প্রেম ও অসুখ পর্ব ১১

প্রেম ও অসুখ পর্ব ১১
নবনীতা শেখ

তিনদিন স্বামী ছাড়া শ্বশুরবাড়ির আলো, বাতাস, ধূলা সব গায়ে মেখে সাঁঝ ঢাকা ফিরল। এই তিনদিনে স্বামীর সাথে ফোনালাপ, ভার্চুয়াল সংসার ও শাশুড়ির সাথে কোমড়ে আঁচল গুঁজে গিন্নি সেজে ঘর সামলানো—সবই সমান তালে করে গেছে সাঁঝ। ওদিকে ভার্চুয়ালে পাতানো নতুন সংসারে সাঁঝের টাঙানো আধহাত ঘোমটা এখনো খোলেনি সাহেব। কী জানি কেন!
সাঁঝ রুমে এলো। পূর্বিকা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হে গৃহিনী? মজা হলো?”
সাঁঝ হেসে হেসে বলল,
-“সেই মজা, আপু। বিবাহ করো। বুঝবা।”
-“মজার বিবরণ দাও। চোখ-মুখে দেখে তো মনে হচ্ছে না শান্তিপূর্ণ মজলিশ থেকে ফিরেছো!”
পূর্বিকার একহাতে একটা বিড়াল গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। সাঁঝ জিজ্ঞেস করল,

-“এটা কার, আপু?”
-“ওহ! বিড়ালটা? ওপরতলার ভাড়াটিয়ার!”
-“কী সুন্দর, আপু! নাম কী?”
-“ইভ।”
সাঁঝের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বিড়ালটাকে নিজের কোলে নিল। ইভ আরও গায়ে মিশে শুলো। সাঁঝ কেমন গলে যাচ্ছে। সে বলল,
-“আরেহ বাহ! ইভ অর্থ সন্ধ্যা, সাঁঝ মানেও সন্ধ্যা.. কী দারুণ মিল!”
পরপরই সাঁঝ পূর্বিকার দিকে তাকাল,
-“আপু, আমি ওকে কিছুসময় আমার কাছে রাখি?”
-“হ্যাঁ, রাখো।”
পূর্বিকা সাঁঝের ব্যাগটা ওর হাত থেকে নিয়ে রুমের এক কোণায় রেখে খাটে আয়েশ করে বসল। অতি কৌতূহলী চাহনি তার। গলায় আহ্লাদ,
-“বলো তো এবার। শ্বশুরবাড়ির মধুরহাড়ি কেমন লাগল?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাঁঝ ইভকে কোলে নিয়ে চেয়ার টেনে সামনে বসল। হাপিত্যেশ সব শব্দের ছোঁয়ায় বের করতে লাগল,
-“বিবাহের তিনমাস পেরিয়ে গেছে, আপাজান। আমার এখনো বাসর হয় নাই। শ্বশুরবাড়িতেও শ্বশুর নাই, দেশের বাইরে গেছেন। স্বামীর বিছানায় স্বামী নাই। ওদিকে রায়বাঘিনী ফুপাতো ননদিনী যেন সাক্ষাৎ শালী চুন্নি! আমার বর চুরি করতে উঠে-পড়ে লাগোয়া। মা-মেয়ে দু’জনের চেহারাতেই চোর চোর ভাব। গা-টা জ্বলে যায়।”
পূর্বিকা অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলল,
-“তো তিনদিন কী করলে ওখানে?”
সাঁঝ ফিসফিসিয়ে বলল,
-“সত্য বলব?”
-“আলবাত সত্য বলবে।”
-“তো শোনো..”
সাঁঝ নড়েচড়ে বসল। পূর্বিকার ভীষণ আগ্রহী মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“প্রেম করেছি।”
পূর্বিকা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
-“কার সাথে!”
-“তোমাকে বলব না।”
-“কেন?”
-“তুমি যদি স্বামীকে প্রেমিকের খবর জানিয়ে দাও?”
পূর্বিকা থতমত খেয়ে গেল। হৃদের সাথে তার পরিচয় আছে, সেই থেকেই তো অদিতি আর সাঁঝকে নিজের সাথে রেখেছে৷ মেয়েটার খোঁজ-খবর নিয়ম করে হৃদকে জানাচ্ছে৷ এগুলো তো গোপন খবর! সাঁঝ কি কোনোভাবে জেনে গেছে? না..নাহ! তা কী করে হয়? এত সহজ নাকি জানতে পারা?

