প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০ (৩)
সুমাইয়া সুলতানা
ডিনার শেষে ডাইনিং টেবিল গোছাতে সায়রা’কে সাহায্য করে অরু। সায়রা বলেছেন, রুবিনা আপা আছে, তুমি চলে যাও। অরু আমলে নিলো না। হাতে হাতে সাহায্য করে দিল। কাজ কমপ্লিট করে পিলপিল পায়ে, হাত কচলাতে কচলাতে বেডরুমে প্রবেশ করল। বক্ষপটে বিষণ্ণতায় ঘেরা। উচাটন শরীর হাঁসফাঁস লাগছে। হ্যাভেন ডিনার করার সময় একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ সবার আগে খেয়ে উঠে পড়েছে। অন্য সময় কত বকবক করে, অরু’কে খোঁচা মেরে কথা বলে অথচ আজকে তা করেনি। পুরো মুহূর্ত নির্বিকার থেকেছে। এতে অরুর বিতৃষ্ণায় গলা ভিজল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মনগহীন। বুকটা কষ্টে দুভাগ। খানখান হলো অন্তঃপুর।
বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে হ্যাভেন। অরু আস্তে করে পাশে এসে বসলো। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কিঞ্চিৎ। মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে খুল্লুর খুল্লুর কাশি দিল, হাত নাড়াল, বিনুনি করা চুল সামনে এনে ঘোরালো, ফলাফল শূন্য। মানুষটার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ল্যাপটপ স্ক্রিনে। অরুর মন খারাপ হলো। হৃদয় ভারাক্রান্ত। নীরবতার যবানিকার করালগ্রাস মুক্ত করে কিছু বলবে, তার পূর্বেই হ্যাভেনের রাশভারী কন্ঠ শুনতে পেলো,
” ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে মানিব্যাগ রাখা আছে, নিয়ে আসো। ”
অক্ষিপটে নিষ্প্রভ চাহনি ধরে রেখে বিনাবাক্যে মানিব্যাগ এনে দেয় অরু। হ্যাভেন হাত বাড়িয়ে নিলো সেটা। উল্টে পাল্টে কিছুক্ষণ দেখে, পুনরায় অরুর হাতে সমর্পণ করল। অরু প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। অরুর অস্থিরতার পারদে তরঙ্গোচ্ছাস তুলে চকিতে আদেশ ছুড়ল সে,
” ব্যাগের চেইনটা খোলো। ”
হ্যাভেনের নজর ল্যাপটপে। বিস্ফোরিত অরু ঈষৎ ভ্রু কুঁচকালো। প্রখর দৃষ্টি তাক করে মানিব্যাগে। চেইনের মাথায় ঝং ধরেছে কিছুটা। হ্যাভেন এটা ব্যবহার করে না। বাড়িতেই পড়ে থাকে। ফেলেও দেয়নি। অল্পসংখ্যক টাকা হলে এটাতে রেখে দেয়। চেইন খোলার অবসান হতেই অরু দেখল, পকেটে টাকা রাখা। ব্যাগটা ফেরত দিতে উদ্যত হয়, তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে হ্যাভেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তোমার হাত খরচ। ”
অরু চাহনি সংকুচিত করে। টাকার বান্ডিল দেখে আনুমানিক উপলব্ধি করল, কম হলেও এটা পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল। কিন্তু টাকা দিয়ে ও কি করবে? হ্যাভেন থেকে অরু কক্ষনো নিজে থেকে টাকা চায় না। সে নিজেই দেয়। অরু আগে হাতখরচ নিতো না, এখন নেয়। তবে প্রয়োজনের বেশি না। কাজে মগ্ন থাকা লোকটার পানে তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে নমনীয় গলায় জানতে চাইল,
” এত টাকা? ”
হ্যাভেন ওর দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয়,
” রেখে দাও। ”
” লাগবে না। ”
