চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪২

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪২
ইশরাত জাহান জেরিন

বৃষ্টির তোড়ে অভ্র আর আয়েশা নীরবে রাস্তায় হাঁটছে। চারপাশের ঝাপসা জলরেখার ভেতর তাদের দু’জনের ছায়া শুধু এগিয়ে চলেছে। আয়েশা সাধারণত হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলে, হাসে, অস্থির হয়ে পড়ে। আজ সম্পূর্ণ নীরব। অভ্রও নিরুত্তর, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, সে ব্যাখ্যা নেই। হঠাৎ, অদ্ভুত এক মুহূর্তে অভ্র থেমে দাঁড়ায়। আকাশ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই এমন একটা বৃষ্টিময় দিন ছিল সেদিনও। যখন আয়েশা নামক চোর টা অভ্রকে কাদাজলে ফেলে দিয়েছিল। আজ কতটা সময় পেরিয়ে গেলো। অভ্র মৃদু গলায় ডাকে,

“আয়েশা।”
আয়েশাও থেমে যায়। তার চোখে প্রশ্ন, ঠোঁট কাঁপছে ঠান্ডায়, আর শরীরের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টির মুক্তোর মতো ফোঁটা। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তার অনির্বচনীয় দৃষ্টিতে। অভ্র এগিয়ে আসে, বুকের গভীরে জমে থাকা দহনকে দমন করতে গিলে নেয় এক শুষ্ক ঢোক। ভিতরের দোলাচল সে আর থামাতে পারে না। আয়েশা মনে মনে অভ্রকে দুটো গালাগাল করে। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে এই বোকা ছেলেটাতো পারে মাঝ রাস্তায় তার হাত ধরে চিৎকার করে বলতে,”আমি তোমাকে ভালো বাসি আয়েশা।” গলা ছেড়ে চিৎকার করেও তো বলতে পারে, “বাঁধবো তোমার সাথে আমি আমার জীবন।” আয়েশার মুখ ছোট হয়ে আসে। এক নির্মম সত্য তাকে কুঁচকে দেয়। এই ছেলেটা তার হবে না। দু’জনের মধ্যকার ব্যবধান যেন অবিনশ্বর। জেগে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস বড়োই কষ্টের। কিন্তু ভাবনার আগুনে পুড়তে থাকা আয়েশাকে আকস্মিকভাবে থামিয়ে দেয় অভ্রর স্পর্শ। হঠাৎ অভ্র খপ করে তার হাত চেপে ধরে টেনে আনে নিজের বুকে। মাথার ওপরে ক্রুদ্ধ আকাশ সাক্ষী হয়ে থাকে। আর সেই অনিবার্য মুহূর্তে অভ্র শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে, “আমার বউ হবি তুই? চল না বিয়ে করে ফেলি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চায়ের দোকানে বসে কলা রুটি খাচ্ছে মাহাদী। এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ দিয়েছে দোকানের ছোট্ট ছেলেটিকে। এলাকা থেকে খানিক দূরের এ অখ্যাত চায়ের দোকানে পৃথিবীর সব না বলা গল্প একসূত্রে জমে উঠে। চায়ের প্রথম চুমুকেই তার কানে ভেসে এলো রাশেদার সংবাদ। সে নাকি এখনো নিখোঁজ। মাহাদীর ঠোঁটে তখন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের হাসি। কি করে ওই মহিলাকে খুঁজে পাওয়া যাবে? তাকে তো নিজ হাতে ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছে মাহাদী। এই দুনিয়ায়, তার স্ত্রীর চোখের জল ফেলার সাহস যার, তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলাই মাহাদীর অঙ্গীকার। তবে রাশেদাকে বিক্রি করে তেমন লাভ হয় নি। বুড়ো মহিলার আবার দাম আছে নাকি? তবে এসবে চলবে না। তাকে আরও নির্দয়, আরও নিখুঁত হতে হবে। কারণ সুন্দরী কিশোরীদের বাজারে এখন চাহিদা প্রবল। তাছাড়া মায়ানমারের নতুন প্রকল্পের খবরে সে নতুন দিগন্তের দুয়ার দেখছে। যত বেশি মেয়ে যোগান দেবে, ততই উর্ধ্বগতি নিশ্চিত। মারিয়ার আর কষ্ট থাকবে না তখন। স্ত্রীর সমস্ত আরাম-আয়েশের প্রতিশ্রুতি সে নিজের হাতে তুলে নিতে চলেছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কোথায় পাবে সে এমন অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে?
চায়ের দাম মিটিয়ে মাহাদী উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে এক ফার্মেসির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। এখানে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। হঠাৎ কী এক দুর্বোধ্য খেয়ালে থমকে দাঁড়ায় তার পা। ফার্মেসির ভেতর থেকে একটা কিশোরী বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে তার আত্মীয়া, হয়তো মা বা খালা। মেয়েটির অবয়বে অদ্ভুত একটা নির্মল সৌন্দর্য, গায়ের বর্ণে দীপ্তি, মুখে আনন্দের ঝিলিক। মনে হয় কোনো সুসংবাদ পেয়েছে সদ্য। মাহাদীর অন্তর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। তার নিজের স্ত্রী যখন দুর্বলতায় পিষ্ট, তখন এই পৃথিবীর আর কারো মুখে এমন সুখের হাসি কীভাবে ফুটে উঠতে পারে? না, কারোই অধিকার নেই তার মারিয়ার চেয়ে সুখী হওয়ার। কারোই না। পুনরায় মেয়েটির দিকে দৃষ্টি ফেলল মাহাদী। এবার তার ঠোঁটে বিষাক্ত রহস্যের ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে।

