমাকে দিয়ে।”
“ আমাকে বললেই তো হয়। আমি আছি কী করতে?”
ইউশা ঝট করে চিরুনি নিয়ে এলো। বসল ওর পেছনে। এত ভালো লাগল তুশির! হাসল একটু।
পাঞ্চক্লিপ খুলে চুলে হাত দিলো ইউশা। চিরুনি গলিয়ে বলল,
“ তুশি,সপ্তাহে দুদিন শ্যাম্পু করবে। চুল তো একদম জট পাকিয়ে যাতা হয়ে আছে। আমার ওয়াশরুমে শ্যাম্পু থেকে শুরু করে সব আছে। তোমার যা লাগবে, নিয়ে নেবে বুঝেছ?”
তুশি মাথা নাড়ল। ও আবার বলল,
“ তোমার চুল কিন্তু বেশ লম্বা। শুধু কুকড়ে থাকাতে বোঝা যায় না। স্ট্রেইট করলে দারুণ লাগবে।”
বুঝল না মেয়েটা,
“ সেটা কী?”
“ এই যে আমার চুল,এমন।”
তুশি ঘাড় ফিরিয়ে চাইল,
“ তোমার মতো সুন্দর হবে?”
“ হ্যাঁ। করবে তুমি?”
“ না,আমি অত টাকা কোথায় পাবো?”
“ আরে,আমার কাছে তো আছে। আমাকে তো বাবা প্রতিমাসে হাতখরচ দেয়। আমি ওসব খুব একটা খরচ করি না। দাঁড়াও,আম্মু কাল নানুবাড়ি যাবে। তারপরই তোমাকে পার্লারে নিয়ে যাব।”
আনন্দে খলবলিয়ে উঠল তুশি,
“ তুমি কত্ত ভালো ইউশা! তোমার মতো এত ভালো মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি। তুমিও ভালো,আর তোমার ডাক্তার মশাইও ভালো। তোমাদের এক সঙ্গে খুব মানাবে।”
ইউশার বুক ধক করে ওঠে। অয়নের নাম শুনলেও যেখানে লাল হয় গাল,সেখানে ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা? কুণ্ঠায় মেয়েটা তাকাতেই পারল না।
কথা কাটাতে মিনমিন করল,
“ ইয়ে, দুটো বাজে তুশি। ঘুমোবে না? কাল আমার ক্লাস আছে। খুব সকালে যেতে হবে।”
শুক্রবার!
ঘড়ির কাঁটা সাতের ঘরে।
এক চোট জগিং সেরে মাত্রই বাড়ি ঢুকেছে ইয়াসির। এখন থেকে ওর ডিউটির সময় কম। হাতে যে দুটো কেস ছিল? আরামসে মিটেছে সেসব। আপাতত খুব জরুরি কেস না হলে ফিরতে রাত হওয়ার ঝামেলা নেই।
ও সোজা ঘরেই যাচ্ছিল, তক্ষুনি রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন তনিমা,
“ সার্থ,সকালের খাবারটা আজ খেয়ে যা না বাবা।”
“ না। এত ভোরে খেতে পারি না আমি। ”
“ সে তো জানি। কিন্তু, কাল রাতে বৃষ্টি হোলো না? খিচুড়ি করেছিলাম সবার জন্যে। তুই এত পছন্দ করিস,একটু অন্তত মুখে দিয়ে যা।”
ইয়াসির হার মানল। কোমলমতি মায়ের ওপর না করতে পারল না। মাথা নাড়তেই তনিমা খুশি হয়ে গেলেন। নিজে এসে টেনে দিলেন চেয়ারটা,
“ বোস বোস। আমি নিয়ে আসছি।”
অয়ন পুরোপুরি তৈরি হয়ে নেমেছে। হাতের ভাঁজে এপ্রোন, আর গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে দাঁড়াল এসে। ওকে দেখে অবাক হলো খুব! বলল,
“ এ কী, তুমি সকাল বেলা টেবিলে ভাইয়া? সূর্য দেখছি পশ্চিমে।”
ইয়াসিরের জবাব শান্ত,
“ তুই টেনে দক্ষিনে নিয়ে আয়।”
হেসে ফেলল অয়ন।
সেই হাসি মুছে গেল তুশিকে দেখতেই।
দুহাতের মাঝে এক গাদা প্লেট-বাটি নিয়ে হাজির হয়েছে মেয়েটা।
এক পল চেয়েই,মুখ ঘুরিয়ে নিলো অয়ন। তাকাল না,ভুলেও না।
কাচের ভেজা প্লেটগুলো টিস্যু দিয়ে মুছে মুছে প্রত্যেকটা চেয়ারের সামনে রাখল তুশি। আজকে হাতটা মোটামুটি পাকা হলেও,প্রথমদিন প্রচণ্ড কেঁপেছে। মনে হয়েছে ঠাস করে পড়ে,টাস করে ভেঙে যাবে সব।
ইয়াসিরের সামনের প্লেটটা খুব রয়েসয়ে রাখল সে। তনিমা এলেন একটু বাদে। বড়ো গামলা ভরা খিচুড়ির সাথে কষা মাংস।
আস্তে আস্তে ইউশা,মিন্তু,সাইফুল সবাই
এলো। তনিমা শুধালেন,
“ তোর মা কোথায়?”
