ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৫
মিথুবুড়ি
‘রূপালী থালার মতো গোল চাঁদটা অর্ধেক হয়ে ঝুলে আছে নিঃসঙ্গ আকাশে। চারপাশ জুড়ে ছমছমে এক নিস্তব্ধতা। নিচে হাসপাতালের সামনের ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটা কুকুরের কর্কশ গর্জন ভেসে আসছে। ওদের মধ্যে সম্ভবত কোনো ঝামেলা লেগেছে। কিছুক্ষণ পরপর একে অপরের দিকে তেড়ে আসছে, আবার থেমে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাতটাকে এভাবেই ফালি ফালি করছে ওদের তীব্র চিৎকার।
‘রিচার্ড বসে আছে তার প্রিয় ব্ল্যাক রোলস রয়েসের ভেতর। চোখ হসপিটালের ছাদে স্থির। ছাদের ওপর ভেসে থাকা হেলিকপ্টারটা লম্বা পাখনার ঘূর্ণিতে বাতাস কাঁপাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো একজনকে স্ট্রেচারে করে হেলিকপ্টারে তোলা হয়। তার ঠিক পরেই হেলিকপ্টারে উঠল মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা তাকবীর, তার পিছু পিছু রেয়ান। এক মুহূর্ত দেরি না করেই হেলিকপ্টারটা দূর আকাশে উড়াল দিল।
‘রিচার্ড মুখে জমানো ধোঁয়া গুলো মুক্ত আকাশের দিকে ছেড়ে দিল। ন্যাসোকে ইশারা করল গাড়ি স্টার্ট দিতে। ন্যাসো ফোসফাস নিশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিল। তবে ছটফট লুকাস দমে থাকতে পারল না। ছটফটিয়ে উঠল,
“বস এসব কি করছেন আপনি?ঐ শালা মিনিস্টার তো ম্যামকে নিয়ে গেল। ম্যামের রিপোর্ট গুলোও এখনো পর্যন্ত দেয়নি। এবার কিন্তু ম্যামকে হারালে সহজে পাবেন না বস৷”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘রিচার্ড একদম শান্ত। চোখেমুখে ক্ষোভের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। এলিজাবেথের কাছ থেকে ফিরে আসার পর থেকেই গাড়িতে বসে ধূমপানে মগ্ন ছিল। প্রতিটি টানে ছিল তার ধৈর্যের প্রতীক। আচরণে এক ধরনের স্থিরতা, যেন সে জানত তাকবীরের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। তাকবীরের জ্ঞান ফিরতেই সে আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি। দ্রুত সব ব্যবস্থা করে এলিজাবেথকে নিয়ে কোথাও চলে যায়। কেউ জানে না, কোথায় নিয়ে গেছে তাকবীর এলিজাবেথকে। এক রহস্যে ঢেকে যায় এলিজাবেথের গন্তব্য।
‘রিচার্ডের নিরবতা লুকাসকে আরও অস্থির করে তুলল। এবার খানিকটা চড়া স্বরে বলে উঠল,
“তাহলে কি ম্যাম শুধুই আপনার কিছুদিনের চাহিদা ছিল ?এভাবে চোখের সামনে দূরে চলে যেতে দেখছেন আর আপনি এমন শান্ত?”
‘রিচার্ড এবার কিরমিরিয়ে উঠল। চোখে জ্বলে উঠল আগুন। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠে চাপা হাসি হেসে, একেকটি শব্দ দাঁতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আমি সেই মানুষ না যে স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু পাশে রাখার ক্ষমতাও নেই। আমি নদী, অশান্ত, স্বার্থপর নদী। যা নিজের পথে বাঁধা পেলেই সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।”
‘এবার মুখ খুললো ন্যাসো। তাচ্ছিল্যের স্বরে চাপা গলার বলে,”স্মৃতি পুষে রাখতে না চাইলে সাথে রাখতে হয়। আর সাথে রাখার জন্য ভালোবাসার প্রয়োজন। আপনার মধ্যে কি আছে সেই ভালোবাসা?”
‘রিচার্ডের সেই একই তেজী স্বর,”তোমাদের মতে যদি ভালোবাসা মানেই কথার স্রোতে ভেসে যাওয়া হয়, তবে আমি সেই স্রোত ভাঙতে রাজি। আমার কাছে ভালোবাসা প্রমাণিত হয় রক্তে, ঘামে, আর নিঃশব্দ চিৎকারে। কথার নাটক আমি পছন্দ করি না। আমি ভালোবাসি সেই আগুন, যা একশনে দাহ করে সমস্ত সংশয়।”
‘রিচার্ডের কড়া জবাবের গভীরতা বুঝতে পেরে এবার দুজনেই মিইয়ে গেল। ন্যাসো শুষ্ক ঢোকের মাধ্যমে ঠৌঁট ভিজিয়ে সরু গলায় বলে,”কিন্তু এখন? ম্যামকে তো আবার নিয়ে গেলো। এবার মনে হয় না আর প্রকাশ্যে রাখবে।”
‘রিচার্ডের ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয়েছে রহস্যের ঘনঘটা। অধর কোণে হাসি তুলল,
“আমার থেকে দূরে নিলেও কিছুই করতে পারবে না। কারণ আগে থেকেই সিল মেরে দিয়েছি। যে জায়গায় পা রাখতে যাবে, সেখানে আমি অনেক আগেই প্রাচীর তুলে রেখেছি।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে বিজয়ের আভাস। একটি নিঃশব্দ যুদ্ধের শেষ শব্দ। আকষ্মিক তিনজনই একসাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তাদের বিকট শব্দের হাসি বারি খেতে থাকে বদ্ধ গাড়িতে। হঠাৎ ন্যাসো হাসি থামালো। দ্বিধা সংকোচ ফুটে উঠল ওর চওড়া তামুকে। উসখুস করতে থাকল। থমথমে গলায় বলল,
“বস আমাদের মনে হয় এবার রিসোর্টে ব্যাক করা দরকার।”
‘রিচার্ড আইপ্যাডে কিছু করতে করতে গম্ভীর গলায় আওয়াজ তুলল,”কেন? তাড়া কিসের! বারে চলো।”
‘ন্যাসোর পাশের সিটে অবস্থানরত লুকাস তুষ্ট হেসে রাশভারি আওয়াজে বলল,”নারীকে বুঝলে নেয়ামত। না বুঝলে কেয়ামত। তাই না ন্যাসো?”
