প্রেমপিপাসা পর্ব ৩১
সুমাইয়া সুলতানা
অপরাহ্নের শেষ প্রহর। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে রক্তিম আঁচল ছড়িয়ে ক্লান্ত দিনের শেষ আলিঙ্গনে বিলীন হতে চায়। আলো নিভে যাওয়ার আগে ধরিত্রী শেষবারের মতো সোনালি রঙে সেজে উঠে। পাখিরা নীড়ে ফিরে যায়, গগনের বুকে আঁকা হয় বিদায়ের এক বিষণ্ন চিত্রপট। নীলিমার নরম সোনালি আলো ছুঁয়ে যায় পাতার কান্না, আর প্রকৃতি এক ধীর লয়ের বিষণ্ন সংগীতে মগ্ন।
সূর্যাস্তের লালিমা আভায় রাঙানো আকাশের নিচে কোলাহলপূর্ণ পথ বেয়ে হ্যাভেনের গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যে। দু’পাশে অল্প ছায়াঘন বৃক্ষ, হালকা হিমেল হাওয়া, দূরে মেঘের ছায়া মাখা পাহাড় যেন নিঃশব্দে গল্প বলে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর নীরব রাস্তার মায়াবী টান মনকে করে তোলে নিঃশব্দে বিভোর। বিকেলের মরা রোদে তেজ নেই তেমন, মিইয়ে আসা সেই তেরছা রোদটুকু ঠিকরে পরছে গাড়ির উপর। আলোর রশ্মি আস্তরণ কাচের উপর পড়ায় সেথায় চিকচিক করছে।
ড্রাইভিং সিটে হ্যাভেন বসা, পাশের সিটে অরু। সায়র পেছনে বসে ফোন দেখায় ব্যস্ত। অতর্কিত মাঝ রাস্তায় ব্রেক কষলো হ্যাভেন। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে অরু। এক ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি ফেলল তার উপর।
বিলম্বহীন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গ্রীবা বাঁকিয়ে গুরুগম্ভীর ভয়েস ছুড়ল হ্যাভেন,
” সায়র গাড়ি থেকে নাম। ”
ফোনে হর্স গেম খেলছিল সায়র। ভাইয়ের পুরুষালি মোটা স্বরের চিৎকারে গেম ফ্রোজ হয়ে গেল! রাগ লাগলো ভীষণ। তীব্র বিরক্তি নিয়ে শুধায়,
” নামবো কেন? ”
” আমি বলেছি তাই। ”
কথা বাড়াল না সে। নেমে দাঁড়ায়। পরপর হ্যাভেনও গাড়ি হতে নেমে অরু’কে নামতে বলে। হ্যাভেনের আকস্মিক কর্মকাণ্ড কারো বোধগম্য হচ্ছে না। অরু গাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র বিনাবাক্যে, হ্যাভেন তাকে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ভেতরে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দেয়। নিজেও গিয়ে পাশে বসে দরজা লাগায়। অরু রাগী চোখে তাকায়।
হ্যাভেন থোরাই কেয়ার করল! বরঞ্চ হা করে দাঁড়িয়ে থাকা সায়রের পানে চেয়ে আদেশ ছুড়ে গমগমে গলায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” মূর্তি হয়ে আছিস কেন? সামনে বোস। ”
” হোয়াই ইন ফ্রন্ট? ”
” ড্রাইভিং করবি। ”
হ্যাভেনের সাবলীল জবাব। সায়র হতবাক! জানতে চায় অবাক হয়ে,
” আমি কি ড্রাইভার? ”
সে মুখের উপর অকপটে জানায়,
” অবাধ্য হলে তোকে রেখেই চলে যাব। ”
প্রখর অপমানে ফাটা বেলুনের মতো মুখখানা চুপসে যায় ছেলেটার। থমথমে মুখে ড্রাইভিং সিটে বসে, গাড়ি স্টার্ট দিল। পুনরায় ভাইয়ের রাশভারী কন্ঠ শুনতে পেলো,
” জাস্ট ফোকাস অন ড্রাইভিং। পেছনে ভুল করেও তাকাবি না। ”
” তাকালে কি? ”
হ্যাভেন নির্বিকার। নিগূঢ় চাউনিতে কঠোরতা। ফ্রন্ট মিররে ভাইয়ের রক্তিম চোখ দেখে, থেমে যায় সায়র। নিশ্চুপ হয়ে ড্রাইভিং করতে লাগলো। স্বগোতক্তিতে ভাইকে কটুকথা বলতে ভুলল না।
হ্যাভেন পুনরায় চড়া আওয়াজ তুলল,
” সামনের ওই নীল কাপড়ের টুকরো দিয়ে ফ্রন্ট মিরর ঢেকে দে, নয়তো মিরর ঘুরিয়ে দে। ”
সায়র এতক্ষণে ভাইয়ের অভিব্যক্তি বুঝতে সক্ষম হলো। মিররে কাঠিন্য মুখশ্রীর অরু’কে পরখ করে দাঁত কেলিয়ে ঈষৎ হাসল। হাসি আড়ালে লুকিয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। মিরর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল।