” জানতে চাইনি। তোমাকে দিয়েছি যা খুশি করো। ”
অরু এক টুকরো ক্ষুদ্র মরণ শ্বাস ফেলল। অল্পস্বল্প টলমলে নির্মল জল কোটরে হামলা দিল অচিরে। কাতর অক্ষি ফেরাল অন্যদিকে। ভগ্নহৃদয়ে বসে রইল চুপচাপ। তৎক্ষনাৎ ফের শুনতে পেলো হ্যাভেনের দুষ্টুমি স্বর,
” তুমি তো বুদ্ধিমতি। ”
অরু কৌতূহলি মুখবিবর ঘুরে তাকায়। ড্যাবড্যাব চাহনি। ডান ভ্রুটা একটু উঁচুতে তুলে বিমূর্ত হয়ে বলল,
” কি করে বুঝলেন? ”
মেয়েটির আগ্রহী কথায় ল্যাপটপ হতে চোখ ফিরিয়ে তার পানে চাইল হ্যাভেন। ঠোঁটের কোণ তুলে একপেশে হাসল। রাশভারী মুখটায় চকচকে লাইটের আলো নিয়ে ঝুঁকে এলো খানিকটা,
” কত সুন্দর করে ব্যাগের চেইনটা খুলে ফেললে। আমি পারছিলাম না বলেই তোমাকে দিয়েছি। শোনো, শুধু এই চেইন না, তুমি চাইলে আমার প্যান্টের চেইন খোলার দায়িত্ব নিতে পারো। আমি মাইন্ড করবো না। আফটার অল, আই অ্যাম অ্যা জেন্টেলম্যান। ”
অরুর বিরস ভাবনার প্রতিফলন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দিল হ্যাভেন। সারা মুখে কুন্ঠায় সূর্যের ন্যায় কিরণ ছড়িয়ে পড়ল। ফুলকো কপোল রাঙা হয় মুহূর্তে। এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। বুক ফুলিয়ে ভীষণ লম্বা শ্বাস নিলো। নিঃশ্বাসটা যেন অন্তঃকরণে আটকে ছিল। থ্যাংক গড, এই লোক নিজের পুরোনো ফর্মে ফিরে এসেছে। অরু খুব করে চাইছিল, হ্যাভেন আবার ওকে জ্বালাতন করুক, বিরক্ত করুক। তখন গুরুগম্ভীর ভয়েস শুনে অরুর হৃদয় ছলকে উঠে ছিল। সায়র’কে নিয়ে অযাচিত ভাবনা ভাবলে, এরচেয়ে লজ্জার বিষয় আর হতেই পারতো না৷
অরুও স্বীয় ভঙ্গিমায় রূপ ধারণ করল। হ্যাভেনের তপ্ত শ্বাস ওর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বারি খাচ্ছে। পরক্ষণে গর্জে উঠে। চিড়বিড়িয়ে চোখ রাঙায়,
” নির্লজ্জ, বেহায়া লোক! আপনার মতো মানুষ আমি দুটো দেখিনি। ”
হ্যাভেন গর্বে কাঁধ উঁচায়। অরুর আরক্ত মুখখানা অবলোকন করে জানালো ভীষণ ধীরে,
” কিছু সত্যি কথা বললাম বলে তুমি আমাকে নির্লজ্জ, বেহায়া উপাধিতে ভূষিত করলে? এখন যদি নির্লজ্জের অল্পস্বল্প ডেমো দেখাই, তখন মনে হয় আমাকে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লুচু বলে আখ্যায়িত করবে! এছাড়া, আরও কী কী ট্যাগ যে আমার নামের পাশে লাগাবে, গড নোজ৷ ”
মেয়েটির চেহারায় বিব্রত ভাব। টেনেহিঁচড়ে স্বাভাবিক থাকার প্রয়াস চালাল কিঞ্চিৎ। কটমটে করে দাঁতে দাঁত পিষল,
” আপনার মুখ থেকে কি কখনো ভালো কথা বের হয় না? ”
হ্যাভেন গ্রীবা দু-পাশে বাঁকিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে ঘাড়ের হাড্ডিসার মটমট আওয়াজ করে ফোটাল। সাবলীল কন্ঠে ঢালল নিদারুণ উচ্ছ্বাস,
” হয়, তবে অন্যদের জন্য। তোমার ক্ষেত্রে এরচেয়ে জঘন্য অশ্লীল কথা বের হয়। সেখানে এটুকু তো কিছুই না। ”
” এসব বলেই টিপিক্যাল মেয়েদের ঘায়েল করেন? ”
অরুর ব্যঙ্গাত্মক বাক্যে সুদর্শন পুরুষটি চোখ ছোট ছোট করে। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিপাত ঘটাল। মৃদু চটে প্রত্যুত্তর করল দ্রুত গতিতে,