অথচ সাঁঝ বোধহয় পুরোটা না হলেও অনেকটা জেনে গেছে। তার জানার পরিসীমার বিস্তৃতি পূর্বিকা আন্দাজ করতে পারল না। বাড়িতে কথা বলতে হবে, এমন বাহানায় সে নিজের রুমে চলে এলো। আর তারপর কল লাগাল হৃদকে।
হৃদ গাড়িতে ছিল। গতদিন কিছু প্রয়োজনে তাকে শহরের বাইরে যাওয়া লেগেছিল। সেখান থেকেই ফিরছে। পথিমধ্যে কল পেয়ে সে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে পূর্বিকা অস্থির চিত্তে বলতে লাগল,
-“ভাইয়া, সাঁঝ মেবি প্রেম করছে। এখন কী হবে?”
হৃদ প্রথমত সেকেন্ড দুয়েকের জন্য হকচকিয়ে গেল। পর পর হেসে উঠল। রসাত্মক গলায় বলল,
-“চিন্তা কোরো না রে, পূর্বি। ভাবি তোমার ভাইয়ের সাথেই প্রেম করছে।”
পূর্বিকার বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। কাঁদোকাঁদো হয়ে সে বলল,
-“আমি তোমাদের একটুও বুঝতে পারি না। আমি জানি না, আমার মাথার ব্রেইন গরমে গলে গেছে নাকি তোমরা এলিয়েন।”
হৃদ জবাবে হেসে বলল,

-“তো ম্যাডাম কী করছে? বাসায় পৌঁছেছে কখন?”
-“এই তো ভাইয়া, পনেরো মিনিট হলো। ফ্রেশ হচ্ছে.. হয়ে গেছে মেবি। তুমি তাকে কল দিয়েই জেনে নাও। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে কল দিই। তোমাদের কাহিনির প্যাঁচে আমার মাথাটা ভো ভো করছে। আপাতত এ বেটা ছাড়া কেউ আমাকে শান্ত করতে পারবে না।”
-“অল দ্য বেস্ট।”
-“হুম। ইউ ঠু, ভাইয়া।”
পূর্বিকা কল কেটে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে “বপ্পেন” নিকনেমে সেভ করা কন্ট্যাক্ট নম্বরটি থেকে কল এলো। পূর্বিকা কল রিসিভ করেই বলল,
-“তোরে আমি এমনে এমনে শয়তানের বাচ্চা কই রে?”
নয়তো তাকে কল দিতে যাওয়ার সাথে সাথেই লোকটার তরফ থেকে কল আসে নাকি! ওপাশ থেকে রাফির নিষ্পাপ কণ্ঠ এলো,

-“কেন? আমি কী করছি?”
পূর্বিকা শান্ত হলো তার আওয়াজ শুনে। মরুভূমির মতো উত্তপ্ত অন্তরটায় একপশলা বাতাস বয়ে গেল। তার রণচণ্ডী আওয়াজ এবার নমনীয় বেশ,
-“কিছু করোনি। খাইছো তুমি? ভাত খাইছো?”
রাফি বলল,
-“এই বিকেলবেলা ভাত খাব কেন?”
-“তাহলে দুপুরে যে খাইছো, সেটাই বলো।”
-“হ, দুপুরে খাইছিলাম।”
-“এই বেটা, শুনো না! একটা কথা বলার ছিল।”
-“হ, শুনতেছি। কও তুমি।”
পূর্বিকা বিছানায় মিশে গেল। আওয়াজ কাঁপতে লাগল সামান্য,
-“আই লাভ ইউ।”
রাফি তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করল,
-“লাভ ইউ ঠু, পূর্বি।”