এদিকে অরু চোখ দুটি বিস্ফারিত, ঠোঁট হালকা ফাঁকা, মুখে জমে থাকা অভিব্যক্তি এক নিঃশব্দ চমকের ছাপ। মুখমণ্ডলে বিস্ময়ের ছায়া। বিহ্বলিত নয়নে প্রশ্ন। বউয়ের কৌতূহল দৃষ্টি অনুসরণ করে ক্ষুদ্র শ্বাস ছাড়ল হ্যাভেন। তবে দৃষ্টি সরাল না। চক্ষু গহ্বরে তলিয়ে আছে মুগ্ধতার অর্হনিশ।
অরু নেত্রমণি ঘুরিয়ে চাইল সে চোখে। কন্ঠ খাদে টানল। রাগে ফোঁসফাঁস করতে করতে জিজ্ঞেস করল রূঢ় সুরে,
” অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছেন কেন? ”
অসন্তুষ্ট হলো হ্যাভেন। বলল হাস্যহীন,
” তোমার হিংসা হলে তুমিও সারাজীবন এভাবে তাকিয়ে থাকো। ”
” আমি আপনার মতো নির্লজ্জ না। ”
হতাশার ভারিক্কি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। উত্তর দিল সিরিয়াস ভঙ্গিতে,
” সেজন্যই আমার কপাল পোড়া। বউ এত সুশীল বলেই বাসর কি আজও না জানা আমি! ”
মেয়েটা কপাল কুঁচকালো। ধাতস্থ হয়। প্রশ্ন করে সন্দিহান চোখে,
” বাসর ছাড়া টুটুল আ…..! ”
পুরো কথার যবানিকা টানার আগেই হ্যাভেন অরুর কোমর চেপে ধরে। সহসা মেয়েটা কথার বাণ গিলে নিলো। এই সুন্দর মূহুর্তে অরুর মন চিন্তার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হোক সেটা বোধ হয় বরদাস্ত করবে না হ্যাভেন। মনোরম পরিবেশটা ঝগড়া করে কাটানোর কোনো মানেই হয় না! যার দরুন ম্যানিউপুলেটিভ পন্থায় মূহুর্তেই ঘুরিয়ে নিলো বিষয়বস্তু।
চমকে উঠা রমণীর অধরে আঙুল ছুঁয়ে হ্যাভেন হৃষ্ট চিত্তে আওড়ায়,
” তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক বিশ্রী লাগছে, খেয়ে ফেলি? ”
” কিহ! ”
আশ্চর্য কন্ঠে শুধায় অরু। লোকটা নিস্পৃহা ভীষণ। গলার স্বর অপরিবর্তিত রেখে ধ্বনিত হয় ঠান্ডা স্বর,
” কুল কুল। আই মিন, লিপস্টিক উঠাতে হেল্প করবো। ”
অরু ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিল। তিরস্কার করল নাক ছিটকে,
” লাগবে না৷ ”
একটু থামল। পরক্ষণেই ভাবুকতা গলায় জানতে চাইল,
” এটা কি হলো? ”
হ্যাভেন কপাল গোছায়,
” কোনটা? ”
” ব্যাক সিটে নিয়ে এসেছেন যে! ”
” দরকার আছে৷ ”
ওর কন্ঠ আগ্রভরা,
” হোয়াট ইজ রিকোয়্যার্ড? ”
হ্যাভেন ঝুঁকে আসে। মেয়েটা ভড়কে যায়। পেলব হস্ত গাড়ির সিটের একাংশ মুঠোয় ধরে। পুরুষালি উষ্ণ ওষ্ঠপুট কানের নিকট পৌঁছাতেই নাজুক শরীর কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করে,
” গাড়িতে নিউমোনিয়া রয়েছে। ”
চোখা নেত্রে চাইল রমণী,
” কোত্থেকে আসলো? ”
” তুমি নিজেই আস্ত একটা নিউমোনিয়া। আমার হৃদয়ে তুফান উঠানো ঘূর্ণিঝড়! ”
হ্যাভেনের ঘোর লাগা মোহময় স্বর। অরু কুন্ঠায় হাঁসফাঁস করল নীরবে। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ফেঁপে উঠল রক্তিম কপোল। শুষ্ক ঢোক গিলল। লোকটার বাহু বন্ধনে থেকেই ছটফটাল ব্রীড়ায়। ঘনঘন শ্বাস টানছে। কুঁকড়ে আসে। পিপাসায় কাতর কণ্ঠনালী, অবরুদ্ধ। কোনো রকম উত্তর দেয়,
” সায়র আছে। কীপ ইয়োর ডিস্টেন্স। ”
আরও সেটে যায় হ্যাভেন। অরুর মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে নেয়। চিকণ আঙুল নাড়াচাড়া করতে করতে আশ্বস্ত করল স্বর নামিয়ে,
” ওর সাহস নেই পেছন ফেরার। ”
অরু চোখ নামায় নিচে। অন্তঃকরণে ধকধক শব্দ হচ্ছে। মুহূর্তে খিঁচে বুজে ফেলল হরিণী নেত্র। তক্ষুনি শুনতে পায় হ্যাভেনের প্রশ্ন। ফের চাইল মেয়েটা।
হ্যাভেন উন্মুখ মোটা ভ্রু কুঁচকে ব্যাকুল গলায় বলল,
” অরু আমার অস্থির লাগছে। ”
মেয়েটা বুঝলো না। বোঝার অবস্থায় নেই। তুফান নেমেছে তার বিশীর্ণ সুশ্রী দেহে। মোচড়ামুচড়ি করছে, তবুও সরতে পারছে না। হ্যাভেন শক্ত করে ধরে আছে। জোর খাটালে সায়রের সম্মুখে যা-তা বলে বসবে। তাই শান্ত হয়ে গেল। মুখ খুলল রয়েসয়ে,
” প্রচুর গরম। সরে বসুন। ”
নিরুৎসাহিত সে। তবে অরুর কথায় মুখবিবরে সূক্ষ্ম উত্তেজনা। নিজস্ব অভিব্যক্তি বদলে গেল নিমিষে। গাঢ় চাউনি বর্তায় মেয়েটির উপর। ললাটে মৃদু ভাঁজ ফেলে এক ভ্রু নাচাল,