মিন্তু জানাল,
“ রেডি হচ্ছে। বের হবে না!”
তনিমা সাইফুলকে বললেন,
“ খালাম্মার শরীর কেমন একটু জানিও ভাই। শোনার পর থেকেই বেশ চিন্তা হচ্ছে।”
মাথা নাড়লেন তিনি,
“ জানাব ভাবি। আমি তো ওকে দিয়েই চলে আসব আবার।”
রেশমী জয়নবের খাবার দিতে গিয়েছে। বাকিরাও খাওয়া শুরু করলো। তুশি খেয়েছে সবার আগে।
খিচুড়ি হতেই থালা ভরে ওকে খেতে দিয়েছেন তনিমা। ভদ্রমহিলা এত ভালো! অথচ পেটে এমন কুমির জন্মেছে কী করে কে জানে! খেতে ব্যস্ত ইয়াসিরকে দেখে ফের ভেংচি কাটল তুশি। কিন্তু প্রান ভরে শ্বাস নিলেন তনিমা। কী এক বাজে অভ্যেস, সকালে ফ্রেশ হয়ে খেতে পারে না। যাক,আজ অন্তত খাচ্ছে। সাথে ভয় হলো একটু-আধটু। শওকত এখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। উঠে, ফ্রেস হয়ে তৈরি হতে হতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লাগবে? ততক্ষণে ইয়াসিরের খাওয়া শেষ হলেই হয়।
এক চামচ খিচুড়ি তুলে বললেন,
“ আরেকটু দেই?”
“ না।”
পানির গ্লাস তুশির হাতের ওইপাশে ছিল। নিতে হাত বাড়াল অয়ন। মেয়েটা এগিয়ে দিলো সাথে সাথে।
অয়নের চোখমুখ থমকাল অমনি। চাইল মাথা তুলে। সৌজন্যতায় তুশি হাসলেও,নজর নামিয়ে নিলো সে।
কাল তুশির দিকে এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও ওর দৃষ্টি অন্যরকম ছিল। যেটা পাপ,মহাপাপ। সম্পর্কে ওর বড়ো ভাইয়ের বউ তুশি।
তার দিকে একটুখানি বাঁকা চাউনিও ঠিক নয়। না,এই মেয়েকে এড়িয়ে থাকতে হবে। দরকার নেই কোনো ভালোমানুষির।
সবার খাওয়ার মাঝেই, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামলেন শওকত।
কোর্ট-প্যান্ট পরুয়া ভদ্রলোকের হাবভাবে তাড়াহুড়ো খুব। ফ্যাক্টরিতে একটু ঝামেলা হয়েছে।
ইয়াসিরকে তিনি লক্ষ্য করেননি। করার কথাও নয়। ও তো সকালে খেতে বসে না কখনো।
ব্যস্ত হাতে চেয়ার টেনে বসলেন শওকত।
“ তনিমা, তাড়াতাড়ি খাবার দাও বুঝলে! এত দেরি হোলো আ…”
কথার মাঝেই দুম করে উঠে দাঁড়াল ইয়াসির। চেয়ার পিছিয়ে যাওয়ার উৎকট একটা শব্দ হলো ফ্লোরে। বাড়ির সকলে শঙ্কায় কিছু নড়েচড়ে বসলেন। অয়ন মুখ দেখাদেখি করল চাচার সাথে। মিন্তু,ইউশা খেতে ভুলে গেছে।
তনিমার চেহারা কাঠ। ততোধিক চমকে গেলেন শওকত। এই সময় অপ্রত্যাশিত ইয়াসির ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে!