‘লুকাস কে চোখ রাঙালো ন্যাসো। অতঃপর ফ্রন্ট মিররে রিচার্ডের কুঁচকানো ভ্রুদ্বয়ে দৃষ্টি রেখে আমতাআমতা করে, “না বস! আসলে রাত একা ছিল রিসোর্টে। তা,,,,
“ওকে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে তোমরা রিসোর্টে ফিরে যাও। কাল ধীরস্থির ভাবে আসো।”
‘লুকাস চকিতে পিছন ফিরে বলল,”আপনি আজই ব্যাক করবেন বস?”
‘উত্তপ্ত গরম নিশ্বাস ফেলল রিচার্ড। আঁধারে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ স্বরে বলল, “এই শহরে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। বিষের মতো লাগছে।”
‘ন্যাসো তুষ্ট হেসে চট করে জিজ্ঞাসা করল, “কারণটা ম্যামের শূন্যতা, নাকি ম্যামের আঘাত?”
‘রিচার্ড কোনো জবাব দিল না। কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল,
“স্টপ দ্য কার।”
‘ন্যাসো চমকে উঠল। লুকাসও অবাক, ঢোক গিলল। আজ তো সে কোনো লাগামছাড়া কথা বলেনি তবুও হঠাৎ এই নির্দেশ? রিচার্ড আবার বলল, “আই সেইড স্টপ দ্য কার ন্যাসো।”
‘এবার ভরকে গেল দুজনেই রিচার্ডের শক্ত ধমকে। বাধ্য হয়ে ন্যাসো গাড়ি থামাল। গাড়ির স্থির হবার সঙ্গে সঙ্গে রিচার্ড দ্রুত নামল। সামনের দরজার কাছে গিয়ে খানিকটা ঝুঁকে আঙুলের গাঁট দিয়ে শক্ত খটখট শব্দ তুলল মিররে। ন্যাসো বিস্মিত চোখে রিচার্ডের দিকে তাকালে রিচার্ড মাথা নেড়ে তাদের নামতে ইশারা করল। ন্যাসো লুকাস, দুজনেই কিছু না বুঝে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। রিচার্ড কী করতে চাইছে, তা এখনো তাদের অজানা। তবুও বসের আদেশ! অগত্যা নামতেই হলো।
‘ওরা নামতেই রিচার্ড হঠাৎ ঝড়ের মতো ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ন্যাসো আর লুকাস। বুকের মধ্যে এক চাপা শীতল ভয়। রিচার্ডের মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট আভাস দিচ্ছে সে যে তার ভিতরের জমে থাকা সব রাগ,ব্যাথা এবার স্টিয়ারিংয়ের ঝাড়বে। ওরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল স্থবির হয়ে। কারোরই সাহস হয় না গাড়িতে উঠার। রিচার্ডের ড্রাইবিং স্কিল সম্পর্কে দুজনেই পরিচিত।
‘তবে রিচার্ডের কঠিন চোখের চাপলিশে বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠল। তবে সামনের সিটে বসার সাহস পেল না কেউ। পিছনের সিটে গিয়ে জায়গা নিল। সিটবেল্ট লাগিয়ে ফেলল তড়িঘড়ি। মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। রিচার্ডের আর কোনো দিকে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। সরাসরি পকেট থেকে ফোন বের করে ব্লুটুথে কানেক্ট করল গাড়ির সাথে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতর বেজে উঠল এক বিষণ্ণ সুর। সেই সুর যা নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর আরও ভারী করে তুলল।
Main aah bharun
tu haaye kare
Bechain likhoon
bechain ho tu
Phir bechaini
ka be kaatoon
Tujhe chain zara
sa ho jaaye..
Abhi “ain” likhoon
tu soche mujhe
Phir “sheen” likhoon
teri neend ude
Jab “qaaf” likhoon
tujhe kuch kuch ho
Main “ishq” likhoon
tujhe ho jaaye
‘জমে থাকা শক্ত মাটি আলগা করে কর্কশ টায়ারের শব্দে ঝাঁকুনি দিয়ে ছুটে গেল গাড়িটা। ঘূর্ণির মতো বেগে শুরুতেই এমন টানে ন্যাসো আর লুকাস সামলে উঠতে না পেরে একে-অপরকে চেপে ধরল। কালো মার্সিডিসটা যেন এক রাক্ষস যা রিচার্ডের ক্রোধকে নিজের ইঞ্জিনে ভর করে ছুটে চলছে। শুরুতেই গাড়ি তার গতি বিপদসীমা অতিক্রম করে যায়।
‘ঝড়ের বেগে বাতাসকে চিরে এগিয়ে চলেছে। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে বাতাসের সাথে সংঘর্ষের ঝাপটা। আশপাশের গাড়িগুলো যেন থেমে থাকা বস্তু, মুহূর্তে তাদের পেছনে ফেলে যাচ্ছে রিচার্ড। তার হাতে স্টিয়ারিং অটল, দৃষ্টি অনড়। রাস্তার কেউই রিচার্ডের সামনে টিকতে পারছে না। কালো মার্সিডিসের গর্জনে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে গেছে। সেই সাথে পিছনের লুকাস আর ন্যাসোর মুখে জমে থাকা আতঙ্কের সুনামি, যা তারা গিলে ফেলার চেষ্টা করেও পারছে না। তবে স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাতটা তবুও শক্ত,শক্ত হাতের মালিকের চিবুক। রিচার্ডের একমাত্র লক্ষ্য অজ্ঞাত, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য।
‘আকস্মিক সামনে থেকে ঝড়ের মতো তেড়ে আসে এক মালবাহী লড়ি। লুকাস আর ন্যাসোর চোখ বড় হয়ে গেল ভয়ে। শক্ত হৃদয়ের দু’জনও এবার আর চুপ থাকতে পারল না। পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু রিচার্ড নির্ভীক। স্টিয়ারিং চেপে ধরে স্পিডমিটারের কাটা শীর্ষে রেখে গাড়ি ছুটিয়ে চলল। দুটো যান যেন একে অপরকে আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসছে। রিচার্ডের চোখে না কোনো ভয়, না কোনো দোটানা। লড়ির হেড লাইটের লাল আলো চোখে এসে পড়তেই ন্যাসো আর লুকাস মৃত্যুর ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। তাদের ভেতর ধ্বংসের প্রস্তুতি বাজতে শুরু করল।
‘কিন্তু রিচার্ড! তার চোখে এক শীতল স্থিরতা। এক মুহূর্তের জন্যও স্পিড কমায়নি, না কোনো টার্ন নিয়েছে। ঠিক সংঘর্ষের এক সেকেন্ড আগে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় গাড়িটা তীব্র গতিতে এক পাশে টার্ন করে লড়ির পাশ কাটিয়ে সামনে বেরিয়ে গেল। লড়ির হর্নের কর্কশ শব্দ যেন ভয়কে আরও গভীর করল। ন্যাসো আর লুকাসের বুকের ভেতর আরেক দফা ঝড় বইল। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে তারা৷ রিচার্ড তখনও নির্বিকার। তার গাড়ি আগের মতোই ছুটছে৷
“ওর রক্তশূন্য মুখে এতো কেন পীড়া?”