মিতালির ক্ষতগুলো পচতে শুরু করেছে। দেহের উপর মাছি ভনভন করছে। কোথাও কোথাও ডিমও পড়েছে হয়তো। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র অসহনীয় দুর্গন্ধ। সোহান একবার মিতালির দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে রাজনকে প্রশ্ন করে,
“কি দোষ এই মেয়ের? মারোও না, ছাড়োও না?”
রাজন গলা নামিয়ে উত্তর দেয়, “এই মাইয়া আমার লোক খোকনরে খু*ন করছে।”
সোহান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কেন?”

রাজন দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “অফার দিছিলো। মাইয়া বেশি সতীত্বের ভান দেখাইছে। তাই আজ এই দশা। আর এইমাইয়া চিত্র-ফারাজের চামচিকা।ভাবছিল পরে গিয়া খোকনের সব ফাঁস কইরা, আমাগোও গর্তে ফেলবো।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সোহান বলে, “সব বুঝলাম। কিন্তু এভাবে আধমরা কইরা রাখার মানে কই?”
রাজনের কপাল ঘেমে একাকার। ইঞ্জিন ঘরের ভেতর জঘন্য গরম। দম ফেলাও দায়। তার ওপর মিতালির শরীর থেকে আসা পঁচা গন্ধে আর টিকতে না পেরে দু’জনেই বাইরে বেরিয়ে আসে।
রাজন থেমে দাঁড়িয়ে বলে, “মারিনাই ওরে, কারণ ওর লাশ দিয়াই ওর সঙ্গীদের শিক্ষা দিতে হইবো। জানাইতে হইবো, মাইয়া মানুষ বেশি তিড়িংবিড়িং করলে কি পরিণতি হয়।”
সোহান ঠোঁট চেপে বলে, “চিত্রা কিছু করছে?”

“করে নাই। তবে মাইয়া কিন্তু তালুকদার বাড়ির। শালা ভুল করছে ফারাজ তার লইগা না জানি কার কার মাশুল দিতে হয়। তার ওপর মজছে মজছে ওই বাড়ির মাইয়ার ওপরই মজতে হইবো? যাই হোক কাল ফারাজ বাড়ি ফিরব। ফিরলে এমন ভাবে কাহিনী সাজাইয়া মিতালির লাশ চিত্রার সামনে আনমু না মাইয়ার আমাগো উপর সন্দেহ হইবো আর না এসবে জোড়ানোর সাহস হইবো। ওই বাড়ির চারা বড় হওয়ার আগেই উপড়ে ফেলতে হইবো বুঝো নাই? ” রাজন আবার ফিসফিস জবাব দেয়।
সোহান কোনো উত্তর দেয় না। কেবল নীরবে নদীর কালো জলে তাকিয়ে থাকে। ভাবনায় বারবার ফিরে আসে একটাই নাম, “চিত্রা! চিত্রা! চিত্রা!
কে এই নারী? দেখতে কেমন?”