” অন্য মেয়েদের কখন বললাম? এত ফাউল সময় হাতে আছে? লিসেন, ইউ আর ভেরি ফুলিশ, মাই ইনোসেন্ট ধানিলংকা। এই কূল ভাঙা একাকিত্ব জীবনে স্রেফ ওর স্রেফ একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছি, তাকে আপন করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি, তাকে বউ বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেছি, তাকে নিয়ে অশ্লীল চিন্তা করেছি, অ্যান্ড দ্য মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট টপিক তার সাথে বেড শেয়ার করার কথা ভেবেছি। ”
গরম তরতাজা তেড়ে আসা কতগুলো বাক্যবহরে অরুর দু-কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। লাজে আরক্ত হলো বদন। চারদিকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। ইতোমধ্যে কান দিয়ে অদৃশ্য গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো। এই লোককে নিয়ে কোথায় যাবে ও? আইঢাই ভাব বুকে চেপে জিজ্ঞেস করলো,
” হু ইজ শী? ”
হ্যাভেনের বিলম্বহীন অটল জাবাব,
” মাই লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। ”
” নাম জানতে পারি? ”
” নো নিড৷ ”
” হোয়াট উইল হ্যাপেন ইফ আই নো? ”
” ভালোবাসা কমে যাবে। ”
নাজুক মেয়েটি হতভম্ব কন্ঠে বলে উঠলো,
” এটা আবার কেমন লজিক? ”
” এটা চুমুর অভাবে শুকিয়ে যাওয়া নিষ্পাপ হ্যাভেনের লজিক। ”
বলেই ল্যাপটপ অফ করে সাইডে রেখে, অরু’কে টেনে কাছে নিয়ে আসে। একদম কোলের উপর বসিয়ে দিল। কোমর প্যাঁচিয়ে সময়ের পলকে ঘাড়ে মুখ গুঁজে নিশ্চুপ হয়ে থাকল। অকস্মাৎ হ্যাভেনের অত্যাধিক নিকট অরুর দেহশ্রী ঝংকার তুলল। হটাৎ করা উষ্ণ স্পর্শে কম্পিত হয় অরুর ছোট্ট শরীর, সেই সাথে মিইয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কে চড়া হওয়া সূক্ষ্ণ রাগের স্ফুলিঙ্গ। দুর্বল বক্ষঃস্থল দুরুদুরু কম্পিত হচ্ছে। পুরুষালি স্পর্শ পেয়ে অরু খানিকটা কুঁকড়ে গেল। গলায় কথা আটকে যায়। শব্দ ভান্ডার কন্ঠনালিতে দলা পাকিয়ে বসেছে। কন্ঠ ফুঁড়ে কথা বের হতে সময় নিচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ বাদে গলায় দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেই কম্পিত কন্ঠে বলল,
” আমার শ্বাস আটকে আসছে। ছাড়ুন। ”
হ্যাভেন ঠোঁট কামড়ে হাসে। টের পায় স্বীয় বাহু বন্ধনে আবদ্ধ থাকা নারীর দেহের কম্পন। কাঁধে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিচেল গলায় বলে,
” এখনো তোমার দেহশ্রী কেঁপে যাওয়ার মতো কিছুই করলাম না অথচ এই সামান্য কথা শুনতেই আর একটু কাছ ঘেঁষতেই তোমার অবস্থা এতটা করুণ? ছোট্ট কথার তোপে শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছে? ”
ঘনঘন শ্বাস টানল সে। নেত্রদ্বয়ে দিশেহারা ভাব ফুটিয়ে জানতে চাইল,
” কোথায় ঘাম? ”
অরুর নাকের ডগায় বৃদ্ধা আঙুল ছুঁয়ে দিল হ্যাভেন। মেয়েটি ফের কেঁপে ওঠে। ঘামযুক্ত আঙুল তার চক্ষু সম্মুখে ধরে। অরু থমথমে খায়। হ্যাভেন ব্যস্ত হাতের উল্টো পিঠে কপালের, ঠোঁটের উপরিভাগের ঘাম টুকুন নিরদ্বিধায় মুছে ফেলল। বারংবার ছোঁয়ায় ঈষৎ কাঁপছে জীর্ণ দেহ।
পুনরায় ঠোঁট টিপে হাসল হ্যাভেন। কন্ঠে প্রবল বিদ্রুপ,