“আজ নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেও ওর যন্ত্রণার ভাগ আমি কেন নিতে পারছি না৷”
“আমার জীবন কেন এতো অভিশপ্ত হলো৷”
‘ন্যাসো আর লুকাস হতবাক। তারা এমন রিচার্ডকে কখনও দেখেনি। গ্যাংস্টারের মুখোশ ভেঙে রিচার্ডের চিৎকারে উগরে আসছে দীর্ঘদিনের গুমোট। তার শক্ত হাত কাঁপছে, শরীর অস্থির। ভিতরে জমে থাকা ঝড় আজ থামার নাম নিচ্ছে না। স্টিয়ারিংয়ে হাত থেঁতলে ক্ষতবিক্ষত করার পর শান্ত হলো রিচার্ড। হাত থেকে উষ্ণ লাল রক্ত টিপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। জোড়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে রিচার্ড। ন্যাসো আর লুকাস হতভম্ব। নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। কিছু বলার সাহস তাদের নেই।
‘রিচার্ড ঠান্ডা মাথায় গাড়ি অটো মোডে দিল, সামনের ছোট ডিস্কস খুলে ওয়াইনের বোতল বের করে রক্তাক্ত হাতে বোতল ঢালতে থাকে৷ এবার আর অবাক হলো না দু’জন। তারা এটার সাথে অভ্যস্ত। ফোসফাস নিশ্বাস ফেলে রিচার্ড আবারো গাড়ি স্টার্ট দিল।
“আল্লাহর ওই বান্দী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার সামনে কেউ তাকে আনবে না।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে কঠোরতা। তবে চোখে এক অদ্ভুত নরম লেপটানো দৃষ্টির আভাস। মিটিমিটি হাসল লুকাস আর ন্যাসো। লুকাস কুটিল স্বরে বলল,
“আমাদের কি সেই স্বার্ধ আছে? আর আমরা তো জানি ই না ম্যাম কোথায় আছে!”
‘উত্তর দিল না রিচার্ড। এবার ধীর-স্থিরতায় গাড়ি চালাতে শুরু করল। হঠাৎ ন্যাসোর উদ্দেশ্য বলে,
“তোমরা ফিরে প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিও।”
‘ন্যাসো অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,”আমরা কি কোথাও যাচ্ছি বস?”
‘রিচার্ড গভীর শ্বাস ফেলল,”আমার রাণীর কাছে এই বাগানবাড়ি অভিশপ্ত। যদিও এর জন্য আমি ই দায়ি। তবুও… আমরা শীঘ্রই নতুন ম্যানশনে উঠছি।”
‘লুকাসের চোখ বিস্ফারিত হলো। বলে উঠল,
“বাংলাদেশে ম্যানশন আসবে কোথা থেকে?”
‘রিচার্ড নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, “বানালেই আসবে।”
‘ন্যাসো হতবাক। “মানে আপনি কি?” বাক্য শেষ করার আগেই রিচার্ড ঠান্ডা গলায় বলল,”হুম।”
‘লুকাস কৌতূহল নিয়ে বলল,”কবে?”
‘রিচার্ডের গলায় অনুশোচনার চাপা সুর ভেসে এলো।
“সেদিন থেকে নতুন ম্যানশনের কাজ শুরু হয়েছিল, যেদিন আমার স্ত্রী হাতের শিরা কেটেছিল এই অভিশপ্ত রাজ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।”
‘ন্যাসো ভ্রু কুঁচকে সরু গলায় শুধালো,”এটা কি রিয়েল?”
‘রিচার্ড কাঠিন্য মেশানো এক তৃপ্ত হাসি দিল,”দ্যাটস ফা°কিং রিয়েল।”
‘ন্যাসো কিছুক্ষণ চুপ থেকে চাপা কণ্ঠে বলে, “কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন ম্যাম আপনার টাইপ না—বেশি আবেগী। তাহলে এখন কী সব বদলে গেল?”
‘রিচার্ড ফোঁস নিশ্বাস ফেলল। একটা ক্লান্ত হাসি দিয়ে বলল, “ফেঁসে গেছি আমি। শালি ধান্ধাবাজ।”
‘চারপাশে ফজরের আজানের মৃদু ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আলো একটু একটু করে ভুবনকে জাগিয়ে তুলছে। প্রকৃতি নতুন দিনের জন্য প্রস্তুত। পাখির কিচিরমিচির শব্দ সেই ঘুম ভাঙার প্রতীক।
‘ঘন বাঁশঝাড়ের আড়ালে স্থাপিত একটি পুরনো কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গ্যাংস্টার বস রিচার্ড কায়নাত। তার চোখে কোনো রাগ নেই, নেই ক্ষমতার অহংকার। এই স্থান তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যেখানে সে ছিল রেদোয়ান—একটি নাম। যা বদ্ধ কবরে শুয়ে থাকা মানুষটি অনেক শখ করে দিয়েছিল। আজ মানুষের সাথে সাথে নামটাও হারিয়ে গিয়েছে অমোঘ সময় চক্রে।
‘যেমন কথা, তেমন কাজ। রিচার্ড রাতেই ঢাকায় ফিরে আসে। লুকাসও তার সাথে ফিরেছে!তবে এই বিশেষ সময়ে লুকাসকে এখানে আনেনি রিচার্ড। কারণ এটা তার জীবনের সবচেয়ে একান্ত ও ব্যক্তিগত মুহূর্ত। এটাই একমাত্র কারণ ছিল রিচার্ডের বছরে একবার দেশে আসার৷ প্রতি বছর একবার রিচার্ড ফিরে আসতো এখানে তার বাবার কবর জিয়ারত করতে। সেই কবর যেখানে তার পুরোনো পরিচয়ের শিকড় রয়ে গেছে।
‘কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত মানুষটা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে। বিধ্বস্ত চেহারায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মাটি স্পর্শ করল তার কাঁপতে থাকা হাতজোড়া। কাঁপা কণ্ঠে নিঃশব্দে কিছু বলার চেষ্টা করল তবে শব্দ যেন আটকে থাকে বুকের ভেতর।
“বাবা তোমাকেও আমি ক্ষমা করব না কখনো। কে তুমি? কেন এতো সৎ হতে গিয়েছিলে? তোমার সেই অভিশপ্ত সততা আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিল।আমি ঘৃণা করি তোমাকে। ঘৃণা করি তোমার সততাকে। আর তীব্র ঘৃণা জানাই এই পৃথিবীর প্রতিটি সৎ মানুষকে, যারা আদর্শের নামে বাঁচতে শেখায়, কিন্তু অন্যদের কষ্টে ডুবিয়ে দেয়।”
‘রিচার্ড চাপা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল। চোখে এক অদ্ভুত আগুন জ্বলে। আকষ্মিক গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“তোমার সততা আমাকে একটা নরখাদকে পরিণত করেছে বাবা। ঘৃণা করি আমি আপনাকে। শুনছেন মি.রেমান ঘৃণা করি আমি আপনাকে, ঘৃণা।”
‘রিচার্ড থেমে গেল। ক্রোধে ফেটে পড়ে হাঁপাচ্ছে । কিন্তু সেই থমকে যাওয়া মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক অন্ধকারে ডুবে গেল। ফিরে গেল সেই চিরাচরিত পৈশাচিক আত্মায়। উগ্রতা ভেঙে হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠল রিচার্ড।
“ছাড়ব না আমি। কাউকে ছাড়ব না। কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো সবগুলোকে। নাহলে আমার নামও রিদ না!”