স্তম্ভিত নয়নে স্ত্রীর পানে চাইলেন তিনি। ইয়াসিরের টা-টু শব্দ নেই।
একটা খালি প্লেট টেনে চুপচাপ হাত ধুলো । সফেদ,পাতলা টিস্যু তুলে রওনা করল ঘরে। অয়ন ডাকতে নিলে,থামালেন সাইফুল। বিমর্ষ গলায় বললেন,
“ লাভ নেই। ও আর আসবে না।”
শওকতের চেহারায় মেঘ। অমানিশার একটা লম্বা রেখা ফুটেছে আদল জুড়ে।
বিরস হেসে বললেন,
“ আমাকে দেখেছে না? আসবেই বা কেন!
তনিমা একবার আমাকে জানাতে। ও আছে জানলে,আমি নাহয় পরে বোসতাম।”
ভদ্রমহিলা উত্তর দিতে পারলেন না। স্বচ্ছ অক্ষিকূট ভরে উঠল জলে। ভেজা গলায় বললেন,
“ তুশি,সার্থর খাবারটা একটু ঘরে দিয়ে এসো তো।”
বিভ্রমে ডুবতে থাকা মেয়েটা নড়ে উঠল এবার। ইয়াসিরের রুমে ওর যাওয়া বারণ। কিন্তু তনিমার টলমলে চোখ দেখে আর মানা করতে পারল না। চুপচাপ ঘাড় নেড়ে প্লেট তুলল হাতে।
ইয়াসিরের ঘরের সামনে এসে থামল তুশি। ভয়ে ঝলসে যাচ্ছে ভেতরটা। মনে পড়ল গতবারের কথা। কেমন হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল,
“ আমার ঘরের দরজায়ও আসবে না।”
আতঙ্কিত তুশি আস্তে করে পর্দা সরায়। ভেতরে কেউ নেই দেখে সাহস হয় একটু। চটপট ঢুকল সে। মনের মধ্যে প্লেট রেখেই ছুটে আসার চিন্তা।
কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো। কোথায় গেল লোকটা?
কৌতূহলে এদিক-ওদিক চাইল তুশি। চোখ পড়ল বারান্দায়।
ইয়াসির দাঁড়িয়ে, আঙুলে জ্বলজ্বল করছে সিগারেটের মাথা। সাদা-কালো ধোঁয়া দেখে ও নাক-চোখ কুঁচকাল। মনে মনে বলল,
“ বিটকেল ব্যাটা এসমোক করে?
একে ভালো ভেবেছিলাম।
সেম( শেইম) মাই ভাবনা। ছি!”
ও আর দাঁড়াল না। লোকটা দেখে ফেললে আস্ত গিলে খাবে।
তড়িঘড়ি করে পালাল তাই।
নিচে এসে দেখল টেবিল প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ নেই। শুধু ইউশা আর মিন্তু চুপচাপ খাচ্ছে। দুজনেরই মুখ কালো।
বাকিদের প্লেটের খাবারও একইরকম রাখা। কেউ খায়নি নাকি!
এতক্ষণ তারার মতো জ্বলতে থাকা তনিমাও নীরস চিত্তে বসে। তুশির মনে খটকার একটা সূক্ষ্ম পোকা কিলবিলিয়ে উঠল। বুড়ো লোকটা বসতেই ইয়াসির অমন চলে গেল কেন? এদের মাঝে কি কোনো বিশেষ গল্প আছে!