” যখন আমার শরীরের সম্পূর্ণ ভার তোমার উপর ছাড়ব, তখন আমাকে সামলাবে কীভাবে? আজও কপালে কোনোদিন বাসর জুটবে কি-না খোদা মালুম! ”
তীব্র লজ্জায় বুঁদ অরু। কর্ণগহ্বর দাহ্য হচ্ছে, হৃদয়ে বিস্ফোরিত ঘটা বাক্যে। কন্ঠ নিচুতে নামাল ও। চোখ খিঁচে বুজে নিলো। আক্রোশ সমেত বলে ওঠে কিড়মিড়িয়ে,
” আপনার লজ্জা করে না এসব বলতে? ”
হ্যাভেন মুখ বাঁকায়। হুল্লোড় বাঁধিয়ে জানান দিল নিজস্ব অভিব্যক্তি,
” লজ্জা থাকলে তো করবে! আমার লজ্জা নেই। তোমাকে বিয়ে করে লজ্জা বেচে দিয়েছি। বউয়ের নিকট যে পুরুষ লজ্জা পায়, তাকে কি আদতে পুরুষ বলে? ”
” আপনার ঠোঁট আমি সেলাই করে দিবো। ”
অরুর চিবুকে আঙুল ছুঁয়ে স্নিগ্ধ লাজুক মুখশ্রী উঁচু করল হ্যাভেন। পরপরই তুরন্ত জবাব দিল দায়সারা ভঙ্গিতে,
” ঠোঁট অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস। এটা দ্বারা অনেক কিছু করা যায়। সো, তোমার আশাটা পূরণ হবে না। ”
বলেই চোখ টিপ মারে। অরু হোঁচট খেলো। পিটপিট করে চায়। হরিণী নেত্রদ্বয় ঠিকরে আসার দশা। ক্ষোভে ফেটে পড়ল শরীর। গোলগাল নাকের পাটাতন ফুলিয়ে, হ্যাভেনের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে উঠে দাঁড়ায়।
হ্যাভেন সঙ্গে সঙ্গে হাত টেনে ধরে। ত্বরিত মুখ খুলল,
” কোথায় যাচ্ছো? ”
কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে,
” জাহান্নামের চৌরাস্তায়। ”
” আমাকে সাথে নিয়ে যাও। ”
অরু রাগান্বিত মুখাবয়বে হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। অমনি শিশুসুলভ চাহনি নিক্ষেপ করল হ্যাভেন। অতর্কিতভাবে মুখবিবর বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। গোমড়া মুখে ফটাফট চেঁচিয়ে ওঠে,
” ডোন্ট লিভ। আমার মনে দুঃখের পাহাড় জমেছে। ”
অরু চমকে উঠল। হতবিহ্বল চাউনি তাক করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ভড়কে শুধায়,
” কেন? ”
” তোমার হরিণী নেত্রদ্বয়ে শুকনো সেজন্য! ”
” মানে? ”
” একদিন গাড়িতে আরেকদিন বাড়িতে আমার টর্চারে অল্প একটু কান্না করেছিলে, এতে আমার মন ভরেনি। তোমার গলা ফাটিয়ে জোরে জোরে কান্নার শব্দ শুনতে চাই। আসো না একটু কাছে। তোমার নিষ্পাপ জামাইটার মনোবাসনা পূরণ করো বউ। ”
সহসা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠে অরু। ক্রোধে ফুঁসতে থাকল। ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। তিরিক্ষি, বিরক্তিকর মেজাজে রুমের বাইরে চলে আসার জন্য পা বাড়াল। আসার আগে তর্জনী উঁচিয়ে কিছু কড়া কথা শোনাবে তক্ষুনি দরজার খটখটে আওয়াজ হয়, সেই সাথে গুনগুন কান্নার শব্দ। অরু হকচকিয়ে যায়। হড়বড়িয়ে দরজা খুলল। টুটুল চোখ ডলতে ডলতে রুমে আসে। অরুর পা জড়িয়ে ধরে। অরু তাকে কোলে তুলে নিলো।
দুপুরে অ্যাক্সিডেন্টের পর, বিকেলের দিকে হ্যাভেন বাড়িতে ফিরে। বাবার কোলে কাঁদতে কাঁদতে সেই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই এখন ঘুম থেকে উঠাতে হ্যাভেন অবাক হলো না। তাকে অবাক করল টুটুলের অপ্রত্যাশিত আগমন। খিদে পেলে খেয়েদেয়ে সায়রের সাথে থাকার কথা৷ তাহলে এখানে কী করছে?