‘এবার রিচার্ড কবরের পাশের মাটিগুলো আউলা ঝাউলা করতে করতে একা একাই বকবক করতে থাকল উন্মাদের মতো অনবরত।
“এই বাপ, এই। তোর সততা আমাকে কেন জানোয়ারে পরিণত করল? আমি তো চেয়েছিলাম অনেক বড় ডাক্তার হতে। মানুষের রক্তে হাত নাড়াতে না, রক্তপাত থামাতে চেয়েছিলাম। আমি তো এমন সকাল চাইনি, যেখানে মৃত্যু দিয়ে দিনের শুরু। তোরা আমাকে এতিম করে কেন চলে গেলি? আগলে রাখতে না পারলে জন্ম দিয়েছিস কেন? তোরা হারামি, তোরা পাষাণ। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো আমার বাবা-মা।”
“আমি খারাপ হতে চাইনি, বিশ্বাস করো বাবা। আমি কখনোই চাইনি এমন হতে। পরিস্থিতি, জীবনের সেই অন্ধকার মুহূর্তগুলো, আমাকে এমন পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের রক্ত আমার হাতের চামড়ার সাথে একাকার হয়ে গেছে। এখন আমি আর রক্ত না ঝড়িয়ে থাকতে পারি না। আমার ভিতর ছটফট করে। আমি চাই, এই ঘৃণার থেকে মুক্তি পেতে, কিন্তু আমার যন্ত্রণা আমাকে তার দিকে ঠেলে নেয়।”
“আমার ভিতরের অমানুষটা জেগে উঠলে আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না। রক্তের স্বাদে উন্মাদ হয়ে যায় আমি।”
“আমি একটু আদর মাখা হাতের ছোঁয়া চাই বাবা। ফিরে আসো না, শুধু সেই স্পর্শটা যেন ফিরে আসে।”
“এই সমাজ আমাকে ভালো হতে দিল না। আমি ঘৃণা করি আমার রক্তকে।”
“হ্যাঁ, আমি অমানুষ, জানোয়ার। কারণ আমি এতিম। আমার ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার কেউ ছিল না। আমার কষ্টগুলো কাউকে কখনো স্পর্শ করেনি, কারণ আমি এতিম।”
“এই দুনিয়ায় এতিমের কেউ নেই। এতিম মানে চূড়ান্ত কষ্টের সাগর। আরে স্বার্থপর বাপ, তুই যে এত ভালো ছিলি, তাও তোর কবরের পাশে বসে ছটফট করার জন্য শুধু এই অমানুষ আমি টা আছি। আমার তো তাও নেই, তিন কূলে কেউ নেই আমার। আমার কবরের পাশে বসে কে কাঁদবে? আমি তো এমনিতেই পাপের সাগরে ভেসে আছি। কে আমার আত্মার শান্তি কামনা করবে? আমি তো এই দুনিয়ায় ও জ্বলেছি ঐ দুনিয়ায়ও জ্বলবো। তোরা আমাকে এতটা একলা, এতটা দুর্ভাগা করে কেন চলে গেলি ?”