নিশি বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এক ঝামেলা থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক ভয়ঙ্কর মোচড়ে এসে পড়েছে। এই তো কিছুক্ষণ আগেই যে অপরিচিত লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল তার এখন সেই লোকই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্বামী। নিশির গলা শুকিয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি নেই। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। রবিনের কথা মনে পড়তেই তার চোখে একরাশ ঘৃণা জমে ওঠে।❝যাকে ঘিরে ছিল নিজের বসবাস, সে চোখে চোখ রেখে করল মনের সর্বনাশ।❞

সদ্য বিবাহিত স্বামী তার ঠিক পাশেই বসে আছে। মুখে স্পষ্ট অস্থিরতার ছাপ। তবে নিজেকে সামলে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। নিকলী এসেছিল সে নিজের বন্ধুর প্রেমিকাকে পালাতে সাহায্য করতে। কে জানত সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে গ্রামবাসীর ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে রাতের আঁধারে নাম না জানা, পরিচয়হীন এক মেয়ের সঙ্গে নিকাহ্ পড়তে হবে! মেয়েটার তখন যে দশা তা দেখে স্রেফ মানবিক বোধ থেকে পানির বোতল আর বাটারবন কিনে দিয়েছিল। আর এতেই লেগে গেল তুমুল গুজব। রাতের বেলায় ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে? নিশ্চয়ই কিছু একটা! ফলে কথার কথা নয়, সত্যিকারের কাজি ডেকে সাক্ষী জোগাড় করে, একেবারে বিয়েই পড়িয়ে দেওয়া হলো। বন্ধুর প্রেমিকাকে পালাতে সাহায্য করতে এসে নিজের গলায় পরে নিয়েছে দায়ের ফাঁস। সেই মেয়েটি, নিশি এখন তার স্ত্রী। অথচ তাদের কেউ-ই এই বিয়েতে মন থেকে রাজি নয়।

রুমে থাকা লোকেরা একে একে বেরিয়ে গেছে। বর-কনেকে একা রেখে বাইরে পাহারা বসিয়েছে বুড়ো। কত বোঝানোর চেষ্টা করেছিল , এই মেয়েকে সে চিনে না। কেবল সাহায্য করতে চেয়েছিল! কিন্তু কে শোনে কার কথা? গ্রামের মাতব্বররা সাফ জানিয়ে দিল, “এই ছেলে মেয়েটার সুবিধা নিতে চায়। প্রেম করে। লটরপটর করতে এখানে এনেছে। আমরা বেঁচে থাকতে গ্রামে পাপ কিছুতেই হতে পারে না।”
ফলে সমস্ত আপত্তি চাপা পড়ে গেল একটুখানি ‘সমাজরক্ষার’ নামে। নিশি ছেলেটার দিকে তাকায়। তার বিয়ে করা স্বামী তবে কি এ-ও সুযোগ নেবে?
পুরুষ জাতির ওপর থেকে তার সব বিশ্বাস উঠে গেছে। একজনকে তো এতোদিন প্রাণ খুলে ভালোবেসেও চিনতে পারেনি আর এই অপরিচিত…!
ঠিক তখনি ছেলেটি এগিয়ে এসে তার পাশে বসে পড়ে। চোখে-মুখে কঠোরতা নিয়ে বলে,
“ক্ষতি তো দু’জনেরই হয়েছে। এখন অন্তত নিজের পরিচয়টা দাও। কেন এভাবে পালাচ্ছিলে?” তার গলা শক্ত। চোয়াল শক্ত করে ফিসফিস করে হুঁশিয়ারি দেয়, “এমন ন্যাকামো কান্না আর চুপচাপ বসে থাকা সহ্য করবো না। খুলে বলো সব। নইলে এখানেই ফেলে চলে যাবো। জলদি বলো, বাড়ি কোথায়?”
নিশির বুকের মধ্যে কেমন দুলে ওঠে। নোনাজলে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে থেমে থেমে সে জবাব দেয়,
“আমা…আমার বা…ড়ি…খু…খুলনা।”