সৈয়দ ভিলা সুনসান, ফাঁকা। আইরিন আর তুশি ছাড়া একটা মানুষও নেই।
মিন্তু ক্লাস টেস্টে ফেইল করেছে। সেজন্যে অভিভাবকদের তলব পাঠিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। রেহণুমা,সাইফুল কেউ নেই বলে রেশমীকে সাথে নিয়ে রওনা করেছেন তনিমা। ইউশা ক্লাসে। ইয়াসির থানায়। অয়ন ক্যাম্পেইনে। যে যার গন্তব্যে থাকায় বসার ঘরের বিশাল সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে তুশি।
আপাতত তার কাজ-বাজ নেই। রেহনূমা বাড়িতে না থাকায়,চারদিকে শুধুই শান্তির হাওয়া বইছে। তুশি এই ফাঁকে একবার পালিয়ে যাবে ভাবলেও,ওসব ভাবনায় অটল থাকতে পারল না। একে গেইট লক, তালা কোথায় জানে না। দুইয়ে ভেগে গেলেও বা,ইয়াসির যে মানুষ! ঠিক গর্ত থেকে টেনে বের করে আনবে।
তুশির চোখে পড়ল টেলিভিশন। অমনি স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে রিমোর্ট তুলল হাতে।
বাটনে প্রেস করতে যাবে,আচমকা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো কেউ একজন।
হতভম্ব চোখে ফিরল মেয়েটা।
আইরিন রুক্ষ স্বরে বলল,
“ টিভিতে হাত দিয়েছ কেন? আর সোফায় বসলে যে,ওঠো। এসব বাড়ির লোকদের জন্যে। কাজের মেয়ের জন্যে নয়।”
তুশির কপালে ভাঁজ। চোখেমুখে বিরক্তি। কথাবার্তা না বলে উঠে দাঁড়াল তাও।
আইরিন বলল,
“ ছোটো মামি নেই বলে ভেবো না কাজ থেকে বেঁচে যাবে। আমি কিন্তু আছি।”
ওর স্বর ছোটো,
“ এখন আবার কী কাজ?”
“ কী কাজ মানে!
কাজের মেয়ের যা কাজ তাই। মামি যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছেন,ওনার ওয়াশরুমটা নোংরা হয়েছে। তোমাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রাখতে।”
তুশির মাথায় পাহাড় ধ্বসে পড়ল। কণ্ঠ শৃঙ্গে নিয়ে বলল,
“ এ্যাহ, আমি টয়লেট পরিষ্কার করব?”
“ এত অবাক হওয়ার কী আছে?
তোমাকে রাখা হয়েছে কেন? এসব কি আমি করব নাকি!”
তুশি ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। মুখ গোঁজ করে বলল,
“ আমি পারব না। মগের মুল্লুক নাকি? মাই সেলবিরিটি ইমেজ ইজ ডিসটোরয়। (ডিস্ট্রয়)। ওয়াশিং জামাকাপড়, মোছামুছি হোম, এখন আবার টয়লেট কিলিনিং?
নো,আই ডু নট।”
আইরিন বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ তাই নাকি! আচ্ছা ঠিক আছে,
আমি বরং ছোটো মামিকে ফোন করে বলি তুমি পারবে না। তারপর মামি ইয়াসির ভাইকে ফোন করবেন । আর ভাইয়াকে ফোন করলেএএএ…”
পথিমধ্যেই লাফ দিয়ে দাঁড়াল তুশি,
“ নো নো পিলিচ! করে দিচ্ছি।”
চতুরের ন্যায় হাসল আইরিন,
“ দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। জিনিসপত্র সব ওয়াশরুমেই রাখা আছে। যাও।”
খুব অনীহায় অসহায় মুখ করে পা বাড়াল মেয়েটা। বুকটা তার দ্বিখণ্ডিত কষ্টে। এখন কী না লোকের কমোড ধুতে হবে?
ছি! ছি! তুশি, ছি!