‘রিচার্ডের চিৎকারে বাঁশঝাড়ের পাতা থরথর করে কেঁপে উঠল। “রিদ” এই নামটা শুধু ফাদারের দেওয়া ছিল না। রিচার্ডের বাবা মি.রেয়ান তার ছেলেকে ভালোবেসে রিদ বলে ডাকত। তাই এই নামের প্রতি রিচার্ডের তীব্র ঘৃণা। এজন্যই বারংবার বারণ করতো ফাদার কে এই নামে ডাকার জন্য। আকস্মিক রিচার্ড পকেটে হাতড়ে ফোন বের করল। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে সরাসরি তালিকা থেকে তাকবীরের নাম্বার খুঁজে বের করল। কোনো দ্বিধা ছাড়াই কল দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে কোনো শব্দ শোনা যাওয়ার আগেই রিচার্ডের পৈশাচিক, সাইকো মস্তিষ্ক সক্রিয় হলো। হিংস্র গলায় বিড়বিড় করে বলল,
“আমার হাতের শিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস করেছিস তার জন্য তোকে মরতে হবে। তাছাড়া তোর সাথে আর কোনো শত্রুতা ই ছিল না। কিন্তু এখন… এখন শত্রুতার তালিকা অনেক লম্বা হয়েছে। তোকে মরতেই হবে। তুই বাঁচবি না শুয়োরের বাচ্চা।”
‘তাকবীরের কিছু বলার সুযোগই দিল না রিচার্ড। হঠাৎ গর্জে উঠল, যেন ক্রোধে পাগল হয়ে গেছে।
“ভাগ্যিস, ঐ মহিলাটা মারা গিয়েছে! নাহলে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে নৃশংস মৃত্যু তারই হতো। খোদার কসম তার লাশের প্রতিটা টুকরো আমি নিজ হাতে পিস পিস করতাম। আর সেই টুকরোগুলো নিয়ে গিয়ে উৎসর্গ করতাম আমার বাবার কবরের পাশে। প্রতিশোধের শুদ্ধতম উপহার হতো ওটা।”
‘যেভাবে ফোন করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই কল কেটে দিল রিচার্ড। রাগ যেন শরীর থেকে ফণা তুলে উঠছে। কঠোর মুখভঙ্গি নিয়ে উঠে দাঁড়াল,তারপর হনহনিয়ে হেঁটে গেল গাড়ির দিকে। একবারের জন্যও কবরের দিকে ফিরে তাকাল না। সেই কবর, যা তার অতীতের ছায়া হয়ে রয়ে গেল পেছনে।
‘আলোছায়া নামক পুরাতন অনাথ আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এরিক এবং তার ট্রিম। তাদের পরণে সোয়েট ইউনিফর্ম, চোখে কালো সানগ্লাস, আর গাম্ভীর্যপূর্ণ এক অবয়ব। এরিক চোখ থেকে কালো চশমাটা সরিয়ে দূর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নিচ্ছে আশ্রমটিকে। যদিও এটি পুরাতন তবুও তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িটি যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করে। সাদা রঙে আঁকা পুরনো রাজবাড়ির মতো দেখতে। সারা বাড়িতে একটি রহস্যময় পরিবেশ ছড়িয়ে রয়েছে।
‘ছায়া ছিল তাকবীরের মায়ের নাম। ছোট থেকেই মা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা, যার ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছিল সে। মা ছাড়া পৃথিবী তাকবীরের কাছে সুনসান ছিল। যখন তাকবীর শুনেছিল যে তার একটি বোন হবে। তখন থেকেই ভেবেছিল বোনের নাম রাখবে ‘আলো’, যাতে মায়ের নাম ‘ছায়া’র সাথে মিলিয়ে এক সুন্দর নাম তৈরি হয়। সেই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতেই তাকবীর এই অনাথ আশ্রমের নাম রেখেছে “আলোছায়া” যেন তার মায়ের স্মৃতিতে আলো জ্বলে থাকে, আর সেই আলো আশ্রয় দেয় সকল নিরাশ্রয় শিশুর জীবনকে।
‘আসমান কান থেকে ফোন নামিয়ে দূর ব্যস্ত পায়ে আসতে আসতে বলল, “সরি স্যার, উপর থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট দেয়নি।”
‘এরিক গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, “কেন?”
‘আসমান ঠাঁসা গলায় উত্তর দিল,”মিনিস্টার তাকবির দেওয়ান এই অনাথ আশ্রমটা বহু বছর ধরে চালাচ্ছে। সাফল্য আর মানবিক গুণগুণের কারণে আশ্রমটা এখন সরকারি খাতে রয়েছে। আর মিনিস্টারের হিস্ট্রি এতটাই স্বচ্ছ যে, সন্দেহের বশে তার আশ্রমে সার্চ ওয়ারেন্ট দেয়নি। এবং আমাদের ভিতরে ঢোকার অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।”
‘এরিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চোখে গভীর চিন্তা। চিন্তিত স্বরে বলল, “ভুল না হলে রেকেটিংটা এখান থেকেই হচ্ছে। সবকিছু আমাদের নিজ হাতে খুঁটিয়ে খাটিয়ে দেখা হয়েছে, শুধু আশ্রমটা বাদে।”
‘পাশ থেকে তাকওয়া যুক্তি দিল,”ইয়েস স্যার! আপনি ঠিক বলেছেন। সম্ভবত নয়, এটা হান্ড্রেড পারসেন্ট যে রেকেটিংটা এখান থেকেই চলছে। গত বারো বছরে এই আশ্রম থেকে চারশোরও বেশি বাচ্চা মারা গিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ছোটখাটো রোগ। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? আর, আরও খুঁটিয়ে দেখা গেছে শহরের বিভিন্ন বস্তি, রাস্তাঘাট থেকে যখনই বাচ্চা বা পাগল গায়েব হয়েছে, আশপাশ সময়ের মধ্যেই আশ্রমে বাচ্চাগুলোও মারা যেত। আর সবথেকে দেখার বিষয় হলো সাধারণ একটা আশ্রমে এতো কড়া হাই সিকিউরিটি প্লাস এতো এতো গার্ড, তাও আবার বাইরের দেশ থেকে ভাড়া করে আনা গার্ড।”
‘তাকওয়া কথা শেষ করে হাতে থাকা ল্যাপটপটা এরিকের দিকে এগিয়ে দিল। সেখানে লাস্ট দশ বছরের মিসিং হওয়া সকল বাচ্চাদের ডিটেইলস ছিল। এরিক রহস্যময় হাসি দিল। পরপর তাকওয়ার দিকে তাকিয়ে খুশমেজাজে বলল,
“এজন্যই তোমাকে আমি আইটেম বোম বলি তাকওয়া। রেয়ালি, ইউ আর জিনিয়াস।”
‘হালকা হাসল তাকওয়া। হঠাৎ এরিকের নজর চলে গেল এক ছোট্ট বাচ্চার দিকে। বাচ্চাটা সম্ভবত এই আশ্রমেরই। হয়তো বাইরে কোথাও গিয়েছিল। এরিকের মাথায় বুদ্ধি খেলা করে গেল। এরিক তাকাল ভিক্টরের দিকে, ঠোঁট ব্যাকিয়ে হাসল এবং ইশারা করল। ভিক্টর মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাটার কাছে চলে গেল। ভিক্টর বাচ্চাদের সাথে খুব ভালো মিশতে পারে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। ভিক্টর অল্প সময়ের মধ্যে বাচ্চাটার সাথে মিশে গেল। কৌশলে বাচ্চাটার কাপড়ের সাথে একটি ছোট খেলনা গাড়ি ঝুলিয়ে দিল। বাচ্চাটা কিছুই বুঝল না। ভিক্টরের সাথে হেসে-দুলে কথা বলে দৌড়ে ভিতরে চলে গেল।
‘ভিক্টর কাজ শেষ করে এসে দাঁড়াল এরিকের সামনে। পাঁচজন একসাথে এক দৃষ্টিতে তাকাল আশ্রমের দিকে। হঠাৎ করেই অট্টহাসিতে মেতে উঠল সকলে। এরিক হাসি থামিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিমায় বলল,”লেটস গো, গাইস। আমাদের কাজ শেষ। এখন যা করার, আমরা অফিসে বসেই করতে পারবো।”
‘থেমে_
“অফিসার প্রেম কোথায়?”