হ্যাভেনের সরু চোখ বর্তায় ছেলের ক্রন্দনরত আদুরে মাখা মুখে। জানতে চায় অত্যন্ত মোলায়েম গলায়,
” আব্বু, তুমি এখানে কেন? তুমি না ঘুমাচ্ছিলে? ”
অরুর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল বাচ্চাটা। থেমে থেমে বুলি আওড়াল ঘুম জরানো আধো স্বরে,
” চাচ্চু পাঠিয়েছে। বলেছে, সুন্দর আম্মুর সঙ্গে না ঘুমালে আমাকে হিরোশীমার দুষ্টু রাক্ষসটা নিয়ে যাবে। রাতে একা চাচ্চু ওটার সাথে ফাইট করবে৷ আমি থাকলে অসুবিধা হবে। ”
অরু ফিক করে হেসে, পরমুহূর্তে অধরে আঙুল রেখে চুপ হয়ে যায়। পেলব হাত গলিয়ে দিল টুটুলের চুলের ভাঁজে। এদিকে হ্যাভেনের উৎফুল্ল আদল পরিবর্তন হয়। নিমিষেই পাহাড় হতে খসে পড়া পাথর খন্ডের মতো বুক জমিন ভারী হয়ে গেল। মুখমন্ডল চুপসে যায়। যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। বদমাশটা ইচ্ছে করে এমন করেছে। রাগ তরতর করে বাড়ল হ্যাভেনের।
কিছু একটা ভেবে অরু বাঁকা হাসল। একপল সময় ব্যয় না করে, টুটুলকে নিয়ে চলে যেতে যেতে জানালো,
” তোমার চাচ্চু সঠিক বলেছে। আজকে আমরা একসাথে ঘুমাবো, তোমার রুমে। ”
টুটুল খুশিতে গদগদ হয়ে অরুর গালে চুমু খায়। আষ্টেপৃষ্ঠে গলা জড়িয়ে ধরে। অরু সামনে আনা বিনুনি ছিটকে পেছনে নিয়ে পৃষ্ঠদেশে ফেলল। ফ্যানের বাতাসে কপাল বেয়ে নেমে আসা চিবুক পর্যন্ত কিছু উড়ন্ত চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অতঃপর ভাব নিয়ে চলে যায়।
ওরা যেতেই হ্যাভেনের টনক নড়ল। চকিতে তাকায়। তটস্ত হয় সেকেন্ডে। তড়াক করে ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে যায়। ততক্ষণে টুটুলের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে অরু। হ্যাভেন করতল দ্বারা জোরে জোরে দরজায় আঘাত করছে। চেঁচামেচি করছে সমান তালে। বাড়ির লোক জেগে যাবে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন ছন্দে দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় মগ্ন সে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। পাষাণ অরু কপাট খুলল না।
দরজায় কপাল ঠুকে হ্যাভেন। অনুনয় স্বরে আর্জি জানায়,
” কলিজা, ওপেন দ্য ডোর। ইউ নো, আব্বুর ঠান্ডায় প্রবলেম হয়। অসুস্থ হয়ে যাব। প্লিজ তোমার আম্মুকে ব্যাক করো। ”
অরু অধরের মিটিমিটি হাসি চেপে, টুটুল’কে ফিসফিস করে বলল,
” তোমার আব্বুকে চলে যেতে বলো। নয়তো আমি রাগ করবো। ”
টুটুল গোল গোল চোখে তাকায়। কন্ঠে ঝলমলিয়ে উঠে শিশুসুলভ সহজ-সরল কথা,
” আব্বু প্লিজ, তুমি তো সবসময়ই আম্মুর সাথে ঘুমাও। আজকে আমি ঘুমাই। ”
অরুর চোখ কপালে। এই ছেলে বলছে কী? একধাপ এগিয়ে বলে কেন? কুন্ঠায় বিমূর্ত অনুভূতি হচ্ছে। পায়ের বৃদ্ধা আঙুল মেঝেতে গাঁথার ক্ষুদ্র বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। ছেলের কথায় নির্লজ্জ হ্যাভেনের ভাবান্তর ঘটলো না। আজ বউ ছাড়া রাত পার করবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে।
জিভের ডগায় শুষ্ক অধর ভেজায় হ্যাভেন। উষ্ণ চোখ নিভে আসে। গুরুগম্ভীর কন্ঠটা হতচেতনায় এঁকেবেঁকে যায়। কন্ঠনালি হতে গভীর, ব্যাকুল বাক্য ভেসে আসে,
” অরু পাখি, মাই কিউট ধানিলংকা, এমনটা করো না। স্বামীকে কষ্ট দিলে আল্লাহ নারাজ হবে। দরজাটা একটু খোলো। তিনজন একসাথে ঘুমাবো। ”