” গাড়িতে এসি চলছে, তবুও গরম? ”
থমথমে খায় অরু। টেনেহিঁচড়ে স্বাভাবিক থাকার প্রয়াস চালাল কিঞ্চিৎ। বারকয়েক পলক ঝাপটায়। এদিক ওদিক চোরা নজর বোলায়। তীব্র বেগে হানা দিল অস্বস্তি। আরক্ত বদনে গুটিয়ে বসলো আরও। জিভে অধর ভেজাল। আমতা আমতা করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” গরম লাগলে বলবো না? ”
এতটুকু বলে আড়চোখে হ্যাভেন’কে দেখল। তার নিগূঢ় সূঁচালো দৃষ্টি। যা দেখা মাত্র ভড়কাল কিছুটা। গিলতে চাইল বিব্রত ভাব। স্বগোতক্তিতে হতভম্ব হয়।
বউয়ের আইঢাই ভাব উপলব্ধি করে ফিচেল হাসে হ্যাভেন। কোমরের আরেকটু চাপ দিয়ে বাকি দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো। মেয়েটার অস্বস্তি চূড়ায় উঠাতে নেশালো চোখে ফট করে বলে বসলো,
” অবশ্য তুমি যা হট, গরম তো লাগবেই। আমারও লাগছে। ”
অরু অসহায় মুখভঙ্গিতে তাকায়। হ্যাভেনের ছোঁয়া ওর নারী সত্তার সবটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। অথচ লোকটা ভাবলেশহীন! সুপ্ত রাগ তরতর করে বাড়ছে। ক্রোধে নাকের পাটাতন ফুলছে। কটমটিয়ে ক্ষিপ্র নয়নে তাকাল। কন্ঠনালি হতে বেরিয়ে এলো ক্ষেপাটে গর্জন,
” মুখটা অফ করুন। এমন করলে যাব না! মাঝ রাস্তায় নেমে যাব। ”
হ্যাভেন শীতল চোখে তাকায়। খুশিতে ফুঁসে উঠা অন্তঃপট সহসা নেতিয়ে যায়। মনঃক্ষুণ্ন হয়। অরুর গালে নাক ঘষে জবাব দিল দায়সারা,
” আমি থাকতে বউ নেমে যাবে, তা কখনো হয়! ঠ্যাং ভেঙে কোলে বসিয়ে রাখবো। ”
অরু মুখ বাঁকায়। মুখশ্রী জুড়ে ফ্যাকাশে ভাব। পরক্ষণেই চিড়বিড়ে গর্জে উঠল। ঠোঁটের কোণে কপটতা খেলে গেল। বলল ব্যঙ্গ করে,
” একটা আঙুল ভাঙার ক্ষমতা নেই! আসছে ঠ্যাং ভাঙতে! ”
ছুটন্ত কটাক্ষ বাক্যে সুদর্শন পুরুষটি অক্ষিপট ছোট করে। ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিপাত ঘটাল। অতঃপর উচ্চারণ করল মেঘমন্দ্র কন্ঠে,
” নেই বলছো? ”
হ্যাভেনের হতবিহ্বল ঔৎসুক কন্ঠ। অরু বাঁকা হাসল। বিদ্রুপ সরূপ চোখে চোখ রেখে ব্যগ্র গলায় ঠোঁট নাড়ল,
” আছে নাকি? ”
হ্যাভেন দমে গেল। বাহ্যিক কাঠিন্য রূপে যতই চোটপাট দেখাক, ওই কাজল টানা ঘন পাপড়ি যুক্ত হরিণী নেত্রদ্বয়ে খেই হারায় ক্ষণে ক্ষণে। বউয়ের রক্তজবা অধর পানে নজর আটকালে দুনিয়া ভুলতে অবকাশ রাখে না সে। আপেলের ন্যায় টোল পড়া মসৃণ থুতনি দেখে বরাবরই পরাস্ত হয় ভেতরের পৈশাচিক সত্তা। জ্বলজ্বল চাহনি নিভে এলো। বউয়ের আহ্লাদী একটা মিহি বাক্য অন্তঃকরণ নাড়িয়ে দেয়।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পরপর বুক ভরে দম টেনে ঠোঁট কামড়ে হাসল। এড়িয়ে গেল অপার্থিব প্রশ্ন। ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়ায় দুষ্টুমি টানল হ্যাভেন। প্রসঙ্গ পাল্টায় অবলীলায়,
” তোমার না গরম লাগছে? চলো বাড়িতে ফিরে যাই। গিয়ে তোমার সবকিছু খুলে দিবো, তখন আর গরম লাগবে না। ”
অরুর কর্ণগহ্বরে বোমা ফাটাল যেন। কপোলে কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। রক্তিম তা গোধূলির ন্যায়। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। ওর মূলত গরম না, অস্বস্তি লাগছে। হ্যাভেনের আধ্যাত্মিক নৈকট্য স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছে না। হৃৎস্পন্দনের ধুকপুকানি বাড়ছে। বহু কসরত করে নিজেকে সামলে নিলো। লাজে রাঙা মুখশ্রী তৎক্ষনাৎ গম্ভীর লালায়িত হয়ে এলো। ক্ষোভ প্রকাশ করতে চেয়েও করল না। বিরস মুখে বিফল শ্বাস ঝাড়ল। এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
তবে হ্যাভেন স্থির থাকল না। একবার অরুর কাঁধে মাথা রাখে, একবার কেশবহুলে নাক ডোবায়, কখনো কানে ফুঁ দেয়, এভাবে পুরোটা সময় মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মেরেছে।