‘অরণ বলল,”উনি ইমারজেন্সি কাজে কোথাও বেরিয়েছে।”
“লাড়া বেবি প্লিজ কাম ব্যাক ইতালি।”
“হ্যালো লাড়া শুনতে পাচ্ছো? আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে কথা বলছো না। স্পিক আপ মাই প্রিন্সেস।”
“লাড়া আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিবে না। আমাকে বাধ্য করো না ড্রাগন গ্রুপের পতন ঘটানোর জন্য।”
‘লাড়া এবার ক্রোধে ফোনটা সামনে ঝিলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে টেনে আরো এলোমেলো করল। তার পরনে এখনও সেই ব্রাইডাল গাউন, যা দু’দিন আগে পরেছিল পার্টিতে। পরিবর্তন করেনি কিছুই। চোখে-মুখে ধ্বংসস্তূপের মতো ক্লান্তি আর ভাঙনের ছাপ। সেই ঝলমলে পার্টির লাড়া যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
দু’দিন ধরে ঘরবন্দি। না খাওয়া, না নাওয়া। একরকম মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। আজ অবশেষে রুম ছেড়েছে লাড়া। তবু তার অবস্থা কিছুটা বদলায়নি। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি ঝিলের ধারে বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরে।
হঠা কাঁধে শক্ত এক হাতের স্পর্শ। লাড়া বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠে চকিতে পেছনে ঘুরে তাকাল।
‘লাড়া প্রেমের দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না। আবারও শূন্য দৃষ্টিতে ঝিলের জলে চোখ রেখে বসে রইল। প্রেম একটু বিরক্ত হয়ে লাড়ার পাশে গিয়ে বসল। পায়ের জুতো খুলে দু’পা সামনে ছড়িয়ে দিল।
“ক্লান্ত, না হেরে গেছো?”
‘কোনো সাড়া দিল না লাড়া। নীরবতার দেয়াল যেন আরও মোটা হয়ে উঠল। প্রেম আবার বলল, “কিছু খাবে?”
‘এবার বাঁধ ভাঙল। গভীর দম নেওয়ার পর ভাঙা স্বরে উঠে এলো কথাগুলো। “অন্য মেয়েদের মতো হুরহুর করে কাঁদতে পারি না বলে কি আমার কষ্ট হয় না? এতো অপমান, এতো তাচ্ছিল্য, নোংরা কথা… ভালোবাসি বলেই তো মেনে নিই! কিন্তু…”
‘প্রেম লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা হালকা ঘুরিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর ধীরে ধীরে বলল, “ভালোবাসলে কষ্ট পাওয়ার মতো সহ্য ক্ষমতা নিয়েই ভালোবাসতে হয়।”
‘লাড়া নাক টানতে টানতে বলে উঠল, “ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন?”
‘প্রেম হালকা মুচকি হেসে পকেট থেকে রুমাল বের করে লাড়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। “মাটির বুকেও প্রেম আছে, যদি জাগিয়ে তুলতে পারো। সেই প্রেম যেদিন তোমার কষ্ট বুঝবে, সেদিন থেকে শুরু হবে তোমার সুখের দিন।”
‘লাড়া হঠাৎই উৎসুক হয়ে প্রেমের দিকে ঘুরে তাকাল।
“সত্যি?”
‘প্রেম মাথা নাড়ল উপর-নিচ। লাড়া নিজের চোখের পানি মুছল রুমালে নিয়ে শান্ত হলো। এই সময় প্রেম আকস্মিকভাবে বলল, “বন্ধু হবে?”
‘লাড়া ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “ইউ নো আই লাভ হিম।”
‘প্রেম হেসে বলল, “তাতে কী? তুমি না হয় তোমার ভালোবাসার পিছনে ছুটলে, আর আমি আমার ভালোবাসার। বন্ধুত্ব থাকুক আমাদের মাঝখানে।”
‘লাড়া চোখ ছোট করে তাকাল। “আবার ফ্লার্ট করছো?”
“ভাবছি দক্ষিণ কোরিয়া চলে যাব। সেখানেই নিজেকে বন্দি করে ফেলব।”
“কেন?”
“বাংলাদেশে সত্যি কথার কোনো দাম নেই,” বলল প্রেম এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘লাড়া নাক কুঁচকে সরাসরি বলল, “টপিকে আসি। এখানে কী করছেন?”
‘প্রেম নির্বিকার ভঙ্গিতে মিথ্যে বলল, “একটা কেসের জন্য এসেছিলাম।”
“তো এখানে কেন? আসামির খুঁজে যান। আমার কাছে কী?”
‘প্রেম হুট করে কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, “I love Laraa.”
‘থমকে গেল লাড়া। এক মুহূর্ত নীরব থেকে পরপর প্রেমের কানে চাটি বসিয়ে উঠে সামনে যেতে যেতে বলল, “I f°°k you.”
‘প্রেমও উঠে পড়ল। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল,“ওয়েট, ওয়েট, দুই মিনিট।”
‘লাড়া দাঁড়িয়ে গেল। বিস্মিত স্বরে পিছন ফিরে বলল,“কেন?”
“দুই মিনিট লাড়া জান্স। এখনই রুম বুক করছি।”
“শালা!”
‘প্রেম দাঁত কেলিয়ে হাসল। পরপর বিটলামি ভরে গাইতে শুরু করল,“বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক, তোমার সাথে গল্প করব আমি সারারাত।”
‘লাড়া বিরক্ত মুখে বলল, “তোর সাথে গল্প না, তোকে নিয়ে সাইকোপ্যাথ জনরার উপন্যাস লিখব আমি।”
‘এক মুহূর্ত থমকাল প্রেম। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই হাস্যজ্বল রূপে ফিরে বলল, “সেখানে যদি তুমি নায়িকা হও,তবে আমি নির্দ্বিধায় উপন্যাসের সবচেয়ে ঘৃণিত চরিত্র হতে রাজি।”
‘লাড়া আবার হাঁটতে শুরু করল। সামনে থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “পাবলিকের টাকা এত সস্তা হয়নি যে তোকে কিনে পড়বে। আর লাড়া লস প্রজেক্টে হাত লাগায় না।”
“তবে যে পথে পা বাড়াচ্ছো, সেখানে তো হার ছাড়া জিত নেই।”
‘আবার থমকে গেল লাড়া। মুহূর্তের জন্য নিস্তব। লাড়া পিছন ফিরে প্রেমের দিকে এগোচ্ছিল ঠিক তখনই অসাবধানতায় এক বয়স্ক মহিলার সাথে ধাক্কা খেল। লাড়া “সরি” বলার জন্য মুখ খুলতেই মহিলাটি ক্ষিপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “এই ছেমরি! দেখে চলতে পারিস না? দিনদুপুরে রাস্তায় নষ্টামি শুরু করে দিয়েছে!”