-“চলো না বিয়ে করি! আমার বয়স এবার চব্বিশ হয়ে গেল। বিয়ের বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে.. ওদিকে অলমোস্ট সব ফ্রেন্ডরাই বিয়ে করে ফেলছে। কারো কারো তো বেবিও হয়ে গেছে। কী ভাল্লাগে ওদের দেখে! আমারও ইচ্ছা করে। আমার ফ্যামিলি থেকে বিয়ে নিয়ে কোনো কাহিনি নেই। তোমারও এবার ছাব্বিশ চলে। ভালো চাকরি পেয়ে গেছো। বিয়ের জন্য পার্ফেক্ট টাইম এটা…প্লিজ!”
রাফির থেকে জবাব আসতে এবার কিছুটা সময় লাগল। পূর্বিকার বুকের ভেতরটা কেমন ছলকে উঠল। ওর গলার স্বর আরও করুণ হয়ে উঠল,
-“রাফি..”
রাফি এবার শুনতে পেল যেন,
-“দেখো পূর্বি, তোমার বিয়ের বয়স হইছে, বুঝলাম। আমারটা একটু বুঝো। কেবল ছাব্বিশ। চাকরিটা হইছে একমাসও হয়নি। লাইফটা গুছায়ে নিতে একটু সময় লাগবে না? এখনই কীভাবে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যাই?”
-“বিয়ের পরও লাইফ গোছানো যায়, রাফি। একসাথে গোছাব আমরা। সাড়ে চারবছর ধরে প্রেম করছি। বিয়েটা জরুরি।”
রাফি অতিষ্ঠ গলায় বলল,

-“প্রেশার দিও না, প্লিজ।”
লাফিয়ে উঠে বসল পূর্বিকা। চোখ দুটো ক্ষণিকেই রক্তলাল হয়ে এসেছে, মাথাটা জ্বলে যাচ্ছে। গলার আওয়াজ অত্যন্ত রূঢ়,
-“প্রেশার দেই আমি তোমাকে? আমাকে তোমার প্রেশার লাগছে? তোমাকে চিনি না আমি? সুবিধাবাদী লোক! সময় বুঝে চলো। সময় এলে আমাকেও ছুড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে না। বুঝতে পারছি না আমি?”
-“ধুর বাল! কথা না বুঝে কাহিনি মারাচ্ছে…”
কল কেটে দিলো রাফি। পূর্বিকা আরও বেশ কয়েকবার কল লাগালো। হাজারটা টেক্সট, কল শেষে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। আচ্ছা, কান্নারা কবে ফুরাবে? নাকি ছোট্ট দুই চোখের কোটরে জমা পড়ে আছে এক অসীম মহাসমুদ্র!

হৃদ পূর্বিকার কল কেটেই সাঁঝকে কল দিলো। সাঁঝ ব্যাগ থেকে কাপড় নামাচ্ছিল। এবার শাশুড়ি মা তাকে একগাদা শাড়ি উপহার দিয়েছেন। সেদিন শাড়ি পরিহিত কোমরে আঁচল গোঁজা গিন্নি সাঁঝকে দেখে আফিয়া বেগম এতই আপ্লুত হয়েছেন যে পরদিনই এত এত শাড়িসহ নিজের শখের জমানো শাড়িগুলো সাঁঝকে দিয়ে বলেছেন,
-“সবসময় শাড়ি পরে থেকো।”
সাঁঝ সব তো নিয়ে আসতে পারেনি। ওখান থেকেই বেছে কয়েকটা নিয়ে এসেছে। সেগুলোই গোছাচ্ছিল এখন। এমন সময় সাঁঝের জেনারেল মোডে থাকা ফোনটা “বেবিডল” গান তুলে বেজে উঠল। সাঁঝ কাপড় গোছাতে গোছাতে কলিং টিউন শুনে নাচতে লাগল। একবার কল কেটে গেল, এরপর আবার, এরপর আবার! চতুর্থ বারে সাঁঝ কল রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে হৃদের অস্থির আওয়াজ,

-“ইউ ওকে?”
সাঁঝ সামান্য কেশে গলায় গাম্ভীর্য এনে বলল,
-“হুম, আ’ম ওকে।”
-“কল ধরছিলে না কেন?”
সাঁঝ মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
-“কী আশ্চর্য! ফোন ধরে বসে থাকব নাকি? ব্যস্ত ছিলাম।”
-“ওহ, ওকে! তো কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, শুনি?”
সাঁঝ আরও খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল,
-“কাপড় ভাঁজ করছিলাম।”
-“এটা কল পিক না করার মতো ব্যস্ততা?”
-“না। একচুয়ালি রিংটোনটা আমাকে এনার্জেটিক করে তুলছিল। শুনেন না! আমি এখন আবার কল কাটব। আপনি ননস্টপ কল দিতে থাকবেন। পুরা চাঙ্গা হয়ে যায় শরীর।”
হৃদ অবাক হতে গিয়েও হলো না। তারই তো বউ! সাঁঝ কল কাটল না। বারান্দার পর্দা সরিয়ে ফেলে জিজ্ঞেস করল,