ভবনের বিশাল ডাবল-ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অরুর চোখ আটকে গেল। আলো, আর প্রাচুর্যের এক অবিশ্বাস্য সংমিশ্রণ। সাদা মার্বেলের মেঝেতে ঝকঝক করছে ঝাড়বাতির আলো। দেয়ালে দেয়ালে দামী চিত্রকর্ম, যেগুলোর ফ্রেম খাঁটি কাঠের আর কারুকাজে ভরা। সোফাসেটগুলো লেদার কাভার্ড, সোনালি-কুঁচানো কুশনে সাজানো। পাশে ছোট ছোট সেন্টেড ক্যান্ডেল জ্বলছে। মিষ্টি একধরনের সুগন্ধি ছড়াচ্ছে পুরো ঘরে।
ঘরের এক পাশে লাইভ পিয়ানো সেশন। কালো স্যুট পরা এক শিল্পী হালকা ব্লুজ বাজাচ্ছে। আতিথেয়তার সাথে একটা নরম, রোমান্টিক মুড তৈরি করে চলেছে সুর। দেয়ালের মাঝে মাঝে লম্বা আয়না, যার ফ্রেমও ঝলমলে ধাতব কাজের। সেন্টেড ক্যান্ডেলের আলোয় চারপাশে এক ধরণের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ভ্যানিলা আর গোলাপের মিশ্র সুবাস। অতিথিরা একে একে প্রবেশ করছে। কেউ ওয়াইন হাতে নিয়ে আলোচনায় মগ্ন, কেউ আবার সেলফি আর রিল ভিডিওতে ব্যস্ত।
সিঁড়ির পাশ দিয়ে উঠেছে এক মখমলি কার্পেট, যা সোজা উঠে গিয়েছে উপরের তলায়। অরু তাকিয়ে দেখল, উপরতলায় কিছু অতিথি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পার্টির মজা নিচ্ছে, কেউ কেউ আবার নিচের পিয়ানো সুরে মাথা দোলাচ্ছে।
বাড়ির ডান পাশে বিলাসবহুল বার কাউন্টার। গেস্টদের জন্য আলাদা আলাদা করে ওয়াইন সেকশন, মকটেইল বার আর মিনি কফি কর্নার। অভিজাত খাবারের বিশাল আয়োজন। সুশি, গ্রিলড স্যালমন, কালো অলিভসহ নানা ধরনের সালাদ, সাথে এক্সক্লুসিভ মিষ্টি কর্নার, যেখানে ফরাসি পেস্ট্রি, টার্ট, চকোলেট ফন্ডু, মিনিয়েচার ম্যাকারুন সাজানো শিল্পের মতো। কাচের গম্বুজের নিচে রাখা কিছু স্পেশাল হ্যান্ডমেড চকোলেট, যেগুলো শুধু ভিআইপি গেস্টদের জন্য দামী ওয়াইন, হুইস্কি, চাম্পেন আর বিদেশি মদ দিয়ে সাজানো। দক্ষ বারটেন্ডার কাচের গ্লাসে পরিবেশন করছে একের পর এক ককটেল আর হ্যাভেনের মতো কিছু ভিআইপির পছন্দের পানীয়।
আরও একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটি সুবিশাল ডাইনিং বুফে সাদা কাপড়ে ঢাকা টেবিল, যার উপরে সারি সারি স্টার্টার, মূল খাবার, ডেজার্ট আর জুস সাজানো। ইনডোর ফাউন্টেনের শব্দ আর হালকা মিউজিক পুরো পরিবেশটাকে করে তুলেছে একেবারে স্বপ্নময়।
সবকিছুর মাঝে অরু ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে বিতৃষ্ণার ছাপ। ওর মনে হচ্ছে বাংলাদেশে না, অন্য দেশের পার্টিতে এসেছে। সেরকমই একেকজনের গায়ের পোশাক। বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকগুলো চোখে লাগছে খুব। তাদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বাড়ি হলেও তাদের বাইরের কান্ট্রিতে আনাগোনা বেশি, যার দরুন সেদেশের কালচার মনে লালন করে বড়ো হয়েছে।
সায়র এসেই দিকবিদিক বেমালুম ভুলে ডান্স ফ্লোরে গিয়ে মডার্ন শর্ট ড্রেস পরিহিত মেয়েদের সঙ্গে নাচতে লাগলো। কারো সাথে না কুশলাদি বিনিময় করল, আর না তো হ্যাভেন’কে পরোয়া করল! শুধু সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো হুইস্কির একটা গ্লাস নিয়ে ডান্স ফ্লোরে চলে যায়।
হ্যাভেন পরিচিত ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কথা বলছে। ওর বন্ধু শাওন গেস্টদের ওয়েলকাম করতে ব্যস্ত। হ্যাভেন’কে ওয়েলকাম করে পার্টি এনজয় করতে বলেছে। হ্যাভেনও হেসে ভেতরে চলে আসে। সামনে যাদের সাথে দেখা হয়েছে সকলের সঙ্গে কথা বলে অরু’কে মীট করিয়ে দিয়েছে। হেঁটে হেঁটে বেশি গেস্ট যেখানে রয়েছে সেদিকটায় এসে থামল।
” আরে হ্যাভেন! হোয়াট’স আপ? ”
