অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ১৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি ঘৃণার সাথে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবতে থাকে এসবকিছু আরহামেরই পরিকল্পনা। এদিকে আরহাম ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই হতবাক হয়ে গেছে যে কিছু বলতেই পারছে না। হঠাৎ করেই নির্ঝর খান এগিয়ে এসে বলে,”এসব কি করলে তুমি? তোমাকে তো আমি সায়রাকে বিয়ে করতে জোর করিনি৷ তুমি যদি এই মেয়েটাকেই পছন্দ করতে তাহলে সেটা আগলে বলতে পারতে। আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার মা-হারা বোনের মেয়েটা এত কষ্ট পেল।”
আরহাম অসহায় কন্ঠে বলে,”ড্যাড, বিশ্বাস করো৷ সত্যটা আমি আজ উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমি আরুশিকে কতটা ভালোবাসি কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নিয়ে যা যা বলা হয়েছে সব মিথ্যা। যেই ছবিগুলো সবাইকে দেখানো হয়েছে তা সত্য নয়। আমি তোমাদের সব ঘটনা খুলে বলছি।”
নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”আমি আর তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। এখন তোমার মুখ দিয়ে মিথ্যা ছাড়া তো কোন সত্য কথা বের হবে না সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি। আমি তোমার সেসব মিথ্যা শুনতে মোটেই ইচ্ছুক নই।”
এদিকে আরিশা খন্দকার হঠাৎ করে এগিয়ে যান আরুশির দিকে। আরুশি নিজের মাকে আসতে দেখে বলে,”আম্মু আমার কথাটা শোনো..”
আরিশা খন্দকার ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেন আরুশির গালে। আরুশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আরুশি বলে ওঠে,”আম্মু তুমি আমায় মারলে..”
“চুপ একদম চুপ। একদম আমায় আম্মু বলে ডাকবি না। আমি কিছু হই না তোর।”
জাঈদ শেখ এগিয়ে এসে বলেন,”আরিশা..শান্ত হও৷ কি করছ টা কি?”
“তুমি আর আজকে আমায় কিছু বলতে এসো না৷ তোমার অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্যই এই মেয়েটা মাথায় উঠেছে। আজ দেখো, আমাদের এত ভালোবাসা, স্নেহের কি দাম দিল। সবার সামনে আমাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরুশি কান্নারত স্বরে বলে,”আম্মু..তোমার মনে হয়, তোমার আরু এমন কিছু করতে পারে যাতে তোমার মান-সম্মান নষ্ট হয়?”
“এটাই তো আমার সবথেকে বড় দোষ যে আমি তোকে অগাধ বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম, তুই কখনো এমন কিছু করবি না যাতে আমার মাথা হেট হয়। ভেবেছিলাম আমি তোকে সঠিক শিক্ষা দিয়েছি, তোকে জন্ম না দিলেও সঠিকভাবে তোকে বড় করতে পেরেছি। জানিস যেদিন তোর বাবা তোকে অনাথ আশ্রম থেকে এনেছিল সেদিন আমার মা হতে না পারার ব্যর্থতা ঘুচেছিল কিন্তু আজ আবারো আমার মনে হচ্ছে আমি মা হিসেবে সত্যিই ব্যর্থ। এজন্যই হয়তো আল্লাহ আমাকে মা হবার ক্ষমতা দেন নি।”
আরুশি কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আম্মু না..”
জাঈদ আরিশাকে বলে,”প্লিজ একটু শান্ত হও, দেখছ তো মেয়েটা কিভাবে কাঁদছে।”
আরুশি এবার মারিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মারিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”কেন করলি তুই এমন? কেন আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিলি, আমি তো তোর ভালোর জন্য কত কি করলাম আর তুই…”
মারিয়া বলল,”আমি কি করেছি? আমি তো শুধু সবার সামনে সত্যটা এনেছি।”
আরহামও এবার এগিয়ে এসে বলে,”সত্যটা এখানে আমরা সবাই জানি। আর সত্য কিন্তু বেশিদিন গোপন থাকে না,একসময় ঠিকই সামনে আসে সেটা তুমি মনে রেখো।”
আরুশি আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি এখন প্লিজ আপনার এই নাটক বন্ধ করুন। আপনিও নিশ্চয়ই মারিয়ার সাথে মিলে এই চক্রান্ত করেছেন তাই না?”
“আরুশি! এসব কি বলছ তুমি?”
এরইমধ্যে নিঝুম খান হঠাৎ করে সেখানে চলে আসেন। আনিকা খানও ছিল তার সাথে। তিনি লাঠিতে ভড় দিয়ে এগিয়ে আসেন। ইতিমধ্যেই তিনি সব জেনে গেছেন। আজকের এই পরিস্থিতি দেখে তার আজ থেকে ৫০ বছর আগে তার এবং আবরাজ খানের বিয়ের কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। কিভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবে বিয়েতে তাদের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছিল। সেসব মনে করেই তিনি এগিয়ে এসে বলেন,”শোনো, তোমরা। ঝগড়া পরে আরো অনেক করা যাবে। কিন্তু এখন আপাতত আমাদের কিছু সমাধানে পৌঁছাতে হবে।”
নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”আর কি সমাধানে পৌঁছাবো মম? তুমি তো নিশ্চয়ই সব জেনেই গেছ যে কত কি ঘটে গেছে এখানে।”
“আমি সবটাই শুনেছি। আর সব শুনে একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছি তোমার ড্যাডের সাথে আলোচনা করে। তোমার ড্যাড ভীষণ অসুস্থ জন্যই এখানে আসতে পারেন নি। কিন্তু আমি আশা করি, প্রবীণ সদস্য হিসেবে আমাদের এই সিদ্ধান্ত তোমরা মেনে নেবে।”
“কি সিদ্ধান্ত মম?”