হাসতে হাসতে অরু মেজেতে লেপ্টে বসে পড়েছে। হাসির তোড়ে পেট ব্যথা করছে। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে গজগজিয়ে বলল,
” রাত-বিরেতে ব্যাঙের মতো ঘ্যানঘ্যান না করে, নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান। ”
” ত্যাড়ামি করছো কেন? ”
অরু ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়ল,
” জামাইয়ের খেয়ে, জামাইয়ের সাথে ত্যাড়ামি করবো। কারণ, আমি তার বউ। এতে আপনার সমস্যা কি? ”
হ্যাভেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলো কী এই মেয়ে? প্রকট চক্ষু ছাপানো হতভম্বের মাঝে। বিভ্রান্তিতে লুটোপুটি খেলো। বক্ষভাগে উথলে পড়ছে ক্লেশের সুনামি। চোখের চাহনি বেগতিক। ওষ্ঠ ভাঁজের প্রহসন ততটাই গাঢ়।
শত চেষ্টা করেও দরজা খোলাতে পারলো না। নির্দয় রমণী পণ করেছে আজকে টুটুলের সঙ্গে ঘুমাবে। হ্যাভেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দুঃখি মনে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে বিড়বিড় করলো,
” কথায় বলে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। আসলে তাই, নয়তো আমার রোমান্টিক মুহূর্ত উপভোগ করার পূর্বে বাড়ির লোকজন এসে ডিস্টার্ব কেন করছে? প্রথমে সায়র, এখন টুটুল। আশ্চর্য! এই ছেলে কি তার ভবিষ্যতের ভাইবোনদের আর পৃথিবীতে আসতে দেবে না? ”
রুমে এসে হ্যাভেন ওয়ারড্রব থেকে অরুর কিছু জামাকাপড় বের করল। সেগুলো নিয়ে বিছানায় বসলো। বউ না থাকুক, আপাতত বউয়ের জামাকাপড় দিয়ে কাজ চালাবে। জামাকাপড়ে অরুর শরীরের মিষ্টি, মাতাল করা ঘ্রাণ মিশে আছে। হ্যাভেন লম্বা শ্বাস টেনে নাসারন্ধ্রে সেই ঘ্রাণ লুফে নিলো। মেঝেতে পড়ে থাকা ছোট একটা কাপড় দেখে, দুই আঙুল দিয়ে সেটা তুলে ধরল চোখের সামনে। কিয়ৎক্ষণ পর মুখনিঃসৃত মৃদুস্বরে উচ্চারিত হয়,
” ইনার? ”
অমনি অক্ষিপট বৃহৎ আকার ধারণ করল। হতবিহ্বল চক্ষু চড়কগাছ। মুহুর্তে সেটা দূরে নিচে ফেলে দেয়। পরক্ষণেই আবার তুলে আনে। তারপর সবগুলো কাপড় পেঁচিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে দলার মতো গোল করে বুকে জড়িয়ে, বালিশ শুয়ে পড়ল।
নীলচে আঁধারে বাতাসের শিরশিরে ছোঁয়া, নিস্তব্ধতা আর অনিবার্য এক শূন্যতার সমাহার। হাড়ের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া শীতল পরশ, অথচ বাতাসে এক ধরনের মৃদু উষ্ণতার অস্তিত্ব কঠোরতা আর কোমলতার অদৃশ্য এক সহাবস্থান।
প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০ (২)
হঠাৎ শীতল পবনের শব্দ কর্ণগোচর হতেই শব্দের উৎসের সন্ধানে হ্যাভেন চোখ মেলে তাকায়। জানালা খোলা। সেখানে থেকে গ্রিলের ছোট ছোট ছিদ্র ফাঁক গলিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজে বাতাস রুমের ভেতর ঢুকছে। বাতাসের দাপটে রঙিন পর্দা উড়ছে। তড়াক করে উঠে বসে সে। মুহুর্তে অকল্পনীয় অযাচিত ভাবনা মস্তিষ্কে হামলা চালাল। স্বীয় কল্পনা জুড়ে বিচরণ ঘটলো ভয়ানক সাই সাই শব্দ। ভীতিগ্রস্ত হ্যাভেন জিভ দ্বারা অধর ভেজায়। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” কে ওখানে? ”
বিলম্বহীন ক্যাচক্যাচ জবাব এলো,
” আমি নিউমোনিয়া। ”
শুষ্ক ঢোক গিলল হ্যাভেন। ভীতিকর নেত্র বুজে পাতলা কম্বল দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে সজোরে চিৎকার ছুড়ল,
” অরুউউ, বাঁচাওও! ”