উপস্থিত গেস্টদের মধ্যে হ্যাভেনের এক ফ্রেন্ড বলে ওঠে। হ্যাভেন আলতো হেসে প্রত্যুত্তর করে, হ্যান্ডশেক করল তার সঙ্গে। পরপরই একদল বন্ধুরা একপ্রকার হামলে পড়ল ওর উপর। হকচকিয়ে উঠল হ্যাভেন। নিচে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলো দক্ষ ভঙ্গিমায়। সবকটার হাত ছাড়িয়ে নিলো। ক্ষুদ্ধ হয়ে স্বল্প রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল,
” বেকুবের দল, আস্তে। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। ”
পাশ থেকে এক বন্ধু ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে শুধায়,
” বিয়ে করেছিস শুনলাম। তোর মতো একজন মানুষ লুকিয়ে বিয়ে করেছে ব্যাপারটা অদ্ভুত! ”
সকলে একযোগে চেঁচিয়ে উঠল আচমকা,
” তাই নাকি? ”
” মিথ্যে বলবো কেন? ”
বন্ধুরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে হ্যাভেনের নিকট তাকিয়ে। হ্যাভেন নিরুদ্বেগ। জানায় দ্বিধাহীনভাবে,
” বয়স হয়েছে বিয়ে করবো না? কতকাল আর কোলবালিশ নিয়ে কাটাবো? তুই শুনলি কার থেকে? ”
বন্ধু ভণিতা ছাড়া বলে,
” শাওন বলেছে। ”
হ্যাভেন লম্বা শ্বাস টানল। উপর নিচ মাথা নাড়ে,
” আসলে হুট করে হয়ে গিয়েছে। ”
ক্ষেপে উঠল বন্ধু। প্রতিবাদ করল নিভু স্বরে,
” হজম হলো না। শত খোঁচাখুঁচি করেও তোকে মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্ট জন্মাতে পারলাম না। সেই তুই আচানক বিয়ে করে ফেললি? আই ক্যান্ট বিলিভ দিস! ”
” আমি তো আবেগে ভাসা মানুষ না, যে কারো কথায় বিয়ে করবো। ”
আরেক বন্ধু চোখ বড়ো করে জানতে চাইল সচকিত হয়ে,
” তাহলে পছন্দ করে বিয়ে করেছিস? ”
এ পর্যায়ে হ্যাভেন ঠোঁট কামড়ে হাসে। জবাব দিল না। নির্বিকার হয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল।
শাওন এসে হুল্লোড় বাঁধিয়ে বলল,
” শালা তলে তলে টেম্পু চালিয়েছে, অথচ আমরা কেউ টের পেলাম না! ”
হ্যাভেন ভ্রু গোটায়,
” না বললে জানলি কি ভাবে? ”
” তুই নিজে বলিসনি। জাজলিনের থেকে শুনেছি। তারপর ফ্রেন্ড-সার্কেলে জানিয়েছি। ”
এবারেও ভ্রুক্ষেপহীন সে। বন্ধুদের অভিমানে কিছু যায় আসে না তার। একজন বন্ধু ডান্স ফ্লোরে বউকে সায়রের সঙ্গে নাচতে দেখে বলে উঠল উদাসীন ভাবে,
” বিদেশের পানি পেলে মেয়েরা আকাশে উড়তে থাকে। হাসব্যান্ড থেকে অন্য ছেলেদের সাথে ডান্স করা বেশি পছন্দ করে। এটা নাকি নরমাল। কিছু বলা যায় না। উল্টো বলে আমি নাকি গাইয়া! ”
পাশে থেকে অন্য বন্ধু চ্যাঁচাল,
” কি আর করবি? বাইরে গিয়ে মশা মার! ”
ঠোঁট চোখা করল হ্যাভেন। বক্ষপটে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়। অশান্ত হৃদয়ের কন্ঠস্বর শৃঙ্গে,
” আমার মতে, মশা মারার চেয়ে বড় কঠিন কাজ হলো বিয়ের পর বউয়ের সঙ্গে তর্কে জেতা। মশা অন্তত মরে, কিন্তু বউয়ের তর্ক কখনো শেষ হয় না। ”
শাওন পিঠ চাপড়ে বাহবা দিল,
” খাঁটি কথা। ”
পাশের বন্ধু অমায়িক হাসি টানল ঠোঁটে। খোঁচা মারল হ্যাভেনের উদ্দেশ্যে,
” বউ এত জ্বলালে আমাকে দিয়ে দে। পছন্দ হলে রেখে দেবো। ”
নিমিষে হ্যাভেনের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা আঁধারে নিমজ্জিত হয়। মেরুদণ্ড সোজা করল। সীনা টানটান করে। শীতল চাহনি কিন্তু সেথায় আগ্নেয়গিরির ভয়ানক লাভা ফুটে উঠেছে। ওষ্ঠে উচ্ছ্বসিত হাসি ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা চালাল। সক্ষম হলো না। তার অরু পাখির কথা উঠলে মাত্রাতিরিক্ত বেগবান হয়ে পড়ে সে। চেতে সোজাসাপটা নীরব হুমকি দিল রাশভারী কন্ঠে,
” বউ জ্বালায় কখন বললাম? আর পছন্দের জিনিস সবাইকে দেওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসার জিনিস কাউকে দেওয়া যায় না! তুই ফান করেছিস, তবুও আমার রাগ বর্ষার অথৈ জলের মতো বাড়ছে। এক্ষুনি থেমে যা। আমার বউ নিয়ে আমি বড্ড সিরিয়াস। তাকে কেউ কল্পনায়ও চাইলে তার মস্তক কেটে ফুটবল খেলতে দু’বার ভাববো না। ”