‘লাড়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সরি বলার ইচ্ছেটা মুহূর্তেই উবে গেল। মহিলার সামনে গিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলল, “এই মহিলা, ব্যবহার ভালো না হলে সম্মানের আশা করিস না একদমই।”
‘মহিলাটি আরও তেড়ে আসতে গেল লাড়ার দিকে। কিন্তু তার আগেই প্রেম পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত এগিয়ে এসে দু’জনের মাঝে দাঁড়াল। লাড়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “উফফ লাড়া, জান্স কুল।”
‘অতঃপর মহিলার দিকে ঘুরে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলল,
“একজন মেয়েকে হেনস্তা করার জন্য কত ধারা এবং কত তম অপরাধের শাস্তি হতে পারে, তা জানেন?”
‘মহিলা শুকনো ঢোঁক গিলল। তবুও ধাঁজ ধরে বলল,“আপনি কে?”
‘প্রেম জ্যাকেটের ভেতর থেকে আইডি কার্ড বের করে দেখিয়ে বলল, “হিয়ার ইজ মাই আইডি কার্ড।”
‘মহিলার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ স্থান ত্যাগ করল। লাড়া ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হাসল। প্রেমও হাসি ধরে রেখেই আবার লাড়ার দিকে ফিরে তাকাল। হঠাৎ লাড়ার নজরে পড়ল প্রেমের হাসি।
“এই অফিসার, হাসি দে তো আবার।”
‘প্রেম জিভ কেটে দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, “এসব কি ধরনের বিহেভিয়ার জান্স? তুমি করে বল। শুধু হাসি কেন, তুমি বললে আমি আমার মেইন পয়েন্টও কেটে দিয়ে দিব তোমায়।”
‘লাড়া চোখ ঘুরিয়ে বলল, “চুপ, যা বলছি তা কর।”
‘বাচ্চা বাচ্চা ভঙ্গিতে প্রেম হাসতে শুরু করল, “হাহা, হুহু, হিহিহি।”
“ওয়াহ, ডিম্পল!”
‘প্রেম গর্ভের সহিত ঠোঁট উঁচিয়ে বলল, “কিউট না?”
‘লাড়া নাক সিঁটকিয়ে বলল, “একদম সে*টা ভাঙা।”
‘এই বলে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল লাড়া। প্রেম পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে মাথা চুলকাতে লাগল। প্রেম এবার পিছু নিল না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। লাড়া খানিকটা অবাক হলেও পিছন ফিরে দেখল না। হেলেদুলে সামনে এগোতে থাকল। হঠাৎ তার সামনে প্রচণ্ড জোরে একটা বাইক এসে থামল। লাড়া সামান্য চমকে উঠলেও মুখে ভয় প্রকাশ পেল না। প্রেম হেলমেটের গ্লাস তুলে আরেকটা হেলমেট লাড়ার দিকে এগিয়ে দিল।
‘লাড়া ভ্রু কুঁচকালো। প্রেম ইশারায় তাকে বাইকে উঠতে বলল। তবে লাড়া উঠল না। উল্টো ঘাড় নাড়িয়ে প্রেমকে নামার ইঙ্গিত করল। প্রেম অবাক হয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে বাইক থেকে নেমে পড়ল। লাড়া একটানে নিজের গাউনের নিচের অংশ ছিঁড়ে ছোট করল তারপর মাথায় হেলমেট চাপিয়ে চট করে গিয়ে বসে পড়ল বাইকের সিটে।
‘প্রেম একটু হতবাক। তবে চুপচাপ পিছনে গিয়ে বসতেই বাইক হাওয়ায় ঝাপসা তুলে ছুটে চলল। প্রেম লাড়ার রাইডিং স্কিল দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। গলা ছেড়ে গান ধরল,
ফিরে এলে তবু
সংশয়ে মন ~
আবার যদি হারাও…….
ইচ্ছে যত …উড়িয়ে দেবো ••
হঠাৎ দমকা হাওয়াতে~~
দস্যু হয়ে তারা….
ভাঙবে যে পাহারা /
জাগাবে তোমায় রাতে
বলো না বলো…
শুনতে কি চাও?
বলো না বলো..
শুনতে কি পাও?
বলো না বলো আজকে আমায়।
‘ধরিত্রীতে তখন আঁধারের চাদর সম্পূর্ণভাবে টেনে দেওয়া হয়েছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আজিমপুরের পুরোনো কবরস্থানের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকবীর। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে গভীর শ্বাস ফেলে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করল। অতঃপর বুকের ওপর একবার ফুঁ দিয়ে ব্যস্ত পায়ে কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করল। গিয়ে থামল দু’টি আড়াআড়ি কবরের সামনে। একটি বড়, আরেকটি ছোট। চোখ মেলে তাকাল তাকবীর, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। পেছনে ছায়ার মতো নিরবে দাঁড়িয়ে আছে রেয়ান।
‘নিজেকে আজ শক্ত ধাঁচে বেঁধে রাখবে বলেও পারল না তাকবীর। শরীর ছেড়ে দিল কবরের উপর। এক মুহূর্তের জন্য পুরো দেহ মাটির মধ্যে গাঁথা হয়ে গেল। বড় কবরটিকে জড়িয়ে ধরল। স্বর নেমে গেল একদম খাদে, কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে ডাকল,
“মামনি?”
‘ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না। তাকবীর আবারও নিস্তেজ স্বরে ডাকল, “ও মামনী, কথা বলো না। তোমার বীর ভালো নেই।”
‘নৈঃশব্দ্য কাটছে মুহূর্তের পর মুহূর্ত। তাকবীর বাচ্চাদের মতো অনবরত ডাকতে থাকে।
“ও মামনী। মামনী গো?”
‘কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল শুকনো ঝুরঝুরে মাটিতে। তাকবীর থেমে থেমে বলতে থাকল,
“যদি নারীর টানে আমাকে বেঁধে রাখতে না-ই পারো, তবে কেন জন্ম দিয়েছিলে? কেন এই স্বার্থপর পৃথিবীতে ফেলে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছো তুমি? আমার বোনের মতো আমার জীবনটাও কেন সঙ্গে করে নিয়ে গেলে?”