মেয়েটার প্রস্থানপথে চেয়ে ক্রুর হাসল আইরিন। দুহাত ঝেড়ে বসল সোফায়। টেনে টেনে বলল,
“ যাও তুশি যাও,মজা টের পাবে এবার। সারপ্রাইজ রেখে এসেছি তোমার জন্যে।”
তুশি নাকচোখ বন্ধ করে সোজা ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মনটা খুব করে বলছে,
“ ঘরে কত দামি দামি জিনিস! কিছু চুরি কর তুশি,একটা কিছু চুরি কর।”
কিন্তু না।
আজ আর সাহসে কূলোলো না ওসব। বাড়িতে শুধু আইরিন আছে। যদি দেখে টেখে ফ্যালে? এ মেয়ে ঠিক কেইস খাইয়ে দেবে। মুখ কালো করে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কা দিলো । টাইলসের মেঝেতে ডান পা ছোঁয়াতেই হড়কে গেল সেটা। সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পড়ে গেল তুশি। ফ্লোরের পিচ্ছিলতায় মাথাটা সজোরে গিয়ে ঠুকল শক্ত বেসিনের সাথে।
প্রচণ্ড ব্যথায় “ মাগোওওওওও ” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠল সে।
বসার ঘরে বসেই সেই চিৎকার শুনেছে আইরিন। আনন্দে ঝলকে উঠল সে। বাড়ল ঠোঁটের হাসি। ওয়াশরুমের মেঝেতে ও সাবান ঘষে রেখে এসেছে।
সেদিনের প্রতিশোধ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেবার আশায়। ওকে দিয়ে ঘর মোছানো? গায়ে ময়লা পানি ঢালা? নে,ঠ্যালা সামলা এবার।
তক্ষুনি দরজার লকে চাবি ঘোরানোর শব্দ হোলো। ত্রস্ত ঘাড় ফিরিয়ে চাইল আইরিন। ইয়াসির ঢুকেছে। মেয়েটার চোয়াল ঝুলে গেল তাতে। ভয়ডরে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। এই রে, ইয়াসির ভাই তো এ সময় কখনো আসেন না বাড়িতে। আজকেই কেন?
মানুষটা যখন দোরগোড়ায়,
তুশির পরের চিৎকার ছুটে এলো নিচে।
আইরিন চোখ খিচে,জিভ কাটল অমনি। গেল রে গেল,সব গেল। ইয়াসির তাজ্জব,বিস্মিত।
প্রশ্ন করল হতভম্ব হয়ে,
“ কে চিৎকার করছে?”
আইরিন চটজলদি উত্তর দিতে পারল না। তুঁতলে উঠল,
“ মমানে,মমান্নে ত ত…”
ইয়াসির বাকি কথা শুনল না। দাঁড়ালও না এক মূহুর্ত। ঝড়ের বেগে ছুটল সিঁড়ির পথে।
তুশির কপাল ফেটে গেছে। রক্ত নামছে এক পাশ বেয়ে। পায়ের গোড়ালি যন্ত্রণায় বিবশ। আচমকা পড়ায়, পিঠের হাড়েও লেগেছে খুব! উঠতে গেলে ব্যথা বাড়ছে আরো। গোঙাতে গোঙাতে ফের চ্যাঁচাল,
“ শুনতে পাচ্ছো, আমাকে একটু ধরবে?”
তুশি আইরিনকেই ডাকছিল। বাড়িতে তো আর কেউ নেই।
তক্ষুনি, দূরন্ত হাতে দরজা ঠেলল ইয়াসির। মেঝেতে লেপ্টে থাকা তরুণীকে দেখে চোখ ঠিকড়ে এলো প্রায়। মেয়েটার ফরসা কপালে রক্ত।
হাত দিয়ে চেপে ধরলেও কব্জি ছুঁয়ে নামছে।
আওয়াজ শুনে মাথা তুলে চাইল তুশি। ইয়াসিরকে দেখে ভরসা পেলো কী না জানা নেই। পানসে মুখে বলতে চাইল কিছু, তবে সময় মানুষটা দিলো না। বিদ্যুতের মতো এসেই ঝট করে কোলে তুলল ওকে।
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৬
তুশি চমকে গেল, স্তব্ধ হোলো। টাল সামলাতে ধড়ফড়িয়ে জড়িয়ে ধরল গলা। পুরন্ত দুই ঠোঁট মেলে হাঁ করে চেয়ে রইল তারপর। ঘরে কেবল এসে দাঁড়িয়েছে আইরিন। অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রিয় এই দৃশ্যে মাথায় বাজ পড়ল তার।
অথচ, এসব দেখার দায়িত্ব ইয়াসির নিলো না। তুশিকে কোলে নিয়েই সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেল সে।