“দেখো, বিয়ে কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। এটা সারাজীবনের বোঝাপড়ার ব্যাপার, অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ে হলে তার পরিণাম কি হয় সেটা আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। বিয়েতে ভালোবাসা থাকাটা জরুরি, আরহাম দাদুভাই সায়রাকে ভালোবাসে না ও আরুশিকে ভালোবাসি। হয়তো এই কথাটা আমাদের জানাতে অনেক দেরি করে ফেলেছে কিন্তু সবটা জানার পর আমাদের উচিৎ ওদের ভালোবাসায় সায় জানানো। আর এমনিতেও আজ যা হলো তাতে সবাই বিভিন্নরকম কথা বলছে, তাই এসব থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই পথ আর সেটা হচ্ছে—আরহাম দাদুভাই আর আরুশির বিয়ে।”
আরুশি হতবাক স্বরে বলে ওঠে,”না..এটা সম্ভব না।”
নির্ঝর খানও বলেন,”এই বিয়েটায় আমার মত নেই৷ তোমাদের যদি মত থাকে তো বিয়ের বন্দোবস্ত করো। কিন্তু আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।”
আরহাম বলে ওঠে,”ড্যাড শোনো..”
“চুপ। আমি তোমার ড্যাড না। আজ থেকে আমার শুধু একটাই ছেলে আর সেটা হচ্ছে আমান।”
বলেই তিনি রেগে স্থানত্যাগ করেন।
এদিকে আরুশি জাঈদ ও আরিশার সামনে গিয়ে বলে,”আম্মু, পাপা তোমরা আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি এই বিয়েটা করতে চাইনা। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”কেন করবি না তুই এই বিয়ে? আমাদের এত অপমানিত করেও তোর শান্তি হয়নি? আর কত অপমানের ভাগীদার করবি আমাদের?”
“আম্মু..আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি কথা দিচ্ছি, প্রমাণ করে দেব যে, আমার আর মিস্টার আরহামের মধ্যে কিছু নেই।”
“আমি কোন প্রমাণ চাই না। আজ যা হলো, তাতে এই বিয়েটা না হলে আমরা কেউ সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। তাই এই বিয়েটা তোকে করতেই হবে। তুই যদি সত্যি আমাকে নিজের মা বলে মেনে থাকিস তাহলে তুই এই বিয়েটা করবি। আর যদি না করিস, তাহলে ভাবব, তুই কখনো আমাকে মা ভাবিসই নি।”
“আম্মু!”
জাঈদ শেখ বলে ওঠেন,”আরিশা, তুমি এটা ঠিক করছ না। আমি আরুকে বিশ্বাস করি। ও যখন একটা সুযোগ চাইছে ওকে সুযোগটা দিয়ে দেখ৷ শুধুশুধু ওকে কেন জোর করছ এভাবে বিয়ে করতে?”
“আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি৷ এবার বাকিটা ভাবার দায়িত্ব আরুর।”
আরুশি অশ্রুমিশ্রিত চোখে বলে,”বেশ, যদি নিজের মাতৃভক্তির প্রমাণ দিতে আজ আমায় এই বিয়েটা করতে হয় আমি তাই করবো..”
জাঈদ শেখ বলেন,”আরু..জেদের বসে ভুল সিদ্ধান্ত নিও না তুমি। আমি তোমার আম্মুকে বোঝাচ্ছি।”
“না,পাপা তোমায় আর কিছু বোঝাতে হবে না। আম্মু আমার মাতৃভক্তি দেখতে চাইছে..আরে আম্মু বললে তো আমি হাসতে হাসতে বিষও খেয়ে নেব। সেখানে এই বিয়েটা আর কি এমন। আমি এই বিয়েতে রাজি।”
বলেই সে আফিফা খানের দিকে তাকিয়ে বলে,”বড় খালামনি, বলো আমায় কি করতে হবে। আমি তাই করবো।”
আফিফা খান আরুশির কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বলে,”চিন্তা করিস না, দেখবি একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ১৩
বলেই তিনি আরুশি ও আরহামকে একসাথে নিয়ে গিয়ে বিয়ের পিড়িয়ে বসান। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। আরুশি অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে “কবুল” বলার মাধ্যমে শুরু করে অশ্রুজলে বোনা বিয়ের এক নতুন অধ্যায়।
এদিকে দূর থেকে তাদের বিয়ে হতে দেখে মারিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”বাহ, আমার আর রাজীব ভাইয়ের মধ্যে আর কোন বাধা রইল না। এবার আর আমাদের এক হতে কেউ আটকাতে পারবে না।”