শাওন এসে ওর গলা প্যাঁচিয়ে ধরল। ঘটনা বেগতিক দেখে রাগত্ব হ্যাভেন’কে মানানোর স্বরে বলল,
” রিলাক্স ইয়ার! হি হ্যাড ফান। ”
হ্যাভেনের রাগ সম্পর্কে অবগত সকলে। তাই আর ঘাঁটল না। পায়ের কাছে একটা বিড়াল খামছে ধরায় হ্যাভেন ঈষৎ কেঁপে দৃষ্টি নত করল। বিড়ালটা পিটপিট করে চেয়ে মিঁয়াও মিয়াঁও আওয়াজ তুলল। খানিকক্ষণ পরে লেজ নাড়িয়ে চলে গেল।
হ্যাভেনের ইতস্তত চমকানো মুখ দেখে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো,
” ভয় পেলি নাকি? ”
তার সরল স্বীকারোক্তি,
” বউ ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না, এই হ্যাভেন তালুকদার।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সকলে। হাসতে হাসতে শাওন গর্বিত সমেত বলে,
” যাক আমাদের ডেঞ্জারাস হ্যাভেন অন্তত কাউকে তো ভয় পায়! শুনে খুশি লাগলো। ”
কথার মধ্যিখানে পাশের বন্ধুর আগ্রহী প্রশ্ন তেড়ে এলো,
” তোর ওয়াইফ কোথায়? ”
হ্যাভেন কাঁধ উঁচায়। বাঁকা হেসে পাশে দেখায়,
” এই যে। ”
” কোথায়? ”
ভ্রু কুঞ্চিত করে গ্রীবা বাঁকায় হ্যাভেন। পাশে অরু নেই। ধরিত্রী সহ থমকে গেল সে। বক্ষঃস্থল ধরাস ধরাস করছে। নিমিষে আতঙ্কে ছেয়ে গেল মুখমন্ডলে। উত্তেজিত হয়ে ধড়ফড়িয়ে এদিক ওদিক নজর বোলালো। কিছুটা দূরে অশান্ত নজর পড়তেই উচাটন বক্ষপট শিথিল হয়। অরু আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে। হ্যাভেন ভেবেছে ওর সাথেই আছে। মেয়েটা পাগল বানিয়ে ছাড়বে ওকে!
বুক ফুলিয়ে আহত শ্বাস ছাড়ল সে। মুখনিঃসৃত ঘটলো শান্ত বাক্য,
” জাস্ট অ্যা মিনিট। আই’ল বি রাইট দেয়ার। ”
কথা শেষে অরুর দিকে এগিয়ে গেল। একদম মুখোমুখি দুজন৷ তার গালে এক হাত রাখল। শান্ত, মোলায়েম কন্ঠ করুণ শোনালো,
” তুমি এখানে! তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। ”
তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না অরু। বলল ভোঁতা মুখে,
” আমি এসবে অভ্যস্ত না। সবকিছুতে বিদেশি আভিজাত্য। ”
ওর হাত ধরে হ্যাভেন জানালো ভীষণ ধীরে,
” আমার সাথে এসো। ”
অরু’কে বাকিদের সঙ্গে মীট করিয়ে দিল হ্যাভেন। অরুর বিরক্ত লাগছে। শাওন বাদে হ্যাভেনের বন্ধুদের গায়ে পড়া স্বভাব! চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাকে।
অরু’কে যে নিজের কাছে রাখার কথা বলেছিল, সেই বন্ধু বুকের বাম পাশে হাত রেখে বলতে লাগল হড়বড় করে,
” দোস্ত, ভাবীকে দেখে কট খেলাম। ”
হ্যাভেন রাগান্বিত চোখে তাকায়। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। বুক ফুলছে সবেগে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। সহসা থেমে যায় বন্ধু। ছেলেটা মেকি হেসে ত্রস্ত মিনমিন করে বলল,
” সরি। ভাবী মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। আমার বোনের মতো। ”
তন্মধ্যে কর্কশ হাসির রোল পড়ল। অরুও অগোচরে ঠোঁট টিপে হাসে। কথা চলল দীর্ঘক্ষণ। অরু’কে নিয়ে সোফায় বসে পড়ল হ্যাভেন। স্বভাবসুলভ অরুর সঙ্গে চিপকে বসেছে। ওয়েটারকে ডেকে অরুর হাতে অরেঞ্জ জুসের গ্লাস ধরিয়ে দিল হ্যাভেন।
এত সেটে বসায় চাপা স্বরে অরু আক্রোশ নিয়ে বলে,
” পার্টির লোকদের চোখে ঠেকছে না? গা ঘেঁষা পুরুষ মানুষ! ”
হ্যাভেন তীর্যক দৃষ্টিতে চায়। আরও কাছাকাছি আসে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা ঢালল,
” একশোবার, হাজার-বার ঘেঁষব। শোনো, সম্পর্ক হলো বিদ্যুৎ কানেকশনের মতো, যা ভুল জুড়ে গেলে সারাজীবন শক দেবে। আর ঠিক জুড়ে গেলে, সারা জীবনটা আলোয় ভরিয়ে দেবে। তাই আমি জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছি। ”