আয়েশাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে অভ্র কোনও কথা না বলেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। আয়েশার মনে প্রশ্ন জাগে, “এত জরুরি আবার কী কাজ হতে পারে ওর?” তবে আজ এসব ভাবার সময় নয়। আজ আয়েশা ভীষণ খুশি। অবশেষে, বহু প্রতীক্ষিত সেই মহামারী ভাইরাসটা এখন তার দখলে। কিন্তু সবকিছু কি এখনই চিত্রা আপা আর ফারাজ ভাইকে বলা উচিত? না না… এসব একসঙ্গে, দুজনকে একত্রে বলতে হবে। অভ্রর সাথে মিলেমিশে। ভাবনায় আয়েশার মুখে একফোঁটা লাজুক হাসি খেলে যায়। সে লজ্জায় নিজের হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে নেয়। তবে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায় চিত্রা আপা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তাঁর মুখ মলিন, চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। আয়েশার বুকের মধ্যে হালকা একটা কাঁপুনি বয়ে যায়। সে একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। চিত্রা আপা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“একি অবস্থা? জামাকাপড় বদলে আয়।”
“হ্যাঁ আপা।” আয়েশা ঢোক গিলে জবাব দিল। মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আপা বুঝি কিছু টের পাননি… কিংবা হয়তো সন্দেহ করেনি। তবে সে রাতে আয়েশার আর ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই অভ্রর মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

কতক্ষণ যে সে অভ্রর জন্য অপেক্ষা করেছে তা আর মনে করতে পারছে না। কখনো রুমের দরজায় গিয়ে চুপি চুপি উঁকি দিয়েছে, কখনো অকারণেই কান পেতে রেখেছে। কিন্তু অভ্র আসেনি। হতাশ মন নিয়ে সে নিজের ঘরে ফিরে যায়। সারাদিনের ক্লান্তি আর মনের তৃপ্তি মিলেমিশে তাকে ক্লান্ত করে ফেলে।অবশেষে চোখ জুড়ে ঘুম নামে। মাঝরাতে, আবছা ঘুমের মধ্যে, আয়েশা অনুভব করে নরম একটা হাতের উষ্ণ ছোঁয়া তার গাল ছুঁয়েছে। ঘুমের ঘোরে চমকে উঠে মনে হয়েছিল, স্বপ্ন দেখছে কি?
চোখ মেলার সাহস করেনি। যদি চোখ খুললেই এই মায়াবী স্বপ্নটা ভেঙে যায়। কিন্তু সেই মৃদু ছোঁয়া, চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেওয়া সবকিছু এত বাস্তব লেগেছিল! আদৌ কি তা বাস্তব ছিল?
নাকি শুধুই তার কল্পনার ফাঁদে আটকে যাওয়া কোনো ভ্রান্ত অনুভূতি?

রাত বেশ ভালোই হয়েছে। চিত্রা ব্যস্ত। মনোযোগে ব্যাগ গোছাচ্ছে। সাধারণত ফারাজ নিজের জিনিস নিজেই গুছিয়ে নেয়। নিজে না গুছালে পরে কোনো কিছুই খুঁজে পায় না। তবে চিত্রা যেহেতু আছে তাই ফারাজের আর কোনো কষ্ট করতে হবে কেনো?
আলমারি খুলতেই চিত্রার চোখ গিয়ে পড়ে আলমারির ভিতর, নিচের দিকে রাখা ছোট্ট লকারের ওপর। বেশি বড় নয়, আবার একে ছোটও বলা চলে না। চিত্রার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে লকারে কী এমন রাখা আছে? হাতে তুলে নেয় লকারটি। কয়েক মুহূর্ত হাতের তালুতে ওজন মেপে নেয়। আবার কোনোরকম নাড়াচাড়া না করেই সাবধানে লকারটি জায়গায় ফিরিয়ে রাখে।

তারপর আলমারির ভাঁজ থেকে কাপড় বের করতে যাবে, ঠিক তখনই একটি শব্দ কানে আসে। ফোনের রিংটোন। চিত্রা শব্দ অনুসরণ করে বিছানার দিকে এগোয়। বিছানার চাদরের ভাঁজে খুঁজে পায় ফারাজের ফোন। স্ক্রিনে আলো জ্বলছে। একটি লাল গোলাপের ইমোজি ভাসছে স্ক্রিন জুড়ে।চিত্রা থমকে দাঁড়ায়। ফুল আর লতাপাতা দিয়ে কেউ নাম্বার সেইভ করে? বিশেষ করে রোজ? ফারাজ নিচে গেছে। হয়তো এই মুহূর্তেই ফিরে আসবে। চিত্রা কোনো প্রশ্ন না তুলে আবার ব্যাগ গোছানোর কাজে মন দেয়। মনে মনে বাড়ির কথা চিন্তা করে। মামাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কাল কিশোরগঞ্জ পৌঁছতেই হবে। যেভাবেই হোক, মামাকে দেখতে যেতে হবে…।