-“তো সাহেব, আছেনটা কই? বাসায় নাকি অন্যত্র? চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছেন?”
-“ফিরছি।”
-“কোথায় আছেন এখন?”
-“ড্রাইভ করছি।”
-“আচ্ছা.. খেয়েছেন দুপুরে?”
-“সময় পাইনি।”
সাঁঝের বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল। ইভ চেয়ারের ওপর গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। সাঁঝ ওর পাশে বসল। লোকটা খায়নি। সকালে কী না কী খেয়েছে! এখন পড়ন্ত বিকেল। বেচারা বিয়ের পরও খাবারের কষ্টে ভুগছে। তারচেয়েও বেশি ভুগছে একাকিত্বে। সাঁঝের কী যে মায়া লাগতে লাগল! তার কণ্ঠে এক আকাশ সমান মলিনতা,
-“কোথাও ব্রেক নিন। কিছু খেয়ে আবার ড্রাইভ করুন।”
-“ডোন্ট ওয়্যোরি, ম্যাডাম। আমি অলমোস্ট চলে এসেছি।”
-“আচ্ছা।”
-“তুমি খাওনি কেন?”
সাঁঝ চমকে গেল,
-“বুঝলেন কী করে?”

-“আমরা কখনো নিজে রিয়ালাইজ না করা অবধি সামনের মানুষটার সিচুয়েশন বুঝি না। আমরা নিজেরা ভালো না থাকলেই কারণে-অকারণে সামনের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করি, ভালো আছো? আর তখন সে যদি বলে, ভালো নেই। রিলেট করি, মন খারাপ করি। তোমার মন খারাপ হচ্ছে। খাওনি কেন?”
সাঁঝের চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠল। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বলল,
-“সম্ভবত আমরা লাইফগেইমে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলব। সাবধানে ফিরবেন।”
-“রেস্ট নাও। আর আমি আছি..”
-“মিথ্যে আশ্বাস দেবেন না। শেষ অবধি কেউ থাকে না।”
-“আমি থাকব।”
-“অনিশ্চিত ওয়াদা করবেন না।”

সাঁঝ কল কেটে দিলো। আর তারপর অকস্মাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। প্রকৃতির প্রিয় কন্যার মন খারাপ, আর প্রকৃতি দুঃখ বিলাস করবে না? সাঁঝ এক ঝলক দেখে নিল সেই বর্ষণটা। বড়ো বড়ো ফোটা। এর ভারকে কি সাঁঝের দীর্ঘশ্বাসের সাথে তুলনায় আনা যায়? সম্ভবত যায়!
সাঁঝ ফট করে উঠে দাঁড়াল। ভাঁজ করে রাখা শাড়ির নিচের দিকের সাদার মধ্যে নীল সুতোর ছোট ছোট নকশা করা শাড়িটা পরে নিল। আটকে রাখা লম্বা চুলগুলো খুলে ফেলল। আর তারপর বড়ো বড়ো পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সবার আগে চোখ গেল পূর্বিকার দিকে। ফুলে থাকা চোখ-মুখ দেখে সাঁঝ বলল,
-“কী হয়েছে, আপু?”
পূর্বিকা আলসেমি মাখানো গলায় বলল,
-“বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এমন ঘুম ঘুমিয়েছি, স্বপ্নেও দেখি প্রেম করতেছি। এই সাঁঝ, তুমি জানো? প্রেম করতে করতে ঘুমিয়ে গেলে কত মজা লাগে!”
সাঁঝ ঠোঁট উলটে বলল,
-“জানি না। আমার উজবুক স্বামী জানায় না আমাকে।”
-“আহারে। পরে জানাবে। শাড়ি পরে কই যাও?”
-“ছাদে।”
-“বৃষ্টি তো..”
-“ভিজব।”