কপোত-কপোতীর টুকরো টুকরো দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটির ক্ষণে জাজলিন সেখানে উপস্থিত হয়। কাজের জন্য হ্যাভেনের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। এসেই হ্যাভেনের পাশে বসলো। একটা জবরদস্ত টাইট হাগ করল। হ্যাভেন’কে বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল না। সে অত্যন্ত নরমাল। জাজলিন একজন ফরেনার। হ্যাভেনও রাশিয়ার কালচার জানে, তাই বিষয়টা নরমালি নিয়েছে।
অরু’কে পরখ করে গদগদে গলায় জাজলিন শুধাল,
” ইজ দিস ইয়োর বিউটিফুল ওয়াইফ? ”
হ্যাভেন মাথা নাড়ল শশব্যস্ত,
” ইয়াহ! ”
জাজলিনের সাথে অরু’কে পরিচয় করিয়ে দিল হ্যাভেন। উৎকন্ঠিত অরু স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। প্রচুর বিতৃষ্ণা হানা দিয়েছে ভেতরে। যত যাইহোক, স্বামীর বুকে অন্য নারী মেনে নেওয়া কঠিন! তার উপর জাজলিন’কে আগে থেকেই সহ্য করতে পারে না। তবুও মুখে কিছু বলল না। জোরপূর্বক হেসে কথা বলতে থাকল তার সাথে।
শাওন ডাকছে। অরু’কে খাবার খেতে দিয়ে হ্যাভেন উঠে পড়ল। কিয়ৎক্ষণ কথা বলে জাজলিন চলে যায়। অরু জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে একা বসে। সকলে যার যার মতো পার্টি এনজয় করছে। বিশেষ করে ডান্স ফ্লোরে সবাই নাচায় মগ্ন।
অরু আড়চোখে আশেপাশে নজর বোলালো। দীর্ঘক্ষণ ধরে বজ্জাত লোকটার দেখা নেই। কোন রাজকার্যে গিয়েছে কে জানে! হঠাৎ পাওয়ারফুল লাইট নিভে গেল। অরু জড়োসড়ো হয়ে বসলো। অন্ধকার ছাপিয়ে সেথায় টিমটিমে ঝলমলে আলোকরশ্মি হানা দিয়েছে। মূলত বেশি আলোতে ডান্স করা বেমানান। আলোকিত রশ্মির মূল ফোকাস বিন্দু ডান্স ফ্লোরে। অরু সেদিকে চাইল। তক্ষুনি দৃষ্টি স্থির হয়। তীক্ষ্ণ চাহনি বর্তায় হ্যাভেনের দিকে। সে আপন ছন্দ তুলে বাকিদের সঙ্গে নাচছে। অমনি চক্ষু কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। হরিণী নেত্র বড়ো করে চেয়ে রইল। পরক্ষণে নাকমুখ বিকৃত করল। হ্যাভেনের নাচটা পুরাই অখাদ্য! সে টলতে টলতে কোমর দোলাচ্ছে! কেমন উজবুকের ন্যায় আচরণ করছে।
সে নাচার তালে এগিয়ে এসে একজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। হাতের বন্ধন দৃঢ়। ক্যাবলা মার্কা হাসি উপহার দিয়ে জরানো গলায় উৎফুল্ল চিত্তে বলতে লাগলো,
” অরু? আমার বউ, নিউমোনিয়ার মহা ওষুধ। আসো, আসো, কাছে আসো। ”
চারপাশে সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে হ্যাভেনের। কিয়ৎক্ষণ বাদেই আলিঙ্গনে আবদ্ধ মানুষটার গাল ছুঁয়ে দেয়। নির্নিমেষ কপাল বেঁকে এলো। আওড়াল গোমড়া মুখে,
” অরু পাখি, পুরুষের মতো তোমার গালে দাঁড়ি গজালো কখন? ”
পরমুহূর্তে ক্রোধে জর্জরিত হয়ে পড়ল। নিভু নিভু অক্ষিপট জ্বলে উঠল। মানুষটাকে আরও ভয়ংকর ভাবে জড়িয়ে ধরে হাঁক ছুড়ল শাওনের দিকে,
” ওই শালা শাওন! ডেট ওভার মাল খাওয়ালি নাকি? আমার মসৃণ পেলব ত্বকের সুন্দরী বউটা গায়েব হয়ে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত বউয়ের উদয় হয়েছে কেন? ”
অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে জড়িয়ে ধরায় দম বন্ধ লাগছে সায়রের। যাকে জড়িয়ে ধরেছে হ্যাভেন, সে সায়র। ছোটার জন্য লাফালাফি করছে, হ্যাভেন ছাড়ছে না। বেচারা ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে ব্যর্থ। মদ খেয়ে সেও টলছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে তর্জন দিল সায়র,
” ছাড়ো বলছি। ”
হ্যাভেন আমলে নিলো না। তার এসবে খেয়াল নেই। অবিন্যস্ত ভঙ্গিমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে সায়র’কে। কন্ঠ নির্লিপ্ত থমথমে,
” ছাড়ব না। ”
সায়রের কাতুকুতু লাগছে। গলা ফাটিয়ে হাসছে। পরক্ষণে অঙ্কিতার কথা মনে পড়তেই সচকিতে আওড়াল,
” ভাই দূরে যাও। ”
সে চিড়বিড়িয়ে কাটকাট জবাব দেয়,
” নেভার। ”
সায়র বিচলিত অসহায়ের ন্যায় মুখে হতবুদ্ধিভাব চিহ্ন তুলল,
” প্লিজ, মাই ইজ্জত ভিক্ষা মি। ”