ফারাজ শীতল হাওয়ায় ছাদের রেলিংয়ের সামনে
দাঁড়িয়ে আছে। পরপর পাঁচটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। আরেকটি সিগারেট বের করে আবার ধরাতে যাবে ঠিক তখনই তার কাঁধে একটা হাত আশ্রয়ের মতো এসে পড়ে। ফারাজ না তাকিয়েই বুঝে নেয় কে এসেছে।অভ্র। এই ছেলেটার উপস্থিতি সে অনুভব করতে পারে। চোখ বন্ধ করেও, অন্ধকারের গভীরতাতেও চিনে ফেলতে পারবে।
“ভাই, আর সিগারেট খাবেন না। নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার মানে কী? যান রাত হয়েছে রুমে যান। ভাবীকে একা রেখে এখানে কি করছেন?” অভ্র শান্ত স্বরে বলে।
ফারাজ নিস্তেজ ভারী স্বরে বলে,

“চিত্রা ঘুমাচ্ছে।”
“তাই বলে আপনি এখানে থাকবেন?”
কি করবো বল? এক গল্প শেষ করার আগেই নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে। ভালোবাসা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না রে, অভ্র। তোর ভাবীর সামনে আমি কোন মুখে দাঁড়াবো? তাকে দেখলেই সেই রাত, সেই অতীতের বিভীষিকা মনে পড়ে। একদিকে মায়া, আরেকদিকে তীব্র ঘৃণার সমীকরণ আমায় পিষে মারছে। খুব মরতে ইচ্ছে করছে, অভ্র… খুব।”
“ভাবী যদি কিছু না জানে তাহলেই তো হলো?” অভ্র আস্তে বলে।
” জানবে জানবে। আজ নয় হয় কাল জানবেই। না রে, অভ্র। এভাবে বাঁচা যায় না। আমি আর ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। অন্তত মরার আগে চিত্রার কাজল চোখে আমার নামের ঘৃণা দেখতে চাই না। তার চেয়ে বরং, আমিই সবকিছু জানিয়ে দেবো।”
“ভাবী যদি তখন আপনাকে ছেড়ে চলে যায়?”অভ্রের কণ্ঠে শঙ্কা।

ফারাজের ভেতরটা চৌচির হয়ে আসে। চোখ কেমন ছলছল করে ওঠে। সে কি কাঁদছে?পুরুষ মানুষ কি কাঁদে?তার মতো কেউ কি কাঁদতে পারে?ভাবলেই বুকটা মোচড়ায়। শেষবার সেই রাতেই কেঁদেছিল… এলাহীর চোখে সেদিন জল ছিল। তারপর আর কখনও কাঁদা হয়নি। শুধু দহনের আগুনে পুড়া হয়েছে … প্রতিটি মুহূর্তে।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪১

“প্রথম দিনই যদি সব শেষ করে দিতাম, আজ এত জঘন্য অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে হতো না,” ফারাজ ফিসফিস করে। “চিত্রাঙ্গনা ফুল ছিলও। নিষ্পাপ একটা ফুল ছিল মাত্র। আর আমি সেই ফুলকে জাহান্নামের আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছি। এই পাপের ক্ষমা হয় না। আগুন সুন্দরী হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে , সবকিছু জানার পর তার ভালোবাসা বিষাদে রূপ নেবে।” কথাগুলো বলতে বলতে ফারাজ হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। চেঁচিয়ে, বেপরোয়া হয়ে বারবার একই কথা আওড়াতে থাকে। অভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে কখনো তার ফারাজ ভাইকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি। আজ ইচ্ছে ছিল ফারাজকে নিজের আর আয়েশার বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে সবকিছুই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ফারাজ ছন্নছাড়া ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“সেই… রা…তে, সেই রাতে সাতাশটির বদলে আটাশটি দেহ যদি আগুনে ঝলসে যেত, তাহলে আজ আমাকে এভাবে অন্তর্দাহে পুড়তে হতো না।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৩