সাঁঝ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল। আর সিঁড়িতেই দেখা হয়ে গেল প্রায় ভিজে থাকা অদিতির সাথে। এককোণায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা ফোনে অর্ণবের সাথে কথা বলছিল। সাঁঝেরই খোঁজ দিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে নিজেরও এটা-সেটা বলছিল। লজ্জায়, ভালো লাগায় মুখখানি তার উজ্জ্বল। হঠাৎ তার চোখ গেল সাঁঝের দিকে। দ্রুত গতিতে ফোন নামিয়ে ফেলল। সাঁঝ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-“প্রেম করছিস?”
ভয়, লজ্জা, জড়তা… সব মিলিয়ে অদিতির নাজেহাল অবস্থা। সে দাঁতে জিভ কাটল। কৈফিয়ত দেওয়ার তাগিদে বলে উঠল,
-“আরেহ নাহ! ময়লাওয়ালা ছেলেটা কল দিয়েছে। বলল দুইদিন ধরে ময়লা দিচ্ছি না। আমিও জানালাম, বাড়িতে দুইজন পরিষ্কার রমনী আছি। তৃতীয়জন শ্বশুরবাড়িতে। সে নাই, আবর্জনাও নাই। আজ আসছে। আপনি আগামীকাল ময়লা নিতে আসবেন। এগুলোই আর কী…”
সাঁঝ সন্দেহ করল না মোটেও। নির্বিকার ভঙ্গিমায় বলল,

-“ময়লাওয়ালাকে ডেইট করছিস? ইন্ট্রেস্টিং। দেখা করাস। বিল আমার, ভালোবাসা তোদের।”
অগত্যা অদিতিকে মানতেই হলো,
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
সাঁঝের ছাদের দিকে চলে যেতেই অদিতি ফোন কানে তুলল, তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
-“অর্ণব ভাইয়া? কিছু মনে কোরো না। জানোই তো.. তোমার বোন কেমন..”
গম্ভীরমুখী অর্ণব বোনের ছেলেমানুষীতে না হেসে পারল না,
-“ইটস ওকে, কিছু মনে করিনি। তুমি ফ্রেশ হও, খাও কিছু..”
আচ্ছা, অদিতির বুকের ভেতর শুরু হওয়া এই অকস্মাৎ তাণ্ডবকে সে কীভাবে নেভাবে?
সাঁঝ ছাদে গিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ক্ষণিকের ঝুমবৃষ্টিতে সমগ্র গা প্রশান্ত হয়ে উঠল তার। সাদা শাড়িটা গায়ের সাথে লেপটে গেল। চুলগুলোও পিঠে, ঘাড়ে, কানে, গালে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে..

সুখ জিনিসটা পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায়। অসুখে আক্রান্ত প্রায় সবাই। পূর্বিকার মতো বাহ্যিকতায় সবসময় উৎফুল্ল মেয়েটিও বন্ধরত রুমে ঘন্টা সময় নিয়ে কেঁদে বের হয়। অদিতির মতো একতরফা অসুখে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিছু বলতে পারে না এরা, সইতেও হয় একাকী; ওদিকে অসুখ নিবারণকারী লোকটা একাংশও জানেই না। আর সাঁঝ? তার তো প্রেমেতেই অসুখ!

প্রেম ও অসুখ পর্ব ১০

ভিজতে ভিজতে বিকেল গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যার পূর্ববর্তী সময়। আকাশে এখনো আলোকছটা দৃশ্যমান। বন্ধরত চোখ তার, ঠোঁটের কোণঠাসা মিষ্টি হাসি, দু-হাত ছড়িয়ে সে ঘুরতে লাগল। আর তারপর অকস্মাৎ থেমে দাঁড়াল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল সোজা সিঁড়িঘরের দরজা বরাবর। ওধারে এক আবছা পুরুষ অবয়ব দণ্ডায়মান।
বৃষ্টিবিলাসী সাঁঝের দৃষ্টি স্বাভাবিক, ঠোঁটের কোণায় অদৃশ্য হাসি। সে বিড়বিড় করে বলল,
-“ডাক্তার সাহেব, মনাকাশে বৃষ্টি নেমেছে..দেখতে পাচ্ছো কি?”

প্রেম ও অসুখ পর্ব ১২