হ্যাভেন শুনতে নারাজ। মোহঘোরে থেকে প্রফুল্ল গলায় বলল ফ্যাসফ্যাসিয়ে,
” তোমার লাজ-লজ্জা আজ হরণ করবো বউ। ”
অকস্মাৎ চোখ বুজে সায়র শূন্য জলে কেঁদে উঠল। ফের খুলে অনুনয়ের চোখে আর্জি জানায়,
” ছেড়ে দাও। আমার এখনও বিয়ে হয়নি। বাচ্চার মুখ দেখা হয়নি। এভাবে আমার ভার্জিনিটি নষ্ট করো না। অঙ্কু জানটুস জানলে রিজেক্ট করে দিবে। ভবিষ্যতে বংশের বাতি জ্বলানো প্রদীপ গুলো খাঁটি বাংলায় লুইচ্চা বাবা ডাকবে। আমার এত বড়ো সর্বনাশ করো না, ভাই। ”
সায়রের উচ্চস্বরে বাজখাঁই বাক্যবাণ কর্ণগোচর হতেই হ্যাভেনের অল্পস্বল্প সম্বিত ফিরল। জবরদস্তি অক্ষিপট বৃহৎ আকার বানালো। চিনতে অসুবিধা হলো না৷ ড্যাবড্যাব চাহনি নিক্ষেপ করে ঘৃণা সমেত প্রত্যুত্তর করল তৎক্ষনাৎ,
” সেজন্যই বলি, বউয়ের গালে দাঁড়ি কেন! ”
ছিঃ! বলে সায়র’কে ছেড়ে দেয়। বউকে খুঁজতে হেলেদুলে গ্রীবা বাঁকায়। তক্ষুনি ভীমড়ি খায়৷ চক্ষুপটে একগুচ্ছ গোলাপের মতো ভেসে উঠেছে অরুর স্নিগ মুখশ্রী। ছন্নছাড়া হৃদয়টা আচমকা শান্ত, স্থির, হিমবাহের ন্যায় শীতল হয়ে এলো। মুখে হাত চেপে স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো সে,
” ওরেব্বাস! আমার এত্তগুলো বউ আসলো কোত্থেকে? ”
এরপর ডান হাতের তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে ভাঙা গলায় গুনতে লাগলো,
” একাটা অরু পাখি, দুইটা অরু পাখি, তিনটা, চারটা, ছয়টা, দশটা আয়ায়া! এত্তগুলো অরু পাখি! কপাল খুলে গেল? নিউমোনিয়া আমাকে আর অ্যাটাক করতে পারবে না। ”
শেষের কথাটা বলে সজীব চিত্তে জোরে জোরে হাসতে থাকল। ওর মাতলামি দেখার সময় কারোর নেই। কারণ, হ্যাভেনের থেকে বেশি নেশা বাকিরা করেছে। ছেলে-মেয়ে উভয়ই।
অরু গটগট কদমে এগিয়ে এসে হ্যাভেনের সামনে পদযুগল থামাল। হ্যাভেন’কে এমন করতে দেখে আরও আগেই উঠে এসেছে। কাছে আসতেই মদের বিভৎস উতকৃষ্ট গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল তার৷ কিড়মিড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষল,
” আপনি ড্রিংক করেছেন? ”
সে খুশি হলো। বেক্কলের ন্যায় গা জ্বালানো হাসি দিয়ে অরুর কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়াল। উত্তর করল থেমে থেমে,
” নাতো। আমি ভদ্র ছেলে। ”
তৎক্ষনাৎ তেতে উঠল অরু। ফেটে পড়ল রোষে। রাগে রক্তিম আদল। শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। অ্যালকোহল নূন্যতম পছন্দ নয় তার। হ্যাভেনের বাহু চেপে শক্ত কন্ঠে বলল,
” সায়র চলো, বাড়ি ফিরে যাই। ”
ঘাড় কাত করল ছেলেটা,
” এসো। আমি গাড়ি বের করছি। ”
সায়রের থেকে নজর ফিরিয়ে অরু যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে হ্যাভেন’কে। সে লোক নাছোরবান্দা,
” যাব না বাড়ি। আসো ডান্স করি। ”
কপাল চাপড়াল রমণী। ইচ্ছে করছে গলাটা টিপে দিতে। খিটখিটে মেজাজে চিকণ গলায় ধমকে উঠলো,
” নো মোর টক! এক্ষুনি বাড়ি ফিরবো। ”
হ্যাভেন গাল ফোলায়। শিশুসুলভ সহজ-সরল চোখে তাকায়। নিমিষে ঠোঁট উল্টায়,
” পঁচা বউ! খালি বকে! চুমু খায় না! ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০
ফোঁস করে নীরস শ্বাস ফেলল অরু। স্বর খাদে নামাল ও। গজগজিয়ে চড়া কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে হুংকার ছুড়ল এবার,
” বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ চলুন। বকবকানি অফ না করলে কপালে ডিভোর্স ঠুকে চলে যাব৷ ”
নিষ্পাপ মুখাবয়ব কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল হ্যাভেনের। বিস্ফোরিত নয়নে তাকায়। অকস্মাৎ নিম্ন ওষ্ঠ ফুলিয়ে অরু’কে বুকে জড়িয়ে ধরল। ঘোর বিরোধিতা জানিয়ে কন্ঠনালি হতে ধ্বনিত হলো প্রেমিক পুরুষের আহাজারি,
” অলরাইট, আই’ল বি কোয়ায়েট নাও। স্টিল, প্লিজ ডোন্ট লিভ মি। ”