“জানো মামনী এই দুনিয়ার নিষ্ঠুরতা আমাকে ধ্বংস করে ফেলছে। আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি তো এমনটা চাইনি। এই দুনিয়ার নিষ্ঠুরতার আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে। এখন দুনিয়ার এই নিকৃষ্টতায় আমাকে শেষ করে ফেলবে। আমি আর ক’টা দিন বাঁচতে চাই, মামনী। আমাকে তোমরা এতো তাড়াতাড়ি তোমাদের কাছে টেনে নিও না।”
‘কান্নার শব্দ ভেজে উঠতে থাকল তাকবীরের গলায়। নিরব রেয়ানের চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রের নিরব বহমানতা থেকে কোনো এক দুঃখিনী ঢেউ তাকেও ছেড়ে গেছে। তাকবীর নিজের হুশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। অসহায় গলায় কাঁপতে কাঁপতে আওড়াতে থাকল,
“মামনী গো, মেয়েটা বোধহয় আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি বাঁচব না মামনী। প্লিজ, আমাকে এত তাড়াতাড়ি তোমাদের কাছে নিয়ে যেও না। ওকে আমি চাই”
‘আচমকা তাকবীরের মুখে উঠে এলো অশ্রুপ্লাবিত এক স্বীকারোক্তি,
“আমি আমার এলোকেশীকে অনেক ভালোবাসি, মামনী। ঠিক তোমাদের মতো। এই দুনিয়ার সবকিছুও যদি মিথ্যে হয়ে যায়, তবে তাকবীরের ভালোবাসা মিথ্যে হবে না মামনী। কেন কেউ আমাকে ভালোবাসে না?”
‘তাকবীর কবরের ওপরে হাত বুলাতে বুলাতে আকাশের দিকে একে একে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্য আমার বেলায় কেন এতো নিষ্ঠুর?”
‘তাকবীর হঠাৎ উঠে বসল। চোখে এক অজানা গ্লানি আর অভিমান। দু’টি কবরের দিকে তাকিয়ে হতাশায় ভরা গলায় বলতে থাকল,
“তোমরা আমার সাথে খেলা করছো, তাই না? মা-মেয়ে ইচ্ছে করে এমন করছো? যতই কিছু করো না কেন! এতো তাড়াতাড়ি আমি আমার এলোকেশীকে ফেলে যাচ্ছি না। আমি ওর দায়িত্ব নিয়েছি, সারাজীবনের জন্য।”
‘থামল,। এবার কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকবীরের মধ্যে চিৎকার জাগিয়ে দিল। মুহূর্তেই গলা ছিঁড়ে চিৎকার করে বলল,
“আমাকে তোমাদের কাছে টেনে নিও না মামনী! আমি ওকে ভালো রাখতে চাই। ওর ভালোবাসা পেতে চাই। ওর চোখে যে নিজের ধ্বংস দেখেছি, আমি। আমাকে বাঁচতে দাও, তোমরা!”
‘এবার অবুঝ তাকবীর তার অভিমানী অভিযোগ গুলো জানাতে থাকল,
“জানো মামনী, ওর চোখে নাহ কখনো আমার জন্য কোনো টান দেখিনি। তবুও, আমার ওকেই ভালো লাগে। মনটা শুধু পাগলের মতো তারেই চাই।”
‘তাকবীর এবার উঠে গিয়ে বসল ছোট কবরটার পাশে। আলতো হাতে মাটি ছুঁইয়ে চোখের কোণে থেকে ঝরঝর করে জল ফেলে মুচকি হেসে বলল,
“জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো বোন। ভাইয়ের প্রতি কি এতোই রাগ ছিল যে, একবার দেখাও করে গেলি না? তুই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছিস সেই কবেই কিন্তু তুই না থেকেও ভাইয়ার কাছে আছিস সবসময়।”
‘একটু থেমে গিয়ে, এক গভীর শ্বাস নিয়ে আবার বলল,
“জানিস বোন, তোর জন্য না, পরির মতো একটা ভাবি খুঁজে বের করেছি। একদম তুলোর মতো নরম। আমার ধরতেও ভয় হয় যদি কোথাও লেগে যায়।”
‘রেয়ান পিছন থেকে নিচু স্বরে বলল, “বস, এবার চলুন।”
‘রেয়ানের কথা শোনামাত্র তাকবীর তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে আবারো মায়ের কবরের উপর উপুড় হয়ে পড়ল। শুকনো মাটিতে মুখ গুঁজে এক নিঃশ্বাসে আওড়াতে থাকল,
“তুমি চলে যাও রেয়ান। আজকে আমি আর আমার এলোকেশী একসাথে মামনীর সাথে ঘুমাবো। বোন, আজ তুই হিংসে করিস না কেমন?”
‘হঠাৎ তাকবীরের চোখের সামনে ভেসে উঠল এলিজাবেথের হাসিমাখা মুখ। মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকবীরও হাসল। হাত রাখল এলিজাবেথের মাথায়। তবে হাতটা গিয়ে পড়ল মাটিতে। তাকবীর নিঃশব্দে বলে উঠল,
“যন্ত্রণার গুলো আমাকে..! ভেতরে পুরাই..! হুমমমম ভাবতে ভাবতে তারে আমি..! চোখ বুঝিয়া জড়ায় ধরি..! চোখ মেলিয়া দেখি আমি…! সে তো বুকে নাই..!”
‘চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তবে ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি। কারণ তার সাথে এখন তার মা আর তার প্রিয়ের থেকেও প্রিয় এলোকেশী আছে। তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।
‘তাকবীর স্কিতজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। যার ফলে তার মাঝে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, নানা ধরনের ভ্রম এবং চিন্তার অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখা যায়। অডিও ও ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন তাকবীরের মাঝে এমন এক কল্পনা সৃষ্টি করে, যেখানে সে নিজেকে সুখী আর নিরাপদ মনে করে। ডিপ্রেশনের গভীর কষ্ট ওকে আরও একাকী করে তোলে এবং এভাবেই সে তার কল্পনায় আশ্রয় খুঁজে পায়।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৪ (২)
‘রেয়ান ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চলে গেল। তার আচরণ থেকে স্পষ্ট ছিল যে সে এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রেয়ান জানে তাকবীরের ভেতরে লুকানো এই মানসিক যন্ত্রণা অনেক সময় তাকে বিপথে নিয়ে যায়। তবে রেয়ান কিছুই বলার বা করার সাহস পায় না। এমন এক দুর্দশার মাঝে তাকবীরের কল্পনা তার একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে অন্তত তাকবীর কিছুক্ষণের জন্য শান্